সুন্দর সমর
ব্যস ঝিনুও তখন দিব্যি গালটাল ফুলিয়ে আদুরে আদুরে গোস্বা করে। আম্মু তারপরেই ফিক করে হেসে টুক করে চুমো দেন ঝিনুর কপালে। ব্যস ! রাগ টাগ কোথায় চলে যায়। মাত্র ধোয়া ভেজা ভেজা দুহাত দিয়ে ঝিনু আম্মুর গলা জড়িয়ে ধরে বলে-‘তুমি কত্ত ভাল আম্মু মনি। ’ এই কান্ড কারখানা শুনে ওর বন্ধুরা হা করে থাকে।
এত বড় ময়ের হাতমুখ মা ধুইয়ে দেন। বলে কি আমরা বাপু নিজেরাই হাতমুখ ধূতে পারি। ওরা ডাট মেরে বলে । আসলে ওদের আম্মু কি আর ঝিনুর আম্মুর মত ভালবাসে। মোটেও না ।
ঝিনু মাথা নাড়িয়ে জানিয়ে দিতে ভুলে না। আবার দেখনা, ভাইয়া যেন কেমন। ওকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে,
-‘মা তোমার এই মেয়ে আতুর-নুলা নাকি?’
-‘আলাই বালাই আতুর হবে কেন?’ আম্মু বলে উঠেন।
ঝিনুও ভীষণ রেগে উঠে। রেগেমেগে বলে বসে -‘যা ভাইয়া যা তোর সাথে আমার আড়ি আর কথা বলব না।
’
হঠাৎ দেখে ভাইয়া ঝলমল হাসিতে মুখ ভরিয়ে তোলে। হাততালি দিয়ে সুর করে বলেন, -‘এ্যা ঠাট্রাও বোঝে না। গরু ! গরু!!’ ঝিনুর তখন‘খুউব লজ্জা লাগে।
নিত্যদিন যে এ রকম হয় তা নয়, আসলে মাঝে সাঝে হয় তাতেই না ভাল্লাগাটুকু ঠিক ঠাক থাকে। আজ আম্মু ছাড়া ছাড়া ভাবে পানি ছিটিয়ে হাত মুখ ধুইয়ে দেন ।
অন্য দিনের মত হাত মুখ রগড়ে দেন না। আগের মত হাজার কথার হল্লোড় নেই নাস্তার টেবিলে । আজকের টেবিল খুব চুপচাপ । এ বাড়ীর নাস্তার টেবিলে নিত্যই মিষ্টি হাসির ফুল ঝুরি আর টুকরো কথার আনন্দ ঝরে পড়ে। ঝিনুর মনে পড়ে ১৫ তারিখে নাস্তার করার সময় মীর্জা সাহেব এসে পড়েন।
ও ভেবে পায়নি রেডিওতে বলছে কারফিউ আর এর মধ্যে দিয়ে সেই নারায়নগঞ্জ হতে উনি আসলেন কি করে।
আব্বুর কথার জবাবে বললেন,-‘ আরে নানা নাস্তা করব কি, পেট ঠাসা। ঠেসে খেয়ে দেয়ে বেরিয়েছি। ’
পেট ঠাসা না থাকুক অন্ততঃ মুখ যে ঠাসা তা দেখাই যাচ্ছিল। গাদা গাদা পানে মুখ ভর্তি।
সেই সব পানের ফাঁক দিয়ে যে কি করে আওয়াজ বেরোচ্ছে সেটাই আশ্চর্য। মীর্জা চাচা পান খেতে পারেন বটে। সে সাথে এক ঝাঁকা পান মুখে নিয়ে অবলীলায় কথাও বলতে পারেন। ঝিনু মাত্তর এক লোকমা ভাত মুখে নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু তার ফল বিচ্ছিরি হয়েছে ।
ঝিনু সে কান্ডটা আর এখন মনে করতে চায় না। মীর্জা চাচা খালি এক সাথে পাঁচ সাতটা পানির খিলি মুখে পুরেন না। তার সুপারি কাটারও কেরামতি দেখার মত। হালকা ফুঁ দিলে বাতাসে উড়ে ভেসে বেড়ায় এই সব সুপারি । রাতেও ্ওই রাক্ষুসে ডিব্বা বোঝাই পান মাথার পাশে রেখে ঘুমান।
