প্রতিবছর হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী উচ্চমাধ্যমিকের সীমানায় দাঁড়িয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো উচ্চশিক্ষার স্থানটিকে ঘিরে নানারকম স্বপ্নের জাল বুনে। সেই অনিন্দ্য সুন্দর স্বপ্ন-গুলকে ছোঁয়ার জন্য তিল তিল করে তৈরি করে নিজেকে । তারপর ভর্তি পরীক্ষার নামে ঝাঁপিয়ে পড়ে এক প্রচণ্ড সম্মুখ সমরে।
ইতিহাসের সকল যুদ্ধের মতো এ যুদ্ধের ফলাফলেও একই পরিবেশ বিরাজ করে। কোথাও চাঁপা দীর্ঘশ্বাসে বাতাস হু হু করে উঠে...............কোথাও-বা প্রভাতের সূর্যের হাসি ঝলমল করে উঠে।
অবশেষে এতো এতো ত্যাগ আর তিতিক্ষার পর তবেই না বিজয়ীরা স্বপ্নটাকে ছুঁতে পারে। তাদের ঝলমলে সুখানুভূতির রশ্মি যেন ছুঁয়ে যায় দিগন্ত থেকে দিগন্ত......হালকা হাওয়ায় দোদুল্যমান কচি পল্লবের ন্যায় দোলে তাদের কচি চিত্ত।
কিন্তু এই বিচিত্রসব স্বপ্ন জাগানিয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার এই একনিষ্ঠ স্বপ্ন-পূজারীদের বিনিময়ে কি দেয় ? কিংবা যা দেয় তা কি কাঙ্ক্ষিত ? তার বিপুল মণ্ডপে কি তার সকল পূজারীই সমান প্রসাদ লাভ করে ?
হ্যাঁ আপনার মতো আমিও একবাক্যে স্বীকার করি, আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্বাধীন বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ। বাংলাদেশের বহু ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী এই বিশ্ববিদ্যালয়। এর উন্মুক্ত গর্ভে বেড়ে উঠা শিক্ষার্থীরাই আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির হাল ধরে...............
..এ সকল কথার কিছুই আমাদের কাছে নতুন নয়।
আমরা সবাই এর বিপুল অবদানের ব্যাপারে অবগত আছি।
কিন্তু, আজ আমরা শুনবো আমাদের এই প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়েরই গর্ভে খু-ব ধীরে ধীরে .........নিঃশব্দে বেড়ে উঠা বিষাক্ত এক ঘায়ের কথা যা হয়তোবা একদিন এর সমস্ত অবদানকেই ম্লান করে দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
সেই দগদগে গা ঘিনঘিনে বাস্তবতার পটভূমিতেই আমার গল্পের বিষয়বস্তু উন্মোচিত.....
----------------------------------------------------------------------------------------------
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি আবাসিক হল। রাত ১০ টা।
গেষ্টরুমে তিনজন পলিটিকাল বড়ভাই বসে আছে।
এদেরকে পাতি নেতা বলা যায়। তবে পাতি নেতা শব্দটি ব্যবহার করলে কেবল এদের পদমর্যাদার আকারের ক্ষুদ্রতাকেই ইঙ্গিত করে। মানুষের নাম সংক্রান্ত তর্কের উৎপত্তি হলেই একটা কথা প্রায়ই শুনতে পাই “নামে নয়, গুনে বা কর্মেই নাকি পরিচয়”। তো এই ‘মহান’(?)... ‘ত্যাগী’(!!)... ‘ক্যাম্পাসের সবুজ চত্বরে বেড়ে উঠা’[]... ‘রাজপথের লড়াকু সৈনিক’দের[] কর্মের কথা কি বলবো ? কোন শব্দটি এদের কর্মের যথাযথ মূল্যায়ন করতে পারবে ? অনেকক্ষণ মাথা চাপড়ে শুধু একটা শব্দই খুঁজে পাই “ছ্যাঁচড়া নেতা”। আমাদের অর্থনীতিতে যেমন মধ্য-স্বত্বভোগীদের দৌড়াত্ব তেমনি আমাদের হলগুলোতেও ছাত্র রাজনীতির নামে তৈরি হয়েছে এই পরজীবী সদৃশ জাহান্নামের কীটগুলো।
কিন্তু পরজীবী মানুষের শরীরের রক্ত বা অন্য কোনও অংশবিশেষ চুষে রেহাই দিলেও এই “ছ্যাঁচড়াগুলো” এদের ভ্রাতৃতুল্য সাধারণ ছাত্রদের এতো অল্পতেই রেহাই দেয় না। এরা রক্তের সাথে এদের এবং এদের মা-বাবার বহুদিনের লালিত স্বপ্নগুলোকেও চুষে চুষে খেয়ে নেয়।
কিছুক্ষণ পর সাধারণ ছাত্ররা প্রবেশ করবে। এরা সবাই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নবীন ছাত্র । গেষ্টরুমের স্বল্প পরিসরের ভ্যাঁপসা গরমে এদের ক্লান্ত আর অবসন্ন দেখায়।
শুধু ভ্যাঁপসা গরমই এদের অবসন্নতার একমাত্র কারণ নয়। এদের ক্লান্তি আর অবসন্নতার সুদীর্ঘ কারণ আছে। নিতান্তই ভারবাহী গর্ধবের ন্যায় এরা পা ফ্লোরের সাথে ঘষে ঘষে প্রবেশ করে। প্রবেশপথের ধারে বসে থাকা “ছ্যাঁচড়া” নেতাগুলোর সাথে হাত মেলায়। এটা অনেকটা মধ্যযুগের দাসদের বাধ্যতামূলক কুর্ণিশ করার মতো যেখানে হাত মেলানোতে কোনোপক্ষেরই কোনও শ্রদ্ধাবোধ বা ভালোলাগা কাজ করে না, শুধু করার জন্যই করে যাওয়া।
