আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কোন গন্তব্যে চলেছে রেলওয়ে?

"আকাশে নক্ষত্র দেখে নক্ষত্রের মতন না হয়ে পারিনি আমি / নদী তীরে বসে তার ঢেউয়ের কাঁপন, / বেজেছে আমার বুকে বেদনার মত / ঘাসের হরিৎ রসে ছেয়েছে হৃদয়"। _আহমদ ছফা

কোন গন্তব্যে চলেছে রেলওয়ে? গত দেড়-দুই মাস সময়ের মধ্যে লাইনচ্যুতিসহ কমপক্ষে ৮টি ছোট-বড় দুর্ঘটনাসহ বিভিন্ন কারণে রেলওয়ে প্রায় প্রতিদিনই সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়েছে। জুলাই মাসের শেষের দিকে পর পর দু’দিন ২৩ জুলাই ফেনী ও ২৪ জুলাই ময়মনসিংহে, মাসের মাঝামাঝি সময়ে ১৭ জুলাই যশোর ও চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে এবং ১৮ জুলাই ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জে ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত হওয়া, লেভেল-ক্রসিংয়ে গাড়ির সাথে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এরও কিছুদিন আগে ঢাকা শহরের বুকে, কমলাপুর রেলস্টেশনের প্রবেশ মুখে এবং মালিবাগ রেলক্রসিং-এ বড় দুটি রেল দুর্ঘটনা সংবাদ শিরোনাম হয়েছে। রেললাইনের পাত ও স্লিপারসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি চুরি, জমি বেদখল, দুর্নীতি-অনিয়ম-লোকসানের নানা হিসাব তো আছেই।

বাংলাদেশ রেলওয়ের বর্তমান অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। এর মাথার ওপর হাজার কোটি টাকার লোকসানের বোঝা; অন্যদিকে, লোকবল সংকট, ইঞ্জিন সংকট, চুরি-দুর্নীতি, রেললাইন ও স্টেশন সংখ্যার সংকোচন, রেলের সম্পদ লুট, দিন দিন যাত্রীসেবা ও মালামাল পরিবহনের বেহাল দশা ইত্যাদি দেখে-শুনে মনে হচ্ছে, পুরো রেলপরিবহনই এখন লাইনচ্যুত অবস্থায়। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বহুল আলোচিত কয়েকটি কথার মাঝে একটি কথা ছিল ‘লাইনচ্যুত ট্রেনকে লাইনে ওঠানো’। কথিত ওই ট্রেনকে লাইনকে ওঠানোর কাজ কতটা হয়েছে, দেশ কোন লাইনে কোন গন্তব্যে চলছে তা মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। কিন্তু মাটির বুকে পাতা লাইন ধরে যে ট্রেন গণপরিবহনের কাজ করে তার গন্তব্য নিয়েও এখন জনগণের মাঝে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে।

এ সংশয় সৃষ্টির একটি কারণ লেখার শুরুতেই বলা হয়েছে। তবে এর চেয়ে বড় কারণ হল বর্তমান মহাজোট সরকার গৃহিত রেলওয়ের সংস্কার কর্মসূচি যার আরেক নাম দেওয়া হয়েছে রেলওয়ের আধুনিকায়ন বা কর্পোরেটাইজেশন। কর্পোরেটাইজেশন কথাটা যতই ওজনদার শোনাক না কেন, এর আসল অর্থ যে বেসরকারিকরণ সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। ফলে প্রশ্ন জেগেছে, কোন গন্তব্যে চলেছে রেলওয়ে? খবরে প্রকাশ, বাংলাদেশ রেলওয়েকে আধুনিকায়নের ২০ বছর মেয়াদী মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সরকার। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা।

