ট্রেন শ্রীমঙ্গলে ঢোকার বহু আগে থেকেই বৃষ্টি, সিলেট শহরেও বৃষ্টি, আর লাউয়াছড়া রিজার্ভ ফরেস্টের গেটে এসেও বৃষ্টি। ভাগ্যিস একটা হার্ডওয়ারের দোকান থেকে তিরিশ টাকা গজে পলিথিন কিনে নিয়েছিলাম সবাই, শীতের চাদরের মত করে গায়ে মাথায় পেচিয়ে আমরা ঢুকে গেলাম জঙ্গলে। ঢোকার সময়ে প্ল্যান ছিলো এক ঘন্টার একটা ট্রেইলে হাটবো, এক বেরসিক গাইড বললো রক্তদান করতে হবে ঐ ট্রেইলে গেলে !!! মঞ্চাইতেসিলো শালারে ধইরা............ !
শ্রীমঙ্গল শহর থেকে ৮ কিঃমিঃ দূরে, ভানুগাছা রোডের পাশে রিজার্ভ ফরেস্ট লাউয়াছড়া সম্ভবত সুন্দরবনের পর বাংলাদেশের সবচেয়ে পরিচিত বন। যদিও ঢোকার মুখের বোর্ড বলছে এ জঙ্গলের সবচেইয়ে উল্লেখযোগ্য প্রানী হলো উল্লুক, পঞ্চাশের দশকে এখানে নাকি ভালুক আর চিতাও দেখা যেতো। দশ টাকার টিকেট কেটে আমরা ঢুকে গেলাম, গাইড ছাড়াই।
তিনটা ট্রেইল রুট আছে, আধা ঘন্টার, এক ঘন্টার আর তিন ঘন্টার। সৌখিন ট্যুরিস্টরা সাধারনত আধা ঘন্টার ট্রেইলটাই বেশি প্রেফার করেন, বাধানো রাস্তায় হেটে হেটে জঙ্গল দেখা !!!
আধা ঘন্টার ট্রেইল ম্যাপ
বৃষ্টি ঝরছে অঝোরে, আমরা গাইড ছাড়াই ঢুকে গেলাম ট্রেইলে। কপালে কি আছে দেখাই যাক না। বর্ষার মাঝে একটা দুইটা সাপও কি বেরোবে না! পাখির ডাক বন্ধ, রিমঝিম বৃষ্টির আওয়াজ আর একটানে ডাকা ঝিঝি পোকার লহরী। কাদামাখা পায়ে ছপ ছপ শব্দ করে নিঃশব্দে (??!!) হেটে যাচ্ছি আমরা।
ইতোমধ্যে অবশ্য রক্তদান প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে, পা থেকে টেনে জোক ঊঠালাম দুইটা। সামনে ট্রেইলটা আরো সরু, জঙ্গল বর্ষার পানিতে একদম ঘন হয়ে গেছে।
ট্রেইলের শুরু
বয়ে যাওয়া ছড়া
মাঝে মাঝে ছড়া বয়ে গেছে বেশ কিছু। খুব বেশি হলে হাটু পানি হবে, মানে এগুলো বর্ষাকালীন ছড়া। পাড়ের বালুটা খুব নরম, নাজমুল ভাই (দারাশিকো) পা দিতেই চোরাবালির মত দেবে গেলো।
একটু টিলার মত জায়গা পেরিয়ে আবার মোটামুটি সমতল।
গাছের সেতু - পিচ্ছিল এই জিনিস পার হওয়ার সাধ্য কারো নাই !!
এই পর্যায়ে বসে বসে এগোনো ছাড়া আর কোন উপায় নাই।
এক পর্যায়ে জঙ্গল এমনই গভীর হয়ে গেলো যে, আর হাটা যাচ্ছে না, শুরু হল বসে বসে ক্রল করা। উপরে আবার বেতের ঝাড় আর কিছু নাম না জানা কাটাগাছ। হাতে পায়ে গায়ে সমানে আটকে যাচ্ছে কাটাগুলো, আমরা বসে বসে এগোচ্ছি আর উপরে বৃষ্টি।
ঐ সময়ে সাপ-জোকের চিহ্ন মনেই ছিলো না কারো! কিছুক্ষন পর আবার হাটার রাস্তা পাওয়া গেলো। ঘন জঙ্গল, বিশাল লম্বা লম্বা দেশী বিদেশী গাছে ঢাকা পথ হেটে আরও দুয়েকটা ঝিরি পার হলাম, সামনে এসে দাড়ালো দুর্ভেদ্য জঙ্গল। একদম ডেড এন্ড, গাছ না কেটে আগানোই যাবে না। দা ছাড়া এসেছি আমরা, ছুরি-টুরিও নেই সাথে। পায়ের দিকে তাকালেই ঝামেলা, জোক তুলতে হয়।
এই চিনা জোক জিনিসটা খুবই খারাপ। পা থেকে হাত দিয়ে টেনে তুললাম, শালা চাইনিজ অ্যাক্রোব্যাটিক্স দেখিয়ে আমার হাতেই আবার কামড়ে ধরলো!!! তবুও এগুলো সাইজে বা দেখতে বান্দরবানের পাহাড়ী জোকগুলোর চেয়ে বেশ ভদ্র। উপায় না পেয়ে আমরা আবার ফিরে চললাম ট্রেইল ধরে। ততক্ষণে অবশ্য এক ঘন্টার বেশিই হয়ে গেছে। বুঝতে পারছিলাম না ট্রেইলেই আছি, না কি বেরিয়ে গিয়েছি।
বৃষ্টি মাথায় লাউয়াছড়া ট্রেক করার মিশনটা ঠিক ইম্পসিবল ছিলো না, আবার আমাদের জন্য সেটা অ্যাকমপ্লিশ করাও সম্ভব ছিলো না। তাই মিশনটা আপাতত............... হাফ পসিবল !!!
