আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিস্ময়কর দাসী

এক বুযুর্গ। আল্লাহর ওলী। দিবা-রাত্রির বেশির ভাগ সময় আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন থাকেন। লোকজন তাঁকে ভক্তি করত। ভালবাসত।

বিভিন্ন প্রয়োজনে দোয়ার জন্য আবেদন জানাত। তিনি বলেন, আমার এলাকায় এক পরমা সুন্দরী দাসী ছিল। মাঝে মধ্যেই সে আমার কাছে আসত। ইসলাম-ঈমান, কবর-হাশর, জান্নাত-জাহান্নাম ইত্যাদি সম্পর্কে নানাবিধ প্রশ্ন করত। জানতে চাইত ধর্মীয় বিধি-বিধান।

আমি তার প্রশ্নের জবাব দিতাম। যথাসাধ্য উত্তম আচরণ করতাম। যখনই সে আসত, আমি লক্ষ করতাম, সে তার ঠিকরে পড়া সৌন্দর্যকে লুকাবার চেষ্টা করছে। কেন করত তা আমি জানি না। তবে তার এ সংযত আচরণ আমার কাছে খুবই ভাল লাগত।

একদিনের ঘটনা। আমি বাজারে যাচ্ছি। হঠাৎ আমার দৃষ্টি পড়ল সেই ক্রীতদাসীর উপর। এক ব্যক্তি তার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। চিৎকার করে বলছে, এই ত্র“টিপূর্ণ দাসীটিকে কেনার মতো কেউ আছে কি? আমি একে অল্পমূল্যে বিক্রি করে দেব।

আমি এগিয়ে গেলাম। দাসীটিকে লক্ষ করে বললাম-- তুমি কি সেই মেয়ে, যে আমার কাছে মাঝে মধ্যে যেতে এবং বিভিন্ন প্রশ্ন করতে? হ্যাঁ। আমিই সেই মেয়ে। তিনি কি তোমার মনিব? পাশের লোকটিকে দেখিয়ে প্রশ্ন করলাম। জ্বি না।

আমার মনিব আশেপাশেই আছেন। এখনই এসে পড়বেন। তোমার এ অবস্থা কেন? তোমার মনিব কেন তোমাকে বিক্রি করে দিতে চায়? মেয়েটি এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময় পেল না। এরই মধ্যে তার প্রকৃত মনিব এসে হাজির হলো। মনিব ছিল অগ্নিপূজক।

আগুনের পূজা করত সে। দাসীর প্রতি চরমভাবে ক্ষিপ্ত হয়েই সে তাকে বিক্রি করতে বাজারে নিয়ে এসেছে। আমি মনিবকে প্রশ্ন করলাম- এই দাসীটির কি সমস্যা? কী দোষ তার? কেন তাকে বিক্রি করতে চাচ্ছে? জনাব! মেয়েটির বুদ্ধিমত্তা ও অপরূপ সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে আমি ওকে চড়া মূল্যে খরিদ করেছিলাম। আমি যখন আগুনের পূজা করতাম, সেও তখন আমার সাথে আগুনের পূজা করত। বেশ ভক্তি ও শ্রদ্ধার সাথেই করত।

তারপর এক রাতের ঘটনা। আপনাদের ধর্মের এক লোক আমার বাড়িতে এল। তারপর কুরআন থেকে একটু পাঠ করে শোনাল। কুরআনের বাণীতে কী আছে জানি না। কিন্তু এ বাণী কানে পৌঁছতেই ও চিৎকার দিয়ে উঠল।

আমরা ভয় পেয়ে গেলাম। দৌড়ে গেলাম তার কাছে। দেখলাম, তার চোখে মুখে চরম অস্থিরতার চিহ্ন। আমরা তাকে অনেক কিছুই জিজ্ঞেস করলাম। কিন্তু কোনো কথারই সে জবাব দিল না।

সেদিন থেকেই তার জীবনধারায় পরিবর্তন এলো। আমরা ল্য করলাম, সে আমাদের প্রভুদের ছেড়ে দিয়েছে। সে আর এখন আগুনের পূজা করে না। রাত হলে সে পশ্চিম দিকে ফিরে আপনাদের মত নামায পড়ে। তাকে অনেক বুঝালাম।