কারণ জানামতে জোর করে নাকি আর যাই হোক মানুষের ভালোবাসা আদায় করা যায় না। নেতাদের সামনে সবাই সারিবদ্ধ হয়ে ইউ (U) আকৃতিতে দাড়ায়।
পাতি নেতাদের মধ্যে বুলেটের চেহারা বেশ সম্ভ্রান্ত । কিন্তু তার গলার আওয়াজ কিছুটা নাকি সুরের। তাই সে পলিটিকাল ফাপর নেয়ার চেষ্টা করলেও তার গলার আওয়াজের জন্য তা ঠিক ‘ফাপর’ হতে পারে না।
তার গৌড় বর্ণের চেহারার সাথেও ব্যাপারটা খুব একটা যায় না। কোনও ধরণের নেশা-টেশা নেই। তবে হঠাৎ হঠাৎ তাকে লোকমানের দোকানের কোণায় নিতান্তই আহাম্মকের মতো সিগারেট টানতে দেখা যায়। ডিপার্টমেন্টের ছোটভাইদের গোপন তথ্যমতে, এই সম্ভ্রান্ত চেহারার মানুষটিই নাকি একজন তুখোড় প্লেবয় ।
তুফানের চেহারা হচ্ছে সবচেয়ে ‘বদসুরত’।
সারাদিন সিগারেট তার দু’আঙুলের ফাঁক দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ে আর প্রায় রাতেই তার রুমে গাঁজার আসর বসে। তার চলাফেরা দেখলে মনে হয় লোকটা অপ্রকৃতস্থ। হঠাৎ হঠাৎ রেগে যায় আর রেগে গেলে মুখে যা আসে তাই প্রতিপক্ষকে বলে বসে।
এদের ভেতর বিদ্যুৎ ছেলেটি সবচেয়ে নিরীহ আর শান্ত মেজাজের। এই ছোটোখাটো মানুষটির নেশা বলতে মোবাইলে গেমস খেলা আর হা করে টিভি দেখা ছাড়া অন্য কোনও উল্লেখযোগ্য নেশা না থাকলেও এ দু’টো মাত্র গুনের বদৌলতে সে তার শিক্ষাজীবনের মূল্যবান দু’টি বছর ফার্স্ট ইয়ারে কাটিয়ে ফেলেছে।
যদিও সে হলে ঠিকই ‘বড় ভাই’ এর পদটি নিষ্ঠার সাথে অলংকৃত করে রেখেছে।
পা আর ফ্লোরের মধ্য থেকে আগত খসখসে আওয়াজ আর ছেলেদের গুনগুনানি যখন প্রায় ঝিমিয়ে পড়ে ঠিক তখন বুলেটের গলাটা রি রি করে উঠে।
- কিরে পোলাপান, ঐদিকে চাইপা খাড়া না! এক কোণায় সব্ডির কি ? আমাগোরে কি মুখ দেখাইতে ইচ্ছা করে না, না ?
তুফান এতক্ষণ বেশ মনোযোগ দিয়ে সিগারেট ধরাচ্ছিল। ধরানো শেষে চোখ বন্ধ করে একটা লম্-বা টান দেয়। তারপর একরাশ মুখ ভর্তি ধোঁয়া উর্ধ্বমুখে উদ্গীরণ করে দিয়ে সকলের উদ্দেশ্যে জিজ্ঞাস করে -তারপর ? কি অবস্থা তগো ? হলে কোনও সমস্যা নাই তো ?
ছেলেরা নির্জীব গলায় সমস্বরে অস্ফুটে বলে উঠে
-না বাই...
এই মর্তের পৃথিবীতে কোনও জায়গায় কোনও সমস্যা নাই এটা যেমন ডাহা মিথ্যা কথা তেমনি অনেক বড় বড় সমস্যাকে দাঁতে দাঁত চেপে হজম করে সমস্যা নেই বললেই খু-ব সত্য কথা বলা হয়ে যায় না।
এরপরে প্রতিদিনের রুটিন মাফিক প্রশ্ন করে বুলেট। এই প্রশ্নের গৎবাঁধা উত্তরে সে ভেতরে ভেতরে বেশ আমোদ বোধ করে। কারণ, তারা তিন বন্ধুর জন্য একরুম বরাদ্দ। এতে আমোদের কি ? তা গৎবাঁধা উত্তরটি শুনলেই বোঝা যাবে...
-এহন্ গণ রুমে তোরা আছোস্ কয়জন কইরা ?
এ প্রশ্নের উত্তরে ভিড়ের মধ্য থেকে ফিসফিস আওয়াজ উঠে। তারপর একজন বলে উঠে
-বাই, কালকে ১১০-এ ঘুমাই ছিলাম ৩৫ জন।
একজনের দেখাদেখি আরেকজন বলে উঠে
-আর ১১১-তে ভাই ৩৩ জন।
এই রুমগুলোর সাইজ ১০*১৪। এসব রুমে প্রথমে হল প্রশাসন কর্তৃক চার জন বরাদ্দ দেয়া হলেও সেই বরাদ্দের পরিমাণ প্রশাসিকভাবেই গিয়ে ঠেকেছে আট জনে, প্রতি বেডে ডাবলিং দেয়ার মাধ্যমে। অর্থাৎ এই আটজনই এই রুমগুলোর সর্বোচ্চ ধারণক্ষমতা। তাও একজন ছাত্র প্রশাসনিক ভাবে আবাসিক ছাত্র হিসেবে হলে সীট পায় থার্ড ইয়ারে উঠার পর।
এখন, একটা ছেলে যে ফার্স্ট বা সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে সে কোথায় থাকবে ?
আমার জানামতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে ‘বড়লোকের বাচ্চা’র সংখ্যা ‘গরীবের বাচ্চা’র তুলনায় কোনোক্রমেই বেশী নয়। আবার এই ‘গরীবের বাচ্চা’র অনেকেরই বাড়ি ঢাকা থেকে অনেক দূরে। অনেকের আবার ঢাকায় থাকার মতো আত্মীয়স্বজনও নেই।
কিন্তু, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন একটা নিতান্তই ‘উজবুক’ এর মতো মহানন্দে সীট বাড়িয়ে যাচ্ছে। আর অন্যদিকে এইসব ‘ছ্যাঁচড়া’ নেতারাও অবৈধভাবে ছাত্র উঠচ্ছে ছাত্ররাজনীতির নামে যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে ব্যবহার করার জন্য।
বিদ্যুৎ মোবাইলটা পকেট থেকে বের করতে করতে
-আপাততো থাক্ কষ্টমষ্ট কইরা। এই যে তোরা এতো কষ্ট কইরা থাকস্ প্রভোস্ট কি একটাবারও উঁকি মাইরা দেহে ?