এ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে দেশের নদীবহুল বরিশাল অঞ্চলও রেল যোগাযোগের আওতায় চলে আসবে। ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের একাধিক রেলপথে স্থাপিত হবে দ্বিতীয় লাইন। শুধু তাই নয়, এ পরিকল্পনার মাধ্যমে বাংলাদেশ যুক্ত হবে ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্কের সাথে। রেল কর্তৃপক্ষের ভাষ্য, এ সংস্কারের মাধ্যমে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থাকে পুনরায় দেশের মূলধারার গণপরিবহন হিসাবে গড়ে তোলা হবে, যদিও বর্তমানে এডিবির পরামর্শ ও সহায়তাক্রমে ৪ বছর মেয়াদী একটি সংস্কার কর্মসূচি চলছে। সরকারের পরিকল্পনা নিয়ে বলার আগে রেলের বর্তমান হাল-দশার চিত্র সংক্ষেপে হলেও খানিকটা বলা দরকার।

প্রথমে গত কয়েকদিনে সংবাদপত্রে প্রকাশিত কয়েকটি প্রতিবেদনের বিষয়ে উল্লেখ করা যায়। গত ১৬ জুলাই ’০৯ দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সম্প্রতি পরিত্যক্ত বাহাদুরাবাদ ঘাট রেলপথে (সাড়ে ৬ কিমি) কর্তৃপক্ষের চোখের সামনে সংঘবদ্ধ একটি চক্র কতিপয় অসাধু রেল কর্মচারীর সহযোগিতায় পাচার করেছে যার আনুমানিক মূল্য এক কোটি টাকার বেশি। ১৯ জুলাই ’০৯ দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন বলছে, পশ্চিমাঞ্চলের পাকশী ডিভিশনের আত্রাই, রানীনগর, সান্তাহার, বাসুদেবপুর, নলডাঙ্গা, নাটোরসহ মোট ৭টি স্টেশন সংলগ্ন বিপুল পরিমাণ জমি কোনো প্রকার নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না করে গোপনে লিজ দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। এর সাথে জড়িত আছে পশ্চিম রেলের এস্টেট বিভাগের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তাসহ একটি সংঘবদ্ধ দালাল চক্র। দৈনিক ইত্তেফাকের ১৯ জুলাইয়ের একটি প্রতিবেদন বলছে, সিলেট-আখাউড়া রেললাইনে ও কুলাউড়া-শায়েস্তাগঞ্জ সেকশনে ৬৩টি লেভেল ক্রসিং রয়েছে।

এর মধ্যে মাত্র ৬টিতে গেটম্যান রয়েছে, ৫৭টি গেটম্যানবিহীন অবস্থায় ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এসব ক্রসিংয়ের মধ্যে মাত্র ২৯টি অনুমোদিত যার ৬টিতে গেটম্যান আছে, বাকি ৩৪টি অনুমোদনবিহীন। গত ৭ বছরে বেশ কয়েকটি দুর্ঘটনায় কমপক্ষে ১৩ জনের মৃত্যুসহ অসংখ্য আহত হয়েছে। প্রতিবেদনগুলো, বলা নিষ্ষ্প্রয়োজন, আমাদের উপরি-উক্ত ধারণা পোক্ত হতেই সাহায্য করছে। বলা দরকার, রেল হচ্ছে সবচেয়ে বড় গণপরিবহন ব্যবস্থা।

এর পরিবহন ব্যয় অর্থাৎ জ্বালানি খরচ কম। আবার আজকে যে পরিবেশ দূষণ পৃথিবীর জন্য বিরাট সমস্যা হিসাবে দেখা দিয়েছে সে বিচারেও রেল অগ্রাধিকার পাবার দাবি রাখে, কারণ রেল অনেক কম পরিবেশ দূষণ করে। দুনিয়ার প্রথম রেল চালু হয় ইংল্যান্ডে ১৮২৫ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর। এরপর ১৮৩৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, ১৮৩৫ সালে জার্মানিতে, ১৮৩৯ সালে ইতালিতে, ১৮৪৪ সালে ফ্রান্সে এবং ১৮৪৮ সালে স্পেনে রেল সার্ভিস চালু হয়। ভারতে প্রথম রেল সার্ভিস শুরু হয় ১৮৫৩ সালে, মুম্বাই অঞ্চলে।

