আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ঝিনুক নীরবে সহো...

"বাঙ্গালী জাতির গৌরবময় ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব এবং জাতীয় সংস্কৃতির জন্য অপমানজনক কোনকিছু এই ব্লগে লেখা যাবে না। "শিহরণে সত্তায় তুমি, হে আমার জন্মভূমি"

নারী-পুরুষের এই চরম বৈষম্য কি থাকবে আবহমান (লিখাটি ২০ তারিখের দৈনিক সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত) আবুল হাসানের একটি বিখ্যাত কবিতা 'ঝিনুক নীরবে সহো'। পুরো কবিতায় লাইন ৩টি 'ঝিনুক নীরবে সহো/ঝিনুক নীরবে সহো, ঝিনুক নীরবে সহে যাও/ভিতরে বিষের বালি, মুখ বুঁজে মুক্তা ফলাও!' কী যে আশ্চর্য লাগে; মনে হয়, আমার নাম ঝিনুক, আমাকে কেউ যেন বলে যাচ্ছে - যা হচ্ছে, সয়ে যাও। সব মেনে নিয়ে আমরা মেয়েরা হয়তো মুক্তা ফলাতে পারি না, কিন্তু সংসার ফলাই। ভীষণ নিষ্ফলা সংসারও আমরা ফলবান করে তুলি ওই সহ্য ক্ষমতার বলে।

কেন এত সয়ে যাই, কার জন্য? নিজের জন্য, নাকি পাছে লোকে কিছু বলার ভয়ে? ভয় তো আছেই। 'আপনা মাঁসে হরিণা বৈরী'। কত ভয়... বয়স অনুযায়ী মানুষের চাহিদা বিকশিত হয়। পারিপাশ্বির্কতা, মানসিক অবস্থা- সব মিলিয়ে মানুষ তার আচরণের কাঠামো তৈরি করে, হয়ে যায়। পঁচিশেও যদি বিয়ে না হয় এবং আমাদের সমাজে প্রচলিত মানদন্ড- অনুযায়ী কেউ যদি সুন্দরী না হয়, তাহলে পরিবারের সবার মধ্যে গেড়ে বসা আতঙ্ক, সেই প্রায় পঁচিশ পার হওয়া নারীর মধ্যেও দেখা দেবে- এটাই স্বাভাবিক।

সেই আতঙ্কে অস্থির হয়ে যদি সে একটা প্রেম করে বসে, তখন কি আমরা তাকে দোষ দিতে পারি? তখন কি সে ছেলের কোষ্ঠী বিচার করবে, না সে বড় ধরনের একটা স্বস্তি পাবে সম্পর্কটা বিয়েতে গড়ালে? মিতু যখন বাসায় পছন্দের কথা বলে, বাসার সবাই একবাক্যে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। বাসার সবাই প্রবল উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে মিতুর বিয়ে দিয়ে দেয়। ছেলে নামকরা বিদেশি কোম্পানিতে চাকরি করে। মিতুও একটা কলেজে পড়ায়। সমস্যা একটাই, দেখতে মিতু ছেলের তুলনায় একেবারেই সাধারণ।

এদিকে, ছেলের বাসায় প্রথম থেকেই এই সম্পর্ক এবং পরবর্তীকালে বিয়েটা ভালো চোখে দেখেনি। শুধু ছেলের পছন্দ- এই ভেবে বিয়েটা মেনে নেয়। মিতু শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার পর শুরু হয় আসল সংকট। শাশুড়ি-ননদ মিলে অবহেলা-অপমানে মিতুর জীবন একেবারে নরক করে তোলে। বাসার জন্য ওকেই সবার রান্না করতে হবে কলেজ থেকে ফিরে।

সকালে নাশতা বানিয়ে তারপর চাকরিতে যেতে হবে মিতুকে। বিয়ের সময় মিতু যেসব ফার্নিচার এনেছে, সেগুলো নাকি বস্তির মেয়ের বিয়েতেও কোনো বাবা দেবে না। মিতু দেখতে এত অসুন্দর, মিতুর সন্তানও নাকি আরো খারাপ হবে দেখতে। কিছুদিন পর দেখা গেল, সুন্দরী মেয়ে দেখলেই তার আশপাশে ছোঁক ছোঁক করাটা মিতুর বরের একদম মজ্জাগত অভ্যাস। মিতুর এক খালাতো ননদের সঙ্গে মিতুর বরের বেশ ভালো আশনাই।

দিনে এক-দেড় ঘণ্টা মোবাইলে কথা হয় সেই খালাতো ননদ আর মিতুর বরের। মিতু এক পর্যায়ে প্রতিবাদও করে। শাশুড়িকে মিতু সেই খালাতো ননদের ব্যাপারে বললে শাশুড়ি জানান, মিতুর বরের এই মেয়ের সঙ্গে বিয়ের কথা হয়েছিল আগে। এখন মিতু যদি তার ছেলেকে দয়া করে ছেড়ে দেয়, তাহলে তিনি এই মেয়েকে ছেলের বউ করে আনতে পারেন। রাগে-দুঃখে মিতু বাবার বাড়ি যায়।

