আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আক্কেল সেলামী : একগুচ্ছ কষ্টের কথা

ওরে ভয় নাই আর, দুলিয়া উঠিছে হিমালয়-চাপা প্রাচী! গৌরীশিখরে তুহিন ভেদিয়া জাগিছে সব্যসাচী! যথারীতি শেষ প্রহরে প্লাটফর্মে ঢুকিলাম টিকিট কাটিবার কোনপ্রকার সুযোগ না পাইয়াই । ৭ নং প্লাটফর্মে ট্রেন আমাদিগের প্রতীক্ষায় অপেক্ষমান । পশ্চাৎদিগ হইতে হঠাৎ এক খাকি উর্দিধারীর ডাক শুনিলাম । থামিতে না চাহিয়াও থামিতে হইল । "কোথায় যাইবেন ? " "ক" জেলায় ।

"টিকিট প্রদর্শন করুন । " "কাটিতে পারি নাই সময়স্বল্পতার দরূণ । আমরা ইস্টুডেন্ট । " "ইস্টুডেন্ট বইলা কি মাথা কিনিয়া খাইয়াছেন? ১১০ টাকা বাহির করুন । " আমরা অবাক দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া তাহাকে বুঝাইবার আপ্রাণ চেষ্টা করিলাম ।

কিছুতেই কিছু হইল না । ৫০ টাকা তাহার হস্তগত করিয়া সম্মুখে অগ্রসর হইলাম । খোঁজা- খোজি করিয়া সুন্দর গদিওয়ালা একখানা বগিতে উঠিতে গেলাম । কিন্তু ইহা কিসের আলামত ! সাদা উর্দিধারী এক ব্যক্তির নিষ্ঠুর বাঁধা । কহিলাম ," ট্রেন চলিতে শুরু করিলে ডান হস্তের কর্ম সম্পাদন করিব ।

" শুনিয়া "ভদ্রলোক' কহিলেন ," যাইবেন কোথায় ?" কহিলাম "ক" জেলায় । উনি কহিলেন ২০০ টাকা লাগিবে । গদিতে বসাইয়া নিয়া যাওয়া হইবে । কহিলাম , "আমরা ইস্টুডেন্ট" । যেন গগন হইতে ভূপতিত হইয়া বলিলেন , "তাহাতে কি হইয়াছে ! ইহা কি লোকাল বাস পাইয়াছেন নাকি ! ইস্টুডেন্ট হোন আর যাহাই হোন তাহাতে কিছু আসিবারও নহে যাইবারও নহে ।

" বলিলাম, "ট্রেনে উঠিতে দিন , চলিতে চলিতে কথা হইবে'' এইযাত্রা রক্ষা হইল বলিয়া মনে হইল । সম্মুখে কি হইবার আছে ভাবিবার অবকাশ পাইলাম জানালার পাশে গদিতে বসিয়া । বন্ধু "স" কহিল, তাহার নিকট একশত বিংশ টাকা রহিয়াছে । আমি কহিলাম আমার টাকার থলিতে একশত টাকার একখানা কাগজ ব্যতিরেক কিছুই খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না । দুইখানা একশত টাকার কাগজ আর একখানা বিংশ টাকার ।

সাদা উর্দি 'ভদ্রলোক' মশাইকে ৫০ মুদ্রা দক্ষিণা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হইল । কিন্তু টাকা যে ভাঙাইতে হবে তাহাতে । একশত টাকা হস্তগত হইলে যে সাদা উর্দি "ভদ্রলোক" মশাই আহ্লাদে নয়খানা হইয়া আর কিছুই ফেরত দিবেন না তাহা না বুঝিবার মত মস্তিষ্ক আমাদিগের ছিল না । আচমকা যেন মেঘ চাহিতেই মেঘ পাইয়া গেলাম । রেলওয়ের আরেক সাদা উর্দি মশাই যাহাকে খাঁটি বাংলাতে বেয়ারা বলা হইয়া থাকে উনি নাস্তার বাটি নিয়া হাজির হইলেন ।