মীর্জা চাচা বলেছেন, এক একবার ঘুম ভেংগে যায়। অমনি পাঁচ-সাতটি পান মুখে পুরে ঘুমাতে ঘুমাতে চিবুতে থাকেন। ফের মুখের পান ফুরিয়ে ঘুম ভেংগে যায় অমনি হাত বাড়িয়ে পান মুখে ঠেসে দেন এবং দিব্যি চিবুতে চিবুতে ঘুমিয়ে পড়েন। কিংবা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে চিবুতে থাকেন। ব্যস, ভোর হতে হতে ডিব্বাও খালি হয়ে আসে উনিও বিছানা ছেড়ে নেমে পড়েন।
এ কথা মীর্জা চাচা একদিন আব্বুকে বলেছিলেন। মীর্জা চাচার পানের ডিব্বায় ঝিনুর সবগুলো পুতুল এটেও কিছু জায়গা খালি থাকবে। ঝিনু তাই মনে করে। মুখে পান পোরা শেষ করে মীর্জা চাচা আবার কথা শুরু করেন।
-‘ তা কি বলছিলেন ভাই সা’ব, হ্যাঁ হ্যাঁ কারফিউ ।
আরে না না ফিউ নয়, কারই নেই। রাস্তায় কার দেখলামই না। ভাইজান লুটের টাকার কার ফেলে সবাই দিব্যি পগাারপার। বাবার আমলের পরানডাদো আর দোকানে পাওয়া যায় না। বা ওতো আর আদমজীর গোডাউনে থাকে না।
একটা গেলেই আর একটা কিনব বা অন্যের টাতে জোর করে চেপে বসলাম। এতো মিরপুর লালমাটিয়ায় বিহারিদের বাড়ি নয়। নিজের নেই তো কি আছে একটা দখল করে নিলেই হলো। হ্যাঁ রাস্তায় সৈন্যতো আছেই কিন্তু ওরা জো কর্তা আর জি হুজুরদের জন্য তৈরি। আমাদের বলবেডা কী? আমরা কি ওদের লোক নই।
’ একটু দম নেবার জন্য থামলেন মীর্জা চাচা। এরই মধ্যে আবার মুখের পান কমে এসছে। ডিব্বা খুলে গোটা কয়েক খিলি ঝপাঝপ মুখে পুরে আবার বলতে লাগলেন-‘ ভাবলাম বাসার ছেলেটাকে সাথে নিয়ে একটু বাজার ঘুরেই আসি না কেন? টুকটাক বাজার সওদা করে নেয়া যাবে, তাছাড়া একটু আধুটু পান খাওয়ার অভ্যেস যখন আছে যদি মিলেই যায়। দেখি ডিগবাবুর বাজার বেশ জমে উঠেছে। পাশ দিয়ে ফুড়ত ফাড়ুত আসা যাওয়া করছে ঢাকা নারায়নগঞ্জের দুয়েকটা কোচ।
বাজার সেরে ছোকরাকে বাড়ি পাঠিয়ে বাসে উঠার লোভ আর সামলাতে পারলাম না। আপনার সাথে মন খুলে আলাপচারি করার জন্য প্রাণ খালি ঠোকর মারছিল। ভাবলাম ঢাকায় যেতে পারলে শহীদবাগের দিকে মেয়ে জামাইয়ের তত্ত্ব তল্লাশীও নেয়া যাবে। আর না সে সাথে রাজধানীর শহরের হাল হাকিকতও জানা যাবে । জিনা ভাইসাব, ওসব গা বিড় বিড় ভয় ডর কোন কালেই আমার ছিল না।
