আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পিঠা

মাঝে মাঝে বৃষ্টি দেখে হাত বাড়ানোর ইচ্ছে জাগে... ভেতর ভেতর যাই পুড়ে যাই, কেউ জানেনা আমার আগে...

শীত মানে কি?
শীত মানে পৌষ মাস। তাহলে পৌষ মানে কি?
পৌষের মানে আমার কাছে দুটি। এক- পৌষ মানেই তীব্র শীত। পৌষের এই তীব্র শীত নিয়ে বাংলাদেশের গ্রামে গঞ্জে অদ্ভুত সুন্দর এক প্রবচন রয়েছে। সেই প্রবচন হল 'মাঘের শীত, বাঘের গায়-, পৌষের শীত মইসের গায়'।



অর্থাৎ, পৌষের শীতে মহিষ পর্যন্ত কাঁপে!

দুই- পৌষ মানেই স্মৃতির উৎসব! সেই উৎসবের পুরোটা জুড়েই দিনগুলো মোর সোনার খাচায় রইলো না। সেই স্মৃতির পুরোটা জুড়েই বুকের বা পাশে অদ্ভুত কান্না! পৌষ নিয়ে আরও একটা দুর্দান্ত প্রবচন রয়েছে, 'কারো পৌষ মাস, কারো সর্বনাশ'

আচ্ছা, এই প্রবচনে 'পৌষ মাস' ব্যাবহারের অর্থ কি কারো জানা আছে?

অর্থ জানা সহজ বিষয় না। বরং কঠিন। ভালোরকম কঠিন। কারণ অর্থ জানতে হয় জীবন থেকে।

জীবনের পুরোটা জুড়েই থাকে নানান অর্থ উপলদ্ধির অভিজ্ঞতা। সেইসব অভিজ্ঞতা পরীক্ষার খাতায় মুখস্ত লিখে আসা হরেক রকম অর্থের চেয়ে ঢের গভীর, ঢের বিশাল।

চকচকে নিকানো উঠোন। উঠোনের একপাশে চুলাহাল। চুলাহাল মানে রান্নাঘর।

এই রান্নাঘরের কোন ছাদ নেই। আছে পাঠখড়ির বেড়া। পৌষের ঘন কুয়াশার ভেতর দিয়ে অদ্ভুত সিঁড়ির হয়ে উঁকি দেয় আলো। আরেকটি ভোর। শীতে কাঁপা দিন।

আমি আর ছোট ভাই মিলে আঁচ নিতে বসে যাই গনগনে চুলার পাশে। কালো গাইটার বাছুর হয়েছে। কি যে ঘন দুধ! ইয়া মোটা তার সর। জিভের আগায় হপ্তাহ খানেক লেগে থাকা স্বাদ। আব্বা বালতি থেকে দুধ ঢালেন হাঁড়িতে।

গনগনে মাটির চুলায় টগবগে ফুটে ওঠে ধবধবে দুধ। আম্মার মুখ জুড়ে ঘাম, আমাদের জিভ জুড়ে জল। চুলার পাশে খেজুরের রস, চিতাই পিঠার স্তুপ। তাতে ঘন দুধ পড়ে। পিঠা পড়ে ফুলে উঠে।

জবজবে রস তার কনায় কনায়। আব্বা গরুর ঘর থেকে হাঁক দেন, 'কইরে বাজান, বাছুরডা একটু ধর, গাইডার ওলানে আরও দুধ আছে মেলা, আরেকবার দোয়াই লই'।

আমি ছোট ভাইকে বলি, 'আব্বায় ডাকে, তুই যা'।
দুধ আর খেজুরের রসে তখন ভেসে আছে ফুলে ওঠা টসটসে চিতাই। সেখান থেকে চোখ সরায় সাধ্য কার? ছোটভাই উল্টা কুনুই দিয়ে গুঁতা দেয়, 'তুমি যাও, আব্বায় তোমারে ডাকে'।



কথা বলতে গিয়ে মুখ খানিকটা ফাঁক হতেই ছলাপ করে লালা ঝড়ে পড়ে মাটিতে। ছোটভাই নির্বিকার ভঙ্গীতে হাতের উলটো পিঠে মুখ মোছে। কিন্তু ভেসে থাকা চিতাইএর পিঠ থেকে চোখ সরে না।

আব্বা আবার ডাকেন, 'কইরে, কেউ একজন আয় এমনে, বাছুরডাতো ধরতে অইব নাকি?'

