আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কয়লার খনি: ভূগর্ভস্থ না উম্মুক্ত প্রদ্ধতি কোনটি?

খুব জানতে ইচ্ছে করে...তুমি কি সেই আগের মতনই আছো নাকি অনেকখানি বদলে গেছো...

এ পর্যন্ত কয়লা নীতি নিয়ে যতো আলোচনা হয়েছে তা হয়তো সরকারের অন্য কোন পলিসি নিয়ে হয়নি। গত ১৫ বছর ধরেই কয়লানীতি প্রণয়ন প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী মেনুফেস্টুর খুব গুরুত্বপূর্ণ জায়গা করে নিয়েছে। প্রত্যেক সরকারই নির্বাচনী ইস্তেহারে মোটা হরফে কয়লা নীতি প্রনয়ন, খনির উন্নয়ন ও আভ্যন্তরীণ ব্যবহারের প্রতিজ্ঞা করে। কিন্তু ক্ষমতায় গেলে তা আর সম্ভব হয়না। বাংলাদেশে কয়লা খনি ও কয়লা নীতির উপর খড়গ নেমে আসে দিনাজপুরের ফুলবাড়ীর ঘটনার মধ্য দিয়ে।

ফুলবাড়ির আন্দোলনের পর থেকেই কয়লানীতি প্রণয়ন ও কয়লা উত্তোলনের যে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে তা থেকে সরকারগুলো বের হয়ে আসতে পারেনি। সামগ্রিকভাবে কয়লার খনি উন্নয়নে রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন গ্রুপে কয়লানীতি এখন বিভক্ত হয়ে পড়েছে। বুঝেই হোক আর না বুঝেই হোক কয়লা উত্তোলনের পদ্ধতিগত বিষয় আশয় নিয়েও ক্রমশ জটিলতার সৃষ্টি হচ্ছে। কারো মতে ভূগর্ভস্থ পদ্ধতি ছাড়া কয়লা উত্তোলন করা যাবেনা।

কেউ কেউ আবার ওপেন পিট বা উম্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনে জোরালো মত দিচ্ছে। ভূতাত্ত্বিক বিশ্লেষনে প্রত্যেকটি প্রদ্ধতিরই কিছু না কিছু ভালো দিক মন্দ দিক রয়েছে। কয়লানীতি চূড়ান্ত করার বিষয়ে সাধারন মানুষ আশান্বিত থাকতে চায়। মানুষ চায় দেশের সম্পদ দেশের উন্নয়নে কাজে লাগুক। সরকারের কাছে জনগণের প্রত্যাশা অনেক।

জাতীয় বিষয়গুলোতে জনমুখি পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন সরকারের পক্ষেই সম্ভব। এবং সেটা অবশ্যই রাজনৈতিক সরকারকেই করতে হবে। জনগণ আশা করে সকল বাধা বিপত্তি পেরিয়ে সরকার সুষম কয়লা নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রজ্ঞার পরিচয় দিবে । এ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর পরই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কয়লা নীতি চূড়ান্ত করার ঘোষণা দিয়েছিল। এ নিয়ে সরকারের আন্তরিকতাও ছিল প্রশংসার দাবিদার।

কয়লা নীতি প্রণয়নে সরকারের তোড়জোড়ও ছিল চোখে পড়ার মতোই । বিদেশ থেকে প্রবাসি বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞদের এনে পিপিপি বা পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশীপ’র মাধ্যমে এ সেক্টর উন্নয়নের প্রস্তাব রাখা হয়েছে। যমুনা রির্সোটে দেশি বিদেশি বিশেষজ্ঞরা কয়লা নীতির কিছু দিক সংশোধনপূর্বক চূড়ান্তকরণে সরকারকে গাইড লাইন বা দিক নির্দেশনা প্রদান করেছে। বহুল প্রতীক্ষার পর জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রনালয়ের ওয়েব সাইটে কয়লা নীতির খসড়াও প্রকাশিত হয়েছে। জনগণের ধারণা ছিল কয়লানীতি বাস্তবায়নের পথে সরকার দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে ।

কিন্তু না, কয়লা নীতি চূড়ান্তকরণ আবারো হোঁচট খেলো। সরকার পূণরায় খসড়া কয়লা নীতিটির রিভিউ করার জন্য কমিটি গঠনের কথা ভাবছে । ওয়েব সাইটে প্রকাশিত খসড়া কয়লা নীতির উপর আপামর জনগণের মতামত চাওয়া হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ সময়ে ওয়েবসাইটে ঝুলানো কয়লা নীতিতে মাত্র বিশটি মন্তব্য এসেছে। যা কয়লানীতি চূড়ান্তকরণে সরকারকে নিরুৎসাহিত করেছে।

