আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মাদকের নেশায় মরছে মানুষ

কথা সাহিত্যিক শরৎবাবুর উপন্যাসের নায়ক দেবদাস মদ ধরেছিল পারুর প্রেমে পাগল হয়ে,পারুকে না পাওয়ার বেদনায়। একটু শান্তির খোঁজে কুহেলিকায় আচ্ছন্ন মরীচিকার পেছনে ছুটছিল সে। পরিনতিতে মদ তাকে আষ্ট্রেপৃষ্ঠে জড়িয়ে সর্বশান্ত করে শেষ পর্যন্ত মেরেই ফেলল। এভাবে প্রেমে ব্যর্থ হয়ে,নয়তো পারিবারিক নানা হতাশা ও অশান্তির কারনে অনেকে মদির সুরায় আকন্ঠ ডুবে নিজেকে তিলে তিলে নি:শ্বেষ করে ফেলে। মাদক-নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্যে জানা গেল আমাদের এই ক্ষুদ্র দেশটিতে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৫০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে।

এটি একটি মারাত্মক দু:সংবাদ,যা সমাজের ভিত নাড়িয়ে দিতে পারে। এমনকি সামাজিক ব্যাধিতে পরিনত করতে পারে। আরও ভয়ানক সত্য হল,এই মাদকাসক্তের ৯০%কিশোর-কিশোরী ও যুবক-যুবতী,যারা কিনা দেশের ভবিষ্যৎ কর্ণধার । ফুলের মত এ নিষ্পাপ কিশোর-কিশোরীরা এ বয়সে স্কুলে যাবে,পড়াশুনা করবে,হাসবে,খেলবে কিংবা সাংস্কৃতিক নানা কর্মকান্ডে অংশ নিয়ে মানসিক ও শারীরিক দিক দিয়ে নিজেদেরকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলবে। কিন্তু আজ আমরা কি দেখছি চারদিকে?সুন্দরভাবে বিকশিত হবার বদলে কেবল আত্মহননের পথে উন্মত্তের মত ছুটছে ওরা।

মাঝে মাঝে গভীর রাতে লঞ্চ-টার্মিনাল বা বাস-স্ট্যান্ডে গেলে দেখা যায় -- ছোট ছোট কিশোর যারা টোকাই বা ভিক্ষুক নামে পরিচিত , তারা পলিথিনের মধ্যে স্পিরিট-মিশ্রিত জুতার গাম বা সলিউশন ভরে নেশার জন্য টানছে। কলেজ ও ইউনিভার্সিটিতে পড়া যুবক-যুবতীরা তো চপলতার বয়স কিছুটা পেরিয়ে এসেছে,উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হবার মানসে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। ভাল-মন্দ বিচারের ক্ষমতা এদের যথেষ্ট আছে, এদের অনেকে কেন বই ছেড়ে মাদকের পেছনে ছুটছে?কারন অনেক, তবে মুখ্য কারন হচ্ছে বহিরাগত কিছু দুবৃত্ত মাদক-ব্যবসায়িদের প্রলোভনের জালে জড়িয়ে নেশাগ্রস্ত হওয়া এবং অবৈধ মাদক-ব্যবসা করে অল্প সময়ের মধ্যে অতিরিক্ত মুনাফা করে সম্পদশালী হওয়া। একটি পরিসংখ্যানে জানা গেছে ,গোটা বিশ্বে বছরে মাদক-ব্যবসায় ৩২০ বিলিয়ন ডলার মুনাফা হয়। , দ্বিতীয়ত: ব্যক্তি-স্বাধীনতা বোধও মানুষের মধ্যে ইদানীং এতই মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে যে , কেউ আর আজ যৌথ পরিবারে থাকতে রাজী নয়।

তাছাড়া আজকাল প্রায় প্রতিটি পরিবারের বাবা-মা দুজনই কর্মজীবী হওয়ায় তাদের সন্তানেরা প্রায়ই একাকীত্বে ভোগে। এই একাকীত্ব কখনও কখনও তাদের মধ্যে হতাশার জন্ম দেয়,টাকার বিছানায় শুয়ে থেকেও এরা সুখ পায়না,শান্তির খোঁজে সহজেই এরা অসৎ-সংগে জড়িয়ে পড়ে। সিগারেট দিয়ে যাত্রা শুরু করে ,ধীরে ধীরে হিরোইন,গাঁজা,মদ,ইয়াবায় আসক্ত হয়ে পড়ে। যৌথ পরিবারে থাকলে হয়তো এমনটা নাও ঘটতে পারতো। আরও একটা চমকপ্রদ তথ্য হল,এই নেশাগ্রস্তদের মধ্যে সর্বাধিক সংখ্যাধারীরা নাকি ধনাঢ্য পরিবারের আলালের দুলাল,অর্থাৎ এদের জন্মদাতারা কেউ শিল্পপতি,কেউ মাদক-ব্যবসায়ি,কেউ বা সরকারি শীর্ষ-পর্যায়ের কর্মকর্তা।