এর পরের বছরই তৎকালীন বেঙ্গল প্রভিন্সে রেল চালু করা হয়। বাংলাদেশে রেলওয়ের ইতিহাস আসলে ভারতবর্ষের রেলের ইতিহাস। ব্রিটিশ শাসিত অবিভক্ত ভারতবর্ষে রেলের যাত্রা শুরু। তৎকালীন ইস্টার্ন-বেঙ্গল রেলওয়ে নামক কোম্পানির পক্ষ থেকে ১৮৬২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর কলকাতা থেকে রানাঘাট পর্যন্ত সার্ভিস চালু করা হয়। এর কয়েকদিন পর ওই বছরের ১৫ নভেম্বর রানাঘাট থেকে কুষ্টিয়ার দর্শনা-জগতির মধ্যে রেল চলাচলের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে রেল যোগাযোগের সূচনা।

১৮৭১ সালের ১ জানুয়ারি চালু করা হয় গোয়ালন্দ পর্যন্ত রেল সার্ভিস। ভারত ভাগ হওয়ার সময়ে ১৯৪৭ সালে উত্তরাধিকারসূত্রে বাংলাদেশ ব্রডগেজ-মিটারগেজ মিলিয়ে ২ হাজার ৬শ’ ৬.৫৯ কিলোমিটার রেলপথ পেয়েছিল। পাকিস্তান আমলে সামান্য কিছু রেলপথ বাড়ানো হয়। বর্তমানে সারাদেশে চলাচল করে ২৫৯টি যাত্রীবাহী ট্রেন। এর ৬৮টি ইন্টারসিটি, ৬৪টি এক্সপ্রেস ও ১২৭টি লোকাল সার্ভিস।

গড়ে প্রতিদিন ৪৯টি যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল করে। গতবছর প্রায় ৫ কোটি ৩৮ লক্ষ যাত্রী পরিবহন করেছে রেল। দেশে এখন মোট স্টেশনের সংখ্যা ৪শ’ ৪০টি যা ৪৪টি জেলায় ছড়িয়ে আছে। বর্তমানে মোট রেলপথের দৈর্ঘ্য ২ হাজার ৭শ’ ৬৮ কিমি, যার ৯৫% এক লাইন বিশিষ্ট। মোট রেল ইঞ্জিনের সংখ্যা ২শ’ ৮৬টি এবং মোট যাত্রীবাহী কোচের সংখ্যা ১৪শ’।

বাংলাদেশের রেলওয়ে মূলত দুটি ভাগে বিভক্ত। প্রধান অংশটি যমুনা নদীর পূর্ব দিকে এবং দ্বিতীয় অংশটি যমুনা নদীর পশ্চিম দিকে। রূপসা নদীর পূর্ব প্রান্তে ৩২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের রূপসা-বাগেরহাট ব্রডগেজ সেকশনটি অলাভজনক বলে বহু দিন ধরেই বন্ধ করে রাখা হয়েছে। এক হিসাবে গত ১০ বছরে রেলের লোকসানের পরিমাণ প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা, গড়ে বছরে লোকসানের পরিমাণ প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও মন্ত্রণালয়ের কাছে রেলওয়ের বকেয়ার পরিমাণ প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা।

রক্ষণাবেক্ষণের অভাব এবং রেলওয়ের কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার কারণে ইতোমধ্যে বেহাত হয়ে গেছে রেলওয়ের প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি। সারা দেশে রেলের জমির পরিমাণ ৬৩ হাজার ৩শ’ ৭২ একর। এর মধ্যে অব্যবহৃত জমির পরিমাণ ২৩ হাজার ৯শ’ একর, যার ১২ হাজার ১শ’ একরই অবৈধ দখলদারের কবলে। আর মোট জমির ২৫ হাজার ৪শ’ ৫৪ একর বেদখল হয়ে আছে। স্বাধীনতার পর গত ৩৮ বছরে ইতোমধ্যেই সারাদেশের প্রায় পৌনে ৩০০ কিলোমিটার রেলপথ ও ১০টি শাখা লাইন বন্ধ করা হয়েছে।

