আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এ ধরিত্রী কেবল সহ্যই করে (আমেরিকার ইতিহাসের অন্ধকার পর্ব)

তথ্য সন্ধানী আজ হতে ১০,০০০ বছর আগে, ১৫,০০০ বছরও হতে পারে, হতে পারে তারচেয়েও বেশিকাল আগে, বরফযুগ শেষ হয়ে যায় নি, রাশিয়ার পূর্ব প্রান্ত আর আলাস্কার মাঝের বেরিং নামক প্রণালীটি ছিল পুরো বরফের সেতু। সেই সেতু বেয়ে এশিয়া হতে এক দল মানুষ হেটে যায় নতুন এক ভূমিতে যেখানে তার আগে কোন মানুষের পা পড়ে নি, যে বিশাল ভূমিকে আজ আমরা বলি আমেরিকা। অবশ্য তারা বিশ্বাস করে তারা কোথাও হতে আসে নি, এই স্বর্গতুল্য দেশেই পরমেশ্বর তাদের জন্ম দিয়েছেন, তার সম্পদরাজি দিয়েছেন অকাতরে। এখান হতে তারা হাজার হাজার বছরে ছড়িয়ে পড়ল এই সুবিশাল ভূভাগের বিভিন্ন প্রান্তে। এক দল গেল একেবারে উত্তর প্রান্তে, কেউ রইল মাঝখানের প্রশস্ত ভূমিতে যা আজকে যুক্তরাষ্ট্র নাম নিয়েছে।

এদের একদল দক্ষিণে ‘এজটেক’, একদল ‘মায়া’ নাম নিল। তারা গেল আরও দক্ষিণে, সেখানে তারা এক শক্তিশালী সাম্রাজ্য গড়ে তুলল, যা ইতিহাসে ইনকা সভ্যতা নামে পরিচিত। তারা ছড়িয়ে পড়ল দক্ষিণ আমেরিকা নামক মহাদেশটি জুড়ে। তারা ভেলায় চরে পাড়ি দিল প্রশান্ত মহাসাগর। ছড়িয়ে পড়ল পুরো প্রশান্ত মহাসাগর জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দ্বীপগুলোয়।

তাদের ছড়িয়ে পড়ার সাথে এশিয়ার একটি প্রলম্বিত খন্ড যা ভূতাত্বিক ভাবে একটি উপদ্বীপ ছাড়া কিছুই নয়, সেই কথিত মহাদেশর বাসিন্দা ইউরোপীয়দের ছড়িয়ে পড়ার সাথে পার্থক্য রয়েছে। আদিবাসীরা যেখনেই গিয়েছে মিশে গিয়েছে প্রকৃতির সাথে। কিন্তু ইউরোপীয়রা যেখানেই গিয়েছে ধ্বংস করেছে যা কিছু সুন্দর, যা কিছু আদিম। প্রকৃতির বিশালতা, উদরতা, সৌন্দর্য তাদের অন্তরেও প্রতিস্থাপিত, তাদের মধ্যে গড়ে উঠেছিল আরও উদার ধর্মীয় বিশ্বাস। আর বাকি বিশ্ব যারা জানত না এই অপার সৌন্দর্যের স্বর্গীয় ভূমির কথা, তাদের কেউ কেউ সমূদ্র ভ্রমণ করে সেখানে পা রেখেছিল।

যুগে যুগে ভাইকিং, মিশরীয়, মুরিশ আরব, চৈনিক নাবিকেরা দেখা দিয়ে গেল তাদের। তখনো তারা আক্রান্ত হয় নি। খ্রীস্টীয় পন্জিকা মতে ১৪৯২ সালের অক্টোবরের ১২ তারিখে এমন একটি ঘটনা ঘটল, যা না ঘটলে পরবর্তী পাঁচশত বছরের ইতিহাস অন্যরকম হত। দুইটি মহাদেশে ছড়িয়ে থাকা ভূমিপূত্ররা ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করতে পারে নি তাদের ভাগ্যাকাশে নিয়তি কি ষড়যন্ত্রের মেঘ ছড়িয়ে দিয়েছে! কলম্বাস নামের এক ইতালীয়ান নাবিক পথ হারিয়ে বহু কাঙ্খিত ভূমির দেখা পেল। পরবর্তীতে সেই ভূমির নাম দেয়া হল সান সালভাদর।

