আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ছেলেবেলার প্রেম ছেলেবেলার গান :আমার হাই ইশকুল বেলা

প্রকৃতিকে করো তব দাস-চে দ্য আইডল (ব্লগার নং - ৩১৩৩৯) আমার প্রাইমারি ইশ্কুল টা বাড়ি থেকে এক মাইল হলেও হাই ইশকুল টা ছিলো বাড়ির মুখোমুখি। রাস্তার এপাশ আর ও পাশ। প্রাইমারি পাশ করে ওখানকার সব ফ্রেন্ড আরো হাফ মাইল দূরের এক স্কুলে ভর্তি হলেও আমি হই এখানে। একা। প্রাইমারীর আর কোনো ফ্রেন্ড এখানে আসে নি।

এই জিনিসটা আমার সবসময় হয়েছে। হাইস্কুল থেকে আমি একাই ভর্তি হই বিএন কলেজ চট্টগ্রামে। আবার ওখান থেকে একাই চান্স পাই চুয়েটে। আমি যেখানে যাই পেছনে সব রেখেই যাই। বাবার হাত ধরে ইশকুলে ভর্তি হতে যাই।

সব স্যার কে আমি চিনি। কিন্তু কখনো কথা হয়নি। ভয় টা ঠিকই লাগছিলো। আমার ভর্তি রোল ছিলো ১৩৮। আমাদের হাইস্কুলে শাখা ভাগ করা হতো ষাট জন করে।

সে হিসেবে আমি গিয়ে পড়লাম গ শাখায়। আমার মন খারাপ। ক শাখায় পড়ালেখা ভালো হয় বলে ধারণা। তাহলে কী আমি ছাত্র খারাপ? সেদিন আর ক্লাস করলাম না। বাড়ি এসে বাবা কে বললাম।

বাবা যতই বোঝায়, আমি ততই মন খারাপ করি। পরদিন স্কুলে গিয়ে হেডস্যার রে বলি। অবশ্য বাবা আগেই বলে গিয়েছিলেন একটা ব্যবস্থা করতে। স্যার বললেন, ক্লাসে গিয়ে বসতে। মন খারাপ করে বসে আছি গ শাখায়।

কিছুক্ষণ পর পিয়ন এসে আমাকে আর আরেকটা ছেলে কে ডাকলো। ছেলেটাকে আমি চিনি। আমাদের পাশের বাড়ির। নাম মাহমুদ। আমার নামেও মাহমুদ আছে।

মিতা! গেলাম দুজন। স্যার বললেন, রোল ৬ আর ১০ এর দুজন অন্য স্কুলে চলে গেছে। সো, মাহমুদ ৬ আর আমি ১০। এবার গেলাম ক শাখায়। ক শাখায় ঢুকে আরো কয়েকজন কে চিনতে পারলাম।

কয়েকবাড়ি পরের ইমতিয়াজ। ইমতিয়াজ কে চিনি একটা স্ক্যান্ডালের কারণে। এলাকার এক মেয়ের সাথে প্রেম করার অপরাধে ওর বাপ ধরে মাইর লাগিয়েছিলো সেই ক্লাস ফোরে থাকতে। আমি তখন প্রেম জিনিসটা ঠিকভাবে বুঝে উঠি নাই। আর এই ছেলে প্রেম করে মাইর খেয়েছে! এইছেলে তো বস! আর চিনলাম আমির হোসেন কে।

নানার বাড়ি থেকে পড়ালেখা করে। নানার বাড়ি আমাদের পাশেই। ওর একটা নাম ছিলো। টিয়া। সবাই টিয়া টিয়া করে খেপাতো।

ও খেপতো না। হাসতো। আরেকজন ওয়াজেদ। আমাদের এলাকায় আগে প্রতিবছর একটা ওয়াজ মাহফিল হত। তিনদিন ব্যাপী।

ওয়াজেদের সাথে পরিচয় ওখানেই প্রথম। ওয়াজ শীতকালে হত বলে নিচে বসার জন্য খড় বিছিয়ে দেয়া হত। আমরা গিয়ে খড় জড়ো করে বাসা বানাতাম। খড় দিয়ে টুপি বানাতাম। চশমা বানাতাম।

