' বাংলা চলচ্চিত্র' পচে গেছে । অরুচিকর! জঘন্য ! যতটা জঘন্য তাঁর চেয়েও বেশি জঘন্য রুপে বাংলা চলচ্চিত্রর পচন ছড়িয়ে দিচ্ছেন আমাদের দেশের সুশীলরা । উনাদের কথা শুনে মনে হয় মানুষ টিকেট কেটে হলে যাবে কলেজ , বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো কিছু জ্ঞান আহরণ করতে। সেখানে কোন বিনোদন বা মজা পেতে যাবে কেন? বিনোদন দিতে হবে আবার বিদেশি ছবিগুলোর সাথে প্রতিযোগিতামুলক ও মানসম্পন্ন যেমন - সানী লিওন, ইমরান হাসমি যা করে সেটাই ছবি আমাদের গুলো বস্তাপচা। ভাইরে কার সাথে কারে মেলায় সেটাই চিন্তা করেনা।
যে ছবি বিশ্বের সব বড় বড় শহর গুলোতে প্রদর্শিত হয় সেটা আমার রহিমুদ্দিন আর ফুলবানুর চেয়ে দেখতে ভালো হবে সেটা কেন এই মানুষগুলো বুঝে না। ইদানীং আরেকটা ব্যপার লক্ষ্য করছি যে সবাই বাংলা ছায়াছবির কাহিনী নিয়ে কথা বলে। সবার কাছে বাংলা ছায়াছবির কাহিনী সব একই রকম। মনে মনে হাসি পায় যে এই সুশীল চিন্তাবিদরা জীবনে কয়টি বাংলা সিনেমা দেখেছে তা নিয়ে সন্দেহ আছে। উনাদের যখন ছবি দেখা শুরু আমাদের তখন ছবি দেখার সমাপ্তি।
জীবনের প্রায় দেড় যুগের চেয়েও বেশি সময় বাংলা ছবি আর সিনেমা হলের সাথে কেটেছে। কোনদিন বিনোদন ছাড়া আর কিছু পাবার আশা করে হলে যাই নাই বলে বাংলা চলচ্চিত্র আমাদের নিরাশ করেনি। হয়তো আমরা সুশীল না। সুশীলরা সব সময় পাবলিক টয়লেটে গেলেও সেখান থেকে জ্ঞান নিয়ে বের হওয়ার চেষ্টা করে। তাই হয়তো বাংলা ছবিকে পচানোর স্পর্ধা কোনদিন করিনি ও করবো না।
আমি সুশীল নই, নিতান্ত এক মূর্খ তাই হলিউড এর ৪০০/৫০০ কোটি টাকায় নির্মিত ছবির সাথে আমার বস্তাপচা বাংলা ছবির তুলনা কোনদিন খুজিনা। এমনকি ভারতের ৫০ কোটি টাকার ছবির সাথেও আমার ৫০ লাখের তুলনা করিনা। বিনা বাক্য মেনে নিই তাঁরাই সেরা আমরা পচা। সবসময় নিজের বাংলার মাঝেই খুঁজে ফিরি যা কিছু ভালো আছে সেগুলো। আজ সেইসব বাংলা ছবির মাঝ থেকে অতি সামান্য কিছু উদাহরন দেখাবো যেগুলোর গল্প গতানুগতিক বাংলা ছবির কাহিনী ছিল না।
যে ছবিগুলো এই ডিজিটাল যুগেরও বহু আগের সেই মধ্যযুগের ছবি। সেইসব সুশীলরা আশাকরি বুঝতে পারবে যে নাহ, আমাদের দেশেও গতানুগতিক এর বাহিরে একাধিক ছবি হয়েছিল।
কাহিনিগুলো বলার আগে একজন পরিচালক সমন্ধে যে কথাগুলো না বললে অন্যায় হবে ঃ বাংলা চলচ্চিত্রে সামাজিক অ্যাকশন ছবির এক অন্যরকম রুপকার পরিচালক দেওয়ান নজরুল । 'রংবাজ' ছবিতে পরিচালক জহিরুল হক বাংলাদেশের দর্শকদের অ্যাকশন এর সাথে সর্বপ্রথম পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন সেই 'অ্যাকশন ' ধারাকে প্রতিষ্ঠিত ও জনপ্রিয় করেছেন এই দেওয়ান নজরুল। নজরুল এর ছবি মানেই অন্যরকম অ্যাকশন গল্পে ঠাসা চরম নাটকীয় উত্তেজনায় থাকা দর্শকদের আড়াই ঘণ্টা।