ইতোমধ্যে ট্রেন চলিতে শুরু করিয়াছে । টাকা ভাঙ্গাইবার এমন সুযোগ কে হস্তছাড়া করিবে ! পুছিলাম, ' কত হে মামা খাদ্যখানি? " কহিল একগাল হাসিয়া উনি , " ২০ টাকা হইলে পাবেন খাদ্য ও পানি " । কিঞ্চিৎ অবাক হইলাম বটে । বাটিতে তিন পদের খাদ্য নজর হইতেছিল । আবার পুছিলাম, " কত হে মামা ? " মামা কহিলেন , ' ২০ টাকা' ।

তাহার আঙ্গুলখানি প্লেটের এককোণায় চলিয়া গেল । অবিশ্বাসের সুরে কহিলাম শুধু কি বিশ ? উনি হু হা করিয়া সামনে সিটে চলিয়া গেলেন দুই বাটি খাদ্য কিংকর্তব্যবিমূঢ় আমাদের দুই মূর্তির কোলে ত্যাগ করিয়া । একে অপরের পানে চাহিয়া প্রথমেই পাউরুটি খাওয়া শুরু করিলাম । লাল জেলিসদৃশ বস্তু দ্বারা মাখানো বলিয়া খাইতে মন্দ লাগিল না । এইবার টিস্যুকাগজে মোড়ানো অন্য দুই খাদ্যদ্রব্য খুলিয়া দেখিলাম ।

প্রথম বস্তু দেখিয়া তো চক্ষু চড়কগাছে উঠিল । এ যে ভাজা মুরগির মাংস । অন্য বস্তুটি যে কি বুঝিলাম না ঠিক যদিও ভবিতব্যে খাইয়া যথেষ্ট আমোদ অনুভব করিয়াছিলাম । ভাবিলাম দেশে ভালোই উন্নতি হইয়াছে বোধ হইতেছে । বিংশ টাকায় এতকিছু এই একবিংশ শতাব্দীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন হলে কোনদিন খাইয়াছি বলিয়াও স্মৃতিতে উকি দিতেছিল না ।

মনে সন্দেহ জাগিল । বন্ধু "স" কে পুছিলাম , " ভ্রাতা , এ কী বস্তু দিয়া গেছে কেবল বিশ টাকা বলিয়া ! সে কি বিশ বলিয়াছিল নাকি একশত বিশ ! ? " বন্ধু আশ্বস্ত করিল সেও বিশ শুনিয়াছে । তবু কাহারো মনের সন্দেহই কাটিল না । কয়েকশত সেকেণ্ড অপেক্ষার পর দেখিলাম মামা গদির পাশ দিয়া পেছনের গদিতে যাইতেছেন । আবার পুছিলাম কত হে মামা ? উনি বিরক্ত কণ্ঠে কহিলেন বিশ ।

এইবার সব সংশয় পাশের জানালা দিয়া ফালাইয়া দিয়া দক্ষিণহস্তের কর্মে মনোযোগ দিলাম । এমতাবস্থায় আসিলেন দরজার সেই সাদা উর্দিধারী 'ভদ্রলোক' । পুলকিত ভাব নিয়া কহিলেন, " কি ইস্টুডেন্ট সাহেবেরা , ভালোই তো ভোজন করিতেছেন ! " বন্ধু 'স' কহিল টাকা ভাঙ্গাইতে হইবে যে । আপনাকে নচেৎ কি দিব ! উনি কহিলেন, " বেশ বেশ । চিন্তা করিবেন না ঘুরিয়া আসিতেছি ।

" খাওয়া শেষ করিয়া ১০০ টাকার কাগজ নিয়া অপেক্ষা করিতে লাগিলাম । ক্ষুদ্র অপেক্ষার অবসান ঘটাইয়া মামার আগমন ঘটিল । বাটি ফেরত নিয়া দক্ষিনহস্ত অগ্রসর করিলেন । বন্ধু 'স' একশত টাকার কাগজ খানি ধরাইয়া দিল । মামার মস্তকে যেন সহস্র কিলোটনের নিউক্লিয়ার বোমা বিস্ফোরিত হইল ।