একবার আমি খড়ের চশমা চোখে লাগিয়ে মন দিয়ে ওয়াজ শুনছি। একটা ছেলে এসে বলে, আমারে একটা চশমা বানায় দিবা? দিলাম। জানলাম, বাড়ি আমাদের পাশেই। নাম ওয়াজেদ। আর কাওকে চিনলাম না।

তবে কিছুক্ষণের মধ্যে জানলাম, পরিচিত আরো দুজন আছে। খ শাখায়, মাহমুদ দের বাড়ির সুজন, সম্পর্কে ভাইগ্না, আর পরানি নামের একটা মেয়ে। মেয়েটাকে এড়িয়ে যাই। গা ঘেষাঘেষির বদ অভ্যাস আছে মেয়েটার। স্যার ঢুকলেন।

নারায়ন স্যার। গণিত নেবেন। রোল কল করলেন। নতুন এসেছি আমি আর আরেকটা মেয়ে। নিগার সুলতানা নামে।

দুজনের আগের স্কুল আর স্কুলের রোল পজিশন জানতে চাইলেন। নিগার এসেছে চরফকিরা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। যেখান থেকে এসেছে ক শাখার প্রায় সবাই। ক্লাস নিয়ে স্যার চলে গেলে দেখি আমার সাথে কেউ কথা বলছে না। ওরা একই প্রাইমারী থেকে এসেছে সবাই, ওরা ওরাই ব্যস্ত নিজেদের নিয়ে।

একসময় ওয়াজেদ এসে পাশে বসলো। ওয়াজেদ আসার পর আসলো আমির হোসেন ও । আমি ওরে বললাম, তোমার নাম কী আসলেই টিয়া? সে খ্যাক খ্যাক করে হাসলো। ওয়াজেদ বাকিদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো। ইমতিয়াজ, রাকিব, গিয়াস, মাঈন, হাসনাত, নিগার, আকাশী।

হাই হ্যালো হলো। খুব একটা কথা হলো না। নতুন পরিবেশে গেলে আমি সহজে মানিয়ে নিতে পারি না। সময় লাগে। এটা এখনো পুরোপুরি কাটাতে পারি নি।

চেষ্টা চলছে। ক্লাস শেষে বেরিয়ে এলাম আমির হোসেন আর ওয়াজেদের সাথে। হঠাৎ কোত্থেকে এসে মাহমুদ দিলো এক ধাক্কা। মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। কিছু বললাম না।

স্কুল থেকে আমাদের বাড়ি হয়ে মাহমুদদের বাড়ি শর্টকাটে যাওয়া যেত। ধাক্কার প্রতিশোধ নিতে আমি বললাম, আমাদের বাড়ির উপর দিয়ে যাওয়া যাবে না। সে যাবেই। শুরু হলো ধাক্কা ধাক্কি। শেষে আমির আর ওয়াজেদ ওকে টেনে নিয়ে যায়।

বিকেলে মাঠের দিকে বের হয়ে দেখা হয় ওদের সাথে। ঘোরা হয়। ভালো লাগে। পরের দিন ক্লাসে গিয়ে দেখি, ওয়াজেদ আর আমির হাসিমুখে এগিয়ে পাশে বসার জায়গা করে দিলো। হাইস্কুলের প্রথম ফ্রেন্ড হলো আমির আর ওয়াজেদ আর প্রথম শত্রুতা মাহমুদের সাথে।

কোনোটাই তেতো ছিলো না। # নতুন স্কুল। নতুন বন্ধুতা। নতুন শিক্ষক। নতুন পরিবেশ।

মজার কিছু ঘটছে না। প্রতিদিন একজন দুজনের সাথে পরিচিত হচ্ছি। ঝালমুড়ি আর আচার খাচ্ছি। হাসছি। সিক্সে আমাদের গণিত ক্লাস নিতেন নারায়ণ চক্রবর্তী স্যার।

