আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

যুদ্ধাপরাধীর জঞ্জাল নিয়ে সরকারের বিস্ময়কর উৎসাহ, কিন্তু ক্ষমা নাই ত্রিদিব রায়!

আমরা যদি না জাগি মা, কেমনে সকাল হবে... রাঙামাটি মহকুমা সদরের এসডিও ছিলেন যে আবদুল আলী, তিনি বেঁচে নেই। এই বীর মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যু হয়েছিল মর্মান্তিকভাবে। দৈবাৎ যদি বেঁচে থাকতেন, তার মুখ থেকে নিখুঁতভাবে জানা যেতো, পাকিস্তান সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকার পরও একাত্তরের এপ্রিলে কী করে তিনি দুটি স্পিডবোটযোগে মহালছড়ি থেকে রাঙামাটিতে নিয়ে এসেছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দলকে। জানতাম, তার সেই এক মূহূর্তের ভুলের কথা, যার ফল তিনি পেয়েছিলেন নিজের জীবন দিয়ে। ঘূণাক্ষরেও তিনি টের পাননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে আসার আগেই চট্টগ্রামের নতুনপাড়ায় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট সেন্টারে আগেই চাকমা রাজা গোপনে বৈঠক করে এসেছেন পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে।

বৈঠকের পরপরই সঙ্গোপনে চাকমা রাজার সঙ্গে রাঙামাটি আসে পাকিস্তানি কয়েকজন জুনিয়র অফিসার। প্রায় একই সঙ্গে কাপ্তাই থেকে পাকিস্তানি হানাদারদের একটি দল কয়েকটি লঞ্চ ও স্ডিপবোট নিয়ে রাঙামাটি এসে চুপিসারে অবস্থান নেয়। যা হওয়ার তাই হল। ভারত প্রত্যাগত মুক্তিযোদ্ধাদের দল রাঙামাটি জেলা প্রশাসকের বাংলোর কাছাকাছি পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গেই সেখানে আগে থেকে ওঁৎ পেতে থাকা পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে মুক্তিযোদ্ধারা ধরা পড়লেন। একপর্যায়ে কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই রাঙামাটি দখল করে নেয় পাক হানাদাররা।

সেই এসডিও আবদুল আলীর পরিণতি হয়েছিল মর্মান্তিক। শরবিন্দু শেখর চাকমার 'মুক্তিযুদ্ধে পার্বত্য চট্টগ্রাম' বইয়ে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে এভাবে- রাঙামাটি পুলিশ লাইনের এক ব্যারাকে আটক করে রেখে আবদুল আলীর শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ব্লেড দিয়ে আঁচড় দিয়ে সেসব জায়গায় লবণ দেওয়া হয়েছিল। এরপর তাকে একটি জিপের পিছনে বেঁধে টেনে রাঙামাটির বিভিন্ন জায়গায় ঘোরানো হয়। নেপথ্যে সেই একজন এই সবকিছুর মূলে, সমস্ত ঘটনার নেপথ্যে কলকাঠি নেড়ে গেছেন একজন দালাল, একজন বিশ্বাসঘাতক, একজন যুদ্ধাপরাধী - চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়। নিজের আত্মজীবনী 'ডিপার্টেড মেলোডি'তে সেই ত্রিদিব রায়ের নিজের স্বীকারোক্তি এসেছে এভাবে- ‌১৯৭১ সালের ১৬ এপ্রিল সকালে তিনি (রাজা ত্রিদিব রায়) তার ভগ্নিপতি কর্নেল হিউম, ম্যাজিস্ট্রেট মোনায়েম চৌধুরী, হজরত আলী এবং আরো কয়েকজন বাঙালি মুসলিম লীগ নেতাসহ চট্টগ্রামের নতুন পাড়ায় অবস্থিত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেন্টারের পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করেন।

পাকিস্তানি হানাদারদের সঙ্গে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হয় যে ম্যাজিস্ট্রেট মোনায়েম চৌধুরী এবং রাজা ত্রিদিব রায়ের সঙ্গে আসা আরো কয়েকজন বাঙালি ঢাকা থেকে আসা জুনিয়র অফিসারকে সঙ্গে করে কাপ্তাইয়ে যাবেন। ঠিক সেদিনই বিকেলে কাপ্তাই থেকে সেনাবাহিনীর একটি দল কয়েকটি লঞ্চ এবং স্পিডবোট নিয়ে রাঙামাটি আসে এবং বিনা প্রতিরোধে দখল করে নেয়। যুদ্ধাপরাধী এক সাচ্চা পাকিস্তানির প্রতিকৃতি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বেঁচে থাকলে বিস্মিত হতেন আজ। কারণ ত্রিদিব রায় তার চেয়েও সাচ্চা পাকিস্তানি হয়ে উঠেছিলেন। পাকিস্তানি হওয়া অপরাধ নয়, কিন্তু এই লোকের গায়ে যুদ্ধাপরাধের ঘনঘোর কালিমা লেগে ছিল আমৃত্যু।

