কিচ কিচ কুচ কুচ কাচ কাচ কোচ কোচ!!! (এই গল্পটা ক্যাডেট কলেজে থাকতে লাইব্রেরির কোন একটা বাংলা বই থেকে পড়েছিলাম। ভারতীয় লেখকদের বাংলায় লেখা সায়েন্স ফিকশনের একটা কালেকশন ছিল বইটা। এই গল্পটার নাম বা গল্পকারের নাম কিছুই মনে নাই, কিন্তু গল্পটার থিম মনে আছে ভালোভাবেই। খুব বেশি অসাধারণ বলেই হয়তো। )
সায়েন্স ফিকশনঃ মানুষ
১
২০৬৫ সাল।
উচ্চপদস্থ ব্যাঙ্ক কর্মকর্তা লাইবা জামান ঢাকার সবচেয়ে বড় মিষ্টির দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। আজকে তার বিশেষ আনন্দের দিন। এত আনন্দ তিনি জীবনে খুব কমই পেয়েছেন।
তার একমাত্র মেয়ে নূপুর আজ এক মহা ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছে। ইউরোপ থেকে একটা টিম এসেছিল বাংলাদেশে, তাদের উদ্দেশ্য ছিল সারা দেশ থেকে বাছাই করে মেধাবি মেয়েদেরকে বাছাই করে একটা ওয়ার্ল্ড ট্যুরের আয়োজন করা।
এতে বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশের মুখ যেমন উজ্জ্বল হবে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে মেয়েদের গুরুত্বকে আরও ভালভাবে মূল্যায়ন করা হবে। শুধু বাংলাদেশ নয়, তাদের কর্মকাণ্ড নাকি সারা বিশ্বের সব উন্নয়নশীল দেশের মধ্যেও বিস্তৃত। সব উন্নয়নশীল দেশ থেকেই নাকি মেধাবি মেয়ে বাছাই করে করে সারা পৃথিবীর সাথে ভ্রমণের মাধ্যমে পরিচিত করিয়ে দেয়া হবে।
বাংলাদেশ থেকে যে দশটা মেয়ে চান্স পেয়েছে তার একজন নূপুর। নূপুরের রেজাল্ট এমনিতে খুব ভালো, এ পর্যন্ত প্রত্যেকটা পরীক্ষায় নিয়মিত ফার্স্ট হয়ে আসছে সে।
সবাই একবাক্যে স্বীকার করেছে, বাংলাদেশ থেকে একটা মেয়ে চান্স পেলেও সেটা হওয়া উচিৎ নূপুরই।
নূপুর শুধু পড়ালেখায়ই নয়, সৌন্দর্যের দিক থেকেও অতুলনীয়। লাইবা জামান মাঝে মাঝে নিজের মেয়েকে দেখে অবাক হয়ে যেতেন। মেয়েটা এত সুন্দর হয়েছে, এত সুন্দর চোখ, এত সুন্দর নাক, এত সুন্দর ভ্রূ, এমনকি লিকলিকে হাত পা এর সাথে আকর্ষণীয় একটা ফিগার মাঝে মাঝেই লাইবা জামানকে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে বাধ্য করত।
মেয়েরা বেশি সুন্দর হলে যা হয়, মায়েদের ঘুম হারাম হয়ে যায়।
লাইবা জামানেরও হয়েছে। কেউ যেন তার মেয়েকে নষ্ট করতে না পারে সেজন্যে তিনি মেয়েকে জোর করে আত্মরক্ষার কৌশল শিখিয়েছেন একজন রিটায়ার্ড আর্মি নন কমিশনড অফিসারের কাছে, ভর্তি করেছেন মার্শাল আর্ট কোর্সে। কোন বিপদই যেন মেয়ের না হয় তার জন্য লাইবা জামান দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
লাইবা জামান দেড় কেজি মিষ্টি কিনলেন। আজ পাড়া প্রতিবেশি সবাইকে খাওয়াবেন তিনি।
মেয়েকেও খাওয়াবেন। ওরা বলেছে, মেয়ের ট্যুর এক সপ্তাহ পরেই শুরু। দীর্ঘ এক মাসের ট্যুর। এর আগে তিনি এক নাগাড়ে তিনদিনের বেশি কখনও মেয়েকে না দেখে থাকেন নি। এবার এক মাস কিভাবে থাকবেন কে জানে?