ভিড় গলে কোনও উত্তর বেড়িয়ে আসে না। অবসন্ন ছেলেগুলো ভাবলেশহীন চেহারায় সামনে স্থির তাকিয়ে থাকে। কেউবা টিকটিক করে গড়িয়ে চলা ঘড়িটার দিকে কপাল কুঁচকে রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে চেয়ে থাকে। নতুন গেমসটা স্টার্ট দিতে দিতে আবার শুরু করে বিদ্যুৎ
-কোনোদিন দেখবোও না।
ভালোমতো politics করতে থাক, তাড়াতাড়ি সীট পায়া যাবি।
তুফান জড়ানো গলায় জিজ্ঞাস করে
-সবাই আইছে ?
সবাই নীরব। কোনও জবাব নেই। ফলে, তুফান ধমকে উঠবে
-কি জিগাইলাম তগরে ? আইছে সবাই ?
এবার ভিড় হতে মৃদু আওয়াজ উঠবে। ভিড়ের মধ্য হতে একজন বড়ভাইয়ের কাছে বিশ্বস্ততা প্রমাণের জন্য ব্যগ্র হয়ে উঠে
-ভাই, সজল আহে নাই।
একথা শুনে তুফানের চোখদুটো সরু হয়ে আসে।
-হারামজাদায় কই ?
-ভাই, Reading Room এ পড়তেছে।
বিদ্যুৎ ক্ষণিকের জন্য মোবাইল থেকে মাথা তুলে ঈষৎ ব্যঙ্গ করে খাঁকারি দিয়ে
-অরে আমার পড়ুয়ারে ! ডাক হারামিরে !!.........
তারপর নির্দেশের সুরে পেছনে দাঁড়ানো কয়েকজনকে উদ্দেশ্য করে
-ঐ রবিন, বিপ্লব যাহ্, হালারে ডাইকা আন ।
ভিড় থেকে খুব দ্রুত দু’জন বেরিয়ে যায়। বড়ভাইয়ের সান্নিধ্য লাভের এই তো সুযোগ!
কিছুক্ষণ পর সজলসহ আগের দু’জন প্রবেশ করে।
দু’জন ভিড়ের সাথে দাড়ায়। সজল দরজার কাছেই দাড়িয়ে থাকে। ঘরে একটা থমথমে পরিবেশ নেমে আসে হঠাৎ করে।
বিদ্যুৎ মোবাইলের দিকে তাকিয়েই জিজ্ঞাস করে
-কই ছিলেন আপনি বিদ্যাসাগর মশাই ?
সজলের ক্ষীণ কণ্ঠ বেরিয়ে আসে
- ভাই, কাইল পরীক্ষা...
তুফান চট করে চোখ মেলে তাকায়
-এই তোর কাইল পরীক্ষা তো আইজ কি ?
বুলেট সজলকে তর্জনী দিয়ে ইঙ্গিত করে
- ঐ সামনে আয়া সোজা হইয়া খাড়া। কয়দিন হইছে হলে উঠছোস্ ?
- জ্বী ভাইয়া?...এই তো পনের দিন ।
বুলেট এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে
-নাম কি তোর ?
-জি ? সজল ।
সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ধীরে ধীরে
-পুরো নাম বল্.........
-মোহাম্মাদ মোহাইমিনুল রিয়াসাদ সজল।
বুলেট যেনও নাম শুনে খুশি হয়
-নাম তো দেহি পুরাই খানদানী। বাড়ি কই তোর ?
-জি, পঞ্চগড়।
বিদ্যুতের এক গেইম শেষ হয়েছে ইতিমধ্যে।
সে মুখ বাঁকিয়ে বলে উঠে
-ও......মঙ্গারথোন উইঠ্ঠা আইছোস্ ?
বিদ্যুৎ তুফানের কাছ থেকে সিগারেট নিয়ে টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়বে। প্রায় এক’শ বিশ জনের মতো মানুষ একটা ছোট্ট ঘরে গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে থাকায় ইতিমধ্যেই ঘরটিতে গুমট একটা পরিবেশ বিরাজ করছে। তাতে তুফান আর বিদ্যুতের সিগারেটের ধোঁয়া রুমটাকে ধোঁয়াটে করে দেয়। এখানে ন্যূনতম হাঁপানির কোনও রোগীর পক্ষে সজ্ঞানে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব নয়। তাই এই কক্ষটিকে এই মুহূর্তে সুপ্ত শ্বাসকষ্টের রোগী নির্ণয়ের একটা ছোটো খাটো পরীক্ষাগারও বলা চলে এবং মাঝেমাঝে যে এ ধরনের রোগী নিতান্তই ধরা পড়েনা তা নয়।
ততোক্ষণে সজল গা এলিয়ে দিয়ে ঝিমতে শুরু করবে। বিদ্যুৎ ব্যাপারটা খেয়াল করে হঠাৎ ধমকে উঠে
-ঐ ঝিমছ্ ক্যান্ ? গেষ্টরুমে ক্যাম্নে খাড়াইতে হয় জানোছ্ না ? হাত পেছনে নেহ্ !
দাঁড়ানো সন্ত্রস্ত ছেলেদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে
- কিরে হারামিরা, অরে তো হলের নিয়ম কানুন কিছুই হিকাছ্ নাই!