তাই সরকার এখন দ্বিধান্বিত। খসড়া নীতিটিতে কতোটুকু দেশের স্বার্থ সংরক্ষিত হয়েছে তা যাচাই করে দেখার জন্য রিভিউ কমিটি গঠন অপরিহার্য। আর এই রিভিউ কমিটি গঠনের মধ্য দিয়ে সরকার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে চায়। সরকারের সামপ্রতিক কর্মকান্ডেও কয়লানীতি চূড়ান্ত না করার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। ক্রমবর্ধমান বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে গিয়ে সরকার কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপন এবং নিকটবর্তী দেশ থেকে কয়লা আমদানি করে বিদ্যুত কেন্দ্রগুলোকে উৎপাদনমুখী করার কর্ম পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।

সরকার এমনও চিন্তা করছে পাশ্ববর্তী দেশসমুহে দ্বিপক্ষীয় সমঝোতার ভিত্তিতে কয়লার খনি লীজ নেয়া। এবং সেখান থেকে আহরিত কয়লা দিয়ে দেশের আভ্যন্তরিণ বিদ্যুত চাহিদা মেটানো হবে । অতচ সরকার আভ্যন্তরিণ কয়লার খনির উন্নয়ন না করে অন্যদেশ থেকে কয়লা আমদানি করতে চায়। পাশ্ববর্তী দেশে কয়লা খনি লীজ নিয়ে দেশের চাহিদা মেটাতে চায় । কিন্তু কেন? তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদের মালিক জনগণ।

জনগণের কল্যাণে সম্পদ ব্যবহৃত না হলে সে সম্পদ থাকা না থাকা সমান কথা। এখন দেশে প্রতিদিনকার বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে ৬৭০০ মেগাওয়াট। অতচ উৎপাদন রয়েছে ৪৫০০ মেগাওয়াট। আগামি বছর দশেক পর বাংলাদেশে বিদ্যুতের চাহিদা দাঁড়াবে ১৩০০০ মেগাওয়াট। তাই ভবিষ্যত ভাবনা ভাবা জরুরি।

অনেকের মতে পদ্ধতিগত জটিলতার অবসান করা না গেলে কয়লা উত্তোলন করাও যাবেনা। সমালোচনার মুখে কয়লা উত্তোলন ও জন কল্যাণে ব্যবহার না করা নিশ্চয়ই কোন বিবেচিত বিষয় হতে পারেনা। ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে কতোটুকু কয়লা উঠানো সম্ভব তা হিসেব করতে হবে। আধুনিক বিশ্বে এখন ভূগর্ভস্থ পদ্ধতির প্রায়োগিক ব্যবহার কমে এসেছে। ভূগর্ভস্থ পদ্ধতির জনক বলা হয় চীনকে।

কিন্তু সেই চীনই এখন ভূগর্ভস্থ পদ্ধতির প্রয়োগে কয়লা উত্তোলন থেকে সরে এসেছে। এ যাবতকালে কয়লার খনিতে যতোগুলো র্দুঘটনা ঘটেছে তার বেশির ভাগই ভূগর্ভস্থ খনিতে সংঘটিত হয়েছে। যা শতকরা হিসেবে প্রায় ৭০ শতাংশ। বাংলাদেশের একমাত্র কয়লার খনি বড়পুকুরিয়া । যা ভূগর্ভস্থ খনির জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত।

এইতো ক’দিন আগে বড়পুকুরিয়া খনির আশে পাশের বিশাল এলাকা এক থেকে দেড় ফুট দেবে গেছে। এই বিপর্যয়ের ফলে খনি এলাকার লোকজন ভূমিহীন হয়ে পড়েছে। ক্ষতি পূরণের আশায় হাজার হাজার লোক রাস্তায় নেমে এসেছে। সরকারের আশ্বাসও ক্ষতিগ্রস্তদেরকে আন্দোলন থেকে বিরত করতে পারেনি। ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের হার খুবই কম।