মিষ্টি হাতে নিয়ে নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন লাইবা জামান।
তার দীর্ঘশ্বাস মিশে গেল ২০৬৫ সালের বাংলাদেশের উষ্ণ বাতাসে।
২
মঙ্গলের তপ্ত বাতাসে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল হাবিব। এখানে বাতাস খুব গরম, কৃত্রিম বায়ু শীতলীকরণ যন্ত্র পুরোদমে কাজ করতে থাকলেও প্রচণ্ড গরম থেকে যায়। এই যন্ত্র না থাকলে সে কবেই পুড়ে কয়লা হয়ে যেত।
হাবিব এখানে পড়ে আছে প্রায় আঠার বছর।
যদিও বছরের কোন হিসাব তার নেই, রাখার প্রয়োজনও নেই। সে জানে সে আর কখনও পৃথিবীতে ফিরে যেতে পারবে না। পৃথিবী কেমন সে ভুলে গেছে। পৃথিবীর রঙ শেষ কবে তার চোখ রাঙ্গিয়েছিল হৃদয় জুড়িয়েছিল বেমালুম ভুলে গেছে সে।
হাবিবের শুধু মনে আছে মঙ্গলে মানুষের বসতি তৈরি করার জন্য বিজ্ঞানী, চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়ার, শ্রমিক, কৃষক ইত্যাদি অনেক মানুষের সমন্বয়ে একটা স্পেসশিপে করে আরও অনেকের সাথে মঙ্গলে এসেছিল সে।
যখন সে এসেছিল তখন তার প্রাণপ্রিয় স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা, স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে সে একবার ভেবেছিল পৃথিবীতেই থেকে যাবে, মঙ্গলে আসবে না। কিন্তু অনেক ভেবে শেষপর্যন্ত আবার মত পাল্টেছে সে। সে একজন বিজ্ঞানী, মঙ্গলে মানুষের বসতির সম্ভাবনা, সম্ভাব্য সমস্যা ও তার সমাধান ইত্যাদি নিয়ে তার রিসার্চ পেপারস আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান অনুষদে সম্মানের সাথে গৃহীত হয়েছে। এখন তার নিজেরই পিছিয়ে আসা মানায় না।
হাবিব অনেক চেষ্টা করে তার স্ত্রীর মুখখানি মনে করার।
পারে না। আঠার বছরের পুরনো স্মৃতি তার মরচে ধরা মস্তিষ্ক হৃদয়ের কবর খুঁড়ে বের করে আনতে ব্যর্থ হয়। হাবিব হতাশায় আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
স্পেসশিপটা আসার পরের প্রথম দু বছর সবই ঠিক ছিল। ঠিকমতই গড়ে উঠেছিল কৃত্রিম অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা, কৃত্রিম পানি সংযোজন ও বিশুদ্ধিকরণ ব্যবস্থা, খাবার তৈরি ও প্রস্তুতকরণ ব্যবস্থা, বায়ু শীতলীকরণ ব্যবস্থা।
চমৎকার একটা সমাজব্যবস্থার দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছিল মানুষের এই ছোট্ট কলোনিটি।