ওপর ওয়ালা না মারলে কে মারে শুনি? মানুষের বাঁচা মরার ফয়সালা আসমানে হয় জমিনে নয় । দুর আপনার ভাবী ভাবতে যাবে কেন? আমি কি বিদেশ সাহারায় গিয়েছি না ঢাকা জুড়ে হাতী হায়না ঘুরে বেড়াচ্ছেৎ। এসব বাজে প্রশ্ন করবেন না। ’ আব্বুকে কথা বলার সুযোগ না দিয়েই মীর্জা চাচা বললেন-‘ এক মজার কান্ড শুনুন। আমি বাজারে ঢুকে দেখি হৈ হৈ কান্ড ছাল ছাড়া মুরগীর গোস্ত বিক্রি হচ্ছে তিন টাকা
সেরে ।
ব্যাপার কি? বুঝলেননা এম পি তোয়া সাহেবর ছেলের বৌ ভাত। মানুষ খেতে পায় না। একসের চাল কিনতে হাড্ডিতে ঘুন ধরে, তখন তিনি ছেলের বৌভাতের জন্য তিরিশ হাজার টাকার মুরগী কিনেছেন। আল্লাহর ্লীলা বোঝাভার শেষ বাদ্য বাজালেন তিনি, ধর্মের কল নড়ে উঠল, রাতের বেলা বাড়া ভাত ছাই পড়ল। কে খায় কার বউ ভাত।
সব পগার পার। এদিকে ব্যাপারীরা দেখল আসল কম্ম শেষ, কোন মতে যদি ক্ষতিটুকুও পুষয়ে নেয়া যায় তাই জবাই করা ছাল ছাড়ানো মুরগী তিন টাকা দরে দিল চড়িয়ে । লাভ না হোক অন্তত খরচাটা যদি উঠে। ’
-‘তা বেশ প্রাণভরে গোশত কিনেছেন বুঝি । ’ আববু জানতে চায়।
-‘তওবা। তওবা। হারাম জিনিসের কারবারে আমি নেই। তাছাড়া...’, ঝিনুর মতে হল মীর্জা চাচা বাচ্চাদের মত কেঁদে ফেলবেন ।
-‘আমি জানি এসব দুঃখের ঘা কোথায় লাগে।
আমার ভাতিজারও বিয়ের দিন তারিখ ঠিক হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তার বিয়ের আগের রাতে ডাকাতি করতে এসে গ্রামে রক্ষীর লোকেরা ধরা পড়ল। গ্রামের লোকজনও আচ্ছা তরাসে উত্তম-মধ্যম হাকল ওদের পিঠে। গ্রামের মাতব্বরদের কারণে কোনও ডাকাত রক্ষীকে পিটিয়ে একদম লাশ বানিয়ে দেয়নি। কিন্তু পরদিন লৌহজং ক্যাম্প থেকে দল বেধে রক্ষীর বর্গি বাহিনী এল।
আর গ্রামে ঢোকার সময় ‘কাউয়া’ মারার মত করে মানুষ মারল। এবং তারপর বেধড়ক মার দিল মাতব্বরদের। গ্রামে কিয়ামত হয়ে গেল। বিয়ে খেতে য়েয়ে আমরা জানাজা পরলাম। বিয়ের পাগড়ী আচকান এখনও আমার কাছে এগুলি নিয়ে কি যে করি।
হতভাগার মাকেও এমন মার মেরেছে যে বুড়ির হাড্ডি আর জোড়া লাগেনি । এখনও হাসপাতালে গোংগাচ্ছে। আর আপনি একটা কথা বল্লেন আমি কিনব ওই গোশত। ’
আব্বু তাড়াতাড়ি বললেন,-‘মাফ করে দিন ভাই। ’
মীর্জা চাচা কতক্ষন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন আব্বুর দিকে ।
কান্নার ছবি তুললে যেমন দেখা যায় ঠিক তেমন চোখমুখ কোচকানো চুপচাপ চেহারা মীর্জা চাচার ।
হঠাৎ করেই আব্বার কথা বলতে শুরু করলেন ”াচা
