নাজমুল ইসলাম মকবুল
নোবেল প্রাইজ ও আন্তর্জাতিক গুম দিবস
নাজমুল ইসলাম মকবুল
আজ ৩০ অক্টোবর আন্তর্জাতিক গুম দিবস। এই গুম শব্দটি শুনলে ভয়ে লোমকুপগুলো যে কারো খাড়া না হওয়াটাই আশ্চর্যের বিষয়। আতকে উঠে ঘুম নিদ্রাও যেন পালাতে থাকে অনেকেরই। তবে যারা এই লোমহর্ষক কাজের সাথে জড়িত এবং যারা নেপথ্যে থেকে কাজটি আঞ্জাম দিতে রসদ সরবরাহসহ সব ধরনের সহযোগিতা করেন তাদের হয়ত গুমে ঘুম হয় অনায়াসে। হয়তো সুখনিদ্রায়ও ভুগেন।
আন্তর্জাতিক গুম দিবসে আমার দেশ’র প্রথম পাতায় প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী আওয়ামী লীগ সরকারের পৌনে চার বছরে বিএনপির কেন্দ্রীয় দুই নেতাসহ দেড় শতাধিক ব্যক্তি গুম ও গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছেন। আতকে উঠার মতো খবর ও ঘটনা হলেও ভাব সাব দেখে মনে হচ্ছে এতে গুণধর সরকারের একটি পশমও নড়ছেনা। পরম সুখনিদ্রায় যেন আচ্ছন্ন তারা। তবে যে সকল মায়ের বুক খালি করে তাদের আদরের সন্তানদেরকে নিয়ে গুম করে তৃপ্তির ঢেকুর তোলা হচ্ছে বা হয়েছে সেসকল মায়েরাই অনুধাবন করছেন তাদের বুকের কি ধন হারালেন। অনেক মা বিলাপ করে করেই কাটাচ্ছেন বাকী জিন্দেগী।
আবার অনেক মায়ের কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানিও যেন শুকিয়ে গেছে। কেহবা হয়ে গেছেন পাথরের মতো। যাদের স্ত্রী সন্তান রয়েছেন তাদেরও দিন কাটছে আহাজারি আর রুনাজারিতে। বাচ্চারা আব্বুর আদর থেকে বঞ্চিত হয়ে শুধু কাঁদছে আর আহাজারি করে ফরিয়াদ জানাচ্ছে মহান রাব্বুল আলামীনের দরবারে।
সবচেয়ে আবেগময় একটি আবেদন জানিয়েছিল গুম হওয়া বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এম.ইলিয়াস আলীর ছয় বছরের ছোট্ট মেয়ে সাইয়ারা নাওয়াল স্বজন হারানোর বেদনা অনুধাবনকারী মহানুভব প্রধানমন্ত্রীর কাছে।
তার জন্মদিনে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেগময় যে নিবেদনটি করেছিল তা হচ্ছে, ‘‘আমার আব্বু আমার জন্মদিনে অনেক উপহার সামগ্রী এনে দিতেন। অনেক আনন্দ করতেন। আমার জন্মদিনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমি একটি উপহার চাই। আর সে উপহারটি হচ্ছে আমার জন্মদিনে আপনি আমার আব্বুকে উপহার দিন। ’’ সেই চিঠিটি দেশ বিদেশের প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াতে ব্যাপক প্রচার হলে বিবেকবানদের অন্তরে প্রবল বেগে ঝাঁকুনি দিলেও প্রধামন্ত্রীর অন্তরে ঝাকুনি দিয়েছিল কিনা তা দেখার সাধ্য হয়তো হয়নি কারও।
প্রধানমন্ত্রীর সাথে এম.ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর লুনাসহ পরিবারের সদস্যরা যখন সাাত করেছিলেন তখন তাদেরকে আশ্বাস দেয়া হয়েছিল রাজনীতি থেকে মানবতা অনেক বড়ো। তাকে খুঁজে বের করে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেবার বুক ভরা আশ্বাসও নাকি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই মানবতার নজির আজও দেখার সুযোগ হলোনা তাদের। এম.ইলিয়াস আলীর গর্ভধারিনী মা সুর্যবান বিবি জায়নামাজে বসে পুত্রকে ফিরে পাবার আশায় আহাজারি করে কাঁদলেও সরকারের তরফ হতে ওই কান্নারতো মা'কে কী শান্তনা দেয়া হয়েছে তা জানতে পারেনি জনগন। বিশ্বনাথের বৃহত্তম ঈদগাহ ময়দান ঐতিহাসিক রামধানা ঈদগাহ ময়দানে এবারে মুতাওয়াল্লীবিহীন ঈদের জামাত আদায় করলেন তাঁর এলাকার জনসাধারন।
তাঁরা ঈদের দিনে হাসি খুশি আনন্দের বদলে তাদের ঈদগাহ ময়দানের প্রতিষ্ঠাতা ও মুতাওয়াল্লী এম.ইলিয়াস আলীকে ফিরে পাবার জন্য মহান আল্লাহর দরবারে হাত তুলে মুনাজাত করে কেঁদে কেঁদে বুক ভাসিয়ে ঈদ উদযাপন করলেন।
সবচেয়ে দুশ্চিন্তার বিষয় হলো, দেশে গুম খুন নির্যাতনের যে ভয়াবহ তান্ডব চলছে তাতে অমানিশার কালোমেঘের ঘনঘটাই শুধু দেখা যাচ্ছে। কে কখন কোথায় গুম খুন নির্যাতনের শিকার হবে তার কোন ঠিক ঠিকানা নেই। এক অজানা ভয় ও আতংকে মানুষের রক্ত যেন হিম হয়ে যাচ্ছে। এমনি অবস্থায় বিরোধী দলের নেতা কর্মীদেরও যেন দেয়ালে পিট ঠেকে গেছে।
তারা ােভে দুঃখে তাদের বক্তব্যে বলছেন এম.ইলিয়াস আলী গুমের বদলা নেয়া হবে। কেহবা বলছেন বিএনপি সরকার মতায় এলে যারাই তাকে গুম করেছে তারাই গুম হবে। কেহবা আবার আবেগ সংবরন করতে না পেরে বলছেন আওয়ামী লীগ সরকারই গুম হবে। এ অবস্থায় দেশের মানুষ শান্তিতে বেঁচে থাকার অধিকার আজ কারা কেড়ে নিল বা নিচ্ছে তা খুজে বের করে দেখার গরজ অনুভব করা হচ্ছে বলেও মনে হচ্ছেনা।
