আমি লেখক খারাপ হতে পারি কিন্তু ছেলে ভাল আমার নাম নাফিজ।
আমি একজন ড্রাগ এডিক্ট।
এই মুহুর্তে আমি আছি সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের ওই স্তম্ভটা, কি যেন ছাতা নাম ওটার, ওর পেছনে বাঁশঝারে।
দিনের আলো মরে গিয়ে সন্ধ্যা নামতে শুরু করেছে। আমি বাশগাছে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসেছি।
আমাকে ঘিরে আছে আরো চার পাঁচজন। আমাদের সবার হাতে হাতে একটা আল্যুমিনিয়ামের চামচ ঘুরছে। আমার হাতে একটা গাঁজার পুরিয়া। ওটাতে আয়েশ করে টান দিতে দিতে আমি আমার পালার জন্যে অপেক্ষা করছি। গাঁজা জিনিসটা চমৎকার।
এতে একটা টান দিলেই মাথাটা পরিষ্কার হয়ে যায়। আমাদের মাঝে আছে সুমন, সে আইবিএ’র ছাত্র। সে আজ কোত্থেকে ইন্ডিয়ান গাঁজা যোগার করে এনেছে। জিনিসটার টেস্টই আলাদা। এর জন্যে সুমনকে অবশ্য সব সময়ের চেয়ে বেশি দাম গুনতে হয়েছে।
তাতে কেউই অখুশি নয়। নতুন এই জিনিসটার জন্যে সবাই সুমনের কাছে আজ কৃতজ্ঞ।
অবশেষে আমার পালা এল। একজন অ্যালুমিনিয়ামের চামচটা আমার দিকে বাড়িয়ে ধরল। চামচে কিছু সাদা গুড়ো, পানি আর একটা তুলোর বল।
সুমন চামচের নিচে একটা জ্বলন্ত লাইটার ধরে রেখেছে। চামচে রাখা সাদা গুড়োগুলো ফুটতে শুরু করেছে। আমি জলদি ফুটতে থাকা তরলটুকু সিরিঞ্জে টেনে নিলাম। তাড়াহুড়া না করলে বাষ্প নষ্ট হতে পারে। স্বচ্ছ সিরিঞ্জের মধ্যে আমার তরল স্বর্গ কেমন চিকচিক করছে।
আমি ধিরে ধিরে কনুই এর উল্টো পাশের ভেইনে সিরিঞ্জটা প্রবেশ করালাম।
আহহ...
এই অনুভুতির কোন তুলনা হয়?? আমার শরীর যেন হালকা হয়ে যাচ্ছে। আমি বাতাসে ভাসছি, ভাসছি। ভাসতে ভাসতে উপরে উঠে যাচ্ছি।
সভ্যতার শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার এই হেরোইন!
***
রাত অনেক গভীর... অথবা কে জানে হয়তো তেমন একটা রাত হয়নি।
আমি ঠিক বলতে পারছি না। হেরোইনের নেশা এখনো কাটেনি। আমি টলতে টলতে এগিয়ে চলেছি। রাস্তাঘাট সব কেমন যেন এলোমেলো লাগছে। বাংলা একডেমির কাছাকাছি পৌচেছি, এমন সময় পেছন থেকে একটা গাড়ি এসে আমাকে ধাক্কা দিয়ে প্রায় দশ হাত দূরে নিয়ে ফেলল।
ব্যথা-ট্যথ্যা তেমন একটা টের পাচ্ছি না। কপালে একটা চটচটে অনুভূতি হচ্ছে। ওই জায়গাটা বোধ হয় কেটে গেছে। নিজে নিজে উঠে বসতে পারছি না। হাড়টার কিছু ভেঙেছে কিনা কে জানে।
কেউ একজন ঝুঁকে আমার মুখ দেখার চেষ্টা করছে। লোকটার মুখ পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু লোকটা বোধ হয় আমাকে চিনতে পারল। আমার মুখ দেখেই অস্ফুট শব্দ করে উঠল। তারপর হাচরে পাচরে কাঁধে তুলে কোন মতে টেনে নিয়ে নিজের গাড়িতে তুলল।
লোকটা গাড়ি স্টার্ট দিয়েছে। আমি কোনমতে বলার চেষ্টা করলাম, “আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?” আমার গলা দিয়ে যেন কোলা ব্যঙ্গের আওয়াজ বের হল। লোকটা বলল, “নাফিজ কোন কথা বোল না। তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাচ্ছি। ”
আরে, লোকটা আমার নামও জানে দেখছি।
আমি সাথে সাথে প্রতিবাদ করার চেষ্টা করলাম, “না, ডাক্তারের কাছে যাব না। ”
লোকটি আঁতকে উঠল, “আরে তোমার কপাল ফেটে গেছে। জলদি ডাক্তার দেখাতে হবে। কয়টা সেলাই লাগে কে জানে!”
“না না... আমাকে এখানেই নামিয়ে দিন... ডাক্তার লাগবে না। ” আমি চিৎকার করে উঠলাম।
লোকটি আমার কোথায় কান দিল না। অবশেষে আমি দরোজা খুলে চলন্ত গাড়ি থেকেই লাফিয়ে পড়ার উপক্রম করলাম। “আরে কর কি কর কি!!!” লোকটা তড়িঘড়ি করে গাড়ি থামাল। আমি দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম। বেশি দূর যেতে পারলাম না, ফুটপাতে বসে পড়তে হল।
মাথা ঘুরছে। লোকটিও গাড়ি থেকে নেমে এসেছে। হাতে একটুকরো কাপড়। কাপরটা আমার হাতে দিয়ে আমার পাশে বসে পড়ল। বলল, “কপালটা বেধে ফেল।
ইস, কি রক্ত পড়ছে। ডাক্তারের কাছে যেতে চাইছ না কেন? সেলাই না করলে এই রক্ত পড়া বন্ধ হবে?”