বেত ফল - এখনও কাচা, তবে এদের কাটায় আমাদের অবস্থা খারাপ
জঙ্গল এখানে খুবই ঘন
হেটে পৌছালাম রেললাইনের ধারে। লাউয়াছড়া জঙ্গল কেটে তিন টুকরো করেছে এরকম দু’টি রেললাইন। এখানেই কোথায় যেন ১৯৫৫ সালে শ্যুট করা হয়েছিলো জুলভারনের ক্ল্যাসিক মুভি - অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটটি ডেইজ। সঠিক লোকেশন কোথায় তা জানা ছিলো না।
এখানে মিনিট দশেক বসে আবার আধা ঘন্টার ট্রেইলটা ধরে হাটা শুরু করলাম। এখানকার সবকিছুই কৃত্রিম, নার্সারি - রাবার বাগান বাশবাগান আর লেবুবাগান। মিনিট দশেক পরই দেখি শেষ মাথায় চলে এসেছি............ কি হলো বুঝলাম না। ঘন্টা দুই লাউয়াছড়ায় ঘোরাঘুরি করে এক জোক ছাড়া দ্বিতীয় কোন প্রাণী চোখে পড়লো না, আমাদের এই আক্ষেপ দূর করতেই যেন পাইন গাছের মাথা থেকে আবির্ভূত হলেন কিছু বানর............। হঠাত দূর থেকে গম্ভীর কিছু ডাক শোনা গেলো, সেটা মায়া হরিণ না কাকার হরিণের ডাক (??!!!) সেটা ভাবতে না ভাবতেই একটু সামনে একটা গোয়াল ঘর দেখা গেল।
গরু দেখে এতো বিরক্ত আর কখনও লাগে নি !!!
রেল লাইন চলে গেছে বহুদূর............
যাত্রা শেষ............ ফেরার পথ ধরি
সব কিছু শেষ করে বেরিয়ে আসলাম গেটে, প্রায় আড়াই ঘন্টা পর। ওখানে শমশেরনগর থেকে শ্রীমঙ্গলগামী চা বাগানের ছোট ছোট পিকআপগুলো ফেরত যায়। তারই একটা থামিয়ে জনপ্রতি দশ টাকায় ফেরত আসলাম শ্রীমঙ্গল। ভেজা রাস্তায় বৃষ্টির মধ্যে ড্রাইভার বেটা গাড়ী চালাচ্ছিলো না, স্রেফ উড়াচ্ছিলো। স্কিড করে কিনা এই ভয়ে ভয়ে পৌছে গেলাম আমাদের পরের স্টপ - বিটিআরআই ক্যাম্পাসে।
শ্রীমঙ্গলের বড় বড় সবগুলো চা বাগান এখান থেকেই শুরু।
ভেজা রাস্তায় গতি - দ্য স্পীডে চলছে গাড়ী
একটা ছোট্ট ঘটনা দিয়ে শেষ করি। আমাদের রিজার্ভ গাড়ী ছিলো না, কি করব ভাবছি এমন সময় ঘ্যাচ করে একটা হাইয়েস মাইক্রোবাস থামলো গেটে। দুদ্দাড় করে তিন তরুণী দুই তরুণ নামলো। লাউয়াছড়া গেটের সামনে নানান পোজে ছবি তোলা হলো, গাড়ীর ভিতরে সম্ভবত তাদের গার্জিয়ানরা বসে, মুগ্ধ হয়ে দেখছিলেন তাদের সন্তানদের।
নানারকম ছবি তুলেটুলে অবশেষে সাই করে দরজা লাগিয়ে মাইক্রোবাস আবার চলে গেলো। নিশ্চয়ই তারা ঢাকায় বা সিলেটে ফিরে বন্ধুদের বলবেন, লাউয়াছড়া থেকে ঘুরে এসছি, দেখ দেখ ছবি !
কি চমৎকার বন ভ্রমণ, তাই না !!!!
দেখতে পারেন এটাও - ঝুম বর্ষায় মাধবকুন্ড হয়ে পরীকুন্ড - পরীরা যেখানে স্নান করে !!! (ছবি ব্লগ)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।