একাত্তরে এই লোক স্বজাতির সঙ্গে বেঈমানি করে মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যায় প্রত্যক্ষ মদদ দিয়ে গেছেন। একাত্তরে রাঙামাটিতে যতো গণহত্যা চলেছে, সবগুলোর পেছনেই তার প্রত্যক্ষ মদদ ছিল। পরাজয় আঁচ করতে পেরে মুক্তিযুদ্ধের শেষ সময়ে তিনি পাকিস্তানে চলে যান। ওই সময়ে তাকে পাকিস্তান সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে শ্রীলংকা, বার্মা, থাইল্যান্ডসহ বৌদ্ধপ্রধান দেশগুলোতে পাঠানো হয় পাকিস্তানের পক্ষে সমর্থন আদায়ের জন্য। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহায়তার অভিযোগে দালাল আইনে অভিযুক্তদের একটি তালিকা প্রকাশ করা ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি, দৈনিক বাংলায়।

ওই তালিকার ৮ নম্বরে রাজা ত্রিদিব রায়, আর ১২ নম্বরে গোলাম আযম! ১২ নম্বর দালাল তবু ষড়যন্ত্রের নতুন মিশন নিয়ে বাংলাদেশে ফিরে এসেছিল, কিন্তু আট নম্বর দালাল ত্রিদিব রায় পাকিস্তানের পদসেবাতেই নিজেকে নিয়োগ করেছিলেন। খোদ পাকিস্তানের মানুষই তাকে বিদ্রুপ করে বলতো- উজির-ই-খামাখা। আজন্ম এই বিদ্রুপ মাথায় নিয়েও তিনি পেয়ারা পাকিস্তানের সেবা করে গেছেন। ১৯৭২ সালে ত্রিদিব রায়কে ফিরিয়ে আনার জন্য তার স্ত্রী বিনীত রায়কে পাকিস্তানে পাঠিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। তিনি ঘৃণাভরে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন।

পাকিস্তানের প্রতি এই আনুগত্যের স্বীকৃতি হিসেবে ওই সময়ের পাকি প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভূট্টো তার সম্মানে বিশেষ ভোজসভার আয়োজন করেছিলেন। পরে কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রিত্ব ছাড়াও ত্রিদিব রায় বিভিন্ন দেশে হয়েছেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত। যুদ্ধাপরাধীকে বরণে সরকারের বিস্ময়কর আগ্রহ এই গুণধর যুদ্ধাপরাধী ত্রিদিব রায়, যিনি বর্তমান চাকমা সার্কেলপ্রধান ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়ের বাবা, গত ১৭ সেপ্টেম্বর ৭৯ বছর বয়সে মারা গেছেন তার স্বপ্নভূমি পাকিস্তানের ইসলামাবাদে। সেই পাকিস্তানি দালালের লাশ এখন ৩০ লাখ শহীদের রক্তস্নাত এই বাংলাদেশের মাটিতে নিয়ে আসার জোর চেষ্টা চলছে। বঙ্গভবনে কদিন আগে অনুষ্ঠিত পাবর্ত্য অঞ্চলের হেডম্যানদের সঙ্গে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী নিজেই এ ব্যাপারে সবুজ সংকেত দিয়েছেন বলে খবর বেরিয়েছে।

অথচ এই লোক তার সারাজীবনই বাংলাদেশকে ঘৃণা করে এসেছেন, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ তার কাছে ছিল শ্রেফ ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, পাকিস্তানে থেকেও নানাভাবে নানা কৌশলে পার্বত্য চট্টগ্রামকে অশান্ত রাখতে ভূমিকা পালন করেছেন, মৃত্যুর পরও সেই লোকের স্থান কিভাবে হয় এই বাংলাদেশে? তবু সেটিই ঘটতে যাচ্ছে। রাষ্ট্রযন্ত্র ত্রিদিব রায়কে বরণের জন্য সবুজ সংকেত দিয়েছে ইতিমধ্যে। চাকমা রাজা দেবাশীষ রায়ের পরিবার ঠিক এই মুহূর্তে ঢাকায়। বিশেষ মর্যাদায় এক দালালের লাশ নেওয়ার অপেক্ষায় তারা ক্ষণ গুণছে। পাকিস্তানের এই দাসানুদাসকে বাংলাদেশের মাটিতে সমাহিত করার ইচ্ছাসংবলিত একটি আবেদন গত আট বছর ধরেই ঝুলছিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে।