আর যে জাতির আশ্রয় পেলেন তার নাম ‘তাইনো’। তারা শুরু করল এই আদিম ‘জংলী’দের ‘সভ্য’ বানানোর মহান প্রয়াস। ‘সভ্যতা’র ভার সইতে না পেরে সেই তাইনো যাদের সাহায্য না পেলে কলম্বাসদের আর কখনো ইউরোপের মাটি দেখা হত না সেই তাইনোরা নিশ্চিহ্ন হল দশ বছরের মাথায়। আরও শ’খানেক বছর পরে ১৬০৭ সালে ইংরেজরা পা রাখে আজকের ভার্জিনিয়ায়। সেখানে বাস করত পাওহাতান’রা।

পরবর্তীতে এখানেই প্রথম ইংরেজ কলোনী গড়ে উঠল যার নাম জেমসটাউন। ইংরেজ দলপতি জন রোলফে বিয়ে করলেন পাওহাতান রাজার মেয়েকে। ইংরেজ দলপতির শ্বশুরবাড়ীর আটহাজার বাসিন্দার সংখ্যা কিছুদিনের মধ্যেই নেমে আসল কয়েক শ’তে। আরও কিছুদিন পরে আরেকটি ইংরেজ জাহাজ এসে ভিরল, নাম মে ফ্লাউয়ার। ১৬২৫ সালে স্থানীয় পেমাকুইড রাজা সামোসেট তাদের প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে ভূমিদান করে ইতিহাস সৃষ্টি করলেন।

ততদিনে এই এলাকা নিউ ইংল্যান্ড নাম নিয়ে ফেলেছে। নেদারল্যান্ডের অধিবাসী ডাচ্’রা আদিবাসীদের কাছ থেকে ম্যানহাটন দ্বীপটি কিনল কয়েকটি বড়শি আর চকচকে কাচের পুতির বিনিময়ে। বাণিজ্যের এই ধারায় এই দ্বীপেই পরবর্তীতে গড়ে উঠবে সারা বিশ্বের বাণিজ্যিক রাজধানী নিউ ইয়র্ক শহড়। ডাচরা এক রাতের অন্ধকারে রারিতান’দের দুটো গ্রামের সকল নারী, পুরুষ, শিশুদের হত্যা করে জ্বালিয়ে দিল। এই আগুন পরবর্তী দুশ বছরেরও নিভবে না।

১৬৭৫ সালে যুদ্ধে পরাজিত ওয়াম্পানোয়াগ গোত্রপতি মেটাকমের মস্তকটি প্লাইমাউথে টাঙ্গিয়ে রেখে বিশ বছর ব্যাপি এক প্রর্দশনীর ব্যবস্থা করা হয়। ১৭৭৬ সালের ৪জুলাই শ্বেতাঙ্গ ইউরোপীয় অধিবাসীরা ১৩ অঙ্গরাজ্য নিয়ে ইংল্যান্ড হতে স্বাধীনতা ঘোষণা করে United States নাম ধারণ করে। পরবর্তী পৌনে দু’শ বছর ধরে নতুন নতুন রাজ্য ‘ক্রয়’ করতে থাকবে। তারও পরবর্তী ষাট বছরের জ্ঞাত ইতিহাসে তারা সারা বিশ্ব জুড়ে সাম্রাজ্যা বিস্তারের প্রয়াস অব্যাহত রাখবে। মহামারীর মত ধেয়ে আসা শ্বেতাঙ্গদের রুখতে শাউনি মহানেতা তিকামশে বিভিন্ন আদিবাসী জাতিকে এক করে গড়ে তুলেন এক বিশাল কনফেডারেশন।

১৮১২ সালে শ্বেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নিহত হন। মৃত্যূ হয় এক পবিত্রতম স্বপ্নের। ১৮৩৮ সালে আইওয়া টেরিটোরির গভর্নর ব্ল্যাক হ্যক নামের এক গোত্রপতির কংকাল অফিসকক্ষে প্রদশর্নীর উদ্দেশ্যে রেখে দেন। এই ব্ল্যাক হ্যকের অপরাধ ছিল ইলিনয়ের আর সব আদীবাসীদের মত পালিয়ে না গিয়ে আমেরিকার বিরুদ্ধে ১৮৩২ সালে যুদ্ধ করেন। ১৮৩৮ সালের শরতের এক হিম শীতল দিন।

