আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শতাব্দীর সন্তান পর্ব- ৩

তরুণ নামের জয়মুকুট শুধু তাহার, বিপুল যাহার আশা, অটল যাহার সাধনা শত বছর কিংবা প্রাচীন আমলের সাধু দরবেশদের গল্প নয়। আজকের পৃথিবীতেও এমন মানুষ আছেন- যার কাছে এত বড় রাজকীয় সম্মান আর এমন মূল্যবান অর্থের কোন প্রয়োজন নেই!! বাদশাহ ফয়সল পুরস্কার। সৌদআরবের পক্ষ থেকে দেয়া এ সম্মাননাকে মুসলিম বিশ্বের নোবেল প্রাইজ মনে করা হয়। প্রতিবছর সৌদীআরবের তরফ থেকে মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন কমিটি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে মনোনয়ন চাওয়া হয়। সেসব থেকে যাচাই বাছাই করে সর্বাধিক মতামতপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে এ পুরস্কার প্রদান করা হয়।

বাদশাহ ফয়সলাল পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তির হাতে তুলে দেয়া হয় নগদ দু লাখ রিয়াল, একটি পদক এবং সনদপত্র। সৌদী আরবের বাদশাহ, যুবরাজ এবং মন্ত্রীপরিষদসহ মুসলিম বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে এ সম্মান জানানো হয়। ১৯৮০ সালের ১৬ জানুয়ারী। নদওয়া মাদরাসার কোন এক রুমে ছাত্রদেরকে পড়াচ্ছেন তিনি। মাদরাসার অফিসরুমে বসে আছেন কিছু শিক্ষক এবং অন্যান্য স্টাফরা।

তারা চা পান খাচ্ছেন। লোকজন আসছে। টেলিফোন একটু পরপর বেজেই চলেছে। হঠাৎ জরুরী টেলিগ্রাম। সৌদীআরব থেকে।

বাদশাহ ফয়সাল সম্মাননা নির্বাচন কমিটির প্রধান এ টেলিগ্রাম পাঠিয়েছেন। তার নাম আমীর খালিদ ফয়সাল বিন আব্দুল আযীয। তিনি মাওলানার সাথে কথা বলছেন। কমিটির প্রধান হিসেবে তিনি শায়খকে এ সংবাদ জানালেন। তাকে রিয়াদে আসার আমন্ত্রণ জানালেন।

এমন পুরস্কার প্রাপ্তিতে আন্তরিক অভিবাদন জানালেন। সৌদীআরবের রেডিও ও টেলিভিশনে ততক্ষণে এ বছরের শ্রেষ্ঠতম মনিষী হিসেবে একজন অনারবের নাম ঘোষিত হচ্ছে। আরববিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে বিস্ময়ভরা কৌতুহল। লোকজন গভীর আগ্রহে সংবাদ পাঠকের কথা শুনছেন। একজন অনারব হয়েও তিনি আরব বিশ্বের এ বিরল সৌভাগ্য অর্জন করেছেন।

এটি কি কম কথা? লাখনৌর নদওয়া মাদরাসায় আসতে শুরু করেছে একের পর এক অভিনন্দন। সমগ্র আরবদুনিয়া তার এ পুরস্কারপ্রাপ্তির খবরে উল্লাসিত ও আনন্দিত। সুধী ও সাহিত্যিকসমাজ নতুন করে উজ্জীবিত হচ্ছেন। লাখনৌতে তখনও ভিন্ন চিত্র। মাওলানা তখনো নিরব।

তার ভেতর অস্থিরতা কিংবা চাঞ্চল্য কাজ করছে না। তিনি স্বাভাবিক নিশ্চিন্ত হয়ে নিজের কাজে ডুবে আছেন। সম্ভবত সেসময় তিনিই একমাত্র মনিষী, এসব পুরস্কার ও সম্মাননা থেকে যে দূরে থাকতে চান। তিনি নীরবে নিভৃতে মানুষের মনন ও চেতনায় নতুন দিনের বীজ বুনতে ভালবাসেন। তার এমন মনোভাব জানা ছিল সৌদীআরব রাজকীয় দফতরের।

শায়খ হয়তো এ পুরস্কার গ্রহণ নাও করতে পারেন। এমন একটি আশংকায় কেউ কেউ চিন্তিত। তারা এ মনিষীকে চেনেন। তার ভেতরের নির্মোহ মনোভাব ও একনিষ্ঠ কর্মসাধনার কথা ঘনিষ্ঠজনরা অনুভব করেন। সৌদীআরব সরকারের শিক্ষামন্ত্রী শেখ হাসান আব্দুল্লাহ।

