আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ছেলেবেলার প্রেম ছেলেবেলার গান (৩)

প্রকৃতিকে করো তব দাস-চে দ্য আইডল (ব্লগার নং - ৩১৩৩৯) ফেলে আসতে আসতে অনেকখানি পথ ফেলে এসেছি সব আনন্দের কথন বেদনার অনুরণন হয়ে উঠেছি কেবল যন্ত্র; অদ্ভুত এক... মহসিন,ফারুক,মাসুমদের সাথে পরিচয় কবে কখন, মনে নেই। তবে মনে আছে, মাসুম ক্লাস থ্রী থেকে আমাদের সাথে ভর্তি হয়। এর আগে সে ছিলো চট্টগ্রামে। প্রথম ক্লাসেই আমার সাথে তার লেগে যায়। ঘটনা হলো, আমি ছিলাম ফার্স্ট বয়, মহসিন সেকেন্ড আর থার্ড জেসমিন।

মাসুম আমার পজিশন নিয়ে প্রশ্ন তুললে গায়ে লেগে যায়। শিশুসুলভ মারামারির পরিণতিতে সাত আট মাস কথা বন্ধ। পরে মহসিন আর ফারুকের চেষ্টায় বন্ধু হয়ে যাই। বন্ধুত্ব টা এত বেশী হয়ে যায় যে ব্যাগ টা ক্লাসরুমে রেখেই মাসুমদের বাড়ি গিয়ে ওকে স্কুলে নিয়ে আসা টা আমাদের নিত্যরুটিন হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের রুটিনে আরো দুইটা ব্যপার ছিলো।

তখন এটিএন বাংলা মাত্র পরীক্ষামূলক সম্প্রচারে এসেছিলো। সারা দিন রাত ওখানে বাংলা ছবি চলত। স্কুল লাগোয়া একটা চায়ের দোকানে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে আমরা বাংলা ছবি দেখতাম। বাংলা ছবি নিয়েও শৈশবে কম মজা হয়নি। রোজ শুক্রবারে বাংলা ছবি দেখার জন্য চলে যেতাম আত্মীয় বাড়ি।

তখনো আমাদের ঘরে টিভি আসেনি। সমস্যা হতো, কারেন্ট চলে গেলে। ক্লাবঘরে তখন দুই টাকা টিকিট করে ব্যাটারীতে টিভি চলত। ওখানে হুমড়ি খেয়ে পড়তাম। যেদিন টাকা থাকতো,সেদিন রাজার হালে ঢুকে পড়তাম।

টাকা না থাকলে পেছনের বাঁশের বেড়ায় ফোঁকর করে এক চোখে উঁকি মেরে দেখতাম। পরে অবশ্য পাশের বাড়িতে টিভি চলে আসলো। ওখানে একটা চেয়ারের দখল নিতে ঘন্টা আগেই গিয়ে বসে থাকতাম। আসল মজা টা হতো ছবি শেষ হবার পর। কেউ নায়ক, কেউ ভিলেন আবার কেউ পুলিশ সেজে অ্যাকশান দৃশ্য গুলো আরেকবার প্রদর্শন করতাম।

নায়িকা পাওয়া যেত না বলে রোমান্টিক দৃশ্যগুলোর কোনো গতি হত না। অবশ্য এনিয়ে আমাদের কোনো। আফসোসও ছিলো না। আমরা মারামারির ভক্ত ছিলাম। জসিম রুবেল মান্না রা আমাদের প্রিয় তালিকায় অনায়াসে স্থান নিত।

রুটিনের আরেকটা ব্যপার হলো, টিফিন পিরিয়ডে প্রত্যেকে দুইটাকা করে দিয়ে মুড়ি আর খোলা চানাচুর খাওয়া। আমাদের ভাষায় এর নাম ছিলো 'খৈল-ভুষি'। মাঝে মাঝে দলবেঁধে চলে যেতাম বেকারীতে। দশটাকায় লুঙ্গির কোঁচড় ভরে নিয়ে আসতাম ভাঙা বিস্কিট, টোস্ট, প্যাটিস এইসব। প্যাটিস টা আমার সবচেয়ে প্রিয় ছিলো।

ভেতরে নারকেল কোরা থাকতো। ভাঙা বিস্কিট খাওয়া বন্ধ হয়েছিলো এই প্যাটিসের কারণেই। একবার নারকেল কোরার ভেতরে জ্যান্ত পোকা পেয়েছিলাম। পঁচা জিনিসে যে সাদা পোকা গুলো কিলবিল করে সেই পোকা। ক্লাস ফোরে আমাদের দলে আরো একজন বাড়ে।

বাপ্পী। সেও চট্টগ্রাম থেকে থ্রী শেষ করে এসেছে। বাপ্পীর সাথে মারামারি হয় নি। বরঙ প্রথম দিন থেকেই বন্ধুত্ব। বাপ্পীর একটা মজার স্মৃতি মনে পড়ছে।

একবার স্কুল পরিদর্শক এসেছিলেন। সবাইকে বিভিন্ন প্রশ্ন করেছিলেন। বাপ্পীকে জিজ্ঞেস করা হলো, আমার একটা ফিতা আছে, এটার ইংরেজী কী হবে? বাপ্পী উত্তর দিলো, আই হ্যাভ আ ফাদার। ক্লাস ফোরের শেষের দিকে হঠাৎ আমরা খেয়াল করলাম, কয়েকদিন ধরে তাছলিমা স্কুলে আসছে না। কাদেরকে দায়িত্ব দেয়া হলো খোঁজ দ্য সার্চের।