‘-মাফ টাফ চাচ্ছেন কেন ভাইসাব? আমার ভাতিজা ওই একটাই, তাও বংশের বড় ছেলে। ওর কথা উঠলে মনটা নরম হয়ে যায়। ’ এরপর অবশ্য মীর্জা চাচা বেশীক্ষণ দেরি করেননি। গালগল্প জমে উঠছিলো না।
মীর্জা চাচা পান মুখে না পুরে অনেকক্ষণ বসে রইলেন। মীর্জা চাচা পান চিবুচ্ছেন না এমন দৃশ্য ঝিনুর কাছে বেদনার মনে হচ্ছিল।
আজকের নাস্তার টেবিলে বসে ঝিনুর মনে পড়ল ওদের স্কুলের বাংলা আপামনি যেদিন মারা যান সেদিনের কথা। সবাই এসেম্বলির লাইনে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করেছিল। কারও মুখে কোন কথা নেই।
সব চুপচাপ সার সার দাড়িয়ে। বুক ভার ভার হিম হয়ে আসছে। শুধু মালির পোষা কুত্তাটা কঁকিয়ে একটানা কেঁদে উঠে। আজকেও বাইরে কুকুরের কান্না শুনতে পায় ঝিনু। নানী বলেছেন কুকুর বিড়ালের চোখে পর্দা নেই।
বালা মুসবিত দেখে ওরা মানুষের আগে দেখতে পায়। কেঁদে ককিয়ে মানুষকে আগেভাগেই তা জানিয়ে দেয়। ঝিনুর মনে হল, কথাটা ঠিকও হতে পারে।
ঝিনুকে আব্বুমনিই স্কুলে নামিয়ে দিয়েগেছেন। আপারা আজ স্কুলে যাননি।
আম্মু মানা করেছেন । ঝিনু কেবল কান্নার জোরে স্কুলে যাওয়ার অনুমতি নিয়েছে। ভাইয়া স্কুলে আর ভাইমনি ভার্সিটিতে চলে গেছেন। ঘর হতে বের হবার আগে আম্মু সবাইকে লাইন ধরে দাড় করিয়ে দোয়া পড়ে ফু দিয়ে দিয়েছেন। প্রথমে আব্বু তারপর ভাইয়া ভাইমনি, সর্বশেষে ঝিনু।
ঝিনুকে আবার চুমোও দিয়েছেন। এ দোয়া পড়ে ফুঁদিলে ঘরে না ফেরা পর্যন্ত কোন বালামুসিবত বিপদ আপদ কারো কাছে ঘেষাতে পারবে না। রাস্তায় নেমে অবাক হয়ে যায় ঝিনু। বারে একদম সুমসাম মানে যার যার মত যে যে চলছে। রিক্সা গাড়ী ভিড় হৈ চৈ মানুষ ফেরিওয়ালা যেমন থাকে সবসময়।
কেথাাও অনেক উচু বড়া বড়া মোচ চকচকে রংয়ের সৈন্যরা হুয়া হুয়া করে কথা বার্তা বলে কৈ কৈ আওয়াজ তুলে রাস্তায় ঘুরে বেরোচ্ছেন না। তবে আম্মু দোয়া পড়ে ফু দিলেন কেন? এমন তো দিতেন সেই সব দিনে যখন মুক্তি বাহিনী, স্বাধীনতা, এস, এল, আর গ্রেনেড় ইত্যাদি বলত। ঝিনুর সে সব দিনের কথা মনে নেই। আপার গল্প থেকে যা একটু জেনেছে। না থানার সামনেও তো বালুর বস্তা দিয়ে ঘর বানিয়ে রাখেনি।
ঝিনুর কাছে একটা জিনিস মজার মনে হয়, লোকগুলো যেন কিভাবে হাটছে। সবাই ঝটপট পা ফেলছে। বাম ডানে তাকিয়ে দেখছে তারপর সুরৎ কর কেটে পড়ছে। ওদেরকে কোন অচিনপুরের দত্যি তাড়া করছে? স্কুলে ঢুকে খানিকটা অবাক হল। আজ হৈ চৈ কম হচ্ছে।
