আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বলছি - খুলনার এক যুবরাজ হাসান সাইদ টিপুর কথা

ক্ষুদ্র এই জীবনে অনেক কিছুই করতে চাই, কিন্তু পারি না। আর কিছু কথা আছে, যা হয়ত বলা যায় না, লিখে প্রকাশ করাই একমাত্র পথ। তাই এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা। (লেখাটি 'কবি ও কাব্য' ভাইয়ের কাছে থেকে ধার করা) ১৯৬৭ সালের ১৬ ই জানুয়ারী খুলনার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম নেয় এক ছোট্ট এক শিশু। সেই ছোট্ট শিশুটি এক সময় বড় হতে থাকে আর তার দুরন্ত ডানপিটে স্বভাব বাড়তে থাকে।

সাথে সবাইকে মুগ্ধ করার মতো আরও একটি চমৎকার গুন আল্লাহ তাকে জন্মের সময়ই দিয়ে দিয়েছিলেন যাকে বলে ঈশ্বরপ্রদত্ত। হ্যাঁ, সেই ঈশ্বরপ্রদত্ত সুকণ্ঠ দিয়েই ছেলেটি সবাইকে গান শুনিয়ে মুগ্ধ করতো। তা হোক স্কুলে অথবা বন্ধুদের আড্ডায় সবখানেই ছিল সেই প্রাণবন্ত কণ্ঠ। ধীরে ধীরে যে ছেলেটি একদিন হয়ে যায় বাংলাদেশের ব্যান্ড সঙ্গীতের অন্যতম যোদ্ধা ও সবার প্রিয় 'টিপু' ভাই। হ্যাঁ বন্ধুরা ! আজ আমাদের প্রিয় অবসকিউর ব্যান্ড এর প্রিয় 'টিপু' ভাইয়ের ৪৫ তম জন্মদিন।

প্রিয় টিপু' ভাইকে জানাই জন্মদিনের শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা। যিনি বাংলা ব্যান্ড/পপ সঙ্গীতে অমর হয়ে থাকবেন তাঁর কালজয়ী সব গান দিয়ে। খুলনার কাছে বাংলা সংগীত অনেক অনেক ঋণী। যে খুলনা থেকে লালন এর জন্ম সেই খুলনা থেকেই যুদ্ধপরবর্তী স্বাধীন বাংলার বাংলা গানের নতুন এক যুগের সব কাণ্ডারিদের আমরা পেয়েছি। খুলনা থেকেই পেয়েছি টিপু ও অবসকিউর, মেজবাহ ও ডীফরেনট টাচ,দেশ সেরা গীতিকার, সুরকার ও কণ্ঠশিল্পী প্রিন্স মাহমুদ এর মতো সব সেরাদের।

যারা আমাদের গুরু আজম খান, পিলু মমতাজ, ফেরদৌস ওয়াহিদ, ফিরোজ সাই ও ফকির আলমগির এর শুরু করা যুদ্ধকে এক বিশাল প্রাপ্তি তে পরিণত করেছেন। আর আমাদের বাংলা গানকে করেছেন আরও সমৃদ্ধশালী। টিপু’র ছেলেবেলাটা আর দশজনের মতোই কেটেছে। লেখাপড়ায় ভালোই ছিলেন তিনি। গান করতেন নিজের মনে।

বাংলা গান খুব বেশি গাওয়া হতো না, গলা খুলে ইংরেজি গানই বেশি করতেন। স্কুল কলেজে গানের জন্য বিখ্যাতই ছিলেন টিপু। বন্ধুরা টিপুকে পেলেই জেঁকে ধরতো আর তিনিও একটার পর একটা গান গেয়েই চলতেন। টিপু যখন কলেজে পড়তেন তখন প্রায়ই ক্লাসমেটদের সঙ্গে রিকশায় ঘুরে বেড়াতেন। তার ভাষ্যমতে, ‘তখন এটাই ছিলো আমাদের এক ধরনের আনন্দ করা উপায়।