ল্যম্পোস্টের আলোয় এই প্রথম মানুসটির চেহারা পরিষ্কার দেখতে পেলাম। সাইমুম। । আশ্চর্য, গলা শুনে একদম বুঝতে পারিনি।
মাথায় বোধ হয় চোট ভালোই লেগেছে। নাকি, হিরোইনের কারনে এমনটা হচ্ছে।
আমি ভাঙা গলায় বললাম, “ও কিছু না। সামান্য কেটে গেছে। ডাক্তার ছাড়াই সেরে যাবে।
”
সাইমুম বলল, “রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাটছিলে কেন? এতো বার যে হর্ন দিলাম খেয়ালই করলে না। ”
আমি দুর্বল ভাবে হাসলাম। সাইমুম এবার আমাকে ভালো করে দেখল। দেখে কি বুঝল কে জানে, কিন্তু একটু গম্ভীর হয়ে গেল। ঠান্ডা গলায় থেমে থেমে বলল, “নাফিজ কি এখন এসব নিয়েই আছ?”
হ্যা... আমি শূন্য চোখে সাইমুমের দিকে তাকালাম।
“কত দিন হল ইউজ করছ?”
আশ্চর্য, ছেলেটা আমাকে দেখেই বুঝে ফেলল আমি এডিক্ট! আমি ওর কথার উত্তর দিলাম না। সাইমুম একটা দির্ঘশ্বাস ফেলল, “তোমার সাহায্য প্রয়োজন নাফিজ। এভাবে করে তো তুমি বাচতে পারবে না”
আমি একটু হেসে বললাম, “আমাকে সাহায্য করার মত কেউ নেই। ”
সাইমুম মাথা নেড়ে বলল, “দুর্ঘটনা আমাদের সবার জিবনেই কম বেশি ঘটে। তোমার জীবনে যা ঘটেছে সেটা নিঃসন্দেহে দুঃখজনক।
কিন্তু তাই বলে জিবনকে তো এই ভাবে নষ্ট করে ফেলা যায় না। ”
আমি টেনে টেনে বললাম, “আমার জীবনে নষ্ট করার মত আর কিছু বাকি নেই। যা কিছু ছিল পরোটাই খরচ করে ফেলেছি। আমার কথা বাদ দাও। তোমরা কেমন আছ বল।
সুস্মিতার সাথে বহু দিন দেখা হয় না। ”
সুস্মিতার কথা বলতেই সাইমুম একটু কেঁপে উঠল। মাথা নামিয়ে বলল, “তুমি খবর জানো না?”
“না তো, কি খবর?”
“সুস্মিতাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। প্রায় এক সপ্তাহ। ”
“কি বলছ এসব?”
“হুম্ম... সকালে ক্লাস করতে বাসা থেকে রওনা হয়েছে।
কিন্তু ক্লাসে আসেনি, বাড়িও ফিরে যায়নি। এরপর থেকে আর কোন খবর নেই। পুলিসে খবর দেয়া হয়েছে। হাসপাতাল মর্গ সব জায়গায় খোঁজ নেয়া হয়েছে। কোথাও কোন খবর পাওয়া যায়নি।
মেয়েটা যেন বাতাসে মিলিয়ে গেছে। ”
আমি তোতলাতে তোতলাতে বললাম, “খারাপ কিছু হয়নি তো? কিডন্যাপ......”
“সে রকম কোন আলামত পাওয়া যায়নি। কিডন্যাপ হলে এতদিনে মুক্তিপণ দাবি করা হত। সেরকম কিছু হয়নি। একটা যদি কিছু খবর পাওয়া যেত... শুধু বেঁচে আছে না মরে গেছে সেটাই যদি জানতে পারতাম...” ল্যম্প পোস্টের আলোয় দেখলাম সাইমুমের চোখে জল টলমল করছে।
আকাশে তখন পঞ্চমির চাঁদ।
***
বাবা নেই...
জসিম চাচা নেই...
সুস্মিতা নিখোঁজ...
আমার অতি প্রিয় আর অতি গ্রিনার মানুষ গুলো একে একে হারিয়ে যাচ্ছে। আমি ক্রমেই একা থেকে আরো একা হয়ে পরছি। আমার চারপাশে শুধুই অন্ধকার। স্মৃতিগুলো ভীষণ যন্ত্রণা দিচ্ছে।
ভারি চশমার পেছন থেকে বাবার আবেগহিন চাহনি, জসিম চাচার প্রশ্রয় মিশ্রিত হতাশার ভঙ্গি... সুস্মিতার অকারনে হেসে উঠা... ক্লাসের মাঝখানে চুল খুলে আবার নতুন করে বেঁধে নেয়া। । আহা... চুল ছিল মেয়েটার দেখার মত। আর সেই হাসি। ।
বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠে। আমি শক্ত করে চোখ বন্ধ করি। মনে মনে বলি, না আমি ভুলে যেতে চাই। তোমারা চলে যাও। আমাকে একা থাকতে দাও।
স্মৃতিরা আমায় মুক্তি দেয় না। চোখ বুজার পরেও চেনা মুখগুলো দেখতে পাই। আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। এখন একটু হেরোইন দরকার। একটু হেরোইন, একটু শান্তি।
আমি হাঁটতে হাঁটতে কখন যে সুস্মিতাদের বাসার সামনে এসে দাঁড়িয়েছি বলতে পারব না। ধানমন্ডির সাত নম্বরে লেকের উল্টো পাশে একটা পাঁচ তলা বাড়ি। সুস্মিতা থাকতো তিন তলায়। কত রাত এখানে এই জাম গাছটার নিচে এসে দাঁড়িয়ে থেকেছি। যদি সুস্মিতাকে এক পলক দেখা যায় এই আশায়।
মেয়েটা বারান্দায় তেমন একটা আসতো না। বেশির ভাগ রাতেই হতাশ হয়ে ফিরে যেতাম। মাঝে মাঝে ওর দেখা মিলতো। হয়তো ফোনে কথা বলতে বলতে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে, পাঁচ সেকেন্ডের জন্যে। ওই পাঁচটা সেকেন্ডের জন্যেই জীবনটা অপুর্ব মনে হত।
ক্লাসে গেলেই সুস্মিতার দেখা পাওয়া যেত। কিন্তু তারপরেও ওই গভীর রাতে বারান্দার পাচটি সেকেন্ড কেন যেন আমার কাছে অনেক মুল্যবান ছিল। ওই ক্ষুদ্র সময়টুকু যেন শুধুই আমার, ওই সময়টুকুতে সুস্মিতাকে আমার বাকি দুনিয়ার সাথে ভাগাভাগি করতে হয় না। সুস্মিতা তখন শুধুই আমার।