বন্ধ করা শাখাগুলোর মধ্যে আছে নরসিংদী-মদনগঞ্জ, ফেনী-বিলুনিয়া, শায়েস্তাগঞ্জ-শাল্লা, হবিগঞ্জ-শায়েস্তাগঞ্জ, ফরিদপুর-পুকুরিয়া, ভেড়ামারা-রায়তা, লালমনিরহাট-মোগলহাট, রূপসা-বাগেরহাট, কালুখালী-ভটিয়াপাড়া ও পাঁচুরিয়া-পুকুরিয়া। এছাড়া প্রায় ৭৬টি রেলস্টেশন বন্ধ হয়েছে, বন্ধ হওয়ার অপেক্ষায় আছে আরো ৪১টি। রেলের ইঞ্জিনের সংখ্যা কমেছে প্রায় অর্ধেক, ৪৮৬টি থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ২৮৬টিতে, যার অর্ধেকই আবার মেয়াদউত্তীর্ণ। প্রতি মাসেই ৩৫ থেকে ৪৫টি করে ইঞ্জিন বিকল হয়ে পড়ছে। কমেছে কোচ বা বগির সংখ্যাও।

১ হাজার ৬শ’ ৪৩টি থেকে কমে বর্তমানে ১৪০০ বগির ৭০ ভাগ ব্যবহার উপযোগী থাকে। বর্তমান বগির ২০ ভাগই মেয়াদ পেরিয়ে গেছে। লোকবল সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। স্টেশন মাস্টার, ট্রেন চালক, সহকারী চালক, গার্ড, লোকোমেকানিক্যালসহ বিভিন্ন বিভাগে শূন্যপদের সংখ্যা এখন ১২ হাজার ৫শ’ ৭৬। এসবের পাশাপাশি লোকসান কমানোর কথা বলে গত প্রায় দুই দশকে ৮৪টি ট্রেনকে বেসরকারি ব্যবস্থাপনার হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

১৯৯৭ সালের ৭ জুলাই ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে প্রথম বেসরকারি বাণিজ্যিক সার্ভিস চালু করা হয়। কিন্তু লোকসান কমতির কোনো লক্ষণ আজ আবধি দেখা যায় নি। বিশাল জনসংখ্যার এই দেশে পরিবহনের খরচ সড়ক পথের তুলনায় অনেক কম হওয়া সত্ত্বেও রেলে যাত্রী পরিবহনের হার দিন দিন কমছে। ষাটের দশকে রেলের যাত্রী পরিবহনের হার ছিল ৫০%, যা এখন নেমে এসেছে ১২%-এ। যাত্রী পরিবহনের চেয়েও রেলের গুরুত্ব অনেক বেশী মালামাল পরিবহনে।

কমেছে মাল পরিবহনের ভাগও। ষাটের দশকে ছিল ৪০% যা বর্তমানে ৭% বা আরও কম। মজার ব্যাপর হল, রেলওয়ে সরকার পরিচালিত প্রতিষ্ঠান হওয়ার পরও সরকার নিজেই এ পরিবহনে কোনো পণ্য বা মালামাল পরিবহন করে না! এখন সরকারের নতুন মহাপরিকল্পনা নিয়ে দু’একটা কথা বলা যায়। জানা গেছে, এ মহাপরিকল্পনা ২০০৯ সালে শুরু হয়ে ২০২৮ সাল নাগাদ শেষ হবে। প্রতি ৫ বছরকে এক একটি পর্ব ধরে মোট ৪ পর্বে (২০০৯-’১৩ , ২০১৪-’১৮, ২০১৮-’২৩ এবং ২০২৪-’২৮) বিভক্ত করা হয়েছে মহাপরিকল্পনাকে।