সেখানে মিতুর বাসার সবাই মিতুকে সবক দিতে থাকে, বরকে ফেরানোর দায়িত্ব মিতুর। মিতু যেন একটু মানিয়ে নেয়। মিতুর পর আরো ২টি বোন আছে। তাদের কথাও তো মিতুকে ভাবতে হবে। সে শ্বশুরালয়ে ফিরে যায়।

মিতু ভাবে, সন্তান নিলে সমস্যাগুলো হয়তো কমবে। মিতুর এই ভাবনা প্রকাশ পেতেই মিতুর বর বলে বসে, তোমার যা খারাপ চেহারা, তাতে সন্তান নেওয়ার ভরসা পাই না, আম্মাও তাই বলে- আমার সন্তানের চেহারা যদি তোমার মতো হয়! সময় থেমে থাকে না। মিতু একসময় সব উপেক্ষা করে গর্ভবতী হয়। খবরটা শুনেই মিতুর বর মিতুকে বাবার বাড়ি রেখে আসে এই বলে যে, মিতুর সঙ্গে তার অনেকদিন দৈহিক সম্পর্ক নেই। এ অবস্থায় মিতু কীভাবে গর্ভবতী হলো, সে বুঝতে পারছে না।

নষ্টা কোনো মেয়ের সঙ্গে তার ঘর করা সম্ভব নয়। মিতু থাকে বাবার বাড়ি। অফিস করে। একদিন বরকে শুধু ফোনে বলে, আমি সন্তানের ডিএনএ টেস্ট করাব। যত টাকা লাগে, আমি এই টেস্ট করাব।

মিতুর এখন সন্তান হয়েছে। ডিএনএ টেস্ট ছাড়াই সন্তানের মা'সহ নিয়ে গেছে। কেন? সন্তানের চেহারা পুরোপুরি বাবার মতো,তাই। নিশাতের কোর্ট ম্যারেজ পল্লবের সঙ্গে। একসঙ্গে পড়াশোনা, একই জায়গায় চাকরি।

শ্বশুরবাড়ি যেতে পেরেছে নিশাত এক শর্তে- বাবার বাড়ির সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখতে পারবে না। বাবা-মার একমাত্র মেয়ে নিশাত, মামাদের একমাত্র ভাগ্নি, নিলয়ের একমাত্র বোন। সেই নিশাত শর্ত মেনে শ্বশুরবাড়ি থাকে। শাশুড়ি প্রথম থেকেই নিশাতকে সহজভাবে নেন না। তার সোনার টুকরো ছেলেকে নিশাতের মতো সাধারণ চেহারার মেয়ে কীভাবে পটালো, তা তিনি কোনোভাবেই বুঝতে পারেন না।

নিশাতের বাবা-মা মেয়েকে কেমন শিক্ষা দিয়েছে, তাও তার বোধগম্য নয়। খারাপ মেয়ে না হলে কেউ কোর্ট ম্যারেজ করে! স্বগতোক্তি করেন- তিনি তো প্রাণ থাকতে নিশাতকে সম্বন্ধ করে বিয়ে করাতেন না। যেই না চেহারার বাহার! খ্যাংরা কাঠির মতো কালো মেয়ে একটা! নিশাত-পল্লব হয়তো অনেক রাতে ঘুমানোর জন্য বেড রুমের দরজা বন্ধ করতে যাচ্ছে, পল্লবের মা মাথাব্যথা বলে এমন এক চিৎকার দিলেন যে, নিশাত-পল্লবকে সারারাত মায়ের মাথা টিপেই কাটাতে হবে। নিশাতের শ্বশুর এমন সময় বউয়ের সামনে একদম বোবা। পল্লবের সঙ্গে নিশাত কোথাও বেড়াতে বেরোচ্ছে, তিনি অবধারিতভাবে ফিট হয়ে পড়ে গেলেন।

নিশাতদের আর বেরোনো হলো না। পল্লবকে তো সারাক্ষণ বলেই যাচ্ছেন- এমন যাচ্ছেতাই একটা মেয়েকে ও বিয়ে করেছে তার মান-সম্মান নষ্ট করার জন্য। বিয়ের পর নিশাত-পল্লব কক্সবাজার যাওয়ার জন্য এক রাতে বাসে ওঠে। পল্লবের মোবাইলে মায়ের ফোন। তুই যদি এক্ষুণি বাসায় না আসিস, আমার মরা মুখ দেখবি।

কুমিল্লা থেকে নিশাতরা ব্যাক করে। তখন রাত ২টা। পল্লবের মায়ের এক কথা, তুই এই মেয়েকে রেখে আয়। মেরুদন্ডহীন পল্লব খুব কাকুতি-মিনতি করে, মা সকালে রেখে আসব, আজকের রাতটা থাকতে দাও। না, কোনোভাবেই না।