আমার দেশ’র ৩০ আগস্টের রিপোর্টে আরও উল্লেখ করা হয়েছে ‘‘দুই বছর পার হলেও বিএনপি নেতা ৫৬ নম্বর ওয়ার্ড কমিশনার চৌধুরী আলমের খোঁজ মিলেনি।
একইভাবে গুম হলেন বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক, সাবেক এমপি এম ইলিয়াস আলী। গুম হয়েছেন তার গাড়িচালক আনসার আলীও। খোঁজ নেই দফতরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিতের এপিএসের গাড়িচালক আজম ও তার পরিবারের। একের পর এক গুমের ঘটনায় জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে। এছাড়াও গুমের তালিকায় রয়েছেন ছাত্রদল, যুবদল, শিবির নেতা, ব্যবসায়ী, জনপ্রতিনিধি ও বিরোধী মতের মানুষ।
এ তালিকায় আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের কয়েকজন নেতাও রয়েছেন। গুম হওয়ার পর কারও লাশ পাওয়া যায় নদীতে, ডোবায়, জঙ্গলে ও ঝোপের মাঝে। তবে অনেকেরই খোঁজ পাওয়া যায়নি।
বিশিষ্টজনরা বলেন, বর্তমান সরকার মতায় আসার পর থেকে দেশ থেকে মানবাধিকার উঠে গেছে। মানুষের বেঁচে থাকারও অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে।
ক্রসফায়ার, অ্যানকাউন্টার ও বন্দুকযুদ্ধসহ নানা নামে চলছে মানুষ হত্যা। র্যাব-পুলিশ পরিচয়ে তুলে নেয়ার পর মাসের পর মাস, বছরের পর বছর গেলেও গুম হওয়া ব্যক্তির হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। এ অবস্থায় দেশে মানবাধিকারের বাণী এখন নিভৃতে কাঁদছে। গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনরা রয়েছেন চরম উদ্বেগে। প্রতিবাদের ভাষা নেই।
প্রতিবাদ করলে গুম হওয়ার আতঙ্কে আতঙ্কিত তারা।
জানা যায়, ল্যাটিন আমেরিকার বেসরকারি সংস্থা ফেডারেশন অব অ্যাসোসিয়েশন ফর রিলেটিভস অব ডিটেইন্ড ডিসঅ্যাপিয়ার্ড এর উদ্যোগে গুম দিবসের সূচনা হয়েছিল। গোপন গ্রেফতার ও গুমের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ১৯৮১ সালে কোস্টারিকায় তৈরি হয়েছিল এই সংগঠনটি। তখন ল্যাটিন আমেরিকার কয়েকটি দেশে প্রতিনিয়তই গোপনে গ্রেফতার করে বিভিন্ন ব্যক্তিকে গুম করা হতো। একইভাবে এখন বাংলাদেশেও গুমের ঘটনায় উদ্বেগ জানাচ্ছে দেশের এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো।
কিন্তু আন্তর্জাতিক সংস্থার চাপের মুখেও থেমে নেই গুম, গুপ্তহত্যা।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এক প্রতিবেদনে বলেছে, দেশ-বিদেশে সমালোচনার মুখে বাংলাদেশে র্যাবের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটনা কমলেও গুমের ঘটনা অনেক বেড়েছে। বিচারবহির্ভূত হত্যা ও নিরাপত্তা হেফাজতে নির্যাতন তদন্ত ও বিচারে বাংলাদেশ সরকার উল্লেখযোগ্য পদপে নেয়নি বলেও মনে করে নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থাটি। প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ধরে নিয়ে গিয়ে গুম করার ঘটনা অনেক বেড়ে গেছে। নিরাপত্তা সংস্থাগুলো এক ধরনের নির্যাতনের বদলে অন্য ধরনের নির্যাতন চালাচ্ছে এমন উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে।
’’
দেশের মানুষকে অশান্তিতে ডুবিয়ে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার ছিনিয়ে এনে নোবেলের সংখ্যা এক থেকে দুইয়ে উন্নীত করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর পে ব্যাপক আন্তর্জাতিক লবিং করেও বিফল হতে হয় বলে পত্র পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। নোবেল বিজয়ী ড. ইউনুস সাহেব নোবেল পেয়ে সম্মানিত হয়ে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের সুনাম বৃদ্ধি করায় কেহ কেহ তাকে বাঁকা চোখে দেখে মনের ঝাল নিবারন করার দুর্ভাগ্যজনক সংবাদও পত্র পত্রিকায় পড়তে হয়েছে দেশবাসীকে। শেষ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক গুম দিবসে গুম কার্যক্রমে বিশ্ববাসীকে পেছনে ফেলে দিয়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার তকমা অর্জন করে এর জন্য কোন ধরনের নোবেল পাওয়া যায় কিনা তার কুশেষ যেন চলছে, অবস্থাদৃষ্টে তাই যেন মনে হয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।