বাধা দিলাম। এমনকি মারধর করলাম। কিন্তু ফলাফল কিছুই হলো না। ধীরে ধীরে তার রূপ-সৌন্দর্য লোপ পেতে লাগল। অবশেষে বহু চেষ্টা করেও যখন তাকে সংশোধন করতে পারলাম না, তখন সিদ্ধান্ত নিলাম, বিক্রি করে ফেলব।

আমি দাসীটিকে বললাম, তোমার মনিব যা বলেছে তা কি ঠিক? সে ইশারায় বলল- হ্যাঁ, ঠিক। আমি মনে মনে আফসোস করলাম। ভাবলাম আহা, এরা না বুঝার কারণে হীরাকে কাঁচ মনে করে ফেলে দিতে চাচ্ছে! আলোকে অন্ধকার মনে করে তাড়ানোর চেষ্টা করছে! মাওলার পরিচয় না পেলে মানুষ বুঝি এমনই হয়!! অতঃপর আমি মেয়েটিকে বললাম, বলতো পবিত্র কুরআনের কোন্ আয়াতটি তোমার জীবনে এ মহা বিপ্লব বয়ে আনল? সে আমাকে আয়াতটি তেলাওয়াত করে শুনাল। যার অর্থ নিুরূপ : ‘‘তোমরা আল্লাহর কাছে ফিরে এসো। নিশ্চয়ই আমি তোমাদের জন্য আল্লাহর প থেকে স্পস্ট ভয় প্রশর্দনকারী।

” আয়াতখানা তেলাওয়াত করার পর সে আমাকে লক্ষ করে বলল, হুজুর! আল্লাহর এই কালামকে আমি সহ্য করতে পারি নি। এই কালাম আমার মধ্যে দারুণ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। হৃদয়ে তুলেছে সাইমুম ঝড়। ফলে আমার যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তা তো আপনাদের সামনে। মেয়েটির কথায় আমি সবকিছুই বুঝে নিলাম।

মনে মনে ভাবলাম, এই মেয়ে তো মাবুদকে পেয়ে গেছে। গভীর সম্পর্ক গড়ে নিয়েছে আল্লাহর সাথে। তাঁর মূল্য এখন আকাশ জমিনের চাইতেও বেশি। কিন্তু এই অগ্নিপূজক মনিব কি আর সেকথা বুঝবে? ওর কাছে থাকলে এই মহামূল্যবান দাসীটি হয়তো আজীবন অবহেলিতই থেকে যাবে। নাহ্ এমন একজন খোদাভীরু দাসীর কদর হওয়া দরকার।

এসব কথা চিন্তা করে আমি মনিবকে বললাম, আমি ওকে কিনে নেব। বলো মূল্য কত? সে বলল, বেচাকেনার আলোচনা পরে হবে। তার আগে আমার একটি কথা শুনুন। কথাটি হলো, আমার এক চাচাতো ভাই এই দাসীকে গভীরভাবে ভালবাসে। তার বিশ্বাস, সে ওকে স্বীয় ধর্মে ফিরিয়ে আনতে পারবে।

আমি যে আজ ওকে বিক্রি করার জন্য বাজারে নিয়ে এসেছি, একথা সে জানে না। এখন মনে হচ্ছে, আমি যদি একে বিক্রি করে দেই, তবে আমার উপর সে সাংঘাতিক নারাজ হবে। এমনকি প্রতিশোধ নেওয়ারও চেষ্টা করবে। এতে আমি ও আমার সহায়-সম্পত্তি নির্ঘাত হুমকির সম্মুখিন হবে। এমতাবস্থায় আমি কী করতে পারি আপনিই বলুন।

আমি বললাম, তুমি এ দাসীর মালিক। তুমি যদি বিক্রি করতে না চাও বা কোনোরূপ সমস্যা হবে মনে কর, তাহলে বিক্রি না করাই ভালো হবে। তবে তোমার কাছে আমার আবদার হলো, তুমি কিংবা তোমার চাচাতো ভাই অথবা তোমার ধর্মের অন্য কোনো লোক তার উপর যেন অত্যাচার না করে। আমাদের কথা শেষ হলো না। এরই মধ্যে মনিবের চাচাতো ভাই এসে হাজির।