একদল চেরোকি আদিবাসীকে বন্দি শিবির থেকে তাড়িয়ে নেয়া শুরু হল পশ্চিমে ইন্ডিয়ান টেরিটোরির দিকে, এই যাত্রা শেষ হবে আগামী বছর। এই দীর্ঘ যাত্রায় অনাহারে, ঠান্ডায়, রেগে শোকে মারা যাবে তাদের চার ভাগের এক ভাগ মানুষ, যার মোট সংখ্যা ৪০০০। এই প্রস্থানকে তারা নাম দেবে ‘অশ্রুর যাত্রা’। তাদের অপরাধ, তাদের এলাকায় স্বর্ণখনি আবিষ্কৃত হয়েছে। ১৮৫৮ সালে গোল্ডরাশের সময় স্বর্ণ সন্ধানীরা হামলে পড়ল পাইকস পীকে।

পরের বছর তারা সেখানে একটি গ্রাম প্রতিষ্টা করবে, যার নাম ডেনভার সিটি। তখনো ওই গ্রামের জমির মালিকানা আদিবাসী আরাপাহোদের। তবে তারা পরে কোন দিনই মালিকানা ছেড়ে দেবার জন্য আর বেচে থাকবে না। আমেরিকায় তখন গৃহযুদ্ধ চলছে, ১৮৬২ সালের বড়দিনের পরদিন, ৩৮ জন সান্টী সীউ মিনেসোটার মানকাতা শহড়ে সার বেধে দাড়িয়েছে, তাদের কন্ঠে ঐতিহ্যবাহী মরণ সঙ্গীত। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের ফাঁশি দেয়া হবে।

তাদের নেতার নাম তা-ওয়া-তে-দুতা, ইউরোপীয়রা যাকে বলে লিটল ক্রো। ১৮৬৬’র ১লা সেপ্টেম্বরে নাভাহো মহানেতা ম্যানুয়েলিতো ওরফে হাস্তিন চি’ল হাজিনি সুদীর্ঘ সংগ্রামের পর তেইশ জন বিদ্ধস্ত যোদ্ধা নিয়ে আত্মসমর্পণ করলেন ফোর্ট উইনগেটে। আর একটু পর দ্বিতয়বারের মত আত্মসমর্পণ করবেন বারবোনসিতো, সাথে একুশ জন যোদ্ধা। কয়েক বছর নারকীয় দুর্ভোগ পোহানোর পর আবার স্বভূমে ফিরে তার আবিষ্কার করবে যে আমেরিকান আদিবাসীদের মধ্যে তারাই সবচে’ কম দূর্ভাগা। ১৮৬৪ সালের নভেম্বরের ২৮ তারিখ, স্যান্ড ক্রীক, চেইনী ক্যাম্প: গোত্রপতি ব্ল্যাক কেটলী তার লোক জনকে রাক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশাল পতাকা টাঙ্গিয়ে দাড়িয়ে আছেন, একে একে ক্যাম্পের সবাই এসে যোগ দিচ্ছে।

কিন্তু ঐ লাল সাদা’র স্ট্রাইপ পাতাকাটি তাদের রক্ষা করত পারবে না। কারণ ঐ পাতাকার স্রষ্টারাই তাদের নিশ্চিহ্ন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রথম গুলিটি চলবে শান্তির আশায় ঘোড়া চালিয়ে আসা এন্টিলোপের বুকে। মৃত্যূর আগে সে গাইবে, ‘কিছুই বাঁচে না চিরদিন, মাটি আর পাহাড় ছাড়া’। ইতিহাসে এই হত্যাযজ্ঞ ‘স্যান্ড ক্রীক ম্যাসাকার’ নামে পরিচিত হবে।

এক মহিলা পেট চেরা অবস্থায় পড়ে থাকবে, সেই চেরা ফোকর দিয়ে দেখা যাবে অভুমিষ্ট শিশু। মারা যাবে ১০৫ জন নারী ও শিশু এবং ২৮ জন পুরুষ। ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.