সজল ইতিমধ্যে সচকিত হয়ে তার অবসন্ন শরীরটা টেনে সোজা হয়ে দাঁড়াবে
-ভাই, কাল সারারাত ছারপোকার কামড়ে ঘুমোতে পারিনি।
এ কথা শুনে বিদ্যুতের মেজাজটা আরও তিরিক্ষি হয়ে উঠে। হলটাকে সে তার বাপ-দাদার সম্পত্তির থেকে কোনও অংশে কম মনে করে না। নিজের বাপ-দাদার ঘরের বিরুদ্ধে এত্তো বড় অভিযোগ কার সহ্য হয়, বলুন ? ব্যঙ্গ করে অতিমাত্রায় শুদ্ধ করে বিদ্যুতের জবাব
-ওরে আমার নবাবরে............ছারপোকার কামড়ে ঘুমুতে পারিনি এতোই যখন খোজো...যাও না বাইরে গিয়ে মেস ভাড়া করে থাকো।
এখানে আসিস কেনো ‘বড়লোকের বাচ্চা’ ?
ইতোমধ্যে নতুন সিগারেট ধরিয়ে চোখ বন্ধ করে টানছিল তুফান । সিগারেটে শেষ টান দিয়ে সে অবশিষ্টাংশ পা দিয়ে পিষে ফেলে এবং সজলের দিকে নেশাগ্রস্থ চোখে তাকায়। কিছুটা জোড়ানো গয়লায়
-তোরে তো আমি মেলা দিন ধইরা খুজতাছি। প্রত্যেকটা দি-ন আহি...মাগার তোরে পাই না। সমস্যা কি তোর ?
সজলের ভেতরটা কেঁপে উঠে।
হাতের তালুতে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠে। চোখেমুখে জিজ্ঞাসু ভাব, কিছুই বুঝতে পারেনি সে। কেনো খুঁজছে তাকে? তাই ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া গলায়
-জি...জি ভাইয়া ? বুঝলাম না।
- চোখে কি কম্ দেখোস্ ?
সজল খুব দ্রুত শূন্য মস্তিষ্কে স্মৃতি হাতড়ে বেড়ায়। কোনোকিছুই না পেয়ে সে আরও ভয় পেয়ে যায়।
জবাব দিতে গিয়ে ঢোক গিলে বসে
-না...নাতো ভাইয়া.........
তুফানের চোখদুটো আরও সরু হয়ে আসে
-ঠিক তো ?
সজল এ ক’দিনেই এই সরু দৃষ্টির অর্থ বুঝে উঠেছে। তাই আসন্ন বিপদের কথা ভেবে তার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসে। অস্ফুটে
-জ্-জ্ব-ই ...
তুফান হঠাৎ চিৎকার করে উঠে পাগলের মতো
-তাহলে শোন্ হারামজাদা.........আরেকদিন তোরে দেখুম্ যে বড়ভাই দেইক্ক্ষা রাস্তাঘাটে সালাম দেস্ নাই। তাইলে কইলাম লাথ্যি দিয়া বুকের খাচা আউলাইয়া ফালামু...
মুহূর্তের জন্য পিন্পতন নীরবতা নেমে আসে। এই সুযোগে ঘড়ির কাঁটাটা তার সরব অস্তিত্ব জানান দিতে থাকে।
যারা বিরক্ত মুখে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় গুনছিল তারা চট করে মাথা নত করে ফেলে। সেই নীরবতা ভাঙবে বিদ্যুৎ। সে ইতোমধ্যে নতুন গেমস শুরু করেছিলো। মোবাইলের দিকে তাকিয়েই মাথা ডানে বামে নাড়িয়ে উদাস গলায়
-No শ্রদ্ধা, No Respect ! আরে আমরা যে বড়ভাই গো কত Respect করছি ! বাথরুমে দেখা হইলে পর্যন্ত সেলামাল্কি দিছি।
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে
-বেআক্কেল পোলাপান সালামের মর্ম বুঝলো না !!
সরু চোখে এবার বুলেটের মুখ থেকে পাল্টা প্রশ্ন
-তোর সামনে যে বড়ভাইরা বইসা আসে তাগো নাম জানোস্?
সজলের হাতের আঙ্গুলগুলো মৃদু কাঁপছিল।
বড়ভাইদের নাম মনে মনে স্মরণ করার আগেই ঝটপট জবাব দিয়ে বসে
-জি...?...জি ভাই।
-বলে যা............
সজল একপাশ থেকে দেখিয়ে শুরু করে
-বুলেট ভাই...আর...তুফান ভাই...আর...আর...............
বিদ্যুতের কাছে এসে থেমে যায়। আর এগোতে পারে না।
বিদ্যুৎ একথা শুনে চট করে মোবাইল থেকে চোখ সরিয়ে সজলের দিকে সরাসরি তাকায়। ব্যাচ-মেটদের কাছে এই অপমান নিতান্তই অসহ্য ঠেকে।
তাই দিশেহারা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অন্যান্য ছেলেগুলোর দিকে তাকিয়ে
-কিরে? আমার নাম কি? আমারে কি ধইঞ্চা মনে হয়?...ধইঞ্চা? আমি কি আস্মান থোন্ পড়লাম না বানের জলে ভাইস্যা আলাম্ ?............
কোথাও থেকে কোনও জবাব ভেসে আসে না। তাই কোণায় দাঁড়ানো একজনকে নির্দেশ করে
-ও-ই...ঐ কোণায় লাল শার্ট। তুই সবার নাম কইতে পারবি ?
-হ বাই...
-ক দেহি, হালার না পারলে আইজ রাইতেই তোরে হলের তে দিমু বাইর কইরা।
কিঞ্চিৎ ইতস্তত: করে ছেলেটি শুরু করে
ভাই...বুলেট ভাই...ভাই...তুফান ভাই...বিদ্যুৎ ভাই।
ছেলেটির এ সাফল্যে বিদ্যুৎ মনে মনে খুশি হয়।
ভাবে, ‘যাক বাবা, মানির মান আল্লায়ই রাখে’। কিন্তু চোখে-মুখে সেটা প্রকাশ করে না বরঞ্চ সজলের প্রতি রাজ্যের বিরক্তি ফুটিয়ে সজলকে বলে বসে
-ওই মদ্না হালা, সবার নাম মনে থাক্বো ?
-জি ভাই।
-হলে থাকতি হলে পরে কি করা লাগে জানিস্ ?
-জি ভাই ?মারামারি করতি হবি। দা, চাপাতি, রড দেকেছিস্ কখনো ?
