সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য টিভি সিরিয়ালের কল্যাণে আমরা অনেকেই সামুরাই যোদ্ধাদের কথা জানি। ৯০০ সালের দিকে উদ্ভব হওয়া জাপানের এই সামরিক শ্রেণীর অন্যতম মারণাস্ত্র ছিলো সামুরাই সোর্ড (জাপানি ভাষায় ‘কাতানা’ হিসেবে পরিচিত), যা আজও তাদের বিলুপ্তপ্রায় গোত্রের শৌর্য-বীর্যের পরিচয় বহন করে। মারণ ক্ষমতা সম্পন্ন ধাঁরালো বাঁক অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। এই বক্রতার কারণে খাপ থেকে তলোয়ার বের করা এবং শত্রুকে আরও কার্যকর উপায়ে আক্রমণ করা সম্ভব হয়।
কিন্তু কিভাবে তারা সে সময়ে এমন তলোয়ার তৈরি করতে সক্ষম হলো?
সে সময়ে জাপানের লোহার আকরিকের মান তেমন ভাল ছিল না।
কামারেরা ‘তাতানা’ নামক এক বিশেষ মাটির তৈরি ফার্নেস তৈরি করতো। এরপর বিভিন্ন আকরিক থেকে লোহা সংগ্রহ করে কাঠকয়লার সাহায্যে তিন দিন ধরে আগুনে উত্তপ্ত করতো। চার-পাঁচ জন লোক দিন-রাত ধরে এ কাজ সম্পন্ন করতো। এতে তৈরি হতো ‘রত্ন স্টিল’ নামক স্টিল যা জাপানি ভাষায় ‘তামাহাগানে’ ('তামানে' অর্থ রত্ন এবং 'হাগানে' অর্থ স্টিল) নামে পরিচিত। এই প্রক্রিয়ায় লোহাকে গলানো হতো না এবং বাইরের দিকে বেশি এবং ভেতরের দিকে কম কার্বনবিশিষ্ট লোহা তৈরি হতো।
৯ টন লোহা এবং ১১ টন কাঠকয়লা থেকে ১ টনেরও কিছু কম স্টিল তৈরি হতো।
কামারেরা এরপর এখান থেকে উচ্চ ও নিম্ন কার্বনবিশিষ্ট স্টিলকে আলাদা করতো। কিভাবে? বেশি কার্বন থাকলে তা হবে ভঙ্গুর, ফলে সহজেই ভেঙে যেতো। আর কম কার্বন থাকলে তা সহজে ভাঙ্গা যেতো না। এছাড়া বেশি কার্বন থাকলে তা উজ্জ্বলতর হয়।
কম কার্বনবিশিষ্ট স্টিল (কোর স্টিল) ব্যবহার হতো তলোয়ারের ভেতরের অংশ তৈরিতে। আর বেশি কার্বনবিশিষ্ট স্টিলকে (স্কিন স্টিল) পর্যায়ক্রমিক স্তরবিন্যাস করে উচ্চতাপে পিটিয়ে নেয়া হতো। এই পেটানোর ফলে ধাতুমল খসে যেতো এবং যথেষ্ট গরম হওয়ায় কার্বন যেখানে বেশি সেখান থেকে অন্যান্য স্থানে ছড়িয়ে পড়তো। এটি বুঝা যেতো স্টিল পেটানোর ফলে কতটুকু বেঁকে যাচ্ছে তা দেখে। বারবার গরম করে পেটানোর ফলে এটি একই সাথে শক্ত ও নমনীয় হতো।
এরপর স্কিন স্টিলকে পিটিয়ে ইউ আকৃতিতে নেয়া হতো এবং কোর স্টিলকে গরম করে এর মাঝে স্থাপন করানো হতো। ফলে বাইরে থাকলো কাটতে সক্ষম কঠিন স্টিল এবং ভেতরে রইলো প্রতিপক্ষের আঘাতে যাতে ভেঙে না যায় তার জন্য সহনশীল স্টিল। এরপর একে ক্রমাগত পেটানো হতো এবং ভাঁজ করা হতো (লম্বালম্বি অথবা আড়াআড়ি), সাধারণত ১৬ বার। এতে করে বাইরের কার্বন ভেতরের দিকে যেতে পারতো এবং স্টিলের ভেতর প্রায় ১ লাখ স্তর সৃষ্টি হতো কার্বনের ভিন্নতার কারণে। শেষের ভাঁজগুলোর সময়, এই প্রক্রিয়ায় তৈরি কয়েকটি পাতলা শিট তাদের পেটানোর দিক অনুসারে পর্যায়ক্রমিকভাবে একটির উপর আরেকটি বসিয়ে তারপর আবার আগের পদ্ধতির পুনরাবৃত্তি করা হতো।
প্রতিবার ভাঁজ ও গরম করে পেটানোর পর একে কাঁদাপানি ও ছাই এর মিশ্রণ দিয়ে ঢেকে দেয়া হতো যাতে অক্সিজেন ও কার্বন স্টিলে ঢুকতে না পারে। এছাড়া এই মিশ্রণ ঐ নিম্নমানের লোহাকে পরিশোধিত করতে সাহায্য করতো।
পরবর্তীকালে, সামুরাই সোর্ডের আধুনিকীকরণে আরও উন্নতমানের স্তরবিন্যাস অবলম্বন করা হয়। এতে কঠিন থেকে নমনীয়, বিভিন্ন মাত্রার স্টিল কে বিভিন্ন নকশায় সাজিয়ে প্রস্তুত করা হয়।
এখন এই তলোয়ারের উপর কাঁদাপানি এবং কাঠকয়লার একটি গোপন মিশ্রণের প্রলেপ দেয়া হতো।
