গত পরশু (শনিবার) বাড়ি থেকে বের হয়েছিলাম কিছুটা সময় হাতে নিয়ে, যার দরুন বেশ কয়েকজনের সাথে দেখা এবং কথা বলাও হলো। ঘরে বসে সময় কাটানোর একটা আরাম আছে বটে; তবে নড়াচড়া না করলে চেনাজানা পৃথিবীটাও ছোট হয়ে আসে। টেলিভিশন দেখে, রেডিও শুনে বা খবরের কাগজ পড়ে, এমনকি আত্মীয়স্বজন আর বন্ধু-বান্ধবের সাথে টেলিফোনে কথা বলে দুনিয়ার হালচালের যে ধারণা পাওয়া যায়, তা অনেকটা পরের মুখে ঝাল খাওয়ার মতো। তাই সেদিন ঘর থেকে বেরিয়ে যা শুনছিলাম তার প্রায় সবকিছুই মনোযোগ আকর্ষণ করছিল।
শিক্ষানীতিতে ধর্মীয় বিষয়ে সরকারের মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গি, তথা অদূর ভবিষ্যতে সরকার ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে যেসব সিদ্ধান্ত নিতে পারে বলে ধারণা জন্মাচ্ছিল, সেগুলোর প্রতিবাদে ওলামা মাশায়েখদের একটা বড় জোট রোববারের জন্য প্রস্তাবিত তার হরতাল প্রত্যাহার করেছে—এ খবরটা দুপুর নাগাদ ছিল লোকজনের মুখে মুখে।
ধর্মীয় বিষয়ের সঙ্গে সব সময়ই সব দেশে, পক্ষে বা বিপক্ষে, তীব্র আবেগ-অনুভূতি জড়িয়ে থাকে। তুরস্কের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী রিসেপ তাইপ এরদোগানকে এক ব্রিটিশ সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন, তুর্কি রাজনীতি থেকে ধর্ম বাদ দেয়া হবে কিনা। উত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘দেখুন, ধর্ম প্রতিটি সমাজের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে মিশে আছে। আর সমাজ ছাড়া রাজনীতি থাকে কোথায়? কাজেই যে কোনো দেশের সমাজে ধর্মের যে প্রভাব আছে, সে দেশের রাজনীতিতে তার কিছু না কিছু প্রতিফলন ঘটবেই। জোর খাটিয়ে রাজনীতি থেকে ধর্মকে বিদায় করা যাবে না কোনো দেশেই।
’ দুনিয়াজুড়ে বিভিন্ন দেশে রাজনীতির বর্তমান গতি-প্রকৃতি দেখে মনে হয় তিনি বাস্তবসম্মত মূল্যায়নই করেছেন। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে মুসলিম ধর্মীয় নেতারা হরতালের মতো কঠোর কর্মসূচিতে যাবেন সেই ঘোষণা দেশে কম-বেশি সবাইকে চিন্তাগ্রস্ত করে রেখেছিল। অবশেষে ক’দিন আগে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বললেন যে, প্রতিবাদকারী ওলামা মাশায়েখরা যদি হরতাল প্রত্যাহার করেন তাহলে সরকার তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে রাজি আছে। এই ঘোষণা আরও বেশ আগে এলে আরও ভালো হতো; কিন্তু তবুও শিক্ষামন্ত্রীর কথায় আমাদের অনেকেরই মনে হলো, বিরোধ নিষ্পত্তির সুযোগ আছে। তারপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা এইচটি ইমামের সঙ্গে আলোচনা করে সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া আশ্বাসের ভিত্তিতে হরতাল প্রত্যাহার করেছে সম্মিলিত মাশায়েখ ওলামা পরিষদ।
বাংলাদেশে এমনিতেই কোনো কাজ করতে গেলে পদে পদে দেরি হয়। সরকারি বাধা (রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের), আমলাতান্ত্রিক বাধা, ঘুষের জন্য বাধা, চাঁদার জন্য বাধা, ‘প্রভাব-বিস্তারের’ জন্য বাধা, মামলাবাজের বাধা, যানজটের বাধা, ট্রেন না চলার বাধা, যারা কাজ করবে তাদের অলসতা ও অনীহা—এসবের দরুন বলতে গেলে কোনো কাজ সময়মত শেষ করাই যায় না। এগুলোর সঙ্গে হরতাল যোগ হলে লোকজনের অসুবিধা তো হয়ই, যারা হরতাল ডাকেন তারা যে একথা জানেন না তাও নয়। তবে তারাও বলেন, উপায়ান্তর না থাকলে অথবা দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে তবেই তারা হরতাল আহ্বান করেন। তাদের কথাও একেবারে ফেলে দেয়া যায় না।