দেওয়ান নজরুল না থাকলে জসিম দুর্দান্ত ভিলেন থেকে গনমানুষের নায়ক হতে পারতেন কিনা জানিনা। এই দেওয়ান নজরুল এর হাত ধরেই বাংলা চলচ্চিত্রের ৭০এর শেষ দিকে জসিম নামক এক দুর্দান্ত ভিলেনের আগমন । যাকে প্রথম দেখায় ভারতের বিখ্যাত অভিনেতা আমজাদ খান প্রশংসা করেছিলেন। 'দোস্ত দুশমন' ছবির সেই ভয়ঙ্কর ডাকু থেকে 'বারুদ' এর গদফাদার যিনি আজিম কে তৈরি করেন অপরাধ জগতের এক ক্ষমতাধর রাজারুপে, 'জনি' ছবির ফেরারি ডাকাত দলের সরদার, 'ওস্তাদ সাগরেদ' ছবির ভয়ংকর কালুগুন্ডা থেকে হয়ে যান 'রকি' নামক এক অন্যায়ের প্রতিবাদি যুবক, চটপটি ওয়ালা থেকে হয়ে যান 'মাস্তান রাজা' আবার কখনও বেবি ট্যাক্সি ড্রাইভার কালু থেকে হয়ে যান 'কালিয়া' যিনি অপরাধ জগতের কিং, আবা
র সেই অপরাধ জগতের কিং হয়ে যান বস্তিবাসী মানুষের 'বাংলার নায়ক' । সবই দেওয়ান নজরুল এর এক একটি অমর সৃষ্টি ।
যারা দেখেছিলেন তাঁরা আজো সেই চরিত্রগুলো ভুলতে পারেননি। 'বারুদ' ছবিটি ছিল সেই সময়ে বিখ্যাত ও কালজয়ী হলিউড মুভি 'গডফাদার' এর বাংলা ভার্শন। যাকে গডফাদার ছবিটিকে বাংলাদেশের দর্শকদের কাছে চমতকারভাবে উপস্থাপন বলা যায়। বাংলা অ্যাকশনধর্মী ছবির মাঝে 'বারুদ' চিরকাল একটা ক্লাসিক হিসেবে ঠাই করে নিয়েছে। দেওয়ান নজরুল ছবির শুরুতেই স্বীকার করেছিলেন ' একটি বিদেশি গল্পের ছায়া অবলম্বনে তৈরি' ।
যে ছবিতে ছিল সেই সময়ের পর্দা কাঁপানো আজিম, সোহেল রানা, ওয়াসিম ও জসিম। যারা সকলেই অপরাধ জগতের বাসিন্দা। পিতা আজিম এর সহযোগী সোহেল রানা ঠিক পিতার মতোই ঝানু অপরাধী , ছোট ভাই ওয়াসিম বিদেশে পড়ালিখা করে দেশে এসেছে । পিতা আজিম চায়না ওয়াসিম অপরাধ জগতে জড়িয়ে পরুক। তাঁর একমাত্র ভরসা বড় ছেলে সোহেল রানা যিনি পিতার সাথে ছায়ার মতো থাকে।
শুরু হয়ে যায় জসিম ও আজিম এর বিচ্ছেদ ও অপরাধ জগতের লড়াই। যেখানে পিতা আজিম এর পক্ষে সোহেল রানা আর বিরুদ্ধে জসিম ও তাঁর বাহিনী। এইরকম টানটান উত্তেজনায় নির্মিত ছিল 'বারুদ'। দেওয়ান নজরুল কোনদিন দর্শকদের নিরাশ করেনি। তাঁর সিনেমা মানেই উপচে পড়া ভিড় আর আড়াই ঘণ্টা শ্বাসরুদ্ধকর উত্তেজনা।
ছবিতে বিনোদনের কোন কমতি ছিলনা, দর্শকদের পয়সা ১৬ আনা উসুল করে দেয়াই ছিল দেওয়ান নজরুল এর লক্ষ্য। বাংলা চলচ্চিত্র যতদিন থাকবে ততদিন বাংলা চলচ্চিত্রে অ্যাকশন ছবির পিতা হিসেবে পরিচালক দেওয়ান নজরুল এর নামটি স্বর্ণাক্ষরে লিখা থাকবে।
ওস্তাদ সাগরেদ ঃ নায়ক সোহেল রানা শহরের একজন নামকরা অপরাধী। তাকে ধরার জন্য সৎ পুলিশ অফিসার আজিম পুরো বাহিনী নিয়ে সোহেল রানার বাড়ি ঘিরে ফেলে। সোহেল রানা স্ত্রী তখন বাড়িতে সন্তান প্রসব যন্ত্রণায় কাতর।
উপায় না দেখে প্রিয় স্ত্রীর মাথায় গুলি ধরে বাড়ি থেকে বের হয় পুলিশের হাত থেকে বেঁচে স্ত্রীকে হাসপাতালে ভর্তি করতে। বাড়ির গেইট থেকে পা রাখার পর স্ত্রীর মাথায় পিস্তল ধরে সব পুলিশকে অস্র ফেলে দিতে বলে। উপায় না দেখে আজিম সবাইকে অস্র নামাতে বলে। এমন সময় আজিম গুলি ছুঁড়লে সোহেল রানার স্ত্রী সোহেল রানাকে পালিয়ে যেতে বলে। সোহেল স্ত্রীকে রেখে পালিয়ে যায়।
পুলিশ ধাওয়া করে সোহেল রানাকে। এমন সময় সোহেল রানার স্ত্রী একটি ছেলে সন্তান প্রসব করে মারা যায় যে সন্তানটিকে পুলিশ অফিসার আজিম এর হাতে তুলে দেয়। আজিম সোহেল এর সেই সন্তানটিকে নিজের সন্তান হিসেবে নিঃসন্তান স্ত্রী আনোয়ারার হাতে তুলে দেয়। সোহেল রানা জানতে পারে তাঁর স্ত্রী ও সন্তান কে মেরে ফেলেছে ঐ পুলিশ অফিসার আজিম। এরপর থেকে সোহেল রানা আজিমের সন্তান কে কিডন্যাপ করার চেষ্টা করে বেশ কয়েকবার কিন্তু ব্যর্থ হয়।