কি সার্থক বাবা-মা এরা!অবৈধ উপায়ে টাকার পাহাড় জমিয়ে তুলেছেন,কিন্তু সন্তান কোন পথে যাচ্ছে,কোন তদারকি নাই ,অথবা দেখেও না দেখার ভাণ করেন,আর এটাকেই আভিজাত্য মনে করেন। যদি কোন স্কুল কর্তৃপক্ষ এই মাদকাসক্তের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে যান,উল্টে অভিভাবকদের হুমকির মুখে চুপসে যান তারা। বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে সন্ধ্যার পর যেন মাদকাসক্তের মেলা বসে। ছাত্র-ছাত্রীদের সবচেয়ে বেশি অংশ সিগারেটে আসক্ত হয়ে পড়েছে। তবে এদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আসক্ত হয়ে পড়ে গাঁজা ,মদ,ইয়াবা ,ফেনসিডিল ও হিরোইনে ।

ঘুমের ওষুধের সংগে কিংবা সিগারেটের মধ্যে এসব নেশার দ্রব্য মিশিয়ে এখানে দেদারসে বেচাকেনা চলছে। আরও জানা গেছে এদেরকে নেশাগ্রস্ত করার পেছনে বহিরাগত একটি শক্তিশালী চক্র সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে । নেশাগ্রস্ত ছাত্র-ছাত্রীরা রাজনৈতিক পরিচয়ের দাপটে প্রকাশ্যে মাদকদ্রব্য গ্রহণ করে চলেছে,ফলে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা এতই অসহায় যে ,এদের কিছুই বলতে সাহস পাচ্ছেনা। আজিমপুর কলোনীর ভিতরে ইডেন কলেজের কিছু কুখ্যাত ছাত্রীদের তাদের প্রেমিকের সাথে প্রকাশ্যে ধূমপান করতেও দেখা গেছে । গুলশান এলাকা আভিজাত্যের গরবে গরবিনী।

সেখানকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়,কলেজ,ও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের বেশির ভাগ ছাত্র-ছাত্রীরা ইয়াবায় আসক্ত। তারা এগুলো নিজেরা যেমন গ্রহণ করে,তেমনি অন্যদের কাছে বিক্রিও করে থাকে। আবার এটাও দেখা যায় কোন কোন নেশাগ্রস্তদের যখন পকেট খালি হয়ে যায়,তখন টাকার ধান্ধায় রাস্তায় নামে পকেট মারতে বা ছিনতাই করতে। এই হল সামাজিক অবক্ষয়ের হাল আমলের মাদকতার ভয়াবহ চিত্র!তাই কথা সাহিত্যিক শংকর বলেছেন,”মাদকের মধ্যে ভীরু সাহস খোঁজে,দুর্বল শক্তি খোঁজে,দু:খী সুখ খোঁজে,কিন্তু অধ:পতন ছাড়া কিছুই পায়না। চিকিৎসকদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য রীতিমত লোমহর্ষক ও ভয়াবহ।

তারা জানিয়েছেন,হেরোইনসহ যে কোন নেশা মানবদেহের ফুসফুস,কিডনী ও লিভার দ্রুত নষ্ট করে ফেলে,মস্তিষ্ক ও স্মৃতিশক্তি হ্রাস করে ফেলে। শরীরের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। ফলে মৃত্যুই হয় তাদের অনিবার্য পরিণতি। নেশাগ্রস্ত মায়েরা বিকলাংগ ও প্রতিবন্ধী শিশুর জন্ম দিয়ে সমাজকেও পঙ্গু করে ফেলে। গর্ভপাতের আশংকাও দ্রুত বৃদ্ধি পায়।

শুধু তাই নয়,নারীদের সন্তান-ধারন ক্ষমতাও চিরতরে নষ্ট হয়ে যায়। আর মাদকাশক্তির কারনে দাম্পত্য-কলহ বেড়ে যায়,যার সমাপ্তি ঘটে সংসার ভাঙার মধ্য দিয়ে। বিশেজ্ঞরা বলেছেন প্রায় ৯০% সংসার ভাঙছে এই ভয়াবহ মাদকের কারনে। বাংলাদেশ মুসলিম প্রধান দেশ। এখানে মদ খাওয়ার ব্যাপারে ধর্মীয় নিষেদাজ্ঞ রয়েছে।

