আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ছেলেবেলার প্রেম ছেলেবেলার গান (১)

প্রকৃতিকে করো তব দাস-চে দ্য আইডল (ব্লগার নং - ৩১৩৩৯) মনে পড়ে যায় দূর ফেলে আসা, বন্ধুতা আর প্রিয় গানের সুর মেয়েটার নাম হ্যাপি। এই নামে যারা তাকে চিনে, তারা কেউ এই লেখাটা দেখবে না কখনোই। যাকে নিয়ে লেখা সেও নয়। অতএব ছদ্মনাম না ব্যবহার করলেও সমস্যা নেই। হ্যাপির প্রেমে যখন উঠেছিলাম, উঠেছিলাম বললাম এই কারণে, হ্যাপি আমার এক বছরের সিনিয়র ছিলো, আমি যখন ক্লাস ফোরে,তখন সে ফাইভে, সময়টা ১৯৯৭।

তো, আমি যখন হ্যাপির প্রেমে উঠেছিলাম, তখন প্রেমবিষয়ক কোন ধারণাই আমার ছিলো না। এটা যে প্রেম ছিলো তা ধরতে পেরেছি মাঝারিবেলায় এসে। মাঝারিবেলা বলার কারণ, এখনো খুব বড় হয়ে যাই নি। মানে, বুড়িয়ে যাই নি। হ্যাপি কে রোজ দেখতাম একটা বড় ঘড়িঅলা ব্যাগ নিয়ে হেঁটে আসতে।

আমার প্রাইমারি স্কুলটা ছিলো আমাদের এক মাইল লম্বা বাজারটার ঠিক মাঝখানে, স্থানীয় মাদ্রাসালাগোয়া। মাদ্রাসার ওপাশে জামে মসজিদ, পাশেই পুকুর। পুকুরটার নাম খোনারপুকুর। কথিত আছে, এই পুকুরটা কখনো শুকিয়ে যায় না, সেঁচেও একে জলশূণ্য করা যায় না। গুজবের কারণেই হবে, কেউ কখনো সব জল সেঁচে ফেলার চেষ্টাও করেনি।

তবে পুকুরটা খুব উর্বর ছিলো। প্রচুর বড় বড় মাছ পাওয়া যেত। এখনো পাওয়া যায় কিনা আমি জানি না। আমার বাড়ি ছিলো বাজারের পুব প্রান্ত থেকে আধামাইল পুবে আর হ্যাপির বাড়ি পশ্চিম প্রান্ত থেকে এক মাইল পশ্চিমে। আমাদের ক্লাস শুরু হত বারোটায়।

গ্রামের স্কুল গুলোর একটা সুবিধা, ঘুম থেকে উঠেই স্কুলে দৌড়াতে হত না। এখন অবশ্য সেই গ্রাম নেই, এখন এখানে আমার ভাতিজা ভাতিজি ভাগনি ঘুম থেকে উঠেই কিন্ডার গার্টেনের মুরগীর খাঁচায় ঢুকে পড়ে। আমার একটা ব্যপার খুব ভয় লাগে, এই খাঁচাগুলো খুব একটা নিরাপদ না। তার উপর ছোট্ট দরজা টা বাইরের দিকে হুড়কো টানা থাকে। কোন একটা দূর্ঘটনা ঘটলে বাচ্চাগুলোর বের হবার কোন উপায় নেই।

হ্যাপির প্রেমে পড়ার অন্যতম একটা কারণ সম্ভবত তার ব্যাগের বড় ঘড়িটা। এটার প্রতি আলাদা একটা আকর্ষণ ছিলো আমাদের। আমাদের বলতে আমরা চারজন। আমি, মহসিন, মাসুম আর ফারুক। আমরা চারজন একটা গ্রুপ মত ছিলাম।

আবার চারজন ছিলাম আলাদা ধরণের। আমি একটু অন্তর্মুখি ছিলাম। বাইরে থেকে কেউ বুঝতে পারতো না যে এই গ্রুপের মূল প্ল্যান টা সবসময় আমার কর্তৃক সম্পাদিত হত। মহসিন ছিলো সবচেয়ে সরেস কাঠি। আইডিয়া ব্যক্ত হইবামাত্র সে ইহা বাস্তবায়নে ব্যস্ত হইয়া যাইতো।