আজ বাড়িটাকে বড় বেশি মৃত, বড় বেশি জড় পদার্থের মত লাগছে।
তিনতলার বারান্দাটা আজ বড় বিষণ্ণ। হঠাত আমার মাথায় কি ভুত চাপল। আমি নিশাচরে রুপ নিলাম। তারপর বাড়ির দেয়াল বেয়ে উঠতে শুরু করলাম। তিনতলার বারান্দায় নেমে এলাম নিঃশব্দে।
বাড়িটা নিঝুম, সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি জানালা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়লাম।
অন্ধকার বাড়িতে আমি ঘুরে বেরাচ্ছি, এঘর থেকে ওঘরে। সুস্মিতার বাবা-মা ঘুমিয়ে আছে। শুধু ডাইনিং এ একটা বাতি জ্বলছে।
এছাড়া বাকি ঘরগুলো অন্ধকার। সুস্মিতার ঘরটা খুঁজে পেতে কষ্ট হল না। এই ঘরটা নিয়ে কত রকম ফ্যন্টাসি ছিল। সাদামাটা একটা ঘর। সুস্মিতার একটা বিষণ্ণ ছবি ঝুলছে দেয়ালে।
সবাই নিজের হাসিখুশি ছবি দেয়ালে ঝুলায়, এই মেয়ে এমন বিষণ্ণ একটা ছবি কেন রেখেছে কে জানে। মেয়েটা হয়তো জানে তাকে বিষণ্ণ চখেই সবচে সুন্দর লাগে। দেয়াল জুড়ে বিশাল বড় একটা বইয়ের শেলফ, তাক ভর্তি বই। মেয়েটা ভীষণ বই পড়ত বুঝা যায়। ছোট্ট একটা পড়ার টেবিল।
এলোমেলো কিছু খাতাপত্র। বিছানাটাও এলোমেলো, যেন একটু আগে সুস্মিতা শুয়ে ছিল। এখনও হয়তো চাদরে ওর গন্ধ পাওয়া যাবে। আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছে শুঁকে দেখি।
সব কিছু বড় বিষণ্ণ, বড় প্রানহিন।
টেবিলের ড্র্যার টেনে ছোট একটা বই বের করলাম। একটা স্ক্র্যপ বুক... এলোমেলো কিছু কথাবার্তা লেখা, কোন গানের বা কবিতার টুকরো টুকরো লাইন। কিছু ছবি, পেপার কাটিং... । একটা ছবির এ্যালবাম। ভেতরে সুস্মিতার নানা বয়েসের ছবি।
ওর মোবাইল ফোন বা ল্যপটপ দেখতে পেলাম না। পুলিস কি নিয়ে গেছে ওগুলো এভিডেন্স হিসেবে?
আচ্ছা ভেন্টিলেটরের উপরে ওটা কি? হাতে বইয়ের মত কিছু একটা ঠেকল। নামিয়ে এনে ফু দিয়ে ধুলো সরাতেই দেখি একটা ডায়েরি। সুস্মিতার ডায়েরি। এটা ভেন্টিলেটরে কেন? এমন অদ্ভুত জায়গায় কেউ ডায়েরি রাখে? নিশ্চয়ই এই কারনেই পুলিসের চোখ এড়িয়ে গেছে।
ডায়েরীটা যেন বিশেষ ভাবে আমার জন্যেই রাখা ছিল। আমি মাঝখান থেকে একটা পাতা খুললাম। একটা দুটা লাইন লেখা কোনটাই খুব গুরুত্বপুর্ন কোন কথা নয়... “আজ বসুন্ধরায় গিয়েছিলাম। অনেক মজা হল”... “সাইমুম আজ হলুদ একটা শার্ট পরে এসেছে। ওকে দেখে যা হাসি পাচ্ছিল।
” ... “সুমিটা এক নম্বরের বজ্জাত... আমার রাসেল ক্রোর কালেকশনটা আজও আনেনি। ... ”
পেইজ উলটে শেষের দিকে চলে এলাম। এবার পুরো পেইজ ভর্তি করে লেখা বেশ কিছু পাতা পাওয়া গেল। এগুলো এলোমেলো কথা নয়, বেশ গুছিয়ে লেখা। পড়ে বুঝলাম একটা চিঠি।
প্রাপকের নাম উল্লেখ করা নেই। তবে বুঝতে পারলাম সাইমুমের কাছে লেখা। সুস্মিতা বোধ হয় ঠিক কিভাবে লিখবে ঠিক করে উঠতে পারছিল না। গেল। বেশ কিছু পাতায় লিখে একাধিক বার কাটাকুটি করা হয়েছে।
কখনো একটা লাইন, কখনো পুরো পাতাটাই কেটে দেয়া হয়েছে। আমি প্রথম থেকে পড়তে শুরু করলাম...
“কথাটা সরাসরি বলতে পারছি না। কোথায় যেন বাঝছে... আমি জানি তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলতে পারব না। পারব না তোমার প্রশ্নের জবাব দিতে। তাই এই চিঠির সাহাজ্য নিতে হল...” চিঠিটা কিছু দূর পড়ে আমি অবাক হয়ে গেলাম।
সুস্মিতা সাইমুমের সাথে ব্রেক আপ করতে চাইছিল!!
...... “তোমার মনে নিশ্চয়ই হাজার প্রশ্ন জাগছে। অনেক রাগ হচ্ছে আমার উপর। আমার নিজেরও নিজের উপর ভীষণ রাগ হচ্ছে। আসলে আমার বোধ হয় মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। পরিষ্কার ভাবে কিছু ভাবতেও পারছি না।
আমি জানি তোমার সাথে ভীষণ অন্যায় করা হচ্ছে। এর জন্যে তুমি আমাকে কখনো ক্ষমা করতে পারবে কিনা জানি না, কিন্তু আমি কখনো নিজেকে ক্ষমা করব না। তবুও বলছি, আমি স্যরি। ... আমি কখনো বুঝিনি ওকে আমি এতো ভালবাসতাম। ভাবতাম ও বোধ হয় আমাকে দেখতেই পায় না।
তাই সেদিন ও যখন সিড়িতে আমাকে বলল... বিশ্বাস কর, এরপর একটা রাতও আমি ঘুমাতে পারিনি। তোমার হয়তো জেনে খুব কষ্ট হচ্ছে... কিন্তু কি করব বল... আমিই তোমার যোগ্য ছিলাম না......”