শীত প্রধান দেশে শরীরের তাপ ঠিক রাখার জন্য মদ খাওয়া অনেকটা অপরিহার্য ব্যাপার,তাই মদে তাদের তেমন একটা ক্ষতি করেনা। কিন্তু আমাদের মত নাতিশীতোষ্ণ-মন্ডলের দেশে মদ কোনদিক দিয়েই গ্রহনোপযুগী নয়। বেশির ভাগ মাদক-দ্রব্য বাংলাদেশে চোরাপথে আসে। মাদকের চোরাচালানের সাথে বিশ্বব্যাপী অন্যান্য অপরাধের যোগসূত্র বারবার প্রমাণিত হয়েছে। মাদক-দ্রব্য বিক্রি করে প্রচুর অর্থ আয় করা যায়।

তাই এগুলো সেবনে তরুণ সমাজের ধ্বংস অনিবার্য জেনেও মুনাফালোভীরা নির্বিকার ভাবে দাপটের সাথে এই জঘন্য ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। মিয়ানমার,থাইল্যান্ড ও লাওস,ওদিকে আফগানিস্তান ,পাকিস্তান ও ইরান হেরোইন,গাঁজা ও পপি –চাষের প্রাণকেন্দ্র বলে খ্যাত। আন্তর্জাতিক চোরা-চালানকারীরা বাংলাদেশকে চোরা-চালানের আন্তর্জাতিক রুট হিসেবে ব্যবহার করে কোটিপতি হয়ে যাচ্ছে। মাদক-বিক্রির বিপুল অর্থে আন্তর্জাতিক সন্ত্রসবাদ সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ছে। সুতরাং এই সর্বনাশা নেশা হতে বিশ্বকে বাঁচাতে হলে আন্তর্জাতিক ভাবেই কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।

অপরাধীর শাস্তি আন্তর্জাতিক আইনেই করতে হবে। আর আমাদের এই ছোট্ট ব-দ্বীপটিকে এই ভয়ানক মারন-দ্রব্যের হাত হতে বাঁচাতে হলে সীমান্তে কড়া প্রহরার ব্যবস্থা করতে হবে। জলপথ,স্থলপথ ও আকাশপথ,কোন পথেই যেন চোরা-চালানকারীরা মাদক-দ্রব্য নিয়ে প্রবেশ করতে না পারে,সেদিকে কঠোর দৃষ্টি রাখতে হবে। আমাদের দেশের উন্নয়নের প্রধান সমস্যা হল সর্ষের মধ্যেই ভূত। তাই সর্ষে ভূত ছাড়াতে পারেনা।

সীমান্তরক্ষী ও সংশ্লিষ্ট প্রশাসককে অনুধাবন করতে হবে মাদক-দ্রব্য ব্যবহারের দীর্ঘমেয়াদী ভয়াবহতা,যা কিনা একটা জাতিকে,একটা দেশকে ধ্বংস করে ফেলতে পারে। মুনাফার লোভ যেন তাদেরও পেয়ে না বসে। তবেই প্রাথমিক নিয়ন্ত্রণ আসবে। তারপর সমাজের সচেতন নাগরিকদের মাদক প্রতিরোধে এগিয়ে আসতে হবে। মাদকের কুফল সম্বন্ধে ব্যাপক গণপ্রচারনা চলোতে হবে বছরের পর বছর ধরে।

হতভাগ্য মাদক-গ্রস্তদের অভিভাবকদের বুঝাতে হবে । যে সকল মাদকাসক্ত এই সর্বনাশা নেশায় জড়িয়ে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে চলে এসেছে,তাদের সচিত্র প্রতিবেদন বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রচার করতে হবে। যাদের সুস্থ হবার সম্ভাবনা আছে,তাদের সুস্থ করে মিডিয়ার সামনে আনতে হবে। নেশাগ্রস্ত হয়ে তাদের জীবনের যত মূল্যবান সময় অপচয় হয়েছে,এসব যুবসমাজকে অবহিত করতে হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে যেমন সবাই একাত্ম হয়ে কাজ করে,তেমনি এ মাদক-তান্ডবেও দেশের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে,এসব বিপথে যাওয়া টগবগে তরুণ-তরুণীদের আলোয় ফিরিয়ে আনার জন্য।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১১ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।