সমস্যা বাঁধল দুবছর পরে। দুবছর পর থেকে মানুষের একেকটা ব্যাচের পৃথিবীতে ফেরার কথা, বিনিময়ে পৃথিবী থেকে একেকটা ব্যাচের দুবছরের জন্য মঙ্গলে এসে বাস করে যাওয়ার কথা।
কিন্তু একদিন বজ্রপাতের মত খবর এল, স্পেসশিপের কাছে পৃথিবীতে ফিরে যাওয়ার মত পর্যাপ্ত জ্বালানী নেই। সব হিসাব করেই নিয়ে আসা হয়েছিল, কিন্তু মঙ্গলের বিশেষ এক ধরণের লিপোফিলিক মাইক্রোঅরগানিজমের সংক্রমণের কারণে সেই জ্বালানীর অধিকাংশ পরিমাণই হয়ে গেছে ব্যবহারের অযোগ্য।
তড়িঘড়ি যোগাযোগ করা হল পৃথিবীর সাথে। সেখান থেকে যা জানা গেল সেটা আরও ভয়াবহ। পৃথিবীতে সরকার পরিবর্তন হয়েছে, নতুন সরকার রাজনৈতিক চাল হিসেবে এই মঙ্গলে বসতি এবং সংশ্লিষ্ট সবকিছুকে অবৈধ ঘোষণা করেছেন। আর মঙ্গলে যারা আটকা পড়েছে তাদের জন্য রেসকিউ মিশন চালানো খুব খরচের কাজ, সরকার মাত্র তিন হাজার পাগল নাগরিকের জন্য এত এত ডলার খরচ না করে সেগুলো দুঃস্থ মা ও শিশুদের কল্যাণে ব্যয় করার ঘোষণা দিয়েছেন। সুতরাং, এখন মঙ্গলের কলোনির মানুষদের কি হবে কেউ বলতে পারে না।
তারপর গেল আরও তিন বছর। আরও তিন বছর। আরও তিন বছর। এভাবেই আঠার বছরের মাথায় এখন ভগ্নভাবে বেঁচে আছে কলোনিটি।
মঙ্গলে, পৃথিবীর মানুষের একমাত্র কলোনিটি।
৩
“আমি যাই মা”।
“যাই না মা, বলতে হয় আসি”।
“আমি আসি মা”।
“এসো মা”।
নূপুর এয়ারপোর্টের নির্দিষ্ট গেট দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল।
তার বেনি করে বাঁধা চুল পিছনে দুলছে। তার চোখেমুখে রাজ্যের আনন্দ, বুকে উত্তেজনা।
লাইবা জামানের চোখে পানি। তার এইটুকু বাচ্চা মেয়েটা কবে বড় হয়ে গেল তিনি বুঝতেও পারেন নি। এই তো সেদিনও তিনি মেয়েকে কোলে করে দুধ খাইয়েছেন।
এই তো সেদিনও কোলে করে স্কুলে নিয়ে গিয়েছেন। এই তো সেদিনও মেয়েকে নিজে নিজে জ্যামিতি পড়িয়ে দিয়েছেন। আর আজ মেয়ে তার বড় হয়ে গেছে। অনেক বড়।
এয়ারপোর্ট থেকে লাইবা জামান বাসায় ফিরলেন।
ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা পুরনো ছবি বের করলেন তিনি। তার এবং আরেকজনের ছবি। পরস্পরকে জড়িয়ে ধরা ছবি। ছবির পিছনে বরফাবৃত পাহাড়চূড়া।
হঠাৎ ছবিটা বুকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলেন লাইবা জামান।
৪
হাবিব সোহেলের দিকে তাকিয়ে বলল, “সুইচ ঠিক হয়েছে?”
“হ্যাঁ হয়েছে”।
“মিনিমাম কত টেম্পারেচার রাখা যাবে?”
“৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস”।
“আচ্ছা তুমি যাও”।
“ওকে”।
এই কলোনিতে সর্বমোট এগারোজন বাংলাদেশি এসেছিল।
এখন টিকে আছে তাদের মধ্যে মাত্র দুজন। হাবিব আর সোহেল। বাকি নয়জনের মধ্যে বিষাক্ত বাতাসে শ্বাস নিয়ে মারা গেছে দুজন, ফুড পয়জনিং এ মারা গেছে তিনজন, হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছে একজন, বাকি তিনজন মারা গেছে আত্মহত্যা করে।
যারা টিকে আছে তাদের মধ্যে বিজ্ঞানী রয়েছে হাতেগোনা কয়েকজন। বেশিরভাগই শ্রমিক।
হাবিব বিজ্ঞানীদের একজন। কিন্তু এখন তাকে শ্রমিকের মতই কাজ করতে হয়। এখানে অনেক কাজ। কাজ না করলে মৃত্যু নিশ্চিত।
হাবিব সারাদিনের কাজ শেষে সোহেলের সাথে গল্প করতে বসে।
সোহেল এসেছিল ডাক্তার হিসেবে, পৃথিবীতে আগে সে ঢাকা মেডিকেলের ইন্টার্নি ডাক্তার ছিল। অথচ এখন তাকে কি না করতে হয়।
হাবিব এবং সোহেল দুজনেই পৃথিবীর স্মৃতিচারণের চেষ্টা করে। কারোরই তেমন কিছু মনে পড়ে না। সোহেল বুক পকেট থেকে একটা ছবি বের করে।
একটা মেয়ের ছবি। জীর্ণ শীর্ণ ছবি। সোহেলের মনে পড়ে, এই মেয়েটা তাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল।
সোহেল দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মেয়েটা এখন কোথায় আছে কে জানে।
মেয়েদের দেখলে বুকের মধ্যে করে ওঠা চিনচিনে অনুভূতি থেকে বঞ্চিত সে অনেকদিন। অনেক, অনেক দিন।
৫
ঘুমানোর আগে নিজের ল্যাপটপে ইন্টারনেটে ঢুকলেন লাইবা জামান। সারা পৃথিবী থেকে কোন কোন মেয়েকে নেয়া হয়েছে, নূপুরের চেয়ে তাদের যোগ্যতা বেশি নাকি কম এই প্রশ্নগুলো নূপুরের যাবার দিন থেকেই তার মাথায় ঘুরছিল।
নির্দিষ্ট সাইটে ঢুকলেন লাইবা জামান।
হ্যাঁ, সারা পৃথিবী থেকে প্রায় দুইশ মেয়ে নেয়া হয়েছে। লাইবা জামান নেহায়েত কৌতূহল বশত প্রত্যেকের প্রোফাইল খুলে পড়া শুরু করলেন।
প্রায় দুঘণ্টা পরে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন লাইবা জামান। তার মাথায় কি যেন একটা প্রশ্ন খচখচ করছিল, ঘুমের ফলে ব্যাপারটা বেমালুম ভুলে গেলেন তিনি। পরদিন সকালে তার আর কিছুই মনে রইল না।
৬
হাবিব শুকনো পাতার মত একটা জিনিস চিবুচ্ছে।
পৃথিবী থেকে নিয়ে আসা মাটিতে গজানো হয়েছে উদ্ভিদটা। এটা একটা জেনেটিকালি ইঞ্জিনিয়ারড উদ্ভিদ, এতে প্রোটিনের পরিমাণ তুলনামূলক ভাবে বেশি। এর চেয়েও বড় কথা, মঙ্গলের বাতাসে কৃত্রিম আবহাওয়া তৈরি করবার পরেও এটা ছাড়া অন্য উদ্ভিদগুলো চাষ করা সম্ভব হয় নি। এজন্য এটাই এখন এই কলোনির প্রধান খাদ্য।