আমার মনে ভয়ঙ্কর একটা সম্ভাবনা উঁকি দিতে থাকে। সুস্মিতা এখানে কার কথা বলছে? সাইমুমকে ছাড়া অন্য আর কাকে ও এতোটা ভালবাসত? সিড়িতে কার সাথে ওর কথা হয়েছিল? সেদিন ডিপার্ট্মেন্টের সিড়িতে সুস্মিতার সাথে আমার যে কথা হয়েছিল, ও কি এখানে সেই কোথায় বলছে? সেদিন মুখ ফসকে ওকে মনের দুর্বলতা প্রকাশ করে ফেলেছিলাম। তারমানে কি সুস্মিতা আগে থেকেই আমার প্রতি ... !!??
আমি আর কিছু ভাবতে পারছি না। এটা পরিষ্কার যে এই চিঠি সাইমুমের হাতে পৌছায়নি।
অথবা হয়তো পৌঁছেছে, কে জানে। দেখে যে মনে হচ্ছে এটা একটা ড্রাফট। হয়তো সুস্মিতা পরে কোন কাগজে পরিষ্কার করে লিখেছে। অথবা হয়তো ও পরে সামনা সামনি কথা বলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কে বলতে পারে।
আচ্ছা এই চিঠি পেলে সাইমুম কি করত? ওর মনের অবস্থা কেমন হত। সাইমুম মেয়েটাকে যে পাগলের মত ভালোবাসে। ওকে হারানোর আঘাত কি সে সহজ ভাবে নিতে পারত? নিশ্চয়ই না। নিশ্চয়ই সাইমুম রাগে ফেটে পড়ত। সেই কলেজ লাইফের সম্পর্ক একটা চিঠি দিয়ে শেষ করে দেয়া সে নিশ্চয়ই মেনে নিতো না।
রেগে গিয়ে ভয়ঙ্কর কিছু করে বসতো।
ধুর এসব আমি কি ভাবছি। আমার অতিরিক্ত উত্তপ্ত মস্তিস্ক নানা রকম ভয়ঙ্কর কল্পনা করছে। কিন্তু এর কোনটাই বাস্তবে সম্ভব নয়। সাইমুমকে আমি যতই অপছন্দ করি না কেন সত্যি কথা হচ্ছে ওর মত ভালো ছেলে সহজে চোখে পরে না।
ওর দ্বারা সুস্মিতার কোন ক্ষতি সম্ভব নয়। কিন্তু যতই ভাবি আমার দুশ্চিন্তা বারতে থাকে। আচ্ছা পুলিস কি সাইমুমকে ঠিকমত জিজ্ঞাসাবাদ করেছে? এসব কেসে তো নিখোঁজের প্রেমিককেই মুল সাসপেক্ট ধরা হয়। আমেরিকা আর বাংলাদেশে এ ক্ষেত্রে একই নিয়ম। কিন্তু সাইমুমের ব্যপারে কি পুলিস গভির ভাবে তদন্ত করতে পেরেছে? সাইমুমের বাবা আর্মির কর্নেল।
তার ব্যপারে পুলিসের খুব একটা বাড়াবাড়ি করার কথা না।
সাইমুমকে সামনা সামনি প্রশ্ন করতে হবে। আমি নিজে ওকে প্রশ্ন করে নিশ্চিত হতে চাই সুস্মিতার নিখোঁজ হবার পেছনে ওর কোন হাত আছে কিনা।
***
রাতের আকাশ আসলে পুরোপুরি কালো হয় না, অনেকটা কালচে নিল। যখন শহরের বেশিরভাগ নিয়ন আলো নিভে যায় শুধু তখনই রাতের এই রঙটা চোখে পরে।
আমি দাঁড়িয়ে আছি সাইমুমদের বাড়ির ছাদে। আমার দৃষ্টি উর্ধপানে। আকাশে লক্ষ কোটি তারা, কিন্তু ওদের কেউ আমাকে এক ফোটা আশার বানি শুনাচ্ছে না।
সাইমুম বাড়িতে নেই। ও আজ রাতে বাড়ি ফেরেনি।
অথচ পথে আমাকে বলল বাড়ি যাচ্ছে। ছেলেটা গেল কোথায়? সে ও কি সুস্মিতার মত গায়েব হয়ে গেল? নাকি সাইমুম কিছু আন্দাজ করতে পেরেছে? নিজে থেকেই গা ঢাকা দিয়েছে?
আমি জানি না।
আমার পোষা কাকটা বসে আছে ছাদের কার্নিশে। ওকে এখন আমি পল বলে ডাকি। কাক সাধারণত রাতের বেলা বের হয় না।
কিন্তু এই ব্যটা সারাক্ষন আমার পিছে পিছে ছায়ার মত লেগে থাকে। ওর কি ঘর বাড়ি নেই?
আমার আইফোনটা মৃদু গুঞ্জন করে উঠে। আমি ফোনের আলোকিত স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে অবাক হই। কেউ একজন আমাকে একটা অডিও ফাইল সেন্ড করতে চাইছে! নম্বরটা পরিচিত নয়। এই রাত-বিরাতে কে আমাকে অডিও ম্যাসেজ পাঠাবে! আমি ক্যন্সেল করে দিলাম।
একটু পর আবার আইফোন গুঞ্জন করে উঠল। আবার সেই একই অডিও ম্যসেজ।
আমি ম্যসেজটা চালু করলাম।
কোন কথা নেই... কেউ একজন ফোস ফোস করে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলছে।
এভাবে কেটে গেল প্রায় একটা মিনিট।
তারপর প্রায় শোনা যায় না এমন স্বরে কেউ একজন বলে উঠল, “বাচাও”
অডিওটা নিরব হয়ে গেল।
আমি আবার প্লে করলাম... পুরো অডিও তে ওই একটাই শব্দ... আর কিছু নেই... গলাটা সুস্মিতার মত মনে হচ্ছে না??!!