রিকশা যেমন চলতে থাকত, তেমনি চলত আমাদের পালা করে গান গাওয়া। মানাম আহমেদ আমার সহপাঠী ছিলেন। তিনি গান করতেন, সঙ্গে আমিও। ’ তখন ১৯৮৪ সাল। একদিন মানাম আহমেদ টিপুকে প্রস্তাব দেন ব্যান্ডে যোগ দিতে।

ব্যান্ড সংগীতের স্বর্ণযুগে নিজেকে যুক্ত করতে দ্বিধা করলেন না টিপু। তিনি যোগ দিলেন চাইমে। টিপু জানালেন, ‘১৯৮৪ সালে আমি চাইমে যোগ দিই। টিএসসিতে আমার অডিশন হয়। সেই সময় টুলু ভাই ছিলেন চাইমে।

তিনি টিপুকে সিলেক্ট করেন এবং তখন টিপু চাইমে ইংরেজি গান গাইতে শুরু করেন। তবে টিপু খুব বেশি দিন ছিলেন না চাইমে। বছর খানেক পর তিনি উপলব্ধি করলেন, তার বাংলা গান করা উচিত। নিজের একটি ব্যান্ড গড়ে তুলবেন বলেও সিদ্ধান্ত নিলেন। অনেক ভেবে-চিন্তে তিনি জন্মস্থান খুলনায় চলে গেলেন।

সেখানেই কয়েকজন মিলে তৈরি করলেন একটি ব্যান্ড। নাম দিলেন অবসকিউর। এমন নামকরণের কারণ সম্পর্কে টিপু বললেন, ‘অবসকিউর মানে অস্বচ্ছ বা অস্পষ্ট। আমরা লুকিয়ে থাকা জনপ্রিয়তা অর্থে নামটি ব্যবহার করেন টিপু ও তাঁর সহযোদ্ধারা । তখন একটি হারমোনিয়াম এবং গিটার নিয়ে ব্যান্ড তৈরি করে বাড়ির নিচের একটি পরিত্যক্ত ঘরে তাঁরা প্র্যাকটিস করতেন’।

ব্যান্ড গঠনের পর গান গাওয়ার চেয়ে গান লেখা এবং সুর করার কাজটাই বেশি হতো তাদের। এভাবে তারা ৩০টি গান তৈরি করে ফেলেন। এরপর সারগাম স্টুডিওর রেকর্ডারের সঙ্গে টিপুর পরিচয় হয়। অবসকিউরের গান শুনে মুগ্ধ হয়ে যান তিনি। গান রেকর্ডিং করে ক্যাসেট বের করার কথা বলেন তিনি।

এমন অসাধারণ সুযোগ হাতছাড়া করতে চাননি টিপু। সেই সেলফ টাইটেল প্রথম 'অবসকিউর' ব্যান্ড এর অ্যালবাম বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীতের ইতিহাসে চিরঠাই করে নেয়। যেখানে পেয়েছিলাম ' মাঝরাতে চাঁদ' ছাইড়া গেলাম মাটির পৃথিবী' 'ভণ্ড বাবা' 'মমতায় চেয়ে থাকা' মত ১২ টি সেরা গান। যা সেই ছোটবেলা থেকে আজো হৃদয়ে গেঁথে আছে এবং থাকবে চিরকাল । এরপর ১৯৯০ সালে বের হয় ২য় অ্যালবাম যেটিও সেলফ টাইটেলড ।