যা শতকরা সর্বোচ্চ ২০ ভাগ বা তারও কম। বাকি ৮০ ভাগ কয়লাই মাটির নীচে থেকে যায় ভূগর্ভস্থ পদ্ধতির প্রায়োগিক জটিলতার কারণে। উম্মুক্ত খনন প্রক্রিয়া অনেকটা সহজ ও অনায়াসে অধিক সম্পদ আহরনযোগ্য। যা প্রয়োগে ৮০ থেকে ৯০ ভাগ সম্পদ আহরন করা সম্ভব। উম্মুক্ত খনন প্রক্রিয়াকে সহজলভ্য ও জনমুখী করা গেলে বিতর্ক অনেক কমে আসবে।

যদিও এ প্রক্রিয়া নিয়ে সুশীল সমাজের বৃহদাংশ আপত্তি তুলছে। উম্মুক্ত খনন প্রক্রিয়ার প্রয়োগ বিজ্ঞান সম্মত না হলে তা পরিবেশের উপর মারাত্নক প্রভাব ফেলবে। উম্মুক্ত খনন প্রক্রিয়ায় প্রধান সমস্যা হচ্ছে ভূমি ও পানি ব্যবস্থা। ভূমি ও পানি ব্যবস্থা ঠিক মতো করা না গেলে ইকোলজির উপর মারাত্নক প্রতিকুল প্রভাব পড়বে। যা হয়তো খনি এলাকাসহ আশে পাশের অনেক এলাকার জীব বৈচিত্র্যের অস্তিত্ব বিনষ্ট করে তুলবে।

এমন আশঙ্কা থেকেই এ প্রক্রিয়া নিয়ে ক্রমাগতভাবে প্রশ্ন উঠছে। অনেকে কয়লা নীতিতে উম্মুক্ত খনন প্রক্রিয়া না রাখার প্রস্তাবও দিয়েছে। কিন্তু পৃথিবী এখন অগ্রসরমান। পরিবেশ সম্মত প্রযুক্তি ব্যবহার করে এসব প্রতিকুলতাকে সহজেই মোকাবেলা করা যায়। খনি প্রতিস্থাপন করার মূল লক্ষই হলো সম্পদ আহরন।

যে প্রযুক্তি ব্যবহারে বেশি সম্পদ আহরন করা যায় সেই প্রযুক্তি নির্ভর প্রদ্ধতিকেই বেছে নিতে হবে। খুব সহজেই উম্মুক্ত খনন প্রক্রিয়ায় ভূমি ও পানির ব্যবস্থা করা যায়। যা এখন আর সমস্যা নয়। বরং উম্মুক্ত খনন প্রক্রিয়া খুব অল্প পরিসরে ধারাবাহিক হওয়ায় এ প্রক্রিয়া ভূগর্ভস্থ খনন প্রক্রিয়ার চাইতে আধুনিক ও পরিবেশের উপর কম ক্ষতিকর। পরিবেশ প্রতিবেশের উপর ক্ষতিকর প্রভাব কমিয়ে আনার জন্য প্রয়োজন পরিবেশগত প্রি-মাইনিং স্টাডি।

যা এনভায়ারনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট ও এনভায়ারনমেন্টাল ম্যানেজমেন্ট প্লানের মাধ্যমে পরিবেশের উপর প্রতিকুলতা কমিয়ে আনার সহজ উপায় বা কৌশল নির্ধারণ করে। এবং পরিবেশ প্রতিবেশ রক্ষায় সরকারকে সুনিদিষ্ট দিক নির্দেশনা প্রদান করে। তাই পদ্ধতিগত জটিলতা অবসানে সরকারকে বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যবস্থা ও সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এ সেক্টরের উন্নয়নে তড়িৎ সিদ্ধান্তই বাংলাদেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে যেতে পারে । আগামি শতাব্দীতে হয়তো পৃথিবীব্যাপীই কয়লা উত্তোলনের হার অনেকাংশেই কমে আসবে।

কারণ পৃথিবী এখন বিকল্প জ্বালানীর দিকে ঝুঁকছে। তাই পদ্ধতিগত জটিলতা থেকে বের হয়ে যুগোপযুগি সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও কয়লা সম্পদের ব্যবহারে সরকারকে আন্তরিকতার পরিচয় দিতে হবে। আর এ সম্পদের সঠিক ব্যবহার সহজেই বাংলাদেশকে আগামি শতাব্দীতে উন্নত বিশ্বের কাতারে জায়গা করে দিবে। হাসান কামরুল : ভূ-তত্ত্ববিদ ।


সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.