আমি পাগলের মত অডিওর সেন্ডারের নম্বরে ডায়াল করলাম। ওপাশে ফোন বন্ধ। আমার মাথার চুল ছিরতে ইচ্ছে করছে!! তখন আমার চোখ পড়ল কার্নিশে বসা কাক পলের উপর। মাথায় একটা পাগলামি চিন্তা খেলে গেল।
সুস্থ মাথায় নিশ্চয়ই আমি এমন কিছু ভাবতাম না। কিন্তু আমার বর্তমান অবস্থাকে আর যাই হোক সুস্থ বলা যায় না। আমি ফোনে সুস্মিতার একটা পোট্রেট ফটো বের করলাম। সেটা পলকে দেখিয়ে বললাম, “এই মেয়েটাকে দেখেছিস? ওকে খুঁজে বের করা খুব দরকার? পারবি না?”
পল কি বুঝল কে জানে। ঘাড় কাত করে খুটিয়ে খুঁটিয়ে ছবিটা দেখল।
তারপর আকাশের দিকে মুখ তুলে অদ্ভুত স্বরে ডাকতে শুরু করল। গভীর রাতে কাকের ডাক নাকি অশুভ, জসিম চাচা তাই বলতেন। এই নিশুতি রাতে পলের ডাক আমার কাছেও একমন অপার্থিব মনে হল। একটু পর পলের ডাকের সাথে গলা মিলিয়ে পুব আকাশ থেকে কর্কশ কা কা আওয়াজ ভেসে এল। আমি অবাক হয়ে দেখলাম ঝাকে ঝাকে কাক উড়ে আসছে।
কিছুক্ষনের মধ্যেই শ খানেক কাকে আকাশটা ঢেকে গেল। তাদের সম্মিলিত কা কা রবে মনে হল পুরো শহর জেগে উঠবে। কাকগুলো ছাদকে ঘিরে ঘুর পাক খেতে লাগল। কয়েকটা উড়ে এসে বসল পলের পাশে। পল গম্ভীর গলায় থেমে থেমে কা কা করছে, যেন পুরো বিসয়টা বাকি কাকদের বুঝিয়ে বলছে! পলের ডাক থামতেই বাকি কাকগুলো চঞ্চল হয়ে উঠল।
পলের মত ভারি গলায় না, কেমন যেন তীক্ষ্ণ কন্ঠে চিৎকার করে উঠল। আমার কেন যেন মনে হল ওরা আমাকে শিঘ্রি ওদের সাথে কোথাও যেতে বলছে। ওদের কন্ঠের অস্থিরতা আমি স্পষ্ট টের পাচ্ছি।
পল পশ্চিম আকাশে উড়ে গেল। কিছু দূর গিয়েই আবার ফিরে এল।
কার্নিশে বসে দু’বার কা কা করেই আবার উড়ে গেল। দেরি না করে আমি পলের পিছু নিলাম।
***
বাড়িটা পুরানো। বোধ হয় একটা ওয়্যার হাউস। ছাদের উপর কাকগুলো ঘুর পাক খাচ্ছে।
আমি একটা খোলা জানালা দেখে ঢুকে পড়লাম। ভেতরটা অন্ধকার, আর কেমন যেন গুমোট। বাতাসটা ভারি। দম নেয়া যায় না। মনে হয় অনেক দিন কেউ এই ওয়্যার হাউসটা ব্যবহার করে না।
আমি ধুলো মোড়া ক্রেটগুলোর মাঝ দিয়ে পথ খুঁজে এগিয়ে চললাম। মুখে একটু পর পর মাকড়সার জাল এসে লাগছে। এই একটা জিনিস আমি একেবারেই দেখতে পারি না।
একটা আলোকিত দরোজা দেখা যাচ্ছে। আধ ভেজানো দরোজার ফাক চুইয়ে হলুদাভ এক চিলতে আলো বাইরে এসে পড়েছে।
আমি সন্তপর্নে দরোজার পাশে গিয়ে ভেতরে উঁকি দিলাম। আলোর উৎসটা চোখে পড়ল। একটা পুরানো ল্যম্প। ঘরের ভেতর অনেকগুলো ঝুল মাখা ক্রেট। মেঝেতে কেউ একজন বসে আছে, হাত বাঁধা।
এলোমেলো চুলে মুখ ঢেকে আছে।
সুস্মিতা!!
মাথাটা সামান্য ঘুরাতেই আরেকজনকে চোখে পড়ল। কাঠের চেয়ারে বসে আছে। হাতে একটা ছুরি। সাইমুম।
আমি দরোজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম। আওয়াজ শুনে সুস্মিতা মুখ তুলে তাকালো। আমাকে দেখে ওর ধুলো মাখা মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। আমার হৃদস্পন্দন যেন থেমে গেল মুহুর্তের জন্যে। সুস্মিতার মুখে আড়াআড়ি ভাবে একটা গভীর আঁচরের দাগ।
চোখের কোন থেকে শুরু করে নাক পেরিয়ে ঠোঁটে এসে ঠেকেছে। কেউ যেন ভয়ঙ্কর আক্রোশে ছুরি দিয়ে ওর মুখটা আঁচরে দিয়েছে।
আমি এক পলক তাকালাম সাইমুমের হাতের ছুরিটার দিকে। তারপরই ঝাঁপিয়ে পড়লাম ওর উপর।
আমি কি করছি জানি না।
শুধু জানি আমি সাইমুমকে খুন করে ফেলব।
ওকে আমি ছিঁড়ে কুটিকুটি করে ফেলব।
ওর মাথা ভেঙে গুঁড়িয়ে দেব।
হাড়গুলো টেনে একটা একটা করে খুলে আনব।
আমি অন্ধের মত একটার পর একটা ঘুসি বসিয়ে যাচ্ছি।
কোনটা কোথায় লাগছে দেখছিও না। আমি সাইমুমের শরীরটা মাটির সাথে মিশিয়ে ফেলতে চাইছি।
হঠাত পিঠের পাজরের নিচে তীক্ষ্ণ চিনচিনে ব্যথা করে উঠল। আমি অবাক হয়ে দেখলাম সাইমুমের ছুরিটা এখন সুস্মিতার হাতে। হ্যচকা টানে সে ছুরিটা বের করে আনলো আমার পিঠ থেকে।
তারপর অকল্পনীয় ক্ষিপ্রতায় আবার আঘাত করল আমার পেটে। একরাশ বিস্ময় নিয়ে আমি জ্ঞান হারালাম।
যখন জ্ঞান ফিরল বুঝলাম আমি একটা চেয়ারে বাঁধা। হাত পা টেনে দেখলাম। ছুটানোর উপায় নেই।
লোহার তার দিয়ে খুব শক্ত করে এটে বাঁধা হয়েছে। হাত টানলে বাঁধন আলগা হয় না, বরং তার মাংসে কেটে বসে যাচ্ছে। আমি তারপরও গায়ের জোরে কয়েক বার টানাটানি করলাম। ফল হল না। হাত কেটে রক্ত বের হতে শুরু করল।
“শুধু শুধু নিজেকে কষ্ট দিচ্ছ। এই বাঁধন ছেঁড়ার সাধ্য তোমার নেই। ” সুস্মিতার কন্ঠ। ও ঘরের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে একটা লম্বা ছুরি।
“সুস্মিতা... তুমি... ”
“কি খুব অবাক লাগছে তাই না। হ্যা অবাক হবারই কথা। আমার মধ্যে যে এতো সম্ভাবনা লুকিয়ে ছিল আমি নিজেই জানতাম না। আচ্ছা আমাকে এভাবে দেখে তোমার কেমন লাগছে বলতো নাফিজ। ”
আমার স্নায়ু আর নিতে পারছে না।
সুস্মিতা আমাকে চিনে ফেলেছে। কিন্তু কিভাবে? আমার নিশাচর রুপ দেখে আমাকে নাফিজ হিসেবে চিহ্নিত করা তো অসম্ভব!!