-না বাই।
-এ বুলেট, এতো দেক্ছি মেন্দা বিলাই।
এই তোর girlfriend আছে? অ্যাঁ ?
সজল মাথা নিচু করে থাকে। স্মৃতির দলিল-দস্তাবেজ ঘেঁটে এ মুহূর্তে তেমন কাউকেই খুঁজে পায় না। বস্তুতপক্ষে তার girlfriend ছিলও না কখনো। কিন্তু বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ কিছু ভাবনারা এসে মনের কোণে অবাধ্য হয়ে উঁকি দিতে শুরু করে...একটা সবুজ জামা...গো-ল একটা মুখ...দু’ভ্রুর ঠিক মাঝখানটিতে খু-ব ছোট্ট একটা কালো টিপ...খোলা লম্বা চুলগুলো সামাল দেয়ার জন্য মাথায় ছোট্ট একটা ক্লিপ । সজল প্রায়ই খেয়াল করেছে যে, মেয়েটা এক গালে হাত দিয়ে হা করে লেকচার গেলে আর রাস্তা দিয়ে যখন হেটে যায় তখন সোজা সামনে তাকিয়ে প্যারেড করার মতো হাত-পা নাড়িয়ে হাটে।
সজলের হাসি পায় আবার ভালো লাগাগুলোও ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়। সজল টের পায় তার নার্ভাসনেস্টা ধীরে ধীরে কমে আসছে। কিন্তু যার সাথে কোনোদিন কথাই হয়নি তাকে তো আর girlfriend বলা যায় না !
-এই তোর কি কানেও সমস্যা ?
তুফানের ধমকে সজল মৃদু কেঁপে বাস্তবে ফিরে আসে
-জি...? জি না ভাই...।
- তাইলে জবাব দেস্ না কেন ? থাব্ড়া দিয়া কানের পর্দা ফাটায়া ফালামু কইলাম......আর...এই বিদ্যুৎ কি সব পোলাপানরে তুই কি জিগাস্ ? এইসব হিজ্ড়া পোলাপানের কি কোনোদিন girlfriend হয় নাকি ?
বুলেট প্রসঙ্গ পাল্টায়
-ওই, হলে থাকতে গেলে পরে প্রোগ্রাম করা লাগে। এইডা জানোস্নি ? নাকি এইডাও জানোস্ না ?!
ঠিক কোন প্রোগ্রামের কথা বলা হচ্ছে তা চট করে বুঝতে পারে না
- জি ভাই?
-আয় হায়...এ দেহি আস্মান তন পড়ছে।
হলে থাকতে গেলে আমাগো লিডারের প্রোগ্রাম করতে হবে।
বিদ্যুৎ আরও কিছু সন্দেহ করে
-প্রোগ্রাম তো পরের কতা আগে দেখ অয় আমাগো লিডারের নাম জানে নাকি। কি জানোস্ নাম্ ?
-না বাই
কাঙ্ক্ষিত উত্তর পাওয়ায় বিদ্যুৎ তার হলুদ একপাটি দাঁত বের করে ব্যাচ মেটদের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠে
-হে হে হে...কইছিলাম না ? হেয় কত নম্বর রুমে থাকে জানোস্ ?
-না বাই।
-অই কলেজে politics করছিলি ?
-না বাই।
বুলেট এতক্ষণ মুখ শক্ত করে শুনে যাচ্ছিলো।
এবার আর ধৈর্য ধরে রাখতে পারে না
-না বাই...না বাই...শুনাতে শুনাতে তো কানে ঘা করে দিলি। কে তোরে মানা করছিলো ?
ধমক খেয়ে সজলের কণ্ঠটা আবার মৃদু হয়ে আসে
-ভালো লাগতো না ভাই।
-তয় এহন হলে থাকবি ক্যাম্নে ? এহন ভালো লাগবো ?
দাঁতে দাঁত চেপে সজল ভাবে ‘ভালো তো লাগাতেই হবে’। মুখে শুধু বলে
-জি বাই।
তুফান যেনও সজলের মনের কথা টের পেয়ে যায়।
তাই মনে হয় ধমকে উঠে
-আরে রাখ্ । সীট পাওয়ার জন্য এসব বলতেছে । অই সজইল্যা, তোর হলে থাকার নিয়ত আছে ?
-জি বাই, আছে।
-তয় যাহ্...৫০১ নম্বর রুমে মাস্টার্সের মোকাররমে মাইর দিয়া আয়। পারলে অক্ষণি তোরে ঐ রুমে সীট দিয়া দিমু।
সজল জবাব না দিয়ে ইতস্তত: করে। সজল মনে মনে ভাবে, সে ভুল শোনেনি তো? না ভুল হবে কেন? স্পষ্টই তো শুনেছে সে। কিন্তু, মাস্টার্সের একজন ভাইকে তার মতো ফার্স্ট ইয়ারের ছেলে কিভাবে মারতে পারে তা তার জানা নেই। তাই সে কি করবে ভেবে পায় না।
সজলের ইতস্তত: ভাবটাও মনে হয় তুফান ধরে ফেলে
-কিরে খাড়ায়া আছোস্ ক্যান্ ? সত্যই কি মাইর খাওনের শখ হইছে ?
এ কথা শুনে সে আরও দিশেহারা বোধ করে।
বিড়বিড় করে শুধু বলে
-বড়ভাইরে মারা কি উচিত হবে...?
এতক্ষণ সোফায় হেলান দিয়ে কথা বলছিল তুফান। সজলের কথা শুনে সে সোজা হয়ে উঠে বসে। নিরীহ বালকের ঠুনকো যুক্তি তার কাছে চরম স্পর্ধা বলে বোধ হয়
-তুই আমারে উচিত-অনুচিত শিখাছ ? অই varsity তে খালি তুই একলাই পড়োস্ ? আমরা পড়ি না ? আমরা কোন্টা উচিত আর কোন্টা অনুচিত হেইডা বুঝি না ?
সজলের কথা শুনে বুলেটের গলায়ও বিস্ময় ঝড়ে পরে
-হালায় তো দেহি Most Foul !