সে জানালো, তাছলিমার বিয়ে হয়ে গেছে। সেসময়ে ব্যপারটা আমাদের খুব একটা আলোড়িত করে নি। অথচ এটা একটা বাল্যবিবাহ! বাল্যবিবাহের রাহু এখন অনেকখানি কমে গেছে গ্রামে। তবুও শেষ হয়নি একেবারেই। এই কিছু দিন আগে কয়েকবাড়ি পরে গ্রামশালিস হচ্ছে শুনে গেলাম।

শালিসের বিষয় শুনে আমি অবাক। আমাদের বয়সী একটা ছেলে তার বৌকে পিটিয়ে আর ঘুষি মেরে দাঁতা ভেঙে দিয়েছে। বৌয়ের অপরাধ, সে রাতে স্বামীর সাথে থাকতে চায় না। বৌটিকে দেখলাম ফোলা মুখে একপাশে বসে আছে। বয়স তের চৌদ্দ হবে।

পরে শুনেছি, মেয়েটাকে তালাক দেয়া হয়েছে। স্কুলে আমাদের একটা প্রিয় খেলা ছিলো। কলম মারামারি। টেবিলের চারকোণায় চারজন নিজেদের কলম নিয়ে দাঁড়াতো। খেলার নিয়ম ছিলো, ক্লক ওয়াইজ প্রত্যেকে একবার করে নিজের কলমে হিট করে অন্যদের কলম টেবিলের বাইরে ফেলার চেষ্টা করবে।

শেষ পর্যন্ত যার কলম টেবিলে থাকবে সে পাবে দশ। এভাবে যে সবার আগে একশ স্কোর করবে সে জয়ী। আমি আর মহসিন কলম মারামারির টুর্ণামেন্ট দিয়েছিলাম একবার। এন্ট্রি ফি পাঁচ টাকা। সেখানে জেসমিন আর রানী ও অংশ নিয়েছিলো।

কিন্তু রানী ইব্রাহিমের কাছে হেরে যাওয়ার গ্লানি মেনে নিতে না পেরে ইব্রাহিম কে কলমাক্রমণ করে বসলে ইব্রাহিমের হাত কেটে যায়। ফলাফলে হেডস্যারের নির্দেশে আমি আর মহসিন পরস্পরের কান ধরে উঠবস করি বিশবার। পরে আমরা টুর্ণামেন্ট বাতিল ঘোষণা করে সব টাকা নিজেরাই মেরে দিয়েছিলাম। আমাদের হেডস্যার আমুদে মানুষ ছিলেন। উনি কখনোই বেত দিয়ে মারতেন না।

কান ধরিয়ে উঠবস করাতেই মজা পেতেন। আরেকজন ছিলেন ওজিউল্লাহ স্যার। উনি ওয়াজ করতেন। মাহফিলে শ্রোতাদের কাছ থেকে অর্থ দান আদায়ে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন বলে ওনার কদরও অনেক ছিলো। সবসময় ধবধবে পাঞ্জাবি পরতেন বলে ছাত্রমহলে নাম ছিলো 'নোয়া স্যার'।

ছাত্রশাসনের জন্য বেতেই উনার সব আস্থা ছিলো। হাতের উল্টো পিঠে মারতেন আর বলতেন, এটা হলো আতর! থানার চেয়ে দারোগার মত স্যারের চেয়ে আতর বেশী ভয়ের ব্যপার ছিলো। গণিতের শিক্ষক ছিলেন মহসিনের নানা/ জেসমিনের বাবা/ আমার কথিত শ্বশুর। সব বিষয়ে আমি সবার চেয়ে বেশী মার্কস পেলেও গণিতে মহসিন আর জেসমিনের চেয়ে কম পেতাম। অথচ সবাই ফুল অ্যানসার করতাম।

দেখা যেত ওরা দশে নয় পেলে আমি পেয়েছি আট। এই ব্যপারটা আমাদের কখনো বড় ব্যপার মনে হয় নি। বন্ধুতায় তো কোন সমস্যা নয় ই! সবচেয়ে কুল মাইন্ডেড ছিলেন ইংরেজীর কেপায়েত উল্লাহ স্যার। আরেকজন টিচার ছিলেন। মকবুল স্যার।

উনি তখনই বয়সের ভারে ভারাক্রান্ত ছিলেন। ক্লাসে এসে ঘুমিয়ে পড়তেন বলে আমাদের প্রিয় স্যারও ছিলেন। ওনাকে নিয়ে একটা ঘটনা মনে আছে। উনি একবার ক্লাসের মাঝখানে গেলেন টয়লেটে। আসার পর কড়া গন্ধে ক্লাসরুম ভরে উঠলো।

উৎস সন্ধান করে দেখা গেলো, উনার পায়জামা ময়লায় ভর্তি! আমাদের স্যার ছিলেন এই পাঁচজন। এদের মধ্যে বেঁচে আছেন কেবল ওজিউল্লাহ স্যার। ওনাকে অবশ্য আমি এখন স্যার ভাবতে ঘৃণাবোধ করি। নিজামী সাঈদীরা গ্রেফতার হওয়ার পর উনি জুমার খুতবায় এই আলেম দ্বীন (?) দের গ্রেফতার করার জন্য সরকারের সমালোচনা আর বাংলাদেশের উপর আল্লার আসন্ন লা'নতের বর্ণনা দেয়া শুরু করলে একজন উঠে প্রতিবাদ করে। তিনি লোকটিকে বেদ্বীন অ্যাখ্যা দিয়ে নামায পড়তে নিষেধ করেন তার ইমামতিতে! ভাবতেই অবাক লাগে, কিছু কিছু মানুষ কি পরিমাণ ব্রেইনওয়াশড হতে পারে! এই একটা ব্যপারে জামায়াত শিবির কে আমার প্রচন্ড সফল মনে হয়! ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।