ইতিমদ্ধো জেল থেকে ছাড়া পায় আলমগীর ও ওয়াসিম যারাও অপরাধী ও সোহেল রানার বন্ধু। তিন বন্ধু মিলে প্রতিশোধ নিতে পুলিশ অফিসার আজিম এর ছেলেকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যায় ।
এরপর সেই কিশোর হয়ে যায় তাদের তিনজন এর মন জয় করা এক কিশোর যাকে বাঁচানোর জন্য নিজের জীবন দিয়ে দেয় সোহেল রানা এবং জানতে পারে এই তাঁর সেই ছেলে যে পুলিশ অফিসার এর বাড়িতে পুলিশ অফিসারের পরিচয়ে বড় হচ্ছিল যাকে ভুল করে সোহেল রানা বারবার কিডন্যাপ করতে গিয়েছিল। হত্যা করতে গিয়েছিল ...... এমনই এক দুর্দান্ত গল্পের নাটকীয়তায় পরিপূর্ণ ছবির নাম 'ওস্তাদ সাগরেদ'। যে 'ওস্তাদ' হলো সেই অপহৃত কিশোর আর 'সাগরেদ' হলো সেই তিন অপরাধী।
ছায়াছবি 'জনি' ঃ পরিচালক দেওয়ান নজরুল এর ৮০র দশকের সুপারহিট ছবির নাম 'জনি'। যে ছবির গল্প ছিল এমন - সৎ সাহসী পুলিশ অফিসার আজিম এর ছেলে কিশোর 'জনি' যে কিশোর বয়সেই বখে যায়। পিতা আজিম কে খুব ভয় করতো সে। একদিন স্কুলে না গিয়ে বখাটে বন্ধুদের সাথে তাশ খেলতে শুরু করে। সেখান থেকে এক বন্ধুর সাথে মারামারি যাকে সে পাথর ছুরে আঘাত করে।
পাথরের আঘাতে রক্তাক্ত হয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে সেই ছেলেটি। কিশোর জনি মনে করে সে মারা গেছে, অর্থাৎ সে খুনি, খুন এর শাস্তি ফাঁসী যা সে তাঁর বাবার মুখে অনেকবার শুনেছে। এমনকি একদিন খুনি ডাকাত জসিমের স্ত্রীও কিশোর জনির সামনে তাঁর বাবার কাছে স্বামীকে বাঁচানোর সুপারিশ করতে এলে বাবা আজিম সোজা না করে দেয় এবং বলে যে 'খুন করলে ফাঁসী হবেই ' যা জনির সেই সময় মনে পড়ে। জনি সেদিন বাড়ি ফিরে না গিয়ে ভয়ে বাসে চড়ে ঢাকায় চলে যায়। পিতা আজিম স্কুলে গিয়ে জানতে পারে জনি স্কুলে সেদিন যায়নি।
সেই জনি শহরে গিয়ে আস্রয় পায় পঙ্গু পকেটমার সর্দার আহমেদ শরিফ এর কাছে। শুরু হয় নতুন এক 'জনি'র জীবন। [link|
চাকরির শেষ সময়ে জনির পিতা ঢাকায় বদলি হোন । আজিমের উপর দায়িত্ব পড়ে পেশাদার অপরাধী 'জনি' কে ধরার নির্দেশ। শুরু হয় অন্যরকম এক গল্প যার জন্য সিনেমা হলের দর্শকদের অপেক্ষা করতে হয়েছিল সিনেমা শেষ না হওয়া পর্যন্ত ।
এই ছবিটিও গতানুগতিক পিতৃহত্যার প্রতিশোধ এর কাহিনী থেকে একদম আলাদা এক গল্পের ছবি ছিল যা দেখে দর্শক হয়েছিল তৃপ্ত । ছবির কাহিনীর সাথে আরও ছিল সুর সম্রাট আলম খানের গান
যা দিয়েছিল ছবিটিকে অন্যরকম একটি পূর্ণতা।
আজ এই পর্যন্ত থাক। আবার আসবো অন্য কোন অগতানুগতিক কাহিনীর গল্প নিয়ে। ভালো জিনিস অল্প দেয়া ভালো, নাহলে বদহজম হয়ে যেতে পারে।
এমনিতেই আমাদের বাংলা ছবির উপরে অরুচি তারউপর বেশি দিলে সুশীলদের দেখতে সমস্যা হবে। বিদেশি ছবি দেখার সময় হাতে অনেক কিন্তু দেশি ছবি দেখার সময় সুশীলদের কোথায় ????
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।