“জানো নাফিজ, ছোটকাল থেকেই আমি বন্দি। কোন কিছুই আমি নিজের মত করতে পারিনি। আমার বাবা মা চেয়েছিলেন ছোট্ট পরীর মত একটা মেয়ে। তাই সারা জীবন আমাকে তারা সেই নিষ্পাপ পরিটি সাজিয়ে রাখতে চেয়েছন।
তারা যখন দেখলেন আমি কোন নিষ্পাপ পরী নই, একটা দানব, তখন কিছুতেই সেটা মেনে নিতে পারলেন না। আমি যখন ছোট তখন আমাদের একটা পোষা টিয়া ছিল। একদিন ওটাকে ধরে নিয়ে আমাদের মাইক্রো-ওয়েভ ওভেনে ঢুকিয়ে দিলাম। পাখিটা কি সুন্দর করে ছটফট করছিল। আমার দেখতে যা মজা লাগছিল।
কিন্তু মা এটা দেখে মহা রাগ করল। আমাকে ঘরে আটকে রাখল। সারা দিন খেতে দিল না। বাবা বাড়ি ফিরলে বাবাকে সব বলে দিল। বাবা বেত দিয়ে আমাকে সেকি মার।
মারের চোটে আমি চোখে অন্ধকার দেখলাম। কিন্তু মারের ভয়ে কি এসব মজা ভুলে থাকা যায় বল? কিছু দিন পরেই আমাদের কাজের বুয়ার গায়ে এক বালতি গরম পানি ঢেলে দিলাম। হিহিহি। । মহিলা গায়ে শাড়ি খুলে মেঝেতে গড়াগড়ি দেয়, আর সেকি চিৎকার।
হিহিহি। মনে পড়লে এখনো হাসি পায়। এবার কিন্তু ফল হল অনেক ভয়াবহ। বাবা আমাকে মারলেন না, বকাও দিলেন না। আমাকে ধরে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে গেলেন।
তারপর দুইটা বছর, দুইটা বছর কি যে কষ্টে গেল। এই ওষুধ-সেই ওষুধ, এই থেরাপি-সেই থেরাপি। আমাকে দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়া হল। বড় বড় ডক্টর আমাকে পরিক্ষা করে দেখল। তারপর একদিন তারা ঘোষণা দিল আমি নাকি ভালো হয়ে গেছি।
বাবা মার ছোট্ট পরী হয়ে গেছি। ঠিক যেমন্টী তারা চাইছিল। কিন্তু আমিজানি আমার ভেতর সেই দানবটা ঠিকই লুকিয়ে ছিল। তারপর এতদিন হয়ে গেল। সব ঠিকঠাক।
আমি ভুলেই গেলাম আমার ভেতরের সেই দানবটার কথা। কিন্তু তারপর ... তারপর দেখা হল তার সাথে। সে... সেই ভয়ঙ্কর সুন্দর... সে আমার উদ্ধার কর্তা, আমার মুক্তিদাতা। সে আঁচরে দিল আমার মুখ। প্রচন্ড যন্ত্রনায় আমি ছটফটিয়ে উঠলাম।
আর জেগে উঠল আমার ভেতরের দেনবটা। সে আমাকে মুক্তি দিয়েছে। আমাকে আবার মিলিত করেছে আমআর অপর সত্ত্বার সাথে। তুমি ভাবতেও পারবে না আমি কতটা ঋণী তার কাছে। ”
আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে সুস্মিতার উন্মাদের প্রলাপ শুনছি।
এই কি সেই মেয়ে যার প্রেমে আমি অন্ধ ছিলাম। আমি নিজেকে বিশ্বাস করতে আপ্রি না। এই সবই একটা দির্ঘ দুঃস্বপ্ন মনে হয়। সুস্মিতা বলে, “জানো আমার ভেতরের ওই দানবটা এখন কি বলছে? বলছে এই ছুরিটা তোমার পেটে ঢুকিয়ে দিতে। চল আমরা খেলাটা শুরু করি।
আমার সাথে পুরো এক সেট কিচেন নাইফ আছে। একটা একটা করে তোমার শরীরে ঢুকিয়ে দেব। কোন ভাইটালে আঘাত করব না। দেখব তুমি কতক্ষণ নিতে পার। সাইমুম দুইবার নিয়েই হেরে গেছে।
তুমি নিশচই ওকে টপকে যেতে পারবে। তুমি না নিশাচর। ”
আমি ঘাড় ফিরিয়ে দেখলাম পাশে আরেকটা চেয়ারে বাঁধা সাইমুমের দেহটা নিথর পরে আছে। ওর পায়ের নিচে একটা কালচে পুকুর তৈরি হয়েছে। সুস্মিতা ছুরি হাতে আমার দিকে এগিয়ে আসছে।
আমি কাতর গলায় বললাম, “সুস্মিতা প্লিজ ... থামো। ”
সহজ ভাবেই সুস্মিতা ওর হাতের ছুরিটা আমার ঘাড়ে ঢুকিয়ে দিল, কলার বোনের ঠিক উপরে। যন্ত্রনায় চিৎকার করে উঠলাম। সুস্মিতা হেসে ফেলল, “এই তো নাফিজ। জোরে আরো জোরে... হ্যা এই তো... তুমি পারবে... তুমি টিকে থাকতে পারবে।
সে আমাকে ভুল বলেনি। সে বলেছিল জগতে কেউ যদি টিকে থাকতে পারে তবে সে হলে তুমি। জানো টিয়া পাখিটা ওভেনে ত্রিশ সেকেন্ডের বেশি বাচেনি। ওই বুয়াটাও মিনিট দশেক দাপাদাপি করে ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল। সাইমুমকেও তো দেখলাম, দুইটা স্ট্যবের বেশি নিতে পারল না।