সে মনিবকে ল্য করে চোখ রাঙিয়ে বলল, ওকে বিক্রি করতে এনেছো? তোমার সাহস তো দেখছি কম নয়। ওকে এসে না পেলে তোমার অবস্থা শোচনীয় হতো। যাক ভাগ্য তোমার ভালো! একটু থেমে সে আবার বলল, আমার হাতে ওকে দিয়ে দাও। উপযুক্ত মূল্য পাবে। এ বলে সে মেয়েটির হাত ধরে রওয়ানা হলো।

কিছুদূর এগুনোর পর মেয়েটি আমাকে ডেকে বলল, শায়েখ! একটা বড় কিছু ঘটবে ইনশাআল্লাহ, অতি শীঘ্রই জানতে পারবেন। এরপর কেটে গেল অনেকদিন। এরমধ্যে মেয়েটির কোনো খোঁজ খবর পেলাম না। মেয়েটির মালিক বা তার চাচাতো ভাইয়ের সাথেও দেখা হলো না। হঠাৎ একদিন ল্য করলাম, মালিকের চাচাতো ভাই সেই প্রেমিক ছেলেটি আমাদের সাথে নামাজ আদায় করছে।

আমি তাকে কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম- তুমি কি সেই ক্রীতদাসীর প্রেমিক নও? অবশ্যই। এখন কী অবস্থা? খুব ভালো। মেয়েটি কেমন আছে? ভালো আছে। একটু খুলেই বলো না। আপনি কী জানতে চাচ্ছেন তা পরিষ্কার করে বললে আমার জন্য সহজ হতো।

আমি জানতে চাচ্ছি, সেদিনের পর থেকে আজ পর্যন্ত তোমার ও তার সংক্ষিপ্ত অবস্থা। তোমাকে মসজিদে নামাজ পড়তে দেখে তো বড় বিস্ময় লাগছে। হ্যাঁ, শুধু বিস্ময় নয়, অপার বিস্ময়ের কথাই বটে! শুনুন সেই বিস্ময়ের কথা। এ বলে সে বলতে লাগল- সেদিন আমি মেয়েটিকে নিয়ে বাসায় যাই। অত্যন্ত নরম ভাষায় বুঝাতে চেষ্টা করি।

বড় বড় উপহারের প্রলোভন দেখাই। তাকে আযাদ করে বিয়ে করব, অতঃপর একটি সুন্দর ও সুখী পরিবার গড়ে তুলব- একথাও তাকে নানাভাবে বলি। আমাদের ধর্মে পুনরায় ফিরে এলে তার সকল আশা ও স্বপ্ন পূরণ হবে, সে হবে বিশাল বিত্ত-বৈভবের মালিক- সেকথাও তাকে বারবার বলতে থাকি। কিন্তু কোনো কথাই তার কানে ঢুকানো যায় নি। কোনো সদুত্তর পাই নি তার কাছ থেকে।

এভাবে অনেকদিন বুঝানোর পর একদিন আমি কোনো কাজে বাইরে যাই। ফিরে এসে দেখি, সে একটি চেয়ারে বসে আমার পরিবারের লোকদের সামনে নিয়ে আল্লাহর একত্ববাদ ও জিকির সম্পর্কে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করছে। অগ্নিপূজার তিকর দিকগুলো অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় তুলে ধরছে। বেহেশ্ত ও দোজখের বর্ণনা এমনভাবে উপস্থাপন করছে যেন তা চোখের সামনে ভাসছে। উপস্থিত সবাই তার কথা তন্ময় হয়ে শুনছে।