যার মাঝে পাই ' তুমি ছিলে কাল রাতে', খোদা 'তোমায় ডাকবো যখন' 'আধার ঘেরা স্বপ্ন ' সন্ধ্যা আকাশ' ' দৃষ্টিরই সীমানায়' এর মত চিরসবুজ ও চিরকাল মনে রাখার মত প্রিয় সব গান। এরপরে খানিক বিরতি দিয়ে ৯৩/৯৪ এর দিকে আসে অবসকিউর এর একটু অন্যরকম রকিং অ্যালবাম 'স্বপ্নচারিণী' যেখানে এতদিনের চেনা শান্ত শিষ্ট, রোমান্টিক 'টিপু' অনেক দুর্দান্ত, বুকের ভেতর জমে থাকা কোন ক্ষোভ যেন বারুদ হয়ে বিস্ফোরণ ঘটাচ্ছে সেইরকম একটি অ্যালবাম ছিল 'সপ্নচারিনি'। এই অ্যালবাম এর আগে খুলনার ২ জনপ্রিয় তারা ফ্রম ওয়েস্ট (প্রিন্স মাহমুদ) ও ডীফরেন্ট টাচ (মেজবাহ) কে নিয়ে একটি অসাধারণ ব্যান্ড মিক্সড অ্যালবাম "আবেগ' বের করে অবসকিউর । যে অ্যালবাম এর প্রতিটা গানই ছিল 'আবেগ' নিয়ে খেলা করা দুর্দান্ত সুন্দর সব গান। 'স্বপ্নচারিণী' অ্যালবাম এর 'সপ্নচারিনি' 'তুমি অকারণে ' 'আধার ঘেরা রাত' 'সেই তুমি কোথায়' 'সেই তুমি' র মত দুর্দান্ত কিছু গান।

এরপর অবসকিউর কে আর পাওয়া না গেলেও শ্রোতারা প্রিয় 'টিপু' কে পেয়েছিল সবসময় বিভিন্ন মিক্সড অ্যালবাম এর চরম জনপ্রিয় ও দুর্দান্ত সব গানে। সেই মিক্সড অ্যালবাম এর যুগে শ্রোতারা পায় প্রিয় 'টিপু'র প্রথম একক অ্যালবাম 'একাকী একজন' । যা এক কথায় একটি অসাধারণ অ্যালবাম ছিল। যেখানে 'টিপু' আবার সেই পুরনো শান্ত শিষ্ট বিরহের আগুনে জ্বলা সুন্দরতম একজন মানুষ। সেই অ্যালবাম এর 'একাকী একজন' 'আমার আমি ছাড়া' 'আমার মন' গানগুলো ছিল চোখে জল আসার মত সব গান।

ব্যক্তিগত জীবনে শহীদ আলতাফ মাহমুদ এর কন্যা শাওন মাহমুদ কে নিয়ে তাঁর সুখের সংসার যিনি 'টিপু'কে সর্বক্ষণ অনুপ্রেরণা দিয়ে যাচ্ছেন গান করার জন্য। ২০০৭ থেকে আবার নতুন রূপে অবসকিউর এর হাল ধরে ফিরে আসেন 'টিপু' ও অবসকিউর। বাংলা গান যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন সেই ইতিহাসের একটি উজ্জ্বলতম তারা হয়ে জ্বলজ্বল করে বাংলা গানের আকাশে জ্বলবে যে তারাটি তাঁর নাম 'টিপু'। যাদের অক্লান্ত পরিশ্রম, গানের প্রতি ভালোবাসা আর স্রোতাদের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে সবসময় বাংলা গানের সম্ভারকে এক একটি ফুল দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছেন তাদর মধ্য টিপু অন্যতম। আজকের এই ভালো ও শ্রুতিমধুর মানসম্পন্ন বাংলা গানের দুর্ভিক্ষের সময়কে যারা দূর করতে পারেন তাদেরই একজন টিপু।

তাঁদের ফিরে আসাটা এবং আবার সেই কাণ্ডারির ভূমিকায় অবতীর্ণ দেখার জন্য কোটি কোটি বাংলার মানুষ আশায় বুক বেঁধে আছে। কারন তাঁদের যে আছে অনেক তারার ভিড়ে উজ্জ্বল হয়ে জ্বলতে থাকা একটি তারা যার নাম টিপু! যিনি এখনো ফুরিয়ে যাননি। তিনি যে বাংলা গানেরই এক 'যুবরাজ' ,যার কণ্ঠে সুরের মুচ্ছনায় ভাসিয়ে নিয়ে যাবে আর আমাদের মুক্তি দিবে কোটি কোটি বাংলা গান পাগল স্রোতাদের খাদের কিনারায় যাওয়া মানহীন বস্তাপচা গানের এই আকালের যুগ থেকে । শুভ জন্মদিনে হে যুবরাজ তোমাকে জানাই কোটি কোটি প্রাণের ভালোবাসা ও সালাম। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১০ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.