বিভিন্ন ধরনের মোট ১৩৪টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। এসব প্রকল্পের আওতায় ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথকে দুই লাইনে উন্নীত করা, প্রয়োজনীয় লোকমোটিভ ও যাত্রীকোচ সংগ্রহ, চট্টগ্রামের পাহাড়তলী রেলওয়ে ওয়ার্কশপ আধুনিকায়ন, চট্টগাম বন্দর সংলগ্ন এলাকায় একটি আইসিডি (রপ্তানি অবকাঠামো) নির্মাণ, পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চল রেলপথের বিভিন্ন অংশের সংস্কার ও আধুনিকায়ন, রেলওয়ের সিগন্যালিং ব্যবস্থার উন্নয়ন, পদ্মাসেতুর ওপর দিয়ে ঢাকা-যশোর রেল যোগাযোগ স্থাপন, যমুনা নদীর ওপর পৃথক একটি রেলসেতু নির্মাণ, খুলনা-মংলা বন্দর রেললাইন স্থাপন, চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে মিয়ানমার সীমান্তের গুনদুম পর্যন্ত রেললাইন স্থাপন ইত্যাদি ইত্যাদি। এ পরিকল্পনা সম্পর্কে প্রথম কথাটি হল, এখনো এর অর্থায়ন কীভাবে হবে তা নির্ধারিত হয়নি। ধারণা করা যায়, এ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য সরকার বিশ্বব্যাংক-এডিবি ইত্যাদি তথাকথিত দাতাসংস্থার দ্বারস্থ হবে। কথায় বলে, ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়।

বিশ্বব্যাংক-এডিবি প্রমুখ সংস্থাগুলো বিনা শর্তে ঋণ দেয় না। আর তাদের বিগত দিনের ঋণ-সহযোগিতার ইতিহাসই হল আমাদের জাতীয় স্বার্থ খর্বকারী কাণ্ডকীর্তি। এমনকি এই রেলপরিবহন নিয়েও বিগত দিনে তাদের পরামর্শ আমাদের গলার কাঁটা হয়েছে। যেমন, সত্তরের দশকে সারাদেশে সার সরবরাহের জন্য রেললাইনের বেশকিছু স্থানে গুদাম তৈরি করে গুদামের গেটে সার বিক্রির পরামর্শ দেয় বিশ্বব্যাংক। গুদাম তৈরি ও লাইন বসানোর জন্য তারা অর্থায়নও করে।

এর ফলে ক্ষতি হয় দু’ভাবে। প্রথমত রেললাইনের পাশে সার বিক্রিকে কেন্দ্র করে রেললাইনের ওপর বাজার বসার রেওয়াজ চালু হয়ে যায়। আর দ্বিতীয়ত কিছুদিন পরেই যখন সরকার সার বিক্রির ওই পরিকল্পনা থেকে সরে আসে তখন হাজার কোটি টাকার রেললাইন অকেজো পড়ে থাকে এবং লুটপাটের শিকার হয়। এরপর এডিবির পরামর্শে রেলওয়েকে প্রথমে বোর্ড এবং পরে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ করা হয়। উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড থেকে শুরু করে কর্মকর্তাদের নিয়োগ-বদলি-পদোন্নতী সবই যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের হাতে তুলে দেওয়া হয়।

রেলওয়ের মহাপরিচালকে পরিণত করা হয় ঠুঁটো জগন্নাথে, তার কাছে কাউকে জবাবদিহি করতে হয় না। স্বৈরশাসক এরশাদের আমলে রেলের পুনর্গঠনের কথা বলে পূর্ব ও পশ্চিম এই দুইভাগে ভাগ করা হয় যার ফলে ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। ওদের পরামর্শেই রেলপথ সংকোচন করা হয়েছে, এ পর্যন্ত রেলওয়ের ৮৪টি ট্রেন বেসরকারিকরণ করা হয়েছে। কিন্তু আগেই বলা হয়েছে, রেলওয়ে লাভের মুখ দেখতে পারেনি। এখন এডিবির পরামর্শে এবং ৪০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ সহায়তা আশ্বাসের ভিত্তিতে রেলওয়েতে লাইন অব বিজনেস (এলওবি) তৈরি করার কাজ চলছে।

