সুবলচন্দ্রের ছেলেটির নাম সুশীলচন্দ্র । কিন্তু সকল সময়ে নামের মতো মানুষটি হয় না । সেইজন্যই সুবলচন্দ্র কিছু দুর্বল ছিলেন এবং সুশীলচন্দ্র বড়ো শান্ত ছিলেন না ।
ছেলেটি পাড়াসুদ্ধ লোককে অস্থির করিয়া বেড়াইত , সেইজন্য বাপ মাঝে মাঝে শাসন করিতে ছুটিতেন ; কিন্তু বাপের পায়ে ছিল বাত , আর ছেলেটি হরিণের মতো দৌড়িতে পারিত ; কাজেই কিল চড়-চাপড় সকল সময় ঠিক জায়গায় গিয়া পড়িত না । কিন্তু সুশীলচন্দ্র দৈবাৎ যেদিন ধরা পড়িতেন সেদিন তাঁহার আর রক্ষা থাকিত না ।
আজ শনিবারের দিনে দুটোর সময় স্কুলের ছুটি ছিল , কিন্তু আজ স্কুলে যাইতে সুশীলের কিছুতেই মন উঠিতেছিল না । তাহার অনেকগুলা কারণ ছিল । একে তো আজ স্কুলে ভূগোলের পরীক্ষা , তাহাতে আবার ও পাড়ার বোসেদের বাড়ি আজ সন্ধ্যার সময় বাজি পোড়ানো হইবে । সকাল হইতে সেখানে ধুমধাম চলিতেছে । সুশীলের ইচ্ছা , সেইখানেই আজ দিনটা কাটাইয়া দেয় ।
অনেক ভাবিয়া , শেষকালে স্কুলে যাইবার সময় বিছানায় গিয়া শুইয়া পড়িল । তাহার বাপ সুবল গিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন , “ কী রে , বিছানায় পড়ে আছিস যে । আজ ইস্কুলে যাবি নে ? ”
সুশীল বলিল , “ আমার পেট কামড়াচ্ছে , আজ আমি ইস্কুলে যেতে পারব না । ”
সুবল তাহার মিথ্যা কথা সমস্ত বুঝিতে পারিলেন । মনে মনে বলিলেন , ‘ রোসো , একে আজ জব্দ করতে হবে ।
' এই বলিয়া কহিলেন , “ পেট কামড়াচ্ছে ? তবে আর তোর কোথাও গিয়ে কাজ নেই । বোসেদের বাড়ি বাজি দেখতে হরিকে একলাই পাঠিয়ে দেব এখন । তোর জন্যে আজ লজঞ্জুস কিনে রেখেছিলুম , সেও আজ খেয়ে কাজ নেই । তুই এখানে চুপ করে পড়ে থাক, আমি খানিকটা পাঁচন তৈরি করে নিয়ে আসি । '
এই বলিয়া তাহার ঘরে শিকল দিয়া সুবলচন্দ্র খুব তিতো পাঁচন তৈয়ার করিয়া আনিতে গেলেন ।
সুশীল মহা মুশকিলে পড়িয়া গেল । লজঞ্জুস সে যেমন ভালোবাসিত পাঁচন খাইতে হইলে তাহার তেমনি সর্বনাশ বোধ হইত । ও দিকে আবার বোসেদের বাড়ি যাইবার জন্য কাল রাত হইতে তাহার মন ছট্ফট্ করিতেছে , তাহাও বুঝি বন্ধ হইল ।
সুবলবাবু যখন খুব বড়ো এক বাটি পাঁচন লইয়া ঘরে ঢুকিলেন সুশীল বিছানা হইতে ধড়্ ফড়্ করিয়া উঠিয়া বলিল , “ আমার পেট কামড়ানো একেবারে সেরে গেছে , আমি আজ ইস্কুলে যাব । ”
বাবা বলিলেন , “ না না , সে কাজ নেই , তুই পাঁচন খেয়ে এইখানে চুপচাপ করে শুয়ে থাক্ ।
” এই বলিয়া তাহাকে জোর করিয়া পাঁচন খাওয়াইয়া ঘরে তালা লাগাইয়া বাহির হইয়া গেলেন ।
সুশীল বিছানায় পড়িয়া কাঁদিতে কাঁদিতে সমস্তদিন ধরিয়া কেবল মনে করিতে লাগিল যে , ‘ আহা , যদি কালই আমার বাবার মতো বয়স হয় , আমি যা ইচ্ছা তাই করতে পারি , আমাকে কেউ বন্ধ করে রাখতে পারে না । '
তাহার বাপ সুবলবাবু বাহিরে একলা বসিয়া বসিয়া ভাবিতে লাগিলেন যে , ‘ আমার বাপ মা আমাকে বড়ো বেশি আদর দিতেন বলেই তো আমার ভালোরকম পড়াশুনো কিছু হল না । আহা , আমার যদি সেই ছেলেবেলা ফিরে পাই, তা হলে আর কিছুতেই সময় নষ্ট না করে কেবল পড়াশনো করে নিই । '
ইচ্ছাঠাকরুন সেই সময় ঘরের বাহির দিয়া যাইতেছিলেন ।
তিনি বাপের ও ছেলের মনের ইচ্ছা জানিতে পারিয়া ভাবিলেন , আচ্ছা, ভালো , কিছুদিন ইহাদের ইচ্ছা পূর্ণ করিয়াই দেখা যাক ।
-রবীন্দ্রনাথ ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।