মাসুম প্রথমে সবকিছুতেই না, কিন্তু দেখা যেত, মহসিনের সব অপকর্মের আমি আর ফারুক বাম হাত হলে মাসুম একাই ডান হাত। আমাদের অপকর্মের একটা বিবরণ দেয়া যাক। আগেই বলেছি, আমাদের স্কুললাগোয়া মাদ্রাসার কথা। সেই মাদ্রাসার একটা কাঠের দোতলা ঘর ছিলো। পুরোনো হয়ে যাওয়ায় ঘরটার উপর তলায় কোন ক্লাস হত না।

শুধুমাত্র নিচতলায় হত। আমরা পলিথিনে বালি ভরে চুপিচুপি দোতলায় উঠে যেতাম আর ফ্লোরের কাঠের ফাঁক দিয়ে নিচে ফেলতাম। নিচ থেকে ক্ষুব্ধ কোন ছাত্র বা মাদ্রাসার হুজুর উপরে উঠে আসার আগেই লাগোয়া কড়ই গাছের ডাল বেয়ে নিচে। এভাবে নামতে হত বলে আমাদের হাত আর বুক সবসময় ছেঁড়া থাকতো। একবার অবশ্য ধরা পড়েছিলাম।

রাগী বদ হুজুরটা সোজা নিয়ে এলো আমাদের হেডস্যারের কাছে। হেডস্যারের নির্দেশে আমাদের চারজন কে রোদের মধ্যে বিশবার কান ধরে উঠবস করতে হয়েছিলো। আমরা কান ধরে উঠবস করছি আর পুরো স্কুল আর মাদ্রাসার অধিকাংশ হাসছিলো। সবচেয়ে দুঃখ হলো, এদের মধ্যে হ্যাপিও ছিলো। আমাদের সব রাগ গিয়ে পড়লো হ্যাপির উপর।

প্রতিশোধ হিসেবে আমরা পরদিন তার ঘড়িটা ভেঙে দিয়েছিলাম। মাদ্রাসার দোতলায় উঠে বালি ফেলা টা এ কারণে বন্ধ হয় নি। বন্ধ হয়েছিলো অন্য কারণে। নিচতলার শেষমাথার একটা রুম মাদ্রাসার মেয়েদের কমন রুম হিসেবে ব্যবহৃত হত। একদিন বালি ফেলার উদ্দেশ্যে আমরা ওদিকে গেলাম।

নিচতলার বাসিন্দাদের অবস্থান দেখতে আমরা কাঠের ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে দেখি সব গুলো মেয়ে বোরকা ছাড়া। হঠাৎ মহসিন ইশারা করলে এক পাশে এগিয়ে যাই। ওদিকটায় কমনরুমের টয়লেট। উঁকি মেরে দেখি, একটা মেয়ে প্রাকৃতিক কর্ম সেরে মাত্র উঠে দাঁড়িয়েছে। কাপড় গুলো তখনো সস্থানে আসেনি।

ওইবয়েসে আমাদের কারো মধ্যেই যৌনতা বাসা বাঁধেনি। স্বাভাবিকভাবেই, আমরা তীব্র ভয় পেলাম। কোনরকম নিচে নেমে এলাম। এরপর থেকে আর বালি ফেলতে যাই নি। মজার ব্যপার হলো, এরকিছু দিন পরেই দেখলাম, মাদ্রাসার দুটো ছাত্র কে মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল জোড়াবেত দিয়ে পেটাচ্ছেন।

পরে জানতে পারলাম, আমরা যেখানে ভয় পেয়ে নেমে এসেছিলাম, ওদেরকে ওখানে আরামে বসে থাকতে দেখা গেছে। আমাদের স্কুলের কাছাকাছি খোনার পুকুরের পাড়ে বাড়ি ছিলো বাচ্চু মিয়া নামে একজনের। উনি বাজার কমিটির সেক্রেটারি হবার সুবাদে সেক্রেটারি বাচ্চু নামেই পরিচিত ছিলেন। ওনার উঠোনের একপাশে বিভিন্ন ফলের গাছ ছিলো। আমাদের দৈনিক কাজ ছিলো, কখন কোন গাছে ফল ধরে।

প্রায় সময় ওগুলো কাঁচাই খেয়ে ফেলতাম। আর ছিলো তুমুল ফুটবল। উঠোনের পাশেই একটা পতিত জমি ছিলো। ওখানে আমরা যতটা না ফুটবল খেলতাম তারচেয়ে বেশী চেঁচিয়ে আশপাশ মাথায় তুলতাম। বাচ্চু আঙ্কেলের ওয়াইফ ছিলেন রাগী টাইপের।