তাও সেটি ত্রিদিব রায়ের নিজের করা আবেদন ছিল না। বাংলাদেশের প্রতি এমনই ঘৃণা ছিল তার। পাকিস্তান সরকারকে লেখা তার একটি চিঠির অংশবিশেষ উল্লেখ করে পাকিস্তান হাইকমিশন থেকে ২০০৪ সালে ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো বার্তায় ওই আবেদন করা হয়েছিল। পাকিস্তান সরকারও একাধিকবার এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য অনুরোধ জানায় বাংলাদেশকে। মাঝখানে বিএনপি সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রী মোর্শেদ খান মানবিক বিবেচনায় নেওয়ার নির্দেশ দিলেও পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তারা স্পর্শকাতর ভেবে বিষয়টি নিয়ে আর এগোতে চাননি।

সেই থেকে ঝুলছিল পাকিস্তান হাইকমিশনের আবেদন। শেষ পর্যন্ত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোট নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল যে আওয়ামী লীগ সরকার, তারাই বিনা বাক্যব্যয়ে, অনেকটা নিজেদের উদ্যোগে যুদ্ধাপরাধী ত্রিদিব রায়ের লাশ পাকিস্তান থেকে বরণ করে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত এখন। এই সরকারের লীলা বোঝা বড়ো কঠিন! ভোটের রাজনীতি বোঝা তার চেয়েও কঠিন। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে পাহাড়ি চাকমাদের মন জয় করাই কি সরকারের মূল উদ্দেশ্য, নাকি অন্য কিছু? অথচ বঙ্গভবনের সামনে যে মাঠ, তার নিচে যে মাটি, সেখানে কান পাতলেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুনতে পেতেন - যুদ্ধাপরাধী ত্রিদিব রায়কে গ্রহণ করার জন্য শহীদের রক্তে ভেজা এই মাটি প্রস্তুত নয়। পাকিস্তানের পরিত্যক্ত ওই জঞ্জাল এই মাটি চায় না।

হায় দুঃখিনী বাংলাদেশ! রাঙামাটির বুড়িঘাটেই শুয়ে আছেন আমাদের বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আবদুর রউফ, সহযোদ্ধাদের জন্য নিরাপদ পথ তৈরি করে দিতে গিয়ে একাই লড়ে নিজে ঝাজরা হয়ে গিয়েছিলেন শত্রুর গুলিতে। সেই মাটিতেই বিশেষ মর্যাদায় সমাহিত হবে বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী ৮ নম্বর দালাল! শুনেছি, রাঙামাটিতে রীতিমতো নাগরিক সংবর্ধনা কমিটি হয়েছে, গোপনে চলছে বিপুল আয়োজনের প্রস্তুতি। একাত্তরে যে লোকের ইশারায় পাকিস্তানি হানাদাররা শত শত মায়ের বুক খালি করেছে, দেশের পর দেশ ঘুরে যে লোক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেওয়ার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে গেছেন, সেই কুলাঙ্গারের লাশ যখন শাহজালাল বিমানবন্দরের রানওয়েতে নামবে, বোবা কান্নায় একটু কি কেঁপে উঠবে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের এই দুঃখিনী বাংলাদেশ? সংযুক্তি ● পাকিস্তানি পত্রিকায় ৮ নম্বর দালালের মৃত্যুসংবাদ এসোসিয়েটেড প্রেস অব পাকিস্তান | ডেইলি ডন | পাকিস্তান অবজারভার ● পাকিস্তানে এক চাকমা রাজা : মূল প্রতিবেদন | অনুবাদ ● আদিবাসী রাজাকারদের কেন বিচার হবে না ● বাংলাদেশে সমাধি চান পাকিস্তানের 'উজির-এ-খামাখা' ● রাঙামাটিতে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা ● যেভাবে যুদ্ধাপরাধী হয়ে উঠলো রাজা ত্রিদিব রায় ● রাজাকার পাকিস্তানি কুলাঙ্গার ত্রিদিব রায়ের ডাম্পিং প্লেস আমার বাংলাদেশ না ● রাজা(কার) ত্রিদিব রায় : এ লাশ সইবে না বাংলার মাটি ● দ্বিতীয় প্রকাশ : ফিউশন ফ্যাক্টরি ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.