একটু দুরে জটলা করছে বড় ক্লাসের ছাত্রীরা। ফিস ফিস করে কি যেন গোপন কথায় মশগুল। কাজে যেয়ে শোনে এক জন ভয়ের স্বপ্ন দেখেছে সে কাহিনী বলছে। তার কথা শেষ না হতেই আর দুজন মেয়ে বলল, আমরাও ভয়ের স্বপ্ন দেখেছি। ঝিনুর মনে হল জেগে থেকে স্বুলেই ও ভয়ের স্বপ্ন দেখতে শুরু করবে! না স্কুলে হুল্লোড় ঝিমিয়ে গেছে।
দুই পিরিয়ড হয়েই ছুটি হয়ে গেল। হঠাৎ করে ছুটি পেলে মন খূশিতে ঝলমল করে উঠে। মনে হয় কেউ বিরাট একটা পিচকারী দিয়ে গুড়ো গুড়ো খুশি সারা মনে ছঁড়িয়ে দিয়েছে । আজ এরকম কিছুই মনে হল না । ঝিনুর খুব হয়রান হয়রান লাগছিলো।
বাড়িফিরে পুতুল খেলতেও ভাল লাগছিলো না। আপা মেজপা নামাজ শিক্ষা নিয়ে পড়ছেন। দোয়া দরুদ ঝালিয়ে নিচ্ছেন। আপাদের পরীক্ষার অনেক দেরী। তাহলে এখন নামাজ শিক্ষা নিয়ে ঘাটাঘাটি করছেন কেন।
পরীক্ষার সপ্তাহ খানে আগে ভাগে জোরেসোরে নামাজ, নামাজের থেকেও লম্বা মোনাজাত এবং ঘুরে ফিরে একই দোয়া, ‘ আল্লাহ প্রশ্ন যেন কমন হয়’ এমন বরাবর দেখে আসছে ঝিনু। এ নিয়ে ভাইয়ার ঠাট্রা আম্মুর কাছে আপাদের নালিশও কম হয় না এ বাড়িতে। পরীক্ষা হয়ে গেলে আপাদের নামাজও কমতে থাকে। তারপর এক সময় মাঝে মাঝে নামাজ কাজা করা শুরু করে।
দুপুরে ফাক পেলেই ঝিনু আম্মুকে পুতুল খেলায় টেনে আনে।
পুতুলগুলোকে সাজিয়ে গুছিয়ে দেন আম্মু। আম্মু সেলাইবাক্স হতে রঙ্গিন টুকরো কাপড় খুঁজে বের করে পুতুলের নতুন নতুন ডিজাইনের জামা-কাপড় বানিয়ে দেন। ঝিনু গিন্নি বান্নি গোছের হাবভাব করে আম্মুকে পুতুল ছেলে মেয়ে-বউদের কীর্তিকান্ড
সবিস্তারে শুনিয়ে দেয়। কোন ছেলেদারুন দস্যি । কে পুকুরে ডুবতে বসেছিলো ।
পাশের বাড়ির ভালামানুষ ঝি সময়মত না দেখলে কি সর্বনাশই না হয়ে যেত। কোন পুতুল ছেলে ঝিনুকে না দেখলে কিছুই মুখে দিতে চায় না। পুতুলের সংসারে কার ছেলের বউ বডড ঝগড়াটে। কার মেয়ের লেখাপড়ায় মন নেই। এমন সব জালা যন্ত্রণায় কথা শুনিয়ে শেষে -মেষে বলে সংসারের জালায় জালায় ঝিনুর স্বাস্থ্যই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
আম্মু সব শোনেন। সংসারের এমনধারা নচছার জালা যে সবার আছে সে কথাও বলেন। তারপর পুতুলকে কোলে তুলে আদর করেন । কোন পুতুলকে বেশি আদর করতে দেখলে ঝিনু গভীর গলায় সাবধান করে দেয়।
-‘অত আদর দিও না।
আদর পেয়ে বাদর হয়ে মাথায় চড়ে বসবে। তা ছাড়া একটাকে অত আদর করছ আমার বাকী ছেলেময়েরা বুঝি বানে ভেসে এসেছে!’
