আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মাদকের বিরুদ্ধে প্রয়োজন সামাজিক আন্দোলন

ব্লগার পাঠক হিসেবেই বেশী আনন্দে আছি।

অন্যান্য সামাজিক সমস্যার মতো মাদকাসক্তি সমস্যা বর্তমানে একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত। মাদক শুধু সেবনকারীকে ক্ষতিগ্রস্ত করে না। এটি পরিবার, সমাজ ও দেশকে ধ্বংস করে দেয়। সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতিবছর ১৭ হাজার কোটি টাকার মাদক ব্যবসা হয় এবং ৭০ লাখের বেশি লোক কোনো না কোনোভাবে মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।

মাদকাসক্ত রোগকে বলা হয় ক্রেনিরিলাফসিন ডিজিজ যার অর্থ মাদকমুক্ত রোগী বারবার সুস্থ হওয়ার পর আবারো আসক্ত হয়ে পড়তে পারে। মাদকাসক্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্র আপনের সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যায়, কৌতূহল থেকে ৪৩ শতাংশ ও বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে ৩৬ শতাংশ লোক মাদক সেবন করে। এছাড়া বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায় হতাশাগ্রস্ত যুব সমাজ বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের মাদক দ্রব্যের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছে। হতাশাগ্রস্ত মাদকাসক্ত যুবকের মাদকদ্রব্য সংগ্রহের জন্য টাকার প্রয়োজন হয় এ জন্য সে চুরি, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, রাহাজানি, অপহরণ প্রভৃতি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে। সে হয়ে ওঠে ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী।

বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ৬০ শতাংশের অধিক অপরাধের মূলে রয়েছে মাদক সেবন। পারিবারিক অশান্তি, মনস্তাত্ত্বিক বিশৃঙ্খলা, নৈতিক শিক্ষার অভাব, পারিবারিক পরিম-লে মাদকের ব্যবহার, বেকারত্ব আর্থিক অনটন, লেখাপড়া বা কাজকর্মে অসফলতা থেকেও ছেলেমেয়েরা মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। মদ, গাঁজা, হেরোইন, ফেনসিডিল, কোডিন, হাশিশ, ভাং বা কোকেনই যে শুধু আসক্ত করে তা নয়। এমন কিছু ওষুধ আছে যা টেনশন বা নিদ্রাহীনতা কমানোর জন্য সেবন করা হয় তাতেও অনেকে আসক্ত হয়ে পড়ে। এসব ওষুধ সেবকরা চাহিদা অনুযায়ী সময় মতো না পেলেও উন্মাদ হয়ে ওঠে।

মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন কিশোর বয়সের ‘ওফবহঃরঃু ঈৎরংরং’, কৈশোর ও যৌবনের বিদ্রোহী ও বেপরোয়া মনোভাব থেকেও ছেলেমেয়েরা মাদকাসক্ত হতে পারে। হাতের কাছে খুব সহজেই বিভিন্ন প্রকার মাদকদ্রব্য পাওয়া যায় বিধায় এটাও মাদকাসক্তের একটা প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত। নেশাগ্রস্ত ব্যক্তির মধ্যে কিছু কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়, যা দেখে পিতা-মাতা বা অভিভাবকরা সহজেই বুঝতে পারবেন তাদের ছেলে বা মেয়ে মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে। পরিবর্তনগুলো হলো : ১. হঠাৎ করে অভ্যাস, প্রকৃতি এবং মেজাজ পরিবর্তন হওয়া। ২. ক্ষুধা কমে যাওয়া।

৩. লেখাপড়ায় অমনোযোগী হওয়া এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে অনুপস্থিত থাকা। ৪. অলসতা, দেরিতে ঘুম থেকে ওঠা, দিনে বসে বসে ঝিমানো। ৫. মিথ্যা কথা বলা। ৬. দেরি করে বাড়িতে ফেরা। ৭. লাবণ্য নষ্ট হয়ে যাওয়া।

৮. মারমুখী হওয়া। ৯. স্বাস্থ্যহানী ঘটা/ওজন কমে যাওয়া। ১০. সমালোচনা সহ্য না করা। ১১. ধার করা/ঘরের জিনিষপত্র চুরি করা/বিনা কারণে টাকার অতিরিক্ত চাহিদা বাড়া। ১২. নেশাগ্রস্তদের সঙ্গে বেশি মেলামেশা করা।

১৩. দুঃস্বপ্ন, অনিদ্রা, ঘুমের ব্যাঘাত প্রভৃতি। ১৪. কম কথা বলা। ১৫. সমবয়সীদের কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়া। ১৬. নিজেকে নিজে আঘাত করা। ১৭. দিনের একটি বিশেষ সময়ে বাড়ির বাইরে যাওয়ার জন্য মন চঞ্চল হয়ে ওঠা।