আমাদের কুনুই দিয়ে গুঁতোর যুদ্ধ চলতেই থাকে, 'তুই যা, তোরে ডাকে'।
- না, তুমি যাও, তোমারে ডাকে।


- না, কাইলকা বাছুর আমি ধরছি না, আইজ তোর পালা, তোরে ডাকে'।
- আমার হাতে ব্যাথা, আব্বায় কইছে অখন থেইকা পরপর তিনদিন তুমি বাছুর ধরবা।
- এহ, কইলেই হইব? দেহি দেহি, তোর কোন হাতে ব্যাথা?
- না দেখা লাগব না, আল্লাহর কিড়া! আমার হাতে ব্যাথা। বিদ্যা! কসম! তুমি যাও!

আব্বা দাক্তেই থাকেন, আমরা কসম কিড়া কাটতেই থাকি, কিন্তু ওই দুধ আর রসে ভিজে থাকা জবজবে চিতাইএর শরীর থেকে আমাদের চোখ আর সরে না। জিহবা বেয়ে ক্রমশই জল ঝড়ে! ইশ! আম্মায় অখনও দেয় না কেন?

- ও আম্মা, ওই যে পাতিলের উত্তর পাশে, লম্মবা পিঠা, ওইখান আমারে দিবেন।


- এহ আইছে, ওইখান হেই কহন থেইক্কা আমি চাইয়া চাইয়া দেইখ্যা রাখচি।
- তুই দেইখ্যা রাখলেই হইব? আমিওতো দেইখ্যা রাখছি।
- এই, তুমি দেখ্যা রাখলেই হইব? আমি অইডার পাশে বইস্যা আছি।
- আম্মা, ওরে মানা করেন। ভালো হইব না কিন্তু, ওইডা কিন্তু আমি খামু, আমি।



মুহূর্তেই আম্মার বাজখাই ধমক, 'আল্লাহ্‌রে আল্লাহ! কি দিছ এই দুইডা আমার ঘরে? দিন নাই, ক্ষ্যান নাই, হারাডা দিন খালি মারামারি! মাইনসের ঘর ভর্তি পোলাপান, কি সোন্দর মিল্যা মিশ্যা থাকে, আর আমার ঘরে দুইডা হইছে, এক্কেরে যেন ঠেহে হতি (সৎ) ভাই। কি হইছে এইগুলান। যা যা, আগে বাপের কাছে যা, গিয়া বাছুর ধইর‍্যা খাড়া। গাইয়ে দুধ না দিলে বেচতেও পারবো না, তহন খাওন বন্ধ! যা যা!'

আম্মা হাড়ির উপর প্লেট দিয়ে ঢেকে রাখেন। আমাদের নিজেদের গরুর দুধ, নিজেদের খেজুর গাছের রস, নিজেদের ক্ষেতের ধানের চাল থেকে পিঠা, তারপরও আমরা হাভাতের মত করি? কেন করি? কারণ এই একটা দুটো দিনই আমাদের পৌষমাস! ওই যে পৌষমাসের কথা বললাম, ওই পৌষমাস।

এইদিনে দুধের সরে পিঠা হয়, খেজুর রসের মিঠা হয়, সিরার ভেতর টসটসে চিতাই ফোলে। ইশ! জিহবার জল সামলানো দায়!

বাকীটা দিন, বাকীটা মাস, আমরা বাছুরের দড়ি ধরে রাখি, আব্বা আমাদের চোখের সামনে দিয়ে গরুর দুধ দুইয়ে বাজারে নিয়ে যান। বাজারের মিষ্টির দোকানের সাথে মাসকাবারি চুক্তি, খেজুরের রস পেড়ে হাড়ি ভর্তি করে ভোর বেলা নিয়ে যান হাটে, এক হাঁড়িতেই কুড়ি টাকা! আমরা তাকিয়ে থাকি! ইশ! আজও তাকিয়েই আছি। আম্মা গটগট করে গরুর ঘরের দিকে যান। গিয়ে বাছুরের দড়ি ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন।

আব্বা বালতিতে ভোরে গরুর দুধ দোহান।

আম্মা চাপা গলায় বলেন, 'আফনে কি এমুনি করবেন?'