এ অকল্পনীয় ও অপ্রত্যাশিত দৃশ্য দেখে আমি হতবাক হয়ে গেলাম। মনে মনে বললাম- আমি চেয়েছিলাম, আমার ধর্মে তাকে ফিরিয়ে আনতে ; এখন দেখছি, ব্যাপার ঘটতে যাচ্ছে তার উল্টোটা। এ ঘটনায় আমি দিশেহারা হয়ে আমার এক বন্ধুর শরণাপন্ন হলাম। পূর্ণ ঘটনার বিবরণ দিয়ে তাকে বললাম, বন্ধু! তুই এবার একটি পথ বাতলে দে। আমি যে চোখে কেবল সর্ষেফূল দেখছি।

আমার বন্ধু ছিল বেশ চতুর। সে আমাকে বলল, চিন্তার কোনো কারণ নেই। তুই একটা কাজ র্ক। এখন বাসায় ফিরে তার হাতে একটা টাকার থলে তুলে দিবি। তারপর গোপনে সেটা সরিয়ে রাখবি।

অতঃপর খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে তার কাছে থলেটি আবার চাইবি। তখন নির্ঘাত সে থলেটি দিতে অম হবে। ব্যাস, এই তো সুযোগ। এই সুযোগে তাকে এমন একটা পিটুনি দিবি, যাতে তার বাপের নাম পর্যন্ত ভুলে যায়। তখন দেখবি, আল্লাহ আর আখেরাতের কথা তার মুখ দিয়ে কখনো বের হবে না।

বন্ধুর কথা অনুযায়ী পাঁচশত দিরহামের একটি থলে তার হাতে তুলে দিলাম। অতঃপর সে যখন নামাজে মগ্ন হলো, তখন পূর্ণ সতর্কতার সাথে থলেটি সরিয়ে নিলাম। কয়েকদিন পর আবার তার কাছে থলেটি চাইলাম। আর আচ্ছামত পিটুনি দেওয়ার জন্য দুই তিনটি লাঠিও প্রস্থুত রাখলাম। কিন্তু আশ্চর্যের কথা হলো, চাইতে না চাইতেই সে উঠে গিয়ে যথাস্থান থেকে থলেটি এনে আমার হাতে তুলে দিল।

এ দৃশ্য অবলোকন করে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। অস্ফুট স্বরে বললাম, আমি কোনো স্বপ্ন দেখছি না তো! একি কাণ্ড!! কোথায় পেল সে এই দিরহাম ভর্তি থলে!!! থলেটি নেড়েচেড়ে দেখলাম। দিরহামগুলো বের করে গুণলাম। সবই দেখি ঠিক আছে। দিরহাম কিংবা থলের মধ্যে কোনো পরিবর্তন নেই।

আমি যা দিয়েছিলাম ঠিক তাই। আমার বিশ্বাস হলো, এ দাসী যার ইবাদত করে নিশ্চয়ই তাঁর শক্তি অসীম। তিনি যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন। ইসলাম ধর্মই সত্য ধর্ম। ইহ ও পারলৌকিক মুক্তির জন্য এ ধর্মে দীতি হওয়া ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর নেই।

হুজুর! এরপর আমি আর একমুহূর্ত সময় নষ্ট করিনি। সঙ্গে সঙ্গে কালেমা পড়ে মুসলমান হয়ে যাই। সেই সাথে মুসলমান হয় আমার পরিবারের সকল সদস্যও। আর মেয়েটির অবস্থা হলো, সে এখন ভালোই আছে। মনমত নিরিবিলি আল্লাহর ইবাদত করছে।

কোনো বাধা নেই, শংকা নেই। এই তো চেয়েছিল সে। প্রিয় পাঠক! দেখলেন তো, আল্লাহর এক দাসী যখন আল্লাহর জন্য জীবন সঁেপ দিয়েছে তখন কিভাবে আল্লাহ তাকে সাহায্য করেছেন। তাই আসুন, আমরাও আল্লাহর কাছে নিজেকে সঁেপ দেই। তাঁর কথামত জীবন পরিচালনা করি।

তবেই আমাদের জীবন সফল হবে, সার্থক হবে। মনের আশা পূর্ণ হবে। কামিয়াব হব উভয় জাহানে। (সূত্র : মিছালী খাওয়াতীন, পৃষ্ঠা-২৫৪) ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।