এই উদ্ভিদ আর কতদিন চাষ করা যাবে কেউ জানে না। মাটির উর্বরতা একদম নেই বললেই চলে। পৃথিবী থেকে নিয়ে আসা কৃত্রিম জৈব পদার্থ প্রায় শেষ। আমিষেরও কোন উৎস নেই। যেসব গরু ছাগল নিয়ে আসা হয়েছিল তারা সন্তোষজনকভাবে বংশবৃদ্ধি করতে পারে নি তো বটেই, বরং ছয়মাসের মধ্যে একে একে মারা গেছে সব।
শেষ কবে আমিষ খেয়েছিল হাবিব মনে করতে পারবে না।
মাঝখানে একবার ক্ষুধার জ্বালা সইতে না পেরে এক মেয়েকে কেটেকুটে খেয়ে ফেলেছিল এক শ্রমিক। পরে বিষক্রিয়া হয়ে মারা গেছে সে নিজেই। কলোনিবাসিরা পরে নিজেদের মধ্যে এক অলিখিত নিয়ম ঠিক করেছে, নিজে মারা গেলেও কেউ কারো মাংস খাবে না। তবু গোপনে অনেকেই নিয়মভঙ্গ করেছে।
প্রেমিক প্রেমিকার মাংস খেয়েছে, বন্ধু বন্ধুর। ক্ষুধার জ্বালা বড় জ্বালা।
হাবিবের মনে পড়ে, তার বউ কি যেন একটা আইটেম খুব ভালো রান্না করতে পারত। ইস, আইটেমটার নাম মনে পড়ছে না কিছুতেই।
৭
ফেসবুকে একটা লোকের সাথে চ্যাট করছেন লাইবা জামান।
সেই লোক বিদেশি, তার মেয়েও নাকি এই ভ্রমণের সুযোগ পেয়েছে। লাইবা এই আই ডি পেয়েছেন ঐ ওয়েবসাইটে, ওখানে মেয়েগুলোর নামের পাশে তাদের অভিভাবকদের ঠিকানাও দেয়া ছিল।
কথায় কথায় লোকটা বলল, “বোন, একটা ব্যাপার কি আপনি লক্ষ্য করেছেন?”
“কি ব্যাপার?”
“কথাটা শুনতে হাস্যকর শোনাতে পারে। বলব?”
“বলুন”।
“আচ্ছা আপনি বলুন তো, এই মেয়েদের সবার মধ্যে কমন একটা ব্যাপার কি ছিল?”
লাইবা জামান বললেন, “কেন? ওদের তো রেজাল্ট দেখে সিলেক্ট করা হয়েছে।
দেখুন সবারই রেজাল্ট ভালো”।
“দেখুন, রেজাল্ট ভালো ঠিক আছে, কিন্তু তার চেয়েও ভালো রেজাল্ট কিন্তু আছে। আমার মেয়ে কলেজে সেকেন্ড গার্ল ছিল, ফার্স্ট গার্লকে কিন্তু নেয়া হয় নি”।
“হয়তো ওদের সিলেকশনে অন্য কোন ক্রাইটেরিয়া দেখা হয়েছে”।
“হ্যাঁ, আমি সেটাই বলছি।
আচ্ছা, আপনি কি মেয়েদের ছবিগুলো দেখেছেন? ঐ ওয়েবসাইটে কিন্তু মেয়েদের ফুল বডির ছবি দেয়া ছিল”।
“হ্যাঁ দেখেছি”।
“কিছু বোঝেন নি?”
“কি বুঝব?”
“বোন, আমাকে আপনার পাগল মনে হতে পারে, কিন্তু আপনি লক্ষ্য করে দেখুন, যে মেয়েগুলো সিলেক্ট হয়েছে, প্রত্যেকেরই বয়স পনের থেকে বিশের মধ্যে। আর...”
“আর কি?”
“আর প্রত্যেকেরই বুকের সাইজ...ফিগার...আপনি কি বুঝতে পারছেন আমি কি বলছি?”
