আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ঝিলিমিলি ভোর - (৭ই নভেম্বরকে নিয়ে একটা শিশুতোষ উপন্যাসের ৫ম অধ্যায় )

সুন্দর সমর

(সাতই নভেম্বর বাংলাদেশের ইতিহাসের এক স্বর্ণোজ্জ্বল দিবস। একদলীয় বিভীষিকাময় দিনগুলোকে ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টাকে সিপাই জনতার ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের মাধ্যমে রুখে দেয়ার এই দিন। আজকের বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রের যে শত ফুল হাজার ধারায় ফুটছে , বহু সংবাদ মাধ্যমের বিকাশ ঘটছে, লক্ষ মানুষের মত প্রকাশের যে ধারা যাত্রা সূচিত হয়েছে তার শিকড় প্রোথিত রয়েছে এই দিবসে। সে কথা অনেকেই ভুলে গেছেন, কেউ কেউ তা ভুলিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছেন। অন্ধকারের বিরুদ্ধে আলোর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ইতিহাসে দ্যুতিময় প্রভাতের বিকাশই কেবল ঘটেছে।

আধার পালিয়ে গেছে বারেবারে। তবুও অন্ধকারের কাপালিক প্রভু এবং তাদের চেলারা নিবৃত্ত হননি। আজও তারা ওত পেতে থাকেন। আজও তারা কৃষ্ণ নি:শ্বাসে ডুবিয়ে দিতে চান মানুষের বিজয় গাথাকে। অন্ধকারের প্রভুদের অতীত এবং চলমান অপচেষ্টার প্রতিবাদের অংশ হিসেবে ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হল শিশুতোষ উপন্যাস ঝিলিমিলি ভোর।

আজ তার ৫ম পর্ব পরিবেশিত হল। ) আজ ঝিনু নিজে নিজেই হাত মুখ ধুয়ে নিল। ঝপাঝপ পানি ছিটোতে যেয়ে ফ্রক ভিজে যায়। কিন্তু মুখের এক কোনা শুকনোই থেকে গেল। আম্মু আজ আর এতসব দেখলেন না।

তিনি তসবী নিয়ে ব্যস্ত। চুল আচড়ে দিলেন আপা। আপার কাছে চুল আচড়াতে ওর কখনও ভাললাগে না। এমন এটে চুল বাঁধেন যে, মাথা ব্যাথা হয়ে যায়। জোরে সোরে চিরুনী চালিয়ে উঁকুন মারেন।

মাথায় একটা দুইটা উঁকুন থাকলে ক্ষতি কি? আপার কান্ডটাকি একদম হাতিমার্কা। ওর বিরক্তি ধরে যায়। ঝিনু চেঁচামেচি শুরু করলে তবেই চুল বাধার হাত থেকে রেহাই মেলে । আজ ওসব ঘটল না। আপা ঝপাঝপ চিরুনি চালিয়ে চুল আচড়ে দিলেন।

ঝিনু হাফ ছেড়ে বাঁচল। আব্বু খবরের কাগজ হাতে নিয়ে পটাপট পৃষ্টা উলটে রেখে দিলেন । ঝিনু বুঝল কোন খবর নেই। কোনো খবর না থাকলে আব্বু এমন করেন। ওর মনে আছে যখন অনেকগুলো লোক চেঁচাত এক নেতা এক দেশ তখনও আব্বু খবরের কাগজ এমনি করে নাড়তেন।

সে সময় কাগজ হাতে নিয়ে তিতে অযুর খাওযার মত তাঁর মুখটা কুচকো উঠতো। নাসতার টেবিলে হল্লোড় নেই। সবাই হাসতে ভুলে গেছে। ভাইমনি কাল রাতে ফারুকভাইকে স্বপ্নে দেখেছে সে কথা বলছেন। আববু চায়ে চুমুক দিতে যেয়ে বিষম খেলেন।

আপার গ্লাসের পানি ছলকে ভাইয়াকে ভিজিয়ে দিলো। ভাইয়া তা নিয়ে কোনো শোরসার করলেন না। ফারুক ভাইর কথা উঠলে বাসার সবার আচার-ব্যবহার একেবারে পাল্টে যায়। ফারুক ভাই ওদের কোন আত্মীয় নয়। আববুর বন্ধুর ছেলে।

এ বাসায় ফারুক ভাইয়ের অবাধে যাওয়া আসা ছিলো। ফারুক ভাই সব সময় দারুন হৈ চৈ করতে পারতেন। এক মুহূর্তে চুপচাপ বসে থাকতে জানতেন না । ঝিনু আর ফারুককে আল্লাহ একই মাটি দিয়ে বানিয়েছেন । এ কথা ভাইমনি বলতেন।