স্যারের বাড়ি ছিলো স্কুল থেকে প্রায় দশ কিলোমিটার দূরে আমাদের উপজেলা পৌরসভায়। বসুরহাট পৌরসভা। উনি বাস বা টেম্পো তে চড়তেন না। রোজ সাইকেল চালিয়ে আসতেন। একই জায়গা থেকে আসতেন আরো দুজন শিক্ষক।

ক্রীড়াশিক্ষক ভবতোষ পাল স্যার আর তৎকালীন সহকারী ও পরে প্রধান শিক্ষক, বর্তমানে অবসরে, অমীয়ভূষণ দাস স্যার। নারায়ণ স্যারের কথা বলা যাক। আমাদের তখনো মানুষের আর্থিক অসঙ্গতি বোঝার বয়স হয় নি। তো স্যার রোজ স্কুলে আসতেন তাঁর পুরোনো সাইকেল নিয়ে, ঘুরেফিরে একটা প্যান্ট আর দুটো শার্ট। আমরা হাসাহাসি করতাম আড়ালে।

কারণ স্যার প্যান্টের পেছনের সেলাই খুলে কোমরের ঘের বড় করে নেয়ায় চিকন একটা অংশ পাশের অংশের চেয়ে উজ্জ্বল হয়ে চোখে পড়তো। আমরা বলতাম, এটা নারায়ণ স্যারের লেজ। আমি স্যারকে নিয়ে একটা ছড়াও বানিয়েছিলাম। 'নারায়ণ চক্রবর্তী রোজ দ্বিচক্রে আসেন স্কুলে, ত্রিচক্র বা চৌচক্রে আসেন না কভু ভুলে; ভুলে নয় ভুলে নয় কিপটামির ছলে। ' স্যারকে নিয়ে আরেকটা ছড়া প্রচলিত ছিলো, ' নারায়ণ নারায়ণ চিক্কার ভেতর ইন্দুর নাচে কী কারণ কী কারণ।

' এই ছড়ার রচয়িতা ছিলেন আমাদেরই আরেকজন শিক্ষক জয়নাল আবেদীন স্যার। উনি এই স্কুলেরই ছাত্র ছিলেন আর নারায়ণ স্যার, ভূষণ স্যার উনারও শিক্ষক ছিলেন। ছড়াটা ছাত্রাবস্থায় রচয়ন করেছিলেন। যায় হোক, নারায়ণ স্যারের কথাতেই আসি। স্যার খুব ভদ্র শান্ত ছিলেন।

তবে যেটা অস্বস্তিকর ছিলো, উনি মুসলমান ছাত্র বা অন্যান্য শিক্ষকদের স্পর্শিত কিছু খেতেন না, কোনো গেলাসে এমনকি পানিও খেতেন না। বছরখানেক আগে স্যার মারা গেছেন। স্যারের মৃত্যুসংবাদ যখন আমি শুনি, আমার মনে হয়েছিলো, হাত পা সব কাঁপছে, আমি উল্টে পড়ে যাবো। আমরা কখনো টের পাইনি, স্যার মৃত্যুকে বরণ করে আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন, আমরা স্যার কে কতখানি ভালোবাসি। আমি যদি একটিবার স্যার কে পেতাম, তবে বলতাম, স্যার ছোটবেলার এইসব বেয়াদবি ক্ষমা করে দেবেন।

ফিরে যাই সেই সময়ে। নারায়ণ স্যার অংক ভালোই বোঝাতেন আর অনেকগুলো বাড়ির কাজ করতে দিতেন। সবচেয়ে ভয়ংকর ছিলো, উনি হঠাৎ হঠাৎ একজনকে ডেকে বোর্ডে অংক কষে দিতে বলতেন। না পারলে সপাং সপাং বেত। হাত লাল।

আমিও একবার ধরা খেয়েছিলাম। অংক টা মোটেও কঠিন কিছু ছিলো না। কিন্তু আমার মনে হচ্ছিলো, না পারলে মাইর। ভয়ের চোটে আমি অংকটা করতেই পারলাম না। সেদিন আধাঘন্টা ধরে হাত ঢলতে হয়েছিলো।