লাইবা জামান ভয়াবহ আতঙ্ক নিয়ে ফেসবুকের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রইলেন। এখন তার মনে পড়েছে সেদিন রাতে তার মাথায় কি খচখচ করছিল।
৮
হাবিবের কাছে একটা বহু পুরনো ছবি আছে। বহু পুরনো ছবি।
তার এবং আরেকজনের ছবি। পরস্পরকে জড়িয়ে ধরা ছবি। ছবির পিছনে বরফাবৃত পাহাড়চূড়া।
হাবিব অবাক হয়ে ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকে। এই ছবিটা ছাড়া তার কাছে তার বউয়ের আর কোন সুভ্যেনির নেই। মস্তিষ্কের জমানো সুখস্মৃতিগুলো ধুয়ে মুছে গেছে অনেক আগেই।
হাবিব মনে করার চেষ্টা করে। হ্যাঁ, বিয়ের পর তারা হানিমুনে গিয়েছিল।
হ্যাঁ, গবেষণাটা আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান অনুষদে গৃহীত হবার সংবাদ পাওয়ার দিনই ও তাকে বলেছিল, ও অন্তঃসত্ত্বা।
হাবিব তার বউয়ের নাম মনে করার চেষ্টা করে। হ্যাঁ, এই তো মনে আছে। বেশ ভালোই মনে আছে তার। যাক, মস্তিষ্ক এখনও একেবারে পচে যায় নি।
মুখে একটুকরো হাসি নিয়ে হাবিব আবার সবাইকে জোরে জোরে তেল সংশোধনের কাজের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিতে থাকে।
৯
“মা তুই ভালো আছিস?”
“হ্যাঁ মা”।
“কোন অসুবিধা নেই তো?”
“না মা”।
“এখন তুই কোথায়?”
“অস্ট্রিয়ায়, মা”।
“তোর গলা এমন লাগছে কেন?”
“এমনি, মা”।
লাইবা জামান ভ্রূ কুঁচকে সামনের দিকে তাকিয়ে আছেন। তার মেয়ে তার সাথে কখনও এত কম কথা বলে না। মেয়ের গলাটাও কেমন কেমন যেন লাগছে। ইনফেকশন হয়েছে নাকি? নাকি অন্য কিছু?
“হ্যালো! হ্যালো!” নিষ্ফল হল লাইবা জামানের আহবান। ফোন কেটে গেছে আগেই।
১০
হাবিবের সারা শরীরে অন্যরকম একটা শিহরণ খেলে গেল।
এইমাত্র পৃথিবী তাদের সাথে যোগাযোগ করেছে। পৃথিবী বলেছে, এই মুহূর্তে তাদের হাতে লোক পাঠানোর মত প্রযুক্তি এবং জ্বালানী থাকলেও মঙ্গল থেকে সব মানুষ ফিরিয়ে নিয়ে আসার মত প্রযুক্তি এবং জ্বালানী নেই। তাছাড়া আঠার বছর ধরে নানাবিধ দূষণের শিকার মানুষের দেহ হয়তো পৃথিবীতে নতুন কোন মহামারী সৃষ্টি করবে, সেটার দায়িত্ব নিতেও পৃথিবী রাজি নয়।
অবশেষে পৃথিবী একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে।
পৃথিবী তাদেরকে খাবার পাঠাবে, প্রযুক্তি পাঠাবে। মঙ্গলে কলোনি টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করবে। এরই সাথে সাথে পাঠাবে একটা বিশেষ সম্পদ, মেয়েমানুষ।
হাবিবের মনে পড়ে, তাদের কলোনির সাথে এসেছিল প্রায় পাঁচশ মেয়েমানুষ। তাদের প্রত্যেকের ছিল লাইগেশন করা, তাদের প্রধান কাজই ছিল পুরুষদের মনোরঞ্জন করা।
কাজটাকে কেউ খারাপভাবে দেখে নি, কারণ এটা ছাড়া এখানে শারীরিক চাহিদা মেটানোর আর কোন উপায় নেই।
দু বছরের মাথায় যখন ভয়ঙ্কর সংবাদটি এল, মানুষ আক্রান্ত হল দারুণ হতাশায়। তাদের হতাশার ছাপ পড়ল মেয়েদের শরীরের উপর। একের পর এক মেয়েকে খুবলে কামড়ে রক্তাক্ত করতে লাগল একেকজন পুরুষ, মেয়েদের সংখ্যা কমতে লাগল আস্তে আস্তে। আর যতই মেয়েদের সংখ্যা কমতে লাগল, পুরুষদের সেক্সহীন দিনের সংখ্যাও বাড়তে লাগল হু হু করে।
