স্যার সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেছেন ওপারের দেশে। যেখান থেকে ফেরে না কেউ আর। তার আত্মাটা চলে গেছে অনেক আগেই। এখন শুধু মাটির দেহটা বাকি। কাল সন্ধ্যায় মাটির ঘরেই মাটির দেহটা রেখে আসবো আমরা।
নিজের বাবার কবরের পাশে শায়িত হবেন আতাউস সামাদ স্যার। পারিবারিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আজিমপুর গোরস্থানে তাকে দাফন করা হবে।
কাল জুহরের নামাজের পর গুলশান আজাদ মসজিদের সামনে তার প্র্রথম নামাজের জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। এরপর লাশ নিয়ে নিয়ে আসা হবে তোপখানা রোডের জাতীয় প্রেসক্লাবে। সেখানে পুনরায় জানাজা হবে।
তারপর কফিনে শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন সহকর্মী সাংবাদিক, সাংবাদিক ও সাংবাদিক নেতারা। পরে লাশ নিয়ে যাওয়া হবে আজিমপুর গোরস্থানে। সেখানে জনমের ঘুম ঘুমাবেন তিনি।
প্রায় তিন দিন অজ্ঞান থাকার পর আজ রাতে আমাদের সবার প্রিয় ও শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক আতাউস সামাদ স্যার ইন্তেকাল করেন (ইন্নালিল্লা....রাজিউন) । রাত ১০:৪১ মিনিটে ডাক্তাররা অফিসিয়ালি মৃত ঘোষণা করেন তাকে।
এর আগে ৯:২৫ মিনিটে স্যারের লাইফ সাপোর্ট খুলে নেয়া হয়। তার মৃত্যু নিশ্চিত হবার পর দৈনিক আমার দেশ অফিসে তাৎক্ষণিক দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়।
আপনাদের জানার কথা, এই যে দৈনিক আমার দেশ এখানো প্রকাশিত হচ্ছে এ কিন্তু শুধু স্যারের জন্য। ১/১১ সরকারের অদ্ভূত শাসনামলের সময় আমার দেশ যখন বন্ধ হওয়ার পথে (এক বছর ধরে বেতন পাচ্ছিল না সংবাদকর্মীরা) তখন স্যার শক্ত হাতে হাল ধরে থাকেন। শুধু তার মুখের দিকে চেয়ে বহু সাংবাদিক বেতন ছাড়াই থেকে যায় আমার দেশে।
এরপর তিনি পত্রিকাটি তুলে দেন সাহসী সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের হাতে ( যিনি বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসের আরেক নতুন সংযোজন)। বর্তমান আওয়ামী জোট ক্ষমতায় বসার পর জেলে নেয়া হয় মাহমুদুর রহমানকে, বন্ধ করে দেয় পত্রিকাটির প্রকাশনা। তখন আবার স্বমহিমায় ফিরেন স্যার। তিনি আবার হাল ধরেন। একাই আইনী লড়াই চালিয়ে যান।
বিজয়ীও হন। আবার প্রকাশ হতে শুরু করে আমার দেশ।
স্যারের এ ত্যাগের সম্মান আমার দেশ পরিবার তাকে দিয়েছে। হয়তো অর্থ দিয়ে নয়-ভক্তি ও ভালবাসার ফুলেল শ্রদ্ধায়।
আমি ভাবছি- এ মৃত্যুর সঙ্গে অবসান হলো স্বাধীন বাংলাদেশের সাংবাদিকতার একটি স্বতন্ত্র অধ্যায়ের।
স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক-এক সোচ্চার কন্ঠের বিদায় বীন বাজল। দেশ হারালো এমন এক নক্ষত্রকে যাকে আর কোনদিন ফিরে পাওয়া যাবে না। আমরা হারালাম আমাদের প্রিয় স্যারকে। তিনি ছিলেন আমাদের সাংবাদিকতা জীবনের বরপুত্র। মান্যবর ও শ্রদ্ধার্ঘ্য।
এক অনুকরণীয়, অনপুম ব্যক্তিত্ব।
আমরা জানি না, তার মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি শোক প্রকাশ করবেন কি না। প্লিজ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্লিজ আপনার কাছে আমাদের করজোড় নিবেদন-এক্ষেত্রে অন্তত বড় মানষিকতার পরিচয় দিবেন। প্লিজ প্রধানমন্ত্রী প্লিজ।
মৃ্ত্যুর সময় তার পাশে ছিলেন একমাত্র ছেলে ও ছোট মেয়ে।
স্যারের স্ত্রীও গুরুতর অসুস্থ। আল্লাহ তাকে শোক সামলাবার শক্তি দিক।
এ দেশ কি দিল স্যারকে