আম্মাকে ফারুক ভাই খালাম্মা বলত। এত সুন্দর, এমন অন্তর থেকে আর কাউকে ঝিনু খালাম্মা ডাকতে শুনেনি। ফারুক ভাই ভাইয়ার সাথেই পড়াশুনা করতেন। ফারুক ভাইদের বাড়িতে ঝিনুদের সব সময় যাওযা আসা ছিল। ফারুক ভাইদের বাসার সকলে ফারুক ভাইর মত আমুদে ছিল।

ফারুক ভাইর আব্বার হাসি গমগম করে উঠত বেজে উঠত। সেই মিষ্টি প্রাণের ফারুক বাইকে মেরে ফেলা হল। সেগুন বাগিচার মোড়ে হাইজ্যাকার বলে থেতলিয়ে দিল ফারুক ভাইকে। কয়েকজন লোক ঝাঁপিয়ে পড়ল আর হারিয়ে গেল ওদের সবার প্রিয় ফারুক ভাই। ঝিনু দেখেছে ফারুক ভাইর লাশ! কত রক্ত! সত্যি সত্যি ফারুক ভাই হাইজ্যাকার ছিলেন না।

বড়দের কাছ থেকে ও শুনেছে, সেদিন সেগুন বাগিচার মোড় হতে হাইজ্যাক হয় এক গাড়ী। গাড়ীর মালিক চেঁচিয়ে উঠলে রাস্তার লোকজন তাড়া করে হাইজ্যাক করা গাড়ীটাকে। ফারুক ভাই তখন একটু দুর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। কোন মতলবে পেছন থেকে হাইজ্যাক করা গাড়ীটা ফারুক ভাইর কাছে একটু থেমে খুব দ্রুত পাশ কাটিয়ে চলে যায়। তাড়া করা লোক জন অতশত না ভেবে ধরে নেয় প্রাণের ভয়ে একজন হাইজাকার বুঝি গাড়িটা থেকে নেমে পড়েছে।

বাস আর যায় কোথায়। সমস্ত রোষ পড়ে ফারুক ভাইর ওপর। গাড়ীর কথা বেমালুম ভুলে ফরুক ভাইকে ওরা তাড়া করে এবং ভ্যাবাচাকা খাওয়া ফারুক ভাই ধরা পড়ে যায় কতগুলো খেপে ওঠা মানুষের হাতে। আইন ছাড়া দেশের চরমে উঠা লোকের গণপিটুনিীতে কয়েক মিনিটে প্রান হারান নির্দোষ ফারুক ভাই । সেই সময় ডাকাতি, হাইজ্যাকের বিচার হত না।

থানায় যাওয়া আর মাসি-পিসির বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া একই কথা। বিচার না পাওয়া খেপা জনগণ তাই সুযোগ পেলে হাতে হাতে বিচার করত। এখানেও সুবিধা নিল সরকারী দল। দলের গুন্ডা বদমাশরা অন্য দলের কর্মীদের জনগণ সেজে পিটিয়ে মেরে বলত হাইজ্যাকার মরেছে। কোন লোকের পকেট কাটতে দেকে কেউ চীৎকার করলে আশে পাশে ছড়িয়ে থাকা পকেটমারের দল একত্রে হয় ওই বেচার চীৎকার করা লোককেই গণপিটুনীর শিকার বানাত।

গুলিস্তানে সে সময় এমনটা নিত্য- রোজই হত। কতশত হতভম্ব নিরীহ নিরাপরাধ ফারুক ভাই হাইজ্যাকার পরিচয়ে মরার পরও মানুষের ছি ছি কুড়িয়েছে তার হিসেব মেলা শক্ত। সেদিন যখন সবাই মিলে পাগলের মত ফারুক ভাইকে মারছিলো। তখন অনেকগুলো ছবি তুলছিলেন কাজী সাহেব। অনেক দিন পর এক পত্রিকায় সে গুলো চাপাও হয়েছিলো।

ক্যামেরা হাতে কাজী সাহেবকে সাংবাদিক ভেবে তার সার্ট আকড় ফারুক ভাই বলেছিলেন, - ‘আমি হাইজ্যাকার নই। আমাকে বাঁচান। ’ কিন্তু তার করার কিছুই ছিল না। উন্মত্ত লোকজন ফারুক ভাইকে ট্রেনে হিচরে নিয়ে গেছে। কাজী সাহেবের ছিড়ে আসা শার্টের অংশ ফারুক ভাইয়ের হাতে ছিলো ।