অবশিষ্ট মেয়েদের ভোগ করার জন্য সবাই যেন পাগল হয়ে গেল। এভাবে এগার বছর আগের এক দিনে, এই কলোনির শেষ মেয়েটিও মৃত্যুবরণ করল।
তারপর থেকে টানা ন’বছর, এই কলোনির বেঁচে থাকা প্রত্যেকটা পুরুষ, নারীদেহের সংস্পর্শহীন হয়ে বেঁচে আছে। ন’বছরের উদগ্র কামনা তাদের দেহে, ন’বছরের সযত্নে লালিত লালসা তাদের চোখে, ন’বছর বয়সী গোপন বাসনা তাদের বিশেষ অঙ্গে।
হাবিব গলা পরিষ্কার করে নিল।
পৃথিবীর ঘোষণার কথা সবাইকে জানিয়ে দেবার দায়িত্ব তারই।
১১
লাইবা জামানের কেমন অস্থির অস্থির লাগছে।
লাইবা জামানের মনে পড়ে, এতটা অস্থির তার লেগেছিল আজ থেকে প্রায় আঠার বছর আগে। আঠার বছর আগের এক রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিনে তিনি অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন, তার প্রাণপ্রিয় স্বামী সেই দিনে তাকে বিদায় জানিয়ে একটা আন্তর্জাতিক পুরষ্কার গ্রহণ করার উদ্দেশ্যে ইউরোপগামি প্লেনে উঠেছিলেন। সেই বিমান ফ্লাইটের আট ঘণ্টার মাথায় ক্র্যাশ করে, লাইবা জামানের হাতে ফিরে আসে স্বামীর দেহের এক টুকরা কাপড়।
লাইবা জামান কষ্টে হতাশায় কেঁদে কেঁদে আধমরা হয়ে যান। তিনি একবার ভেবেছিলেন আত্মহত্যা করবেন, কিন্তু পেটের অনাগত সন্তানের কথা ভেবে নিজেই নিজেকে নিবৃত করেন তিনি। নূপুর জন্ম নেয় এই ঘটনার তিন মাস পর।
লাইবা জামান মেয়ের কলেজে খোঁজ নিয়েছেন। অন্য যেসব মেয়েকে নেয়া হয়েছে তাদের কয়েকজনের মায়ের সাথে খুঁজে খুঁজে যোগাযোগ করেছেন।
কেউ তাকে কোন সদুত্তর দিতে পারে নি। সবারই ধারণা, মেয়েকে তো ইউরোপের মত একটা জায়গার টিম এত টাকা দিয়ে নিয়ে গেছে, নিশ্চয়ই তারা সহিসালামতে ফেরত দিয়ে যাবে। আর মেয়েদের সাথে তো প্রতিদিন কথা হচ্ছেই।
লাইবা জামানের কেমন অস্থির লাগছে। তার বারবার মনে হচ্ছে আজ হাবিব পাশে থাকলে বড় ভালো লাগত।
হাবিবের বুকে মুখ লুকিয়ে তিনি তার সব দুঃখ ঐ প্রশস্ত বুকে প্রোথিত করতেন।
১২
“ভায়েরা আমার। পৃথিবী আমাদের জবাব দিয়েছে। তারা আমাদেরকে খাবার পাঠাবে, প্রযুক্তি পাঠাবে। আর সবচেয়ে বড় কথা, মেয়ে পাঠাবে।
পিওর মেয়ে, কুমারি মেয়ে”।
উপস্থিত সবাই আনন্দে চিৎকার করে ওঠে।
“আমরা ন’বছর আগের মত বোকামি করব না। মেয়েরা আসার পর তাদের সংখ্যা অনুসারে আমাদের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হবে। একেকজন শুধু নির্দিষ্ট সময়েই তাদেরকে ভোগ করতে পারবে।
নিয়ম যে না মানবে তাকে উপযুক্ত শাস্তি দেয়া হবে”।
আবারও জনতার মধ্যে আনন্দের একটা হিল্লোল বয়ে যায়।
“আমাদের মনে রাখতে হবে নিজেদের বোকামিতে আমরা ন’বছর মেয়েমানুষ ছাড়া কাটিয়েছি। শুধু নিজেদের ভুলে নারীদেহ থেকে আমরা বিচ্ছিন্ন রয়েছি আজ নয় নয়টা বছর”।
উপস্থিত সবাই হাবিবের কথায় সায় দেয়।
“ওদের সাথে সবাই ভালো ব্যবহার করবে। ওদেরকে ভালো খাবার খেতে দেবে। তাহলে ওদের শরীর ঠিক থাকবে, ওরা অনেকদিন বেঁচে থাকবে। ওরা যত বেশি বেঁচে থাকবে আমাদের ততই লাভ”।
উপস্থিত সবাই হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে।
হাবিব কথা শেষ করে নির্দিষ্ট স্থান থেকে নেমে আসে। কতদিন সে নারীদেহের স্বাদ পায় না? কতদিন?