তুমিই শেষ ভরসা। কিন্তু তুমি পারবে। ”
কথা বলতে বলতেই আরেকটা ছুরি ঢুকিয়ে দিল আমার বুকের পাঁজরের নিচে। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটল। আমার বুক ও আমার মুখ থেকে, একই সাথে।
“ওহ আমি কি ভাইটাল অর্গানে আঘাত করে ফেললাম। তুমিও কি এখন মরে যাবে সাইমুমের মত? বা ওই টিয়া পাখিটার মত?” সুস্মিতা আতঙ্কিত হয়ে উঠল। আমি কিছু বলতে মুখ খুললাম। কিন্তু মুখ দিয়ে আরো রক্ত বেড়িয়ে এল।
“না না না... প্লিজ মরে যেও না... প্লিজ প্লিজ প্লিজ” সুস্মিতা যেন কেঁদে ফেলবে।
এই সময় ঝনঝন শব্দে জানালার কাঁচ ভেঙে পড়ল। জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ল ঝাঁক ঝাঁক কাক। ক্ষিপ্ত কা কা রব তুলে ওরা আক্রমন করল সুস্মিতাকে। সুস্মিতা পাগলের মত শুন্যে ছুরি চালাচ্ছে। কাকগুলোকে তারিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে।
লাভ হচ্ছে না। আঁচরে কামরে ওরা সুস্মিতাকে ব্যতি ব্যস্ত করে তুলছে। ওর শরীর ক্ষত বিক্ষত হয়ে যাচ্ছে।
প্রচন্ড যন্ত্রণা উপেক্ষা করে আমি হ্যচকা টানে চেয়ার থেকে হাত ছুটীয়ে আনলাম। তারপর শান্ত গলায় নির্দেশ দিলাম, “পল, যথেষ্ট হয়েছে।
এবার থাম। ”
সুস্মিতার রক্তাক্ত দেহটা মেঝেতে পরে আছে। ওর অপুর্ব মুখটাকে এখন আর চেনা যাচ্ছে না। আমি কোন শারীরিক যন্ত্রণা উপলব্দধি করছি না। শুধু বুকের ভেতর কেমন যেন একটা শুন্যতা।
আমার আইফোনটা গুঞ্জন করে উঠল। আমি যন্ত্রের মত ফোন
কানে ঠেকালাম। ওপাশ থেকে ক্রূর কণ্ঠস্বর ভেসে এল, “আমাদের দেখা করার সময় হয়েছে। আজিমপুর কবরস্থানে চলে এস। তোমার বাবার কবরের পাশেই আমি অপেক্ষা করছি।
”
কানেকশন কেটে গেল। আজ সারাটা রাত কেউ আমাকে নিয়ে খেলেছে। এখন খেলার অন্তিম অধ্যায়। এই খেলায় শুধু একজনই বেঁচে থাকবে। আমি রওনা হয়ে গেলাম।
***
ঝড়ো হাওয়া বইছে। আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গেছে। কান ফাটানো শব্দে একটা বাজ পড়ল কাছেই কোথাও। ঝর আসতে আর বেশি দেরি নেই। কবরস্থানের কবর গুলোর ফাকে ফাকে শুকণো পাতার ঘূর্ণি শিস দিয়ে উড়ে যাচ্ছে।
বাতাসের শব্দ মনে হচ্ছে একশ অতৃপ্ত প্রেতের সম্মিলিত দির্ঘশ্বাস।
বাবার কবরের পাশেই সে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখেই হাত তুলে আহ্বান জানাল। “এসো নাফিজ। তোমার জন্যেই অপেক্ষা করছি।
”
বিদ্যুৎ চমকে উঠল। সেই আলোয় তাকে দেখতে পেলাম। ক্ষিনিকের জন্যে। কিন্তু একদম স্পস্ট।
নিশাচর।
হ্যা, বাবার কবরের পাশে নিশাচর দাঁড়িয়ে আছে। দেখতে ঠিক আমারই মত। কিন্তু হাজারগুন ভয়ঙ্কর।
নিশাচর কথা বলতে শুরু করে। “তোমার মনে অনেক প্রশ্ন জাগছে।
আমি কে, কেন আমি এসব করছি ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রথমেই আমার পরিচয় দেই। আমি নিশাচর। হ্যা এখন থেকে দুনিয়ায় একটাই নিশাচর। আর সেটা আমি।
তোমার বাবা নুরুল হুদা শুধু তোমার উপর পরিক্ষা চালিয়েই থেমে থাকেননি। তুমি যেই নিটোজেন ফর্মুলাটা নিয়েছিলে ওটা আসলে একটা দুর্বল ভার্সন। নিটোজেনের সত্যিকার ক্ষমতার কোন সীমা নেই। ডক্টর নুরুল হুদা সেই অপার রহস্য উন্মোচন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আর আমি সেই রহস্যের ফসল।
আমিই সত্যিকারের নিশাচর। সম্পুর্ন বিশুদ্ধ নিটোজেন থেকে যার জন্ম। ”
আমি চাপা গলায় বললাম “আমার বাবা তাহলে আত্ম্যহত্যা করেনি?”
নিশাচর বলল, “এর উত্তর হ্যা বা না দুটোই হতে পারে। তিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন। যে কোন স্রষ্টার জন্যেই আমার মত অকল্পনীয় শক্তিশালী একটি সত্ত্বাকে সৃষ্টি করা আসলে এক ধরনের আত্মহত্যা”
“এই সবই তুমি করেছ শুধু আমাকে খুন করতে?”