তিনিও চিন্তিত। মাওলানা কি পুরস্কার ফিরিয়ে দিবেন? না, তা হতে দেওয়া যায় না। তিনি টেলিফোন করলেন তার কাছে। বিনয়ের সাথে মাওলানাকে বোঝাতে চেষ্টা করছেন, হযরত! কোন স্বার্থ নয়, আপনি শুধু আমার খাতিরে এ সম্মাননা গ্রহণ করুন। শায়খ মনস্থির করলেন।

তিনি এ সম্মাননা ফিরিয়ে দিবেন না। তার প্রিয়তম একজন মানুষ শায়খুল হাদীস মাওলানা যাকারিয়া সাহেবও তাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। তাই তার এ সিদ্ধান্ত। তবে তিনি নিজে যাবেন না এ অনুষ্ঠানে। কারণ জীবনভর আড়ম্বরপূর্ণ এসব আয়োজন তার অপছন্দ।

তার শিষ্য ডক্টর আব্দুল্লাহ আব্বাস নদভীকে এ পুরস্কার গ্রহণের জন্য সৌদীআরব পাঠাতে সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি একটি চিঠি লিখে দিলেন। চিঠিতে এ পুরস্কার দেওয়ায় তার আন্তুরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। সেইসাথে পুরস্কারবাবদ প্রাপ্ত অর্থ নিজের ইচ্ছানুযায়ী খাতে খরচের সবিনয় অনুমতি প্রার্থনা করলেন। ১৯৮০ সালের ১২ ফেব্র“য়ারী।

সৌদীআরবের রাজধানী রিয়াদের আলো ঝলমলে রাত। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল এর ফয়সাল হলে আজকের অনুষ্ঠান। দেশ বিদেশ থেকে সুধীজনরা আসছেন। তবুও কোথায় যেন শূন্যতা রয়ে যাচ্ছে। কারণ যাকে ঘিরে এ আয়োজন, তিনি এখানে নেই।

এমন দিনেও মানুষটি আড়ালে রয়ে যেতে চান। অনুষ্ঠান শুরু হল। সবার মুখে মুখে শায়খের জীবন ও কর্ম নিয়ে বিশ্লেষণ। বক্তারা তার একনিষ্ঠ সাধনার প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান জানাচ্ছেন। যুবরাজ ফাহাদ মাওলানার সম্মানে এ পুরস্কার তুলে দিলেন তার প্রতিনিধির কাছে।

মাওলানার প্রতিনিধি পুরস্কার গ্রহণ করলেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত বিশ্বের অতিথিবৃন্দ তখনও ঘোরের মধ্যে। এমন বিরল সম্মান নিজের জীবদ্দশায় পাওয়া কি কম ভাগ্য! নিজের হাতে এ সম্মান গ্রহণ করার সুযোগ কে হাতছাড়া করে? আর তিনি!! নিজে না এসে প্রতিনিধিকে পাঠালেন!! হলভর্তি আমন্ত্রিত অতিথিরা অবাক হয়ে শুনছেন মাওলানার প্রতিনিধির দিকে। তিনি একটি চিঠি পড়ে শোনাচ্ছেন সবাইকে। চিঠির প্রতিটি শব্দ তাদেরকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছে।

তারা তাদের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। সুদূর ভারতের এ মাওলানা পুরস্কারবাবদ যে চল্লিশ লাখ রুপীর মালিক হলেন, এর এক কানাকড়িও তিনি নিজের জন্য রাখছেন না। এ বিশাল অংকের টাকা থেকে বিশ লাখ রুপী তিনি আফগানিস্তানের অসহায় শরণার্থীদের জন্য দান করে দিয়েছেন। বাকী অর্ধেকের কিছু অংশ কুরআনুল কারীমের হাফেজদের জন্য এবং বাকীটুকু মক্কা নগরীর এক মাদরাসার জন্য তিনি ওয়াকফ করে দিয়েছেন। এমনও কি মানুষ হয়!! শত বছর কিংবা প্রাচীন আমলের সাধু দরবেশদের গল্প নয়।

আজকের পৃথিবীতেও এমন মানুষ আছেন যার কাছে এত বড় রাজকীয় সম্মান আর এমন মূল্যবান অর্থের কোন প্রয়োজন নেই!! অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে। অতিথিরা বের হয়ে আসছেন। তারা একে অপরের দিকে নির্বাক তাকিয়ে আছেন। সবার মনের ভেতর বিস্ময়ের ঘূর্ণিঝড়। যে ঝড়ে উড়ে যায় লোভ লালসায় ঘেরা পৃথিবীর রঙীন স্বপ্নগুলো।

আগের পর্ব ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১১ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.