আব্বা গরুর পেটের নিচে বসে দুধ দোহাতে দোহাতে জবাব দেন, 'কি করবো?'

এমনে প্রত্যেক দিন পোলাপানের সামনেরতন দুধগুলান বাজারে দিয়াসেন, শীত আইল, পৌষ মাসটাও যায় যায়, পোলাপানের শীতের পিঠা লাডা খাইতে মন চায় না?'

আব্বা নির্বিকার জবাব দেন, 'খাইতে তো মানা নাই, আইজকাতো খাইবই, আইজকা বানাইছ না?'

- হ, বানাইছি? কয়টুক দুধ দিছেন? কয় ফোঁটা রস দিছেন? এইগুলানে কয়ডা পিঠা হয়? তারওপর দাওয়াতও করছেন চাইরজন। আফনের আক্কেল কবে হইব? চুলার পারে বইয়া পলা দুইডা কেমুন করতেছে গিয়া দেহেন, যান। আফনের দিলে কি কিছুই নাই?'।

আব্বা এই কথার জবাব দেন না।

তার আঙুলের বিস্ময়কর দ্রুততম চাপে ছিরিং ছুরিং শব্দে কালো গাইয়ের দুধে ভরে উঠতে থাকে বালতি।

আমরা পিঠা খেতে বসেছি, অনেক খেয়েছি। আমাদের ঠোঁট, মুখ, গলা, বুকের খানিকটা সেই দুধ, রস, ঝোলে মাখামাখি। এই পিঠা, এই যত ইচ্ছা খাওয়া যায়, 'আম্মা আরেকখান পিঠা দেন? দুধ একটু বেশি দিয়েন। '

আম্মা কথা বলেন না।

আচলের কোণা প্লেটের পানিতে ভিজিয়ে দুইভাইয়ের কাছে এসে বসেন। তারপর মুখ চেপে ধরে সেই জলে ভেজা আচলে গলা, মুখ, ঠোঁটে লেগে থাকা খাবার মুছিয়ে দেন। দিতে দিতে ফিসফিস করে বলেন, 'একসাথে বেশি খাইতে অয়না বাজান, হ্যাশে প্যাট খারাপ হইব, দেহো নাই, প্যাটে কি বেদনা হইছে হেইবার! অইরম বেদনা হইব'।

- হউক বেদনা, তাও দেও, একখান দেও'।

এইবার আর আম্মা কথা বলেন না।

পিঠার শুন্য হাড়ি নিয়ে উঠে যান পুকুরে।

প্রতিবার শীত আসে, শীত যায়। নানান ব্যাস্ততায় আর বাড়ী যাওয়া হয় না। শীতের সেই রস, দুধ, পিঠার কথা কবেই ভুলে গেছি! আজ হঠাৎ ছোট ভাই বাড়ি থেকে ফোন, 'ভাইয়া, আমি কাইলকা ঢাকায় আইতেছি, আম্মায় দুই-তিন পাতিল ভইরা পিঠা দিতাছে'।

আমি বিরক্ত গলায় বলি, 'ধুর ধুর!! আমি এইসব পিঠা টিঠা খাই না, এইসব ঝামেলা আনিস না'।


ছোট বোনটা হঠাৎ ভয়ে ভয়ে পাশ থেকে বলে, 'ভাইয়া তুমি কি জানো, আম্মা আব্বা কত বছর শীতের কোন পিঠা খায় না? খালি তোমাগো লাইগ্যা? তোমরা বাড়ি নাই দেইখ্যা, তোমরা খাইতে পারো না দেইখ্যা? তোমরা খাও না দেইখ্যা হেরাও খায় না!'

আমি হঠাৎ চুপ করে যাই। একদম চুপ!
আর অপেক্ষায় থাকি, কাল পিঠা আসবে... কাল।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।