-হারামজাদারে হলেরতে বাইর কর্...এক্ষণ বাইর কর্। হে হলে থাক্বো, আবার প্রোগ্রাম, মারামারি কিছুই করবো না; অরে এমনি এমনি হলে রাখুম্ নাকি ?
এমন সময় বাইরে নীরবতাকে বিদীর্ণ করে মটর সাইকেলের বিকট আওয়াজ শোন যায়। মোবাইলে কথা বলতে বলতে লিডার প্রবেশ করবে।
পাতি নেতারা সব উঠে দাঁড়াবে, মাঝের চেয়ার ছেড়ে পাশের চেয়ারগুলোতে বসবে এবং সাধারণ ছাত্ররা হাত মেলানোর জন্য হুড়োহুড়ি লাগিয়ে দিবে। পীরের আশীর্বাদ নেয়ার জন্য যেমন তার মুরিদরা হুম্ড়ি খেয়ে পড়ে অনেকটা সেরকম। বস্তুত: এসব নেতাদের কারোরই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাজীবনের বয়স কমপক্ষে দশ বছরের কম নয়।
মোবাইলে কথা বলতে বলতে
-ঠিক আছ্ছে ভাই; ও নিয়ে আপনি চিন্তাই করবেন না। পোলাপান কয়টা লাগে খালি আমারে কইবেন।
আমরা থাকতে আপনের মিছিলে পোলাপান নিয়া ভাবতে হয় ? আচ্ছা...আচ্ছা ভাই...জি ভাই...স্লামালিকুম্ ভাই।
বসতে বসতেই যেনও তার চেহারা পরিবর্তিত হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পূর্বের ‘কাঁচুমাচু’ ভাবটা নিমেষেই গায়েব। এখন তার বদলে সেখানে স্থান করে নিয়েছে এক নিখাদ গাম্ভীর্য। গলাতেও আগের সেই ‘চামচা-চামচা’ গন্ধটা নেই।
বেশ দরাজ গলায় আওয়াজ তোলে। সেই আওয়াজ এতোগুলো মানুষে ঠাঁসা ঘরটাকেও গম্গমিয়ে তোলে।
-কি অবস্থা ? কি নিয়া কথা বলছিলে ? কাকে বের করতে চাচ্ছ তোমরা ?
জবাব দিতে গিয়ে বুলেটের ‘নাকি’ গলা আরও চিকন হয়ে আসে। হাত কচলাতে কচলাতে
-ভাই, এই যে নতুন আমদানি তো...তাই একটু ঝাড়্তেছিলাম আর কি...
কিন্তু বুলেটের কচলানিতে লিডারের দিল যেনও কচলায় না। মুখে আঁটা গাম্ভীর্যের পর্দাটা স্থির হয়ে থাকে।
সজলের দিকে নিতান্তই অবহেলায় না তাকিয়ে আঙ্গুল দিয়ে নির্দেশ করে
-নাম কি এটার ?
বুলেট সজলকে ইশারা করে নাম বলার জন্য। সজলের কাঁপা গলা কথা বলে
-ভাই, সজল।
-কোন ডিপার্টমেন্ট ?
-ভাই, Economics ।
লিডার চট করে চোখ তুলে তাকায়। এক বিজাতীয় বিদ্বেষ ফুটে উঠে চোখে মুখে
-এগুলোকে হলে উঠাও কেনো তোমরা ? এগুলোকে দিয়ে তো politics হবে না।
সারাদিন reading room এর কোণায় পড়ে থাকবে।
সেই পালে বুলেট হাওয়া লাগায়
-ভাই, এরে বাইর কইরা দিই ? কোনও কামের পোলা না ।
তুফানও দ্বিমত পোষণ করে না। তবে এই ফাঁকে সে কিছুটা পুরনো কাসুন্দিও ঘেঁটে নেয়।
-হ বাই......মারামারির করার কথা কইলে আমারে নীতি গিলায়...
বিদ্রূপের হাসিতে মুখ ভরে উঠে তার।
-তোমাদের তো বলেছি...কাকে রাখবে, কাকে রাখবে না সব তোমাদের হাতে। তোমরা যা decision নিবে তাই হবে । তোমরা তো জানোই আমাদের দলে গণতন্ত্রের চর্চা করা হয়।
পাতি নেতারা সন্তুষ্ট চিত্তে বলের
-জি বাই...
এখানেই এদের গণতন্ত্রের আলোচনা থেমে থাকে না। এ প্রসঙ্গে বিরোধী দল কোন ‘তন্ত্রে’ বিশ্বাসী এবং তার অতীত কুকীর্তিসমূহ সম্পর্কে লিডার তার যথারীতি মহামূল্যবান বক্তব্য উপস্থাপন করেন।
বোঝা যায় ‘প্রতিহিংসার’ রাজনীতি চট করে মগডালে উঠে যায়নি, তা শিকর বেয়েই উপরে উঠেছে।
লিডার কিছুক্ষণ সজলকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত নিরীক্ষণ করে। অস্বস্তিকর সে দৃষ্টি। ধীরে ধীরে সে দৃষ্টি আরও তীক্ষ্ণ হয়। মুখের কাছে এসে স্থির হয়ে যায়।
স্থির তাকিয়ে থেকে
-Background কি ?
-ভাই Economics….
লিডার চোখমুখ কুঁচকে তুফানের দিকে তাকায়। সজলের আহাম্মকিতে চরম বিরক্ত সে। তুফান সেটা বুঝতে পেরে খাঁকারি দিয়ে উঠে
-কিরে ভাই জিগাইলো Background কি আর তুই কইলি Economics । কিরে ? মায়ের পেটে থাকতেই কি Samuelson খায়া আইছোস্ ?
সজল নেতার ‘বিরোধীদলীয়’ সংগীত শুনে কিছুটা ঝিমিয়ে পড়েছিলো। তাই সে নেতার প্রশ্নটা ঠিক বুঝতে পারেনি।
কিন্তু, তার ধনুক থেকে ছুটে যাওয়া তীর এবং তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় ঘুমে ছোটো হয়ে আসা চোখদুটো বড়ো বড়ো করে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে।
-ভাই, দেখছেন ? কেমনে চায়া আছে ? মন্ডা লয় সোজা তলপেটে একটা লাথ্যি বসায়া দেই।
লিডার এতো ছোটোখাটো বিষয় নিয়ে মাথা গরম করার লোক নয়। সে বুঝিয়ে বলে
-তোর Background কলেজ না মাদ্রাসা ?