-‘ওহে তাইতো !’ আম্মু মনির মনে পড়ে যায়। ওই পুতুলটাকে আস্তে করে নামিয়ে রেখে কাকীগুলোকেও একটু আদর করে দেন। আজ সব কিছুই হলো না। এমনকি স্কুলের ইয়া কঠিন কঠিন হোমাটাস্কগুলোও করতে হলো না।
স্কুলে আজ সবাই খালি খারাপ স্বপ্ন দেখা নিয়ে গল্প করেছে তাও বলতে ইচ্ছে হল না। ঝিনু জানালা দিয়ে আকাশ দেখল কিছূক্ষণ । একটা ট্রাক বিশ্রী শ্বব্দ করে চলে গেল। কতগুলো কাক কা কা করে হাহাকার শোনাচ্ছে দুপুরের কড়া রোদে চুপসে যাওয়া আকাশ আর থমকে থাকা ল্যাম্প পোষ্টকে। ঝিনু তার রং পেন্সিল দিয়ে তার ড্রইং খাতায় আনমনে আকি বুিক কাটতে থাকে।
আজের দিন অংকের ঘন্টার মঠ লম্বা হয়ে গেছে। ঝিনু এক সময় ডইং খাতার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠে। আকিবুকি কাটতে কাটতে কি এক আজব জন্তু বানিয়ে ফেলেছে । চোখ দু’টো ঢেলা ঢেলা প্যাচার মত। দাঁত মানুষের মহিষের মত শিং ।
নাকের জায়গায় বিরাট গোল। কান হলো হাতীর । জিভ মাঝ দিয়ে সাপের মত ফাঁড়া। লক লকে। ওটা একটা রাক্ষস ।
তাকিয়ে দেখতে নিজের ভয় ভয় লাগে। ঝিনু রাক্ষসের চোখে মুখে ছপাছপ আচড় কাঁটতে থাকে ওটার চেহারা পালটিয়ে দিতে চায়। চেহারা ঢাকা পড়ে গেলেও ঝিনুর মনে হয় ওটা এখনও ঢেলা ঢেলা চোখে ভয় কর হা করে তাকিয়ে আছে সবদিকে। সব খানে। সব জায়গায়।
কাকগুলো তখনও বিচ্ছিরী ডাক ডেকেই চলেছে। ঝিনু হাতের ড্রয়িং খাতাটা দুরে ছুড়ে ফেলে। তারপর ঘর থেকে বের হয়ে যায়।
বাসার সামনের নরম জমিতে বিকেলের টসটসে আলো পড়েছে। ভাইমনি মুখ হুম করে বসে আছেন।
ওহো। সেই সাদ্দাতের গল্প শোনা হল না। কিন্তু ভাইমনি এমনভাবে বসে আছেন যে এখন গল্পের বায়না ধরলে নির্ঘাৎ বকা খাবে ঝিনু ।
-‘গল্পের কাজ নেই তারচেয়ে রুকাদের বাসা থেকে ঘুরে আসি। ’ ভাবলো ও।
রুকা আজ স্কুলে যায়নি ওদের কাজের ছেলে ঝিনুকে দেখে বলল,
-‘আপামনি আপনার বন্দুর জ্বর, বিছানায় শুইয়া রইছে। ’ একটা সাদা কম্বল বুক পর্যন্ত টেনে নিয়ে রুকা চোখ বন্ধ পড়ে রয়েছে। খলাম্মা মাথার কাছে বসে হাত বুলাচ্ছেন। ঝিনু পা টিপে টিপে ওর কাছে যায়। খালাম্মাকে নরম গলায় জিজ্ঞেস করে, ওকি ঘুমিয়েছে।
খালাম্মা মাথা নাড়েন, না। ঝিনু কপালে হাত দিয়ে চমকে উঠে ইস গা পুড়ে যাচ্ছে। রুকা একবার চোখ খুলে তাকায় । লাল দুচোখ ঝিনুর হাতটা কপালে চেপে ধরে রুকা বলে,
-‘তোর হাতটা কি ঠান্ডা । ’ ওর হাত একসময় ঢিলে হয়ে আসে।
বড় বড় শ্বাস পড়তে থাকে। রুকা ঘুমিয়ে পড়েছে । খালাম্মা মাথার কাছে বসে রুকার চুলে হাত বুলিয়ে যাচ্ছেন । ঝিনু চুপচাপ বাসায় চলে আসে। ফেরার সময় রুকাদের কাজের ছেলের সাথে দেখা হয়।
ওর নাম রুহুল আমিন। ঝিনুর সাথে সাথে রুহুল আমিন সামনের সবুজ জমি পেরিয়ে বাসায় এসে ঢোকে । আব্বু এরই মধ্যেই এসে
গেছেন । ভাইমনি, ভাইয়া আব্বু রেডিও সামনে নিয়ে বসে আছেন। সকালের মতই রেডিওতে ভুতের কান্না শোনা যাচ্ছে।
রহুল আমিন আব্বুকে জিজ্ঞেস করে,
-‘স্যার আইজ রেডিও খুলে নাই ক্যান?’