প্রাইসওয়াটার কুপার্স লিমিটেড নামের একটি বিদেশী সংস্থার পরামর্শক দল ২০০৮ সাল থেকেই তাদের কাজ শুরু করে দিয়েছে। এ সংস্কারের ব্যয় ধরা হয়েছে ২৫১ কোটি টাকা যার ৪০ কোটি টাকাই চলে যাবে পরামর্শকদের বেতন-ভাতা বাবদ। এর পাশাপাশি স্টেশন রি-মডেলিং বা আধুনিকায় এবং ইন্টার লকিং সিগন্যালিং ব্যবস্থা প্রবর্তন করার কাজ চলছে। এ তালিকায় আছে নরসিংদী, ভৈরব, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া, শায়েস্তাগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল, কুলাউড়া, কুমিল্লা, লাকসাম, ফেনী ইত্যাদি স্টেশন। এ বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছে ২৯ কোটি ৫৩ লক্ষ টাকা।

বিগত বিএনপি-জামাত জোট সরকারের আমলেও ১০০ কোটি টাকা খরচ করে ২০টি স্টেশনের সৌন্দর্য বর্ধন করা হয়েছে। যখন কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে স্টেশনের সৌন্দর্য বর্ধন বা রি-মডেলিং করা হচ্ছে তখন রেলের সামনে সবচেয়ে বড় সমস্যার একটি হল ইঞ্জিনের সমস্যা। সাধারণত একটি পূর্ণক্ষমতাসম্পন্ন ইঞ্জিন কমপক্ষে ২৪টি যাত্রীবাহী বগি টানতে পারে। কিন্তু বর্তমানে রেলের মেয়াদ উত্তীর্ণ ইঞ্জিনের সংখ্যাই বেশি যা দিয়ে ৪/৫টি বগি টানাই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। ২৫ কোটি টাকা খরচ করলে একটি অত্যাধুনিক ইঞ্জিন কেনা যেত।

বাকি টাকায় ইন্টারসিটি ট্রেনের কমপক্ষে ২০টি অকেজো শোভন চেয়ারকোচ মেরামত করা যেত। আর এই নতুন ইঞ্জিন এবং ২০টি কোচ যদি ঢাকা-চট্টগ্রাম লাইনে চলাচল করত তাহলে রেলের বার্ষিক আয় হত কমপক্ষে ১৪ কোটি ২৫ লাখ ৬০ হাজার টাকা। এ সংস্কার বাস্তবতার সাথে কতটা অসামঞ্জস্যপূর্ণ সেটা আরো বোঝা যায় যখন কোটি টাকা ব্যয়ে শায়েস্তাগঞ্জ স্টেশন রি-মডেলিং করা হচ্ছে তখন ঠিক একই সময়ে সংস্কারের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ না করায় সিলেট-খাজাঞ্চি-ছাতক রেলপথ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এরকম ঝুঁকিপূর্ণ রেলপথের সংখ্যা নেহাত কম নয়। ঠাকুরগাওয়ের পীরগঞ্চে রেলের বগি লাইনচ্যুত হওয়ার কারণ আর কিছুই নয়, পর্যাপ্ত স্লিপার না থাকা।

নতুন মহাপরিকল্পনায় ট্রান্স এশিয়ান নেটওয়ার্কের কথার আড়ালে, আমাদের ধারণা, আসলে অন্য একটি কথা আছে। সেটি হল, ভারত প্রস্তাবিত ট্রানজিট। যে কারণে যখন বলা হচ্ছে বাংলাদেশ ট্রান্স এশিয়ান রেল নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত হবে তখন কিন্তু রাজধানী ঢাকা শহরকে ওই লাইনের সাথে যুক্ত করা হচ্ছে না। খুলনা থেকে রাজবাড়ী দৌলতদিয়া নদীবন্দরে এসে সমস্ত ব্রডগেজ রেললাইন ঢাকা শহরকে পাশ কাটিয়ে চলে যাবে। প্রশ্ন হল, রাজধানীকে যুক্ত করা ছাড়া ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্কে যুক্ত হওয়ার অর্থ কি? বিগত বছরগুলোতে কখনোই রেল পরিবহনকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।