-ভাই...মাদ্রাসা ।
-পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়িস্ ?
-চেষ্টা করি ভাই...।
সজল মাথা নিচু করে মাথা চুলকায়। রাতে ছারপোকার কামড়ে তার ঘুম হয় না আর গণ রুমে তো রাত তিনটার আগে ঘুমানো যায় না সেটা সবার জানা। ছেলেরা বসে তাস খেলে আর হইহুল্লর করে। ফলে সকালে উঠে আর নামাজ পড়ার সময় থাকে না। হাঁপাতে হাঁপাতে ক্লাস ধরে সে।
তবে অন্য ওয়াক্তগুলো সে ঠিকই আদায় করে নেয়।
কিন্তু নেতা যেনও একটা ভুল অংকের সমাধান কষছিল তার কিছু গৎবাঁধা ফরমুলা দিয়ে। সেই ফরমুলা অনুযায়ী অংকে ভুল ধরা পড়তেই তার বিকট কালো মুখটা চিৎকার করে উঠে পাতি নেতাদের দিকে তাকিয়ে।
-কি করো তোমরা ? এই হারামজাদায় নামাজ পড়ে না। মুখে আবার খোঁচা খোঁচা দাড়ি নিয়া ঘুরে বেরায়।
একে দেখলেই তো বোঝা যায় এর ভেতর বড় একটা ‘কিন্তু’ আছে।
সজল বুঝতে পারে না কিসের ‘কিন্তু’ তার ভেতর। শুধু ‘কিন্তু’ শব্দটাই চোখের সামনে ঘুরে বেড়ায়। সে আজ অ-নে-ক দিন পর ‘কিন্তু’ শব্দটা জানার প্রয়োজন বোধ করে।
সজলের বাবা পঞ্চগড়ের একজন অসচ্ছল কৃষক।
সেখানে তার মতো অনেক কৃষকেরই ভাগ্য দোলে প্রকৃতির খেয়াল-খুশিতে। তাই এই প্রকৃতির স্রষ্টা যিনি তাকে সন্তুষ্ট রাখতে এই দুর্ভাগা মানুষগুলোর প্রাণান্ত প্রচেষ্টা। তা সে হিন্দুই হোক আর মুসলমানই হোক। সজল জন্মাবার পূর্বে পর পর দু’বছর সজলের বাবা মজিবর তার নিজের কিছু জমি আর অন্যের জমি বর্গা নিয়ে আলুর চাষ করেছিলেন। তার অর্থ, সময়, শ্রম-সবটা দিয়ে চেষ্টা করেছিলেন ভালো ফসল ফলানোর জন্য।
কিন্তু, কিছুতেই যেনও কিছু হল না। বীজ থেকে সুন্দর সবুজ পাতা গজাল। সেই মাঠভরা সবুজ দেখে মজিবরের চোখ জুড়িয়ে যায়।
মজিবরের মনে পড়ে বেশ শীত পড়েছিলো সেবার। যখন ফসল তোলার সময় হল তখন সে আবিষ্কার করলো ব্যাপারটা।
কি এক অজানা ছত্রাকের আক্রমণে জায়গায় জায়গায় মাটির তলায় আলুগুলো পচে যেতে শুরু করলো। উপরে সবুজ পাতা কিন্তু নিচে পচা আলু। কৃষি কর্মকর্তারাও কোনও সুরাহা করতে পারলো না ব্যাপারটার। তারা এখন এটা ছিটাতে বলে তো তখন ওটা ছিটাতে বলে। কিন্তু কোনও ছত্রাক নাশকেই যেনও ঠেকানো যাচ্ছে না মজিবরের আসন্ন দুর্ভাগ্যকে।
মজিবরের শুধু খরচই বেড়ে চলে।
তারপর যা হবার তাই হল।
সেবার খরচের একতৃতীয়াংশেরই শুধু উঠাতে পেরেছিলেন তিনি। এরপর বেশ কিছুদিন কারো সাথে কোনও কথা বলেননি তিনি। সে শুধু ভাবে আর ভাবে।
কোনও কূলকিনারাই খুঁজে পাননা তিনি। কেন এমন হল তার সাথে ?
যেখানে বিজ্ঞান তার সর্বময়ী প্রভাব নিয়ে অনুপস্থিত, যেখানে শ্রমের কোনও মূল্যায়ন নেই সেখানে প্রায় অশিক্ষিত মুজিবরকে কে এই ব্যর্থতার কোনও সন্তোষজনক ব্যাখ্যা শোনাবে ? তখন মুজিবরদের শুধু একটা কাজই করার থাকে। আকাশের দিকে তাকিয়ে শুধু দীর্ঘশ্বাস ছাড়া... “স-ব তেনার ইচ্ছা !!!”