আহ ! কি বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছেন ফরুক ভাই । ওই ছবির দিকে তাকালেই চোখে পানি আসে। ঝিনু ঠিক জানে ফারুক ভাই কক্ষনো খারাপ লোক ছিলেন না। ঝাকড়া চুলের ফারুক ভাইকে ঝিনু বলত, -‘এই তোর মাথায় বেনী করে দেই আয়। ছেলেদের মাথায় লম্বা চুল।

ঢং । ’ হাসিতে ঘর ভরিয়ে ফারুক ভাই ভাইমনিকে বলতেন, -‘এই পাক্কা বুড়ীর কথা শোন। মনে হয় আমার দাদী এসেছে’ ঝিনুর গালটা আস্তে টিপে দিয়ে বলতেন -‘তুই আমার দাদী হবি নাকিরে?’ জবাবে ঝিনু শুধু ধ্যাত ধ্যাত করত। ফারুক ভাইয়েদের বাড়ী এখন এক পাষানপুর। এই ক’দিন আগেও ঝিনুরা ও বাড়ী ঘুরে এসেছে ।

কেমন যেন থমকে গেছে সব। টবের গাছগুলো শুকিয়ে মরে গেছে। ভাই মনি আজকের স্বপ্নে কথা বলেছেন, -‘দেখলাম আমি আর ফারুক যেন এক তছনছ হয়ে যাওয়া বাগান গুছিয়ে তুলছি। ওই বাগান ঘিরে রয়েছে এক নদী । ধীরে ধীরে ফুলগাছ তরুতাজা হয়ে উঠছে।

কত রংবেরংয়ের ফুল, পাখীর গানে নদীর কুলেকুলে ঝাক বেধে আসা মৌমাছি আর প্রজাপতির ভিড়ে হেসে উঠছে বাগান। এমন সময় দেখি নদীর ওপারে ভীষন এক সাদা ভালুক আর তিন মাথা ওয়ালা সিংহ এসে দাড়িয়ে ফুসতে থাকে । আমরা ভয়ে চমকে উঠি। কিন্তু ওদুটো নদী পার হয়ে বাগানে আসতে পাচ্ছে না। বাগানের শক্ত গেট হঠাৎ করে নদীতে পড়ে গিয়ে নৌকা হয়ে য়ায়।

নদীর পানি ইতিমধ্যে টগবগে রক্ত হয়ে উঠেছে। নৌকায় চড়ে ওই দুটো জানোয়ার দিব্বি বাগানে এসে হাজির হয়। তারপর প্রচন্ড বেগে আমাদের তাড়া করে। আমরা ভয়ে পালাতে শুরু করি। ফুলের কেয়ারি নষ্ট করে।

পাখীর বাসা ভেংগে। প্রজাপতির ডানা ছিঁড়ে জানোয়ার দুটো তেড়েই আসছে। এ সময় ফারুক বলে ওঠে, -‘ আরে জানোয়ারের ভয়ে ভাগছি কেন? চল রুখে দাঁড়াই। ’ -‘তাইত । লড়ব, নয় মরব।

’ আমরা রুখে দাঁড়াই । এবং আক্রমণ করতেই তিন মাথাওয়ালা সিংহের সাথেসাথে সাদা ভাল্লুক ভেগে গেল। কিন্তু যাওয়ার আগে ছো মেরে ফারুককে নিয়ে গেল। তারপর দেখলাম খালূ- খালাম্মা ফারুক ফারুক ডেকে ওকে খুঁজতে আসছেন। আর চারদিক হতে হাজার হাজার ফারুক নেমে আসছে।

খালাম্মা, খালু কাঁদতে কাঁদতে বলছেন, -‘আমি এত ফারুক চাই না। কেবল আমাদের ফারুককে চাই। ’ তারপর আমার ঘুম ভেংগে যায়। ’ সব শুনে আম্মু বললেন, -‘যা দেখেছ ভালই দেখেছ। ’ ঝিনু জানে স্বপ্ন দেখলে ওটা নাকি বলতে হয়।

তাহলে স্বপ্ন ভালভাবে ফলে যায়। আব্বু চুলে হাত বুলাচ্ছেন। তার মানে আব্বু চিন্তা করছেন। -‘আমারা জানি না দেশের ভাগ্যে কি আছে। মনে হল অনেক দুর হতে আব্বুর স্বর ভেসে আসছে।

’ নাস্তার টেবিলের অমন চমৎকার শুকনো মোরব্বা ঝিনু খেতে পারল না। তিতা তিতা লাগছে। খাবার নষ্ট করায় আম্মু চোখ রাংগিয়ে উঠলেন না।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.