একটু চুপ থেকে আব্বু ধীর গলায়,
-‘ গন্ডগোল হচ্ছে। ঠিক ঠাক কিছু শুনিনি। তবে সৈন্য বাহিনীর মধ্যে ঝগড়া লাগিয়ে এ দেশে যার একদিন সব দলকে বাতিল করে দিয়ে একদল তৈরি করেছিলো তাদের লোকেরা ফের আসতে চাচ্ছে। ’
-‘ইল্লাবিল্লা। ’ রহুল আমিনের মুখ চোখ কুচকে উঠে।
কেমন অসহায় বলে,
-‘তাহইলে আবার কচু ঘেচু আটার লেই খাইতে হইব। ’ ওর চেহারা বদলে যেতে থাকে । বৃষ্টির মত অঝোরে রহুল আমিন বলে চলে। নিজের জীবনের সেসব দিনের কথা যখন মাসের পর মাসের অনাহার অর্ধাহার সুর্যের মত স্বাভাবিক ছিল। জীবন তখন ষ্টেনের খালি বুলেটের থেকেও হালকা।
এক চিমটি নুন ্একমুঠো ভাত একটি শুকনো মরিচ কি দারুন সুখ কল্পনা। রুহুল আমিন কতদিন ভাত না খেয়ে থেকেছে তা সে এককুড়ি দু’কুড়ি হিসেব করেও মিলাতে পারে না। যা পেয়েছে তাই খেয়েছে। কিন্তু পেটের আগুন যে হাবিয়া দোজখ । বাবা বিছানায় পড়ে গিয়েছেন।
মায়ের শাড়ি ছিড়ে ছিঁড়ে ত্যানা হয়ে গেছে। লজ্জায় মায়ের দিকে তাকানো যায়নি। নাকি সুরে হাড় জিরজিরে ছোট ভাইটির কান্না,- ‘এডডু ভাত খামু। ’ আকালের দিন। কাজ কাম নেই চারটা ভাত মুখে দেয়ার আশায় পুরানো ‘পিরফিন’ কাঠাল গাছটি বিক্রি করে দেয়।
লীগের মাতবর কিনে নেয় মাত্র পঁচিশ টাকায়। ধরা গলায় রহুল আমিন বলে,
-‘ওমন মিঠা কাঠাল গাছ কাউর বাড়িতে আছিল না। বিরাট গাছের শিকড় পর্যন্ত ছেয়ে যেত কাঁঠালে কাঁঠালে। লীগের মাতবর তিন ঘর ভর্তি সব ফার্ণিচার বানাইছিলো। আর বিক্রির পঁচিশ টাকায় ভাগ্যে জুটে আড়াই সের চাল।
অনেকদিন পর ভাতের দুটো দানা মুখে দিলেও তা সোয়াদ মত খেতে পায়নি। নুন জুটেনি বরাতে। নুন মানে তখন সাত রাজার ধন। সোনার দরে বাজারে বিকোয় । দুঃখের রাত্রি শেষ হয় না।
রহুল আমিনের কথাও ফুরায় না। জ্বীনের আসরে ধরা মানুষের মত বলে চলে, ‘আল্লারে বাজান মরার আগে কাঁঠাল গাছটার জন্য কি আহাজারিই না করত। মরার দুবছর আগেও বাজানে বাজি ধরে চার মাইল দুরের হাট থেইক্যা দইুমনি ষাড় কান্ধে চড়াইয় বাড়ি নিয়া আইছিলো। গ্রামের বা আশেপাশের কারও বিয়ের সময়ে কুটুম বাড়ির লোকদের জব্দ করার জন্য খাওয়ার দাওয়াত পেত রহুল আমিনের বাবা। এমন লোকের শেষ দিনে হাডডি গোনা যেত।
কবরে তাকে শুইয়ে দিয়েছিলো কলা পাতা মুড়ে । কথার শেষ দিকে রহুল আমিন কেঁদে ফেলে।
-‘অনেক কিছুই কইলাম, তয় বেয়াদবী নিয়েন না। ’ বলতে বলতে চলে যায় রুকাদের কাজের ছেলে রুহুল আমিন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।