“তোমাকে আগেই বলেছি আমিই সত্যিকারের নিশাচর।
দুনিয়ায় দ্বিতীয় কোন নিশাচরের অস্তিত্ব থাকতে পারে না। তাই আমি তোমাকে দ্বংস করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। কিন্তু আমি কি তোমাকে শুধু খুন করতে চেয়েছিলাম? না না না। খুন করতে চাইলে আমি সেটা অনেক আগেই করতে পারতাম। তোমার ঘুমন্ত অবস্থায় অনেকবার আমি তোমার ঘরে গিয়েছি।
তুমি আমাকে দেখেছ। ভেবেছ দুঃস্বপ্ন। তোমাকে খুন করতে চাইলে ঘুমের মধ্যে মেরে ফেলা কোন ব্যপার ছিল না। কিন্তু আমি চেয়ে ছিলাম তোমাকে ভেতর থেকে একটু একটু করে মেরে ফেলতে। একটু একটু করে তোমাকে পৃথিবীর বুক থেকে মুছে ফেলতে।
সেই সাথে তোমার চেনা জানা সবাইকে। ”
“কিন্তু ... কিন্তু কেন সুস্মিতা কে...... ??”
“সুস্মিতাই তো ছিল আমার দাবার আসল গুটি। ওকে ছাড়া আমার খেলা অসম্পুর্ন থেকে যেত। ওর মুখে আচর ফেলে ওর ভেতরের ঘমন্ত খুনিটাকে আবার জাগিয়ে তুললাম। আর পর একে একে তোমার জন্যে সুত্র ফেলে গেলাম, ডায়েরি, সেলফোনে অডিও ম্যসেজ।
আর তারপর তুমি যখন বিরের বেশে নায়িকাকে উদ্ধার করতে হাজির হলে... ব্যং... জ্যক পট হা হা হা”
“আমি আশা করি তুমি জানো তুমি কি শুরু করেছ। আজ এই কবরস্থান থেকে আমাদের যে কোন একজন বেঁচে ফিরবে। ”
“হা হা হা আমি তো সে জন্যেই অপেক্ষা করে আছি। এতো কথা বলে আমি হাপিয়ে উঠেছি। এস, গেম শুরু করা যাক”
বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে।
কবরের ধারে আমরা দুজন দাঁড়িয়ে আছি। আমরা দুজন রাতের অশরিরি... আমরা দুই প্রেত... আমরা দুই অশুভ শক্তি...
আর একটু পরেই প্রচন্ড শক্তিতে আমরা একে অপরকে ছিন্ন ভিন্ন করে ফেলব।
প্রকৃতি দম আটকে সেই দৃশ্যের অপেক্ষা করছে।
***
বেঁচে আছি।
এখনো মরিনি।
নিশাচর এক হাতে আমার ক্ষত বিক্ষত দেহটা শুন্যে ঝুলিয়ে রেখেছে। অপর হাতটা ধিরে ধিরে মুঠি পাকাচ্ছে। নিশানা ক্করছে আমার হৃদপিণ্ডের দিকে। জানি এটাই শেষ আঘাত। ওই এক আঘাতেই সে আমার বুকের পাজর ভেঙে হৃদপিণ্ড ছিড়ে নিয়ে আসবে।
নিশাচর মুঠি পাকিয়ে আছে। ও যেন দ্বিধা করছে। ওর চোখে আমি অনিশ্চয়তা দেখতে পারছি। নিজের ভেতরে ও যেন একটা ভীষণ যুদ্ধ করছে।
আমি দুই পায়ে নিশাচরের মাথাটা চেপে ধরলাম।
তারপর শরীরের শেষ বিন্দু শক্তিটুকু এক করে মাথাটা মুচড়ে দিলাম। হাড় ভাঙ্গার বিশ্রি শব্দ হল।
খেলা শেষ। কাদার মধ্যে শুয়ে আমি হাপাচ্ছি। নিশাচরের মৃত দেহটা পরে আছে আমার পায়ের কাছে।
একটু একটু করে ওটার চেহারা বদলে যাচ্ছে। সে তার স্বাভাবিক মানুষ রুপে দিরে আসছে। আমি ক্লান্ত দেহটা কাদা থেকে টেনে তুললাম। বহু কষ্টে নিজেকে টেনে নিয়ে গেলাম নিশাচরের কাছে। ওর পরিবর্তন প্রায় শেষের দিকে।
মানুষটার চেহারা ভীষণ চেনাচেনা লাগছে।
ভীষণ চেনাচেনা!!!
****
আমি বসে আছি আমাদের বাসার ছাদে। আকাশ ভর্তি লক্ষ তারা। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখছি।
বাবা একটা অডিও লগ রেখে গেছে।
আনমনে আমি অডিও লগটা আবার চালু করলাম। এই নিয়ে বোধ হয় ষাট বার এটা শুনছি।
“ নিটোজেনকে বাঁচানোর এছাড়া আর কোন উপায় নেই। আমি আমআর আবিষ্কার ওদের হাতে তুলে দেব না কিছুতেই। এর জন্যে যে কোন ত্যগ আমি সিকার করতে রাজি আছি।
...... সব প্ল্যন মতই এগুচ্ছে। নিটোজেন গবেষণার ফাইনাল স্টেজ সফল হয়েছে...... আমি নিটোজেনকে লুকিয়ে রাখব নিজের ভেতর... নিজের শরীরে... ক্রুজ রেইস কিছুতেই খুঁজে পাবে না। ... আমার মৃত্যুর সব আয়োজন ঠিকঠাক। নিটোজেন ড্রাগ আমার বডীর প্রাইমারি সকল ফাংসান স্লো করে একেবারে মিনিমাল স্তরে নিয়ে যাবে। শরীর চলে যাবে এক দির্ঘ হাইবারনেশনে।
ডাক্তাররা সহজেই আমাকে মৃত্য বলে ভুল করবে। কোন পোস্ট মর্টেম যেন না হয় সে ব্যবস্থা আগেই করা হয়েছে... সব কিছু নির্ভর করছে প্রোপার টাইমং এর উপর। জসিমকে ঠিক রাত দুইটার আগে আমাকে কবর থেকে তুল।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।