মনে মনে স্যারের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করেছিলাম। আমাদের তখন হেডস্যার ছিলেন এ কে ফজল করিম স্যার। স্যারের ছিলো ঝাকড়া চুল। স্কুলের সামনে ছিলো বিশাল মাঠ। পাশে দীঘি।

স্যার রোজ বিকেলে একটা পিঠউঠা চেয়ার নিয়ে বসতেন পুকুর পাড়ে। বড়শি দিয়ে মাছ ধরতেন। আর আমাদের কাওকে দেখলেই ডেকে বলতেন, মাথা টা টিপে দে, চুলগুলো টেনে দে। স্যার আমাকে আগে থেকে চিনতেন। ক্লাস ফাইভের মাঝামাঝি হবে, সন্ধ্যার দিকে আমি মাঠে বসে ছিলাম খেলা শেষে।

স্যার বললেন, এই তোর না কি রে?বাড়ি কই? কোন ক্লাসে পড়িস? নাম আর ক্লাস বলে লাগোয়া বাড়ি দেখিয়ে দিতেই বললেন, একটা বাঁশ আনতে পারবি? আমি ভয় পেয়ে গেলাম। বাঁশ দিয়ে কী হবে? স্যারই বললেন, অফিসরুমের চাবি টা ভেতরে রেখে উনি তালা মেরে দিয়েছিলেন। পরে আরেকটা ছেলে সহ জানালা দিয়ে চাবি টা বের করে দেই। তো স্যার আমাকে দেখলেই ঢেকে বলতেন, মাথাব্যথা করছে, চুল ধরে থাক। দশ বিশ মিনিট ঝুলে থেকে আমি কাহিল হয়ে যেতাম কিন্তু স্যার থাকতেন নির্বিকার।

স্যার কে আমরা বেশী দিন পাইনি। বদলী হয়ে গিয়েছিলেন। তার বদলে এসেছিলেন কাজী শরীফ উল্লাহ স্যার। উনার বড় ছেলেটা আমাদের সাথেই পড়তো। আমার হাইস্কুল জীবনের তৃতীয় কি চতুর্থ দিনে নারায়ণ স্যারের ক্লাসে গুটিগুটি পায়ে দরজায় এসে দাঁড়ায় ছোট খাটো একটা মেয়ে।

স্যার তো রেগে উঠলেন। আমরাও একটি সুন্দর মাইরের দৃশ্য দেখার জন্য আগ্রহী হয়ে উঠলাম। স্যারের ক্লাসে লেটকামারের কোন জায়গা নেই। কিন্তু আমাদের হতাশ করে মেয়েটা বলে, স্যার আমি গতকাল ভর্তি হয়েছি। আজ প্রথম ক্লাসে আসলাম।

স্যার বললেন ,রোল কত? ২৯৯। মেয়েটার উত্তর। স্যার বললেন, তুমি তো গ শাখায়। এটা ক শাখা। আমরা খ্যাক খ্যাক করে হেসে উঠলাম।

মেয়েটা একটা স্লিপ দিলো স্যার কে। স্যার স্লিপ পড়ে বসতে বললো ক্লাসে। হেডস্যারের স্লিপ। আমরা বাকিটা ক্লাস জল্পনা কল্পনা করলাম মেয়েটার ব্যপারে। সবাই একমত হলাম, মেয়েটা দেমাগি।

অহংকারী। বেইল দেয়া ঠিক হবে না। কিন্তু আমার কেন যেন মেয়েটাকে ভালো লাগলো। কিন্তু যখন দেখলাম, কারো সাথেই কথা বলছে না, ভালো লাগাটা উড়ে গেলো। এই মেয়েটার দিকে পাঠকের একটা চোখ থাকলে ভালো হয়।

এই মেয়েটা আমার লেখায় বার বার আসতে পারে। আবার কোনভাবেই নাও আসতে পারে। মেয়েটার নামটা বলে দেই। নীলিমা। আমরা ডঃ নীলিমা ইব্রাহিম বলে ক্ষেপাতাম।

(চলবে) ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।