তিনি শিক্ষক-সাংবাদিক আতাউস সামাদ। আমাদের স্যার। প্রিয় ও শ্রদ্ধেয়।
এ দেশে, বাঘা বাঘা কত রিপোর্টার তৈরির কারিগর এ মানুষটি। বাংলাদেশের আধুনিক সাংবাদিকতা তার হাতে গড়া। আমরা নবীন বা প্রবীণ সব সাংবাদিকই তাকে স্যার বলে ডাকি। এক বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী তিনি। কত অজস্র স্মৃতি আর অর্জণ তার।
সাংবাদিকতা, দেশ ও মাটিকে গভীরভাবে ভালবেসেছেন। প্রতিদান হিসেবে পেয়েছেন জেল, জুলুম আর নির্যাতন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের খণ্ডকালিন শিক্ষক ছিলেন।
এরশাদের শাসন আমলে স্যার ছিলেন বিবিসির বাংলাদেশ প্রধান। দেশে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে।
আতাউস সামাদ স্যার সারা দেশ ঘুরে ঘুরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এরশাদের বিরুদ্ধে জন মনোভাব তুলে ধরতে থাকেন। এটা সহ্য করতে পারেনি এরশাদ। ফলে তাকে কারাবরণ করতে হয়। স্বল্প সময়ের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয় বিবিসির সম্প্রচার।
স্যারকে নিয়ে আমার একান্ত অনুভূতি
স্যারকে অকেটা দূর থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে আমার।
খুব বেশি সংস্পর্শ পাইনি। আজ কেমন যেন আপসোস হচ্ছে। সংস্পর্শ আসলে নেইনি! ভয় হতো তার কাছে ঘেষতে। কখন আবার কি জিজ্ঞাসা করে বসে থাকেন।
আমার কাছে মনে হতো দুনিয়ার এমন কোন বিষয় নেই তিনি জানেন না ।
আর দেশের কোন খবরই তার অজানা নয়।
প্রতি শনিবার সাপ্তাহিক মিটিং হতো আমাদের। স্যার শুধু শনিবারেই অফিসে আসতেন। এ মাসের প্রথম শনিবার হবে হয়তো-আদালত নিয়ে একটা স্পেশাল রিপোর্ট করতে বলেন আমাকে। আমি হু বলে 'করবো' সম্মতি দেই।
গত শনিবারে আমার দেশ অফিসে আসার সময়ই অসুস্থ হয়ে পড়েন স্যার । ফলে সাপ্তাহিক বৈঠকে আর আসা হয়নি তার। তবে কেন জানি-কোন কাজ না থাকলেও বৃহস্পতি এবং শুক্রবার অফিসে এসেছিলেন তিনি । এটা কি এজন্য যে তিনি একেবারে চলে যাবেন! তাই প্রিয় অফিসটাকে শেষ বারে মতো দেখে গেলেন!
আতাউস সামাদের সংক্ষিপ্ত জীবনী
মুরব্বী সাংবাদিক দৈনিক আমার দেশ-এর উপদেষ্টা সম্পাদক আতাউস সামাদ-এর জন্ম ময়মনসিংহে ১৯৩৭ সালের ১৬ নভেম্ব¦র। তার গ্রামের বাড়ি হচ্ছে, কিশোরগঞ্জের সতেরদরিয়ায়।
তার পিতার নাম আবদুস সামাদ ও মাতা সায়েরা বানু। স্ত্রীর নাম কামরুন্নাহার রেনু। তিনি এক ছেলে ও দুই মেয়ের জনক।
আতাউস সামাদ তার কর্মবহুল সাংবাদিকতা জীবন শুরু করেন ঢাকায় ১৯৫৯ সালে। তার শেষ কর্মস্থল দৈনিক আমার দেশ।
তিনি এই পত্রিকার উপদেষ্টা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন । শুরু থেকেই ছিলেন আমার দেশের সঙ্গে। এছাড়াও তিনি বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস নিউজ-এর বাংলাদেশস্থ সংবাদদাতা (১৯৮২-৯৪), নয়াদিল্লিতে বাসস-এর বিশেষ সংবাদদাতা (১৯৭২-৭৬), পাকিস্তান অবজার্ভার (অধুনালুপ্ত বাংলাদেশ অবজার্ভার) পত্রিকার চিফ রিপোর্টার (১৯৬৫-৬৯) ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়ন (ইপিইউজে, ১৯৬৯, ১৯৭০) সাধারণ সম্পাদকও ছিলেন এ প্রবীণ সাংবাদিক।
শেষ কথা: তাকে অনন্ত শ্রদ্ধা-ওপারের জীবনে শুভ কামনা @}; আমারও একবারের জন্য ঐ দুনিয়াটা দেখার খুব সখ। স্যার পারলে আমাকে জানাবেনতো ঐপারের জীবনটা আসলে কেমন? শুধুই কি সুখ....নাকি পৃথিবীর মতো জঞ্জালে ভরা? ভাল থাকবেন স্যার। ভাল থাকবেন কিন্তু... ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।