১৩
লাইবা জামান শূন্য চোখে আকাশের দিকে চেয়ে আছেন। তার হাতে একটা কাপড়।
তার মেয়ের জামার কাপড়। খবর এসেছে, মেয়েদের প্লেন ক্র্যাশ করেছে।
যাত্রী ও ক্রু সহ সবাই মারা গেছে।
১৪
মঙ্গলের কলোনির বাইরে একটা ছোট্ট স্পেসশিপ অবতরণ করল।
স্পেসশিপের দরজাটা খুলে গেল স্বয়ংক্রিয়ভাবে। একশজন নারী ভারি ভারি স্পেসস্যুট পরে বাইরে বেরিয়ে এসে ইতস্তত ঘোরাফিরা করতে লাগল।
হাবিব ও তার বিশ্বস্ত কয়েকজন মানুষ মেয়েদের দলটাকে হাঁটিয়ে কলোনির মধ্যে নিয়ে আসলেন।
তাদের স্পেসস্যুট খুলতে বললেন। কৃত্রিম বাতাসে নিজেদের অভ্যস্ত করে নেবার জন্য সময় দিলেন।
মেয়েরা জোরে জোরে টেনে টেনে শ্বাস নিতে লাগল। অনেক দিন পরে স্পেসশিপের বাইরে বের হবার সুযোগ পেল। অনেক দিন পর পেল অন্য মানুষের দেখা।
এদের মধ্যে শুধু একজনের মস্তিষ্কে, হাবিবকে দেখে কি একটা যেন খচখচ করতে লাগল।
১৫
নূপুর মহা আতঙ্কিত হয়ে তার, বা তাদের দিকে ধেয়ে আসা রুক্ষ, ময়লা চেহারার মানুষদের স্রোতের দিকে তাকিয়ে রইল। মানুষগুলো তার, বা তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার আগমুহূর্তে হঠাৎ করে সে বামে তাকাল, দেখল সেই মানুষটা যে তাদের স্পেসস্যুট খুলতে বলেছিল, সে নিজেই দৌড়ে আসছে নিজের ভদ্রতার মুখোশ খুলে, কি অদ্ভুত পাশবিকতা তার চোখে মুখে, কি অদ্ভুত একটা লালসাময় হাসি তার রুক্ষ ঠোঁটের কোণে, হুট করে নূপুরের মনে পড়ল মস্তিষ্কে খচ খচ করার কারণ, তার মায়ের হানিমুনের ছবিতে মা যে লোকটার সাথে জড়াজড়ি করে ছবি তুলেছিল সেই লোকটার সাথে এই লোকটার খুব মিল আছে, খুবই মিল, এজন্যেই খচখচ করছিল তখন নূপুরের স্মৃতি...
মানুষগুলোর মধ্যে প্রথমজনের কামতাড়িত হাত তাকে স্পর্শ করা মাত্রই নূপুর “বাবা” বলে একবার চিৎকার দিয়ে উঠেছিল, যদিও সে চিৎকার কারো কানে যায় নি। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।