১৮. অবাঞ্চিত কোনো গন্ধ বা দাগ শরীরে বা কাপড়ে পাওয়া। উপরোক্ত লক্ষণগুলো সন্তানের স্বাভাবিক বৃদ্ধির সঙ্গে বিভ্রান্তি তৈরি করতে পারে। তাই হঠাৎ করে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন আপনার সন্তান আসলেই মাদকাসক্ত কিনা। মাদকদ্রব্যের অপব্যবহারে কী কী ক্ষতি হয়? ১. মাদক দ্রব্যে আসক্ত হওয়ার ফলে মস্তিষ্কের কার্য ক্ষমতা হ্রাস পায়। মানসিক প্রতিভা ও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা হ্রাস পায়।

২. স্মৃতিশক্তি নষ্ট হয়। ৩. নিদ্রাহীনতা, খিঁচুনি ও আত্মহত্যা করার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। ৪. ক্ষুধা কমে যায় এবং পাকস্থলীতে গোলযোগ দেখা দেয়। ৫. রক্তচাপ বেড়ে যায়। ৬. আলসার, এসিডিটি, কোষ্ঠ-কাঠিন্য, ক্যান্সার প্রভৃতি রোগ দেখা দিতে পারে।

৭. জন্ডিস, হেপাটাইটিস-বি, সিরোসিস প্রভৃতি রোগের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। ৮. যক্ষ্মা, ব্রঙ্কাইটিস, নিউমোনিয়া রোগ ছাড়াও মাদক দ্রব্যের প্রভাবে দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হতে পারে। ৯. এইডস রোগের সম্ভাবনা বেশি থাকে। ১০. কিডনীর কার্য ক্ষমতা হ্রাস পায়। ১১. মাদক দ্রব্যে আসক্ত মহিলারা বিকলাঙ্গ সন্তান প্রসব করে।

এছাড়াও নবজাতকের মধ্যে বিভিন্ন প্রকার জটিল সমস্যা দেখা যায়। ১২. দীর্ঘদিন মাদক দ্রব্য সেবনের ফলে যৌন ক্ষমতাও হ্রাস পায়। ১৩. এর প্রভাবে আত্মবিশ্বাস কমে যাওয়া, দুঃশ্চিন্তা বৃদ্ধি পাওয়া, ভয় পাওয়া, বিষণœতা ইত্যাদি গুরুতর মানসিক রোগ দেখা দেয়। মাদকাসক্তি থেকে মুক্তির উপায় কী? ১. অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হচ্ছে নিজের ভরাডুবি উপলব্ধি করে মাদক ছেড়ে দেয়ার ইচ্ছাশক্তি বাড়ানো। জোর করে কাউকে এ পথ থেকে ফেরানো অসম্ভব।

মনোবিজ্ঞানীরা মনোচিকিৎসার মাধ্যমে ব্যক্তির মধ্যে মাদক ছেড়ে দেয়ার তাগিদ জাগিয়ে তোলেন। এ জন্য অভিভাবকদের দায়িত্ব হচ্ছে চিকিৎসার জন্য তাকে উদ্বুদ্ধ করা, কাউন্সেলিংয়ে নিয়মিত হাজির করানো। ২. মাদক থেকে দূরে থাকার জন্য মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে সঙ্গ দিতে হবে। তাকে বিভিন্ন ধরনের ইতিবাচক আনন্দ দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। (যেমনÑ বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে নিয়ে যাওয়া)।

৩. নেতিবাচক বিষয় থেকে দূরে রাখতে হবে। ৪. বিকল্প জিনিসের প্রতি আকর্ষণ বাড়াতে হবে। অনেক সময় দেখা যায়, মাদকদ্রব্য সেবনের বিরুদ্ধে ভয়-ভীতি বা শাসন প্রদর্শন মাদকদ্রব্যের প্রতি আকৃষ্ট হওয়াকে ত্বরান্বিত করে। মাদকাসক্তদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা দুঃসাধ্য ব্যাপার। তবে মাদকদ্রব্যের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে ছেলেমেয়েদের অবগত করতে পারলে ভালো হয়Ñ এ জন্য বাবা-মা এবং শিক্ষকদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।

পাশাপাশি পাঠ্যপুস্তকে মাদকদ্রব্যের কুফল সম্পর্কিত বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা, মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতা দূর, মাদক সরবরাহকারীদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা, চলচ্চিত্র, টেলিভিশনে মাদকদ্রব্যের কুফল সম্পর্কে প্রচারণা চালিয়ে গণসচেতনতা তৈরি করতে হবে। এছাড়াও যারা মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে তাদের পুনর্বাসন করার জন্য সরকার, বিশেষজ্ঞ মনোবিজ্ঞানী, সমাজকর্মী ও এনজিওদের ভূমিকা রাখতে হবে। মাদকাসক্তদের সুচিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে হবে। মাদকমুক্ত সুন্দর ও সুস্থ সমাজ গঠনে সারাদেশে একটি দুর্বার সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলাই হোক আজকের দিনের অঙ্গীকার।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।