বরাবরই বিমাতাসুলভ আচরণের শিকার হয়েছে রেল ও নৌ পরিবহন ব্যবস্থা। রাষ্ট্রীয় মনোযোগ এবং মদদ প্রায় পুরোটাই পেয়েছে সড়ক পরিবহন, এবং সেখানেও বেসরকারিকরণের জোয়ার বইয়ে দেওয়া হয়েছে। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত পরিবহন খাতের মোট বরাদ্দের ২৭ ভাগ রেলওয়ের জন্য বরাদ্দ করা হত। ৩২ শতাংশ ছিল সড়ক যোগাযোগের জন্য। ২০০০-'০৩ সালে এসে রেলের বরাদ্দ নেমে এসেছে ২৪ ভাগে, অন্যদিকে সড়ক পরিবহনের জন্য বরাদ্দের পরিমাণ বেড়ে ৭৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।

বাংলাদেশে ১৯৪৭ সালে পাকা রাস্তা ছিল মাত্র ৪শ’ কিলোমিটার। বর্তমানে তা বেড়ে প্রায় ৫০ হাজার কিলোমিটারে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে, রেল পথের দৈর্ঘ্য মাত্র দু’ হাজার ৮৩৫ কিলোমিটার। গণপরিবহন হিসাবে রেলওয়ের গুরুত্ব কাউকে ব্যাখ্যা করে বোঝানোর প্রয়োজন নেই। বাস-ট্রাকে যাত্রী ও মালামাল পরিবহনে চাইতে রেলপথে পরিবহন অনেক বেশি নিরাপদ শুধু নয়, খরচও অত্যন্ত কম।

এক গ্যালন ডিজেল দিয়ে একটা রেলইঞ্জিন ৯টি ওয়াগনকে ১ কিলোমিটার পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারে। এ পরিমাণ পণ্য পরিবহন করতে প্রয়োজন হবে ২২৭টি ট্রাক। একইভাবে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে ১৫০টি বাসের সমান যাত্রী পরিবহন করতে পারে মাত্র ২টি ট্রেন। রেলের তুলনায় বাসের ভাড়াও অনেক বেশি। বিলাসবহুল এসি বাসগুলোর ভাড়া তো চার-পাঁচ গুণ বেশি।

যেমন, ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে এসি বাসের ভাড়া ৫৫০ টাকা বা তার চেয়েও বেশি, আর নন-এসির ভাড়া ৩০০ টাকা, সেখানে রেলের ভাড়া ১২৫ টাকা। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে রেলের ভাড়া ৬ টাকা, আর বাসের ভাড়া ২৬ টাকা। এ পথে প্রতিদিন ৫০ হাজারেরও বেশি যাত্রী চলাচল করে, কিন্তু রেলে চড়ার ব্যবস্থা আছে মাত্র ৬/৭ হাজার যাত্রীর। ফলে রেলের উন্নতি হলে পরিবহন খরচ অনেক কমে যেত। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত রেলওয়ের কোনো উন্নতি করা হয়নি।

বরং পরিকল্পিত উপায়ে চরম দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনাকে উৎসাহ যুগিয়ে তাকে ধ্বংসের কিনারায় এনে দাঁড় করানো হয়েছে। আজ সরকার যখন বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে নতুন করে রেলওয়েকে ঢেলে সাজাবার কথা বলছে, তখন আশার চেয়েও আশঙ্কাই প্রবল হয়ে ওঠে। সত্যিই কি রেলকে প্রকৃত গণপরিবহন হিসাবে গড়ে তোলা হবে? নাকি জনগণের টাকায় ঘষে-মেজে আধুনিক যে রেলওয়ে দাঁড় করানো হবে সেটা নিছক একটা মুনাফা লোটার কলে পরিণত হবে? কোন গন্তব্যে যাবে রেলওয়ে?

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।