উনি কহিলেন , " এইটা কী ? " আমরা কহিলাম "ষাট ফেরত দাও হে মামা । ভাংতি হইবে না । " মামা চমকিত হইয়া ধমকিত সুরে কহিলেন , " ২৪০ হইয়াছে । " আমরা কহিলাম ," কি হে মামা ! তুমি যে ২০ করিয়া বাটি দেখাইয়া দিয়া গিয়াছিলে !" মামা বাংলিশে কহিলেন , " পাউরুটি বিশ ,বলি Bread বিশ । কাবাব,স্যান্ডউইচ কি বিনামূল্যে গ্রহণ করিবেন ? " ইহা হইতে নিষ্ঠুর বাক্য শেষ কবে শুনিয়াছিলাম স্মৃতিতে আনিতে পারিলাম না ।

এইবার আমাদিগের মস্তকে সহস্র মেগাটনের নিউক্লিয়ার বোমা বিস্ফোরিত হইল । বলে কি লোক !!! আমাদিগের নিকট সর্বসাকুল্যে হইবে ২২০ টাকা । ২৪০ কোথা হইতে হইবে ! জনসম্মুখে মান সম্মান কি এইরূপে ধুলোয় মিশ্রিত হইবে ! জানালার স্নিগ্ধ বৈশাখী হাওয়ার মাঝেও ঘাম জাগ্রত হইল । বুকের মাঝে যেন চিনচিনে ব্যথা লাগিতেছিল । বুকে হাত দিতেই কি যেন ঠেকিল ।

বাজ চমকাইবার মতো মনে পড়িল বুকপকেটে তিনশত টাকার কোষাগার রহিয়াছে । বুলেটের বেগে টাকা বাহির করিলাম । চমকিত হইয়া গেলাম । মামার হাতে ধরাইয়া দিয়া এই যাত্রা মুক্তি পাইলাম বোধ হইল । সত্যই কি মুক্তি পাইলাম ।

সাদা উর্দি ধারীদের খেলা যে একে একে চলিতেই থাকে । আরেক মামা আসিলেন খাবার নিয়া । সাদা উর্দির বুকপকেটে লেখা BR । উনি পুছিলেন কিছু নিব কিনা । দেখিলাম সেই একই খাদ্য তালিকাভুক্ত বাটি ।

কৌতুহলবশত পুছিলাম ," কত হে মামা !" কহিলেন মামা , " ২০ টাকা মাত্র । " কহিলাম , " আশ্চর্য !" এইবার পুছিলাম কোনটা বিশ ? মামা পাউরুটিতে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া কহিলেন , " ইহা বিশ । " পুছিলাম , " তবে বাটিতে যে তিন প্রকার খাদ্য আছে ? কেবল একটার দাম কহ কেন ? আপনারা যে এভাবে বিংশ করিয়া কহিয়া খাদ্য দিয়াই দৌড় দিয়া থাকেন তাহাতো আমাদিগের মতো নিরীহ বালকদের মনে বিভ্রান্তির সূচনা করে । " মামা এইবার সদানন্দ চিত্তে কহিলেন , "একশত বিশ বলিলে বেশি বেশি লাগিতে পারে । কেউ খরিদ করিতে চাহে না ।

তাই বিশ কহিয়া থাকি । " পুছিলাম , " সবাই তো ইহা বুঝিতে পারিবে না " মামা নিষ্ঠুরভাবে কহিলেন ," যে বুঝিবে সে-ই খাইবে । তা আপনারা কয় বাটি খাইয়াছেন আর কত খরচ গিয়াছে? " করুণসুরে জবাব কহিতেই মামা সহাস্য প্রস্থান করিলেন । কাঁটা ঘায়ে যেন নুনের মালিশ পড়িল । জানালা দিয়া বাঁকা চাঁদখানিকে দেখিয়া মনে হইল উহাও তীব্র ব্যাঙ্গের হাসি হাসিতেছে ।

সেই চন্দ্রমুগ্ধ রাত্রের আক্কেল সেলামীর অবসান ঘটিয়াছিল দরজার সেই সাদা উর্দিধারী 'ভদ্রলোক' যাহাকে ভদ্রলোকে টি.সি. বলিয়া থাকে তাহার দক্ষিণে হস্তে ষাট টাকা সম্প্রদান করিয়া । ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৭ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.