যে নিশাত পল্লবের ভরসায় বাবার বাড়ির সঙ্গে এত মাস কোনো যোগাযোগ করেনি, সে সেদিন রাত ৩টায় নিজের বাসায় উপস্থিত হয় এক কাপড়ে। তারপরও নিশাত পল্লবের সঙ্গে থাকতে চেয়েছিল। আমরা জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেন যেতে চাস? আমি ডিভোর্সি হতে চাই না। এ পরিচয়টা খুব খারাপ, মানুষ একেবারে সহজলভ্য হিসেবে দেখে। একই অফিসে কাজ করি।

কীভাবে চলব? পল্লব কিছুদিনের মধ্যেই চাকরি পরিবর্তন করে ফেলে। নিশাতের অনেক ডাকাডাকিতেও আর পল্লব নিশাতকে ঘরে নেয়নি। পাঠিয়েছে উকিল নোটিশ। শুনেছি, পল্লব এখন স্কলারশিপ নিয়ে অক্সফোর্ডে। ফিরে বিয়ে করবে মায়ের পছন্দে, হয়তো কোনো ডানাকাটা পরীকে, অবশ্যই যাদের অনেক অর্থ থাকবে।

পাত্র হিসেবে তো জহির ভালোই ছিল। কে জানত জহির মাদকাসক্ত! জানলে কি আর নিম্মির বাবা-মা এখানে ঘটা করে বিয়ে দিতেন? ডনম্মি রাজি হতো? আহা! নিম্মির এক বছরের সংসার। প্রতিদিন ঝগড়া। একটা মানুষ ফেনসিডিল খেয়ে পড়ে থাকে আর তার বাসার কেউ এত বছরেও জানে না, তা বিশ্বাস করতে নিম্মির অনেকদিন কেটে যায়। জহির সপ্তাহে ৩ দিনই অসুস্থ, না হয় বেজায় ক্লান্ত।

দু'জন মানুষ চাকরি করে, তবু সংসার চলে না। জহিরকে টাকার কথা বললেই বলে, বিয়েতে আমার অনেক দেনা হয়েছে, সেগুলো দিতে হচ্ছে, তুমি চালাও আপাতত। নিম্মি নিজের বেতনের টাকায় সংসার চালাবে, না জহিরের নেশার টাকা জোগাবে! মারধর করে যখন জহির নিম্মির কাছ থেকে টাকা নিতে শুরু করল, তখন নিম্মি খোঁজ-খবর নিল। বের হলো, ছেলে নেশাসক্ত। কত অনুনয় নিম্মির, কত চেষ্টা।

বাবার বাড়ি-শ্বশুরবাড়ির সবার এক কথা, ওকে ফেরাতে চেষ্টা করো। একটু সয়ে যাও। নিম্মি শেষ পর্যন্ত পারেনি। পরিণতি অবধারিত বিবাহ বিচ্ছেদ। নিশাত ও নিম্মির জন্য আমরা হন্যে হয়ে পাত্র খুঁজছি।

পাওয়া কি এত সহজ! কোনো অনূঢ়া(!) ছেলেই ওদের বিয়ে করতে রাজি নয়। অভিভাবকরা সম্বন্ধ আনেন ছেলে ডিগ্রি পাস, ভালো ব্যবসা করে। নিশাত, নিম্মি ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে ডাবল মাস্টার্স। যে চাকরি ওরা করে তা বাংলাদেশের অনেক ছেলেও করতে পারে না। কত দেশে মানুষ ৫ বারও বিয়ে করছে।

নিশাত-নিম্মিরা জীবনে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার জন্য প্রতি মুহূর্তে ছোট হয়ে থাকে। ও ডিভোর্সি! বলেই মানুষ কেমন করে যেন মুখ ফিরিয়ে নেয়! এক টানে সামাজিক অবস্থান নেমে যায় কয়েক ধাপ নিচে। অথচ নিশাত বা নিম্মির বয়সী এখনো অনেকের বিয়েই হয়নি। পল্লব অক্সফোর্ড থেকে ফিরে এসে আবার বিয়ে করবে, মায়ের পছন্দের মেয়েকে; নিশাত পারবে না। কারণ, আমাদের সমাজ।

নিশাতের জন্য সম্বন্ধ আসবে, চল্লিশোর্ধ্ব, বিপত্নীক, আগের ঘরের সন্তান আছে- এমন পাত্র জেনেই আসবে সেই সম্বন্ধ। অথচ মাত্র ৯ মাসের একটা আধখেচড়া বিয়ে চঞ্চল নিশাতকে নিশ্চল যন্ত্রে পরিণত করেছে যেন! কত সইলে নারী মুক্তা ফলাবে আমার জানা নেই। অথচ কিছুটা বদলালে বাঁশি, কিছুটা বদলালে সুর, আমাদের রক্তচক্ষু সমাজের অসহজ আদল, সয়ে যাওয়ার জায়গাটা অনেক মসৃণ হয়ে যেত।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।