উনি প্রায়ই উঠোনে দাঁড়িয়ে বকা দিতেন। প্রতিবাদস্বরুপ, উনি ঘরে ঢুকে গেলে ওনার ঘরের চালে আমরা বড় বড় ঢিল ছুঁড়ে পালাতাম। বাচ্চু আঙ্কেল তুলনামূলক ভালো ছিলেন। দেখলেই বড় একটা ধমক লাগাতেন কিন্তু স্যারের কাছে কখনোই নালিশ দিতেন না। আমাদের নামে অবশ্য নিয়মিতই নালিশ যেত।

আমাদের সাথে একটা মেয়ে পড়তো। নাম রুমকী। বৌ জিনিসটা কি, এটা না বুঝলেও আমরা রুমকীকে খেপাতাম মহসিনের বৌ বলে। এটা রুমকী আর মহসিন, কেউই স্বাভাবিকভাবে নিতে পারতো না। মহসিনের সব রাগ পড়তো গিয়ে রুমকীর উপর।

ছোট্টবেলার আক্রোশ ছেলে মেয়ের ব্যবধান বুঝতো না। মহসিনের অধিকাংশ আক্রোশ গিয়ে থামতো রুমকীর চুলে। আমরা মজা পেয়ে আরো খেপাতাম। আর রুমকীও ছিলো মোটামুটি বিত্তশালী বাবার মেয়ে। তাই, বাংলাছবির নায়িকাসুলভ প্রতিশোধপরায়ণতায় সে নালিশ নিয়ে যেত তার গৃহশিক্ষক মাদ্রাসার এক হুজুরের কাছে।

হুজুর নালিশ দিতেন হেড স্যারের কাছে। কিন্তু রুমকীকে মাদ্রাসার দিকে যেতে দেখলেই আমরা স্কুল কম্পাউন্ডের বাইরে! বৌ ভিত্তিক খেপানো টা আমাদের চারজনকেই সহ্য করতে হতো। আমাদের সাথেই পড়তো মহসিনের জমজ বোন আর ওর এক খালা। বোনের নাম রোকসানা আর খালার নাম জেসমিন। আরো কয়েকটা মেয়ে ছিলো।

তার মধ্যে দুজনের নাম মনে আছে। তাছলিমা আর রানী। রানী কে আমরা ডাকতাম নানী। জেসমিন ছিলো আমার কথিত বৌ আর মাসুমের বৌ ছিলো তাছলিমা। সবচেয়ে অবস্থা খারাপ ছিলো ফারুকের।

সে ছিলো নানীর জামাই। খেপানো হলেও জেসমিন কিংবা তাছলিমা কিংবা রানীর সাথে আমাদের কখনোই মারামারি হতো না। আমাদের সব মারামারি ছিলো রুমকীর সাথে। এদের সাথে অনেকদিন যোগাযোগ নেই। আমি, মহসিন,শাহ আলম, ইব্রাহিম, কাদের সহ আরো কিছু ছেলে , আমরা নিজেদেরকে ঐবয়েসে আওয়ামীলীগ দাবি করতাম।

আমরা কিন্তু তখন ছাত্রলীগ, শিবির কিংবা ছা্ত্রদল কে চিনতাম না। আমাদের ফ্যামিলিগুলো আওয়ামীলীগ করতো বলে আমরা শেখমুজিব কে চিনতাম। শেখমুজিব দেশ স্বাধীন করেছেন বলে উনার প্রতি অসম্ভব কৃতজ্ঞ ছিলাম। একবার একটা সাদা কাগজে বড় বড় অক্ষরে লিখেছিলাম, "শেখমুজিবের জন্য আমরা রক্ত দিতে পারি"। রক্ত যে দিতে পারি তার প্রমাণ স্বরুপ আমরা প্রত্যেকেই মাদার গাছের কাঁটা হাতের উল্টোপিঠে আঘাত করে তারপর হাত কে চক্রাকারে ঘুরিয়ে রক্ত বের করে সাদা কাগজটায় লাগিয়ে স্কুলের দেয়ালে টাঙিয়েছিলাম।

অবাক লাগে, আমাদের কেউ বলে দেয় নি যে তোমরা শেখমুজিবের জন্য রক্ত দাও। তবুও আমরা নিজেদের হাত রক্তাক্ত করার সাহস আর ইচ্ছা কোথায় পেয়েছিলাম! ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।