তবে ধারের দিকে দেয়া হতো না অথবা খুবই পাতলা প্রলেপ দেয়া হতো। তারপর একে খুবই সতর্কতার সাথে নির্দিষ্ট তাপে উত্তপ্ত করা হতো। কতটুকু গরম হলো তা বোঝা যেতো স্টিলের রং দেখে। কমলা রং আসলে একে দ্রুত পানিতে চুবিয়ে দেয়া হতো। প্রলেপের ভিন্নতার কারণে ধারের দিকে দ্রুত ঠান্ডা হতো এবং বাকি অংশ ঠান্ডা হতো ক্রমান্বয়ে।
ঠান্ডা হওয়ার ভিন্নতার কারণে বাইরের ধারালো দিকের প্রসারণ এবং ধীরে ঠান্ডা হওয়া বাকি অংশের সংকোচন ঘটতো। এরই ফলে তলোয়ারে বাঁকের সৃষ্টি হতো। এছাড়াও এই পর্যায়ক্রমিক ঠান্ডা হওয়ার ফলে রঙের ভিন্নতার মাধ্যমে একটি বিশেষ লাইন (যা জাপানি ভাষায় ‘হ্যামন’ নামে পরিচিত) সৃষ্টি হতো। এই লাইনের ধরণ নির্ভর করে কিভাবে ঐ প্রলেপ দেয়া হয়েছিলো তার উপর এবং এটি একজন কারিগরের ব্যক্তিগত দক্ষতা ও নৈপুণ্যের সাক্ষ্য বহন করে।
সবশেষে এটি প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে পর্যায়ক্রমে সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর পৃষ্ঠবিশিষ্ট পাথরের দ্বারা ঘষা হতো।
ফলে এটি হতো আয়নার মতো মসৃণ, চকচকে আর মারাত্মক ধাঁরালো। মজুদ করে রাখার ক্ষেত্রে, এসব তলোয়ার খাপের ভেতরে এমনভাবে সাজিয়ে রাখা হতো যাতে ধাঁরালো দিকটি উপরের দিকে মুখ করে থাকে। অনেকদিন রেখে দেয়া থাকলে নিয়মিত তা পরিদর্শন করা হতো, যাতে এতে মরিচা ধরতে না পারে। আর ব্যবহারকারিও নিয়মিত এর যত্ন নিতো যাতে ধাঁর এবং সৌন্দর্য অক্ষুন্ন থাকে। এই তলোয়ার ছিল একই সাথে তার আত্মরক্ষার অবলম্বন এবং গৌরবের প্রতীক।
একটি তলোয়ার তৈরি করতে লেগে যেতো ছয় মাস পর্যন্ত সময়। সে সময়ে তলোয়ারের মান পরীক্ষা করা হতো মৃতদেহ অথবা অপরাধীদের শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে। এটি সহজেই এক কোপে একজনকে দ্বিখন্ডিত করতে সক্ষম। একটি তলোয়ার একবারে এক বা একাধিক দেহ ভেদ করতে পারলে সেটি ভাল মানের বলে গণ্য করা হতো।
বর্তমানে যুদ্ধে এর ব্যবহার না থাকলেও জাপানি সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং প্রাচীন নিদর্শন হিসেবে এর মূল্য অনেক।
সৌখিন ও বিলাসি সংগ্রহকারিরা এগুলো কিনে থাকেন হাজার হতে লক্ষ ডলার দিয়ে।
আজ হতে হাজার বছর আগে কিভাবে সেই জাপানি কারিগরেরা এত উচ্চমানের অস্ত্র তৈরির ধারণা পেল, তা আসলেই বিস্ময়ের ব্যাপার। ধারণা করা হয়, তারা ভাঁজ করে স্তর সৃষ্টির ধারণা পেয়েছিল গাছের গুঁড়ির মাঝ বরাবর তার আয়ুরেখা লক্ষ্য করে। প্রতি বছরে একটি স্তরের সৃষ্টির মাধ্যমে গাছ যেমন অটল দাঁড়িয়ে থাকে, তেমনি সামুরাই সোর্ডের ভাঁজগুলো তার মজবুত কাঠামো ও স্থায়িত্ব দান করে।
আমরা আজ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রসরতার কল্যাণে জানতে পেরেছি কোনটি ‘কেন হয়’।
এখন হয়তো আরও সহজে, কম সময়ে এবং ব্যাপকহারে এরকম বা এর চেয়েও ভাল জিনিস তৈরি করতে পারব। আর সে সময়ের কারিগরেরা শুধু জানত ‘কি হয়’ এবং তা দিয়েই তাদের প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম হয়েছিল। হয়তো সবকিছু জানাটাই একজন প্রকৌশলীর আসল বৈশিষ্ট্য নয়, বরং তার কাছে যা আছে তা দিয়ে চাহিদা পূরণ করতে পারাতেই আছে আসল স্বার্থকতা।
(তথ্যসূত্র: ইন্টারনেট)
(বি.দ্র: এটি আমার প্রথম লেখা, যেকোনো ভুল ও আনাড়িপনার জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত ) ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।