তাই পছন্দ হোক না হোক, একেবারে দলীয় (মানে যাদের বিরুদ্ধে হরতাল) লোক না হলে অন্যরা কিছু ক্ষতি স্বীকার করে হলেও হরতাল মেনে নেন। এ অবস্থায় ওলামা পরিষদ তার ডাকা হরতাল প্রত্যাহার করেছে, রোববার স্বাভাবিকভাবে (বাংলাদেশী মাপকাঠিতে) কাজকর্ম করা যাবে—একথা নিশ্চিত হওয়ার জন্য অনেকেই বিষয়টির খোঁজখবর নিচ্ছিলেন। উত্কণ্ঠা-উত্তেজনা দূর হলো বলেও অনেকে স্বস্তি প্রকাশ করলেন।
দ্বিতীয় বিষয়টি আমাকে একটু বিস্মিতই করল। আমি একটা ধার করা গাড়িতে করে এক বৈঠকে যাচ্ছিলাম।
তবে গাড়ির চালক আমার আগে থেকেই পরিচিত। গাড়ি চালানোই তার পেশা। তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘যানজট সমাধানের জন্য সরকার নাকি ঢাকা থেকে সব প্রাইভেট গাড়ি তুলে দেবে?’ তার উদ্বেগের কারণ খুব পরিষ্কার ছিল। প্রথমত, ব্যক্তিমালিকানার সব গাড়ি যদি নিষিদ্ধ হয়ে যায়, তাহলে তার চাকরির কী হবে? দ্বিতীয়ত, প্রাইভেট গাড়ি এখন এত মানুষ ব্যবহার করছেন যে, এই বাহন না থাকলে শুধু বাস দিয়ে সবার যাতায়াতের ব্যবস্থা হবে কি? অনেককেই কি তাহলে এখনকার চেয়ে লম্বা সময় বাসের জন্য অপেক্ষা করতে হবে না? তাহলেও তো ব্যক্তিগত কষ্টের সঙ্গে যোগ হবে কাজে ব্যাঘাত হওয়া। বুঝলাম, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত যে মন্তব্য করেছেন ঢাকার যানজট কমানোর জন্য সরকার পথে বেশি করে বাস নামাবে আর একই সঙ্গে বিশেষ বিশেষ রাস্তায় ব্যক্তিগত গাড়িতেও একাধিক যাত্রী নেওয়া বাধ্যতামূলক করবে, সেই কথাই লোকমুখে ঘুরতে ঘুরতে এক শঙ্কাজনক বিষয়ে রূপান্তরিত হয়েছে।
আমাদের চালককে বিষয়টা ব্যাখ্যা করে বললাম, তবে তিনি পুরোপুরি আশ্বস্ত যে হলেন না, তাও বুঝলাম।
আমাদের বৈঠকে ঘটনাটা উল্লেখ করলাম। আমি জনাব মুহিতের প্রস্তাব সমর্থন করলাম। এও বললাম যে, এই সরকার যদি বিআরটিসির জন্য আগের সরকারের আমদানি করা দোতলা বাসগুলোর মধ্যে যেগুলো খারাপ হয়ে পড়ে রয়েছে সেগুলো ইতিমধ্যে মেরামত করে রাস্তায় রাখত, তাহলেও ঢাকার পথে চলাচলের সুবিধা হতো এবং একটা পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থার পক্ষে জনমত গড়ে উঠত। আমার সহকর্মীরা এ মন্তব্যে উত্সাহিত হলেন না।
তারা বললেন, ঢাকায় ব্যক্তিমালিকানাধীন যে বিরাটসংখ্যক ছোট বাস আছে সেগুলোর মালিকরা তাদের ব্যবসা অক্ষুণ্ন রাখার জন্য সরকারি উদ্যোগে বেশিসংখ্যক বড় বাস চালাতে দেবেন না। তারা যেভাবেই হোক অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাব ব্যর্থ করে দেবেনই। তারা এও বললেন, ছোট বাসের মালিকদের মধ্যে আছেন ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতারা ও বেশ কিছুসংখ্যক পুলিশ কর্মকর্তা। এরা যে কোনো সরকারি পরিবহন ব্যবস্থাকে বানচাল করে দেবেন অবশ্যই। আমার সহকর্মীরা বললেন, এসব বাস মালিক অতীতেও বিআরটিসির মাধ্যমে জনপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে উঠতে দেননি, এখনও দিচ্ছেন না এবং ভবিষ্যতেও দেবেন না।
আর যারা শুধুই ব্যক্তিগতভাবে ব্যবহারের জন্য গাড়ি কিনেছেন বা সরকারি গাড়ি একা ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছেন, তারাও ছোট গাড়ির ওপর কোনো বিধিনিষেধ আরোপ করতে দেবেন না। এ আলোচনা আমি আর এগিয়ে নিতে পারিনি।
অন্য যে দুটি বিষয় বারবার শুনলাম, তা হলো বাড়িভাড়া ও স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের পড়ানোর জন্য প্রদত্ত বেতন বৃদ্ধি। এ দুটি প্রসঙ্গ এলো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যস্ফীতির কথা উঠলে; কিন্তু দেখলাম যে, যারা বাড়িভাড়া ও স্কুলের বেতনের কথা তুললেন, তারা শঙ্কিত ও খুবই ক্ষুব্ধ। তাদের কাছে চাল-ডাল-তেলের মূল্যবৃদ্ধি এখন শুধু পুরনো নয়, বরঞ্চ নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার।
এ সমস্যা যেভাবেই হোক তাদের মোকাবিলা করতেই হয়; কিন্তু অন্য দুটো বিষয়ে ব্যয়বৃদ্ধি একেবারে অত্যাচার হিসেবে দেখা দিয়েছে। তারা বললেন, বাড়ির মালিকরা এই ডিসেম্বরে এসে ভাড়াটেদের জানিয়ে দিচ্ছেন যে, এখন থেকে বাড়িভাড়া বাড়ল। আর এই বৃদ্ধি যেমন-তেমন নয়। যে বাড়ির ভাড়া মাসে ১০ হাজার টাকা ছিল তা এখন ১২-১৩ হাজার টাকা করা হচ্ছে আর মাসিক ১২ হাজার টাকা ভাড়া বাড়িয়ে করা হচ্ছে কমপক্ষে ১৫ হাজার টাকা। বাড়িভাড়া বাড়িয়ে দেয়ার ব্যাপারে বাড়ির মালিকরা কোনো চুক্তি মানতে রাজি নন এবং ভবিষ্যতের জন্য কোনো চুক্তি করতেও রাজি নন।
তাদের সাফ কথা, ‘হয় যে ভাড়া চাওয়া হচ্ছে তা দেবেন, না হয় বাড়ি ছেড়ে দেবেন। কোনো ছাড় নেই। ’
স্কুলের বেতনও অনেকখানেই বাড়ানো হয়েছে উচ্চ হারে এবং সেটা করা হচ্ছে স্কুলের পাঠ্যক্রম বছরের শেষ মাসে এসে, কোনো অগ্রিম নোটিশ ছাড়া। এভাবে বাড়ালে অভিভাবকদের পক্ষে তুলনামূলকভাবে কম বেতন দিতে হবে এমন স্কুল খোঁজ করার বা সেখানে ভর্তির সময়সীমার মধ্যে আবেদন করার সুযোগ থাকে না। সবকিছু মিলিয়ে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের মাথায় বাজ পড়ার মতো ব্যাপার আর কি।
এসবের সঙ্গে যোগ হয়েছে যানবাহনের ভাড়া বৃদ্ধি। এ মাসের ১৫ তারিখে সন্ধ্যায় গুলশান থেকে ধানমন্ডি যেতে বেবিট্যাক্সি ভাড়া ২০০ টাকা এবং আসার সময় ৩০০ টাকা দিতে বাধ্য হয়েছি। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে কবি নজরুল ইসলাম এ্যাভেনিউ যেতে বেবিট্যাক্সি ভাড়া গুনতে হয় কমপক্ষে ১৫০ টাকা। রিকশা ভাড়া এখন অতি সামান্য পথের জন্য ন্যূনতম ১০ টাকা। মাইলখানেক যেতে লাগে ২০ থেকে ২৫ টাকা।
খাদ্যমূল্য যেভাবে বাড়ছে তার খবর সবাই জানেন এবং জানছেন নতুন করে রোজই। তাহলে খাদ্যমূল্য, যানবাহন ভাড়া, বাড়িভাড়া, ছেলেমেয়েদের পড়ার খরচ—সবকিছু যেভাবে বাড়ছে এই মুহূর্তে তাকে কি আমরা শুধুই মূল্যবৃদ্ধি বলব, নাকি ভয়ানক মূল্যস্ফীতি বা ংঃধমমবত্রহম রহভষধঃরড়হ বলব? সরকার কি এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য কোনো কিছু করতে পারবে বা কোনো পথ বাতলাবে?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।