তাই সজলের জন্মের পরপরই তার বাবা নিয়ত করেন এই ছেলেকে তিনি আল্লাহ্র রাস্তায় দিবেন। দিলেন ‘কওমি’ মাদ্রাসায়। ‘এবতেদায়ি’ পর্যন্ত পড়লো সেখানে।
তারপর দেয়া হল আলিয়া মাদ্রাসায়। মাদ্রাসার লাইনে সে খুব একটা সুবিধে করতে পারেনি। দাখিল দেয়ার পর একদিন হঠাৎ তার মামা দুবাই থেকে এসে উপস্থিত। সেই মামার যুক্তিতে তার মাও বেঁকে বসলেন। “আরে মাদ্রাসায় পড়ে এ ছেলে কি করবে ? মাদ্রাসায় পড়ে আজকাল ক’টাকা কামানো যায় ?” সুতরাং সজলকে মাদ্রাসা ছাড়তে হল।
মফস্বলের কলেজে ভর্তি হবার পর সে কিছু আত্নজিজ্ঞাসার সম্মুখীন হল। ...জীবনটা যে অনেক বড়ো...অনেক। অনেক বড়ো হতে হবে তাকে এ জীবনে। নইলে সারা জীবন রোদে-বৃষ্টিতে গায়ের চামড়া পুড়িয়ে প্রকৃতির সাথে অসম যুদ্ধে লিপ্ত হতে হবে তাকে। আর সারাদিনের যুদ্ধ শেষে ঐ ছোটোখাটো মাটির ঘরের শক্ত বালিশেই তাকে মাথা গুঁজতে হবে।
সজল কখনো আগে এমনটা ভাবেনি। কিন্তু আজ তার ভেবে মনে হচ্ছে সে এ জীবন কোনোভাবেই আর চায় না। তার চোখে ভাসে কেবল ছোটবেলার মায়ের কোলে শুয়ে শোনা সেই রাজপুত্রের কথা। শহরের চোখ ধাঁধানো আভিজাত্য তার দু’চোখে খুব একটা লাগেনি কিংবা লাগলেও তা তার চোখকে ধাঁধিয়ে দিতে পারেনি। সে শুধু দেখেছে কলেজের প্রফেসরগুলো।
কি সুন্দর করে কথা বলে মানুষগুলো, কি সুন্দর তাদের ব্যবহার, কি সুন্দর পরিপাটি করে সাজানো তাদের জামা-কাপড়। তাদের মাঝেই সে যেনও সেই রাজপুত্রকে দেখতে পায়। ভাবে, তাকেও এরকম বড়ো হতে হবে। হতে হবে এরকম সত্যিকারের মানুষ।
সজল ঠিকই ধরতে পেরেছিল ওরকম বড়ো হতে হলে তার মতো ছেলের পড়াশুনা ব্যতীত আর কিছুই করার নেই।
সজল পাগলের মতো পড়াশুনা শুরু করে। কতো কষ্টেই না কেটেছে সেই দিনগুলো। মাদ্রাসায় পড়ার দরুন তার ইংরেজির ভিত্তিটা ছিল বরাবরই নড়বড়ে। সেটাকে ঘষে মেজে শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়েছে সে।
গরমের দিনগুলোতে সাঁকোয়ায় নিয়ম করে দু’ঘণ্টা কারেন্ট যাবেই।
প্রচণ্ড গরমে লুঙ্গি ভিজে উঠত আর সাথে তো মশার কামড় থাকছেই। মোটা মাটির দেয়ালটার একটিমাত্র জানালা গলে যখন হালকা লিলুয়া বাতাস বয়ে যেতো তখন আরামে চোখ দু’টো বুজে আসতো। মা বলতেন ওটা নাকি বেহেশতী হাওয়া। কখনোবা মা পাশে দাঁড়িয়ে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করতেন। সেই বাতাসে মিশে থাকতো একটা বিচিত্র গন্ধ।
সেটা ঠিক তার দরিদ্র কর্মব্যস্ত মায়ের ঘামের গন্ধও না, একটু অন্যরকম চিরচেনা একটা গন্ধ। ছোটবেলা মায়ের কোলে শুয়েও সে একই গন্ধটা পেতো। পৃথিবীতে কত রং, কত গন্ধ-কত বিচিত্র তাদের নাম। কিন্তু এ গন্ধটার কি নাম দেবে সজল ?
সজল আজ ভাবে সেই কষ্টের দিনগুলোর প্রতিটি স্মৃতিতে আজ সে মা নামের ছোটোখাটো, গোলগাল একটা অদ্ভুত মানুষকেই ঘুরেফিরে দেখতে পায়।
লিডার তুফানের সাথে কানে কানে কি যেনও বলে।
তুফানের চোখ দু’টো জ্বলজ্বল করে উঠে। সহসাই যেনও উত্তেজিত হয়ে উঠে সে।
-ভাই,...আপনি খালি order দেন । এক্ষণি লাত্থি দিয়া বাইর কইরা দেই !!!
-আরে order ? oredr কি ? তোমাদের তো নির্দেশ দেয়া হয়েছেই।
তারপর লিডার কি যেনও ভাবে।
তারপর তাকায়
-গতকাল প্রোগ্রামে গিয়েছিলে ?
-ভাই, গতকাল একটা important ক্লাস ছিল তাই...
সজলের বাকী কথা মুখেই থেকে যায়। তার আগেই বেশ শান্ত ভঙ্গীতে সজলকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে
-এটাকে যেনও কাল সকালে না দেখি।
তুফানও সায় দেয়
-ভাই, এইটার system আইজকাই করতাছি।
সজলের মাথা শূন্য হয়ে যায়। সে হতবিহ্ব্লের মতো এদিক-ওদিক তাকায়।
চোখে আতংক মেশানো। সজল এ ক’দিনেই বুঝতে পেরেছে লিডার এক কথার মানুষ। তার কথাই এখানে আইন। সে আকুল হয়ে বোঝানোর চেষ্টা করে
-ভাই, আমি....আমি সাধারণ একজন ছাত্র...আমি অন্যকিছু জানি না...আমার ভেতর কোনও ‘কিন্তু’ নাই...
এবার বুঝি সজলের গলা আটকে আসে। সামনের মানুষগুলো ঝাপসা হয়ে আসে।
ডুকরে উঠে সজল--
- আমি সাধারণ ছাত্র...পঞ্চগড় থেকে আসছি পড়াশুনা করার জন্য...ভাই আপনারা যা বলবেন আমি তাই করুম...
“আপনারা যা বলবেন আমি তাই করবো”— এটাই তো চাই। এই একটা কথা ও এর কার্যকারিতার জন্যই তো আজকের তথাকথিত ছাত্র রাজনীতির নামে পর্দার আড়ালের কিছু লোকের দাসত্ব করে যাওয়া। অন্ধ কুকুরের মতো লম্বা জিভ বের করে আগাগোড়া পা চেটে যাওয়া। কি চাটছি ? কেন চাটছি ? তা জানার দরকার নেই। শুধু চাটও...আর চাটও!!
তোমার পড়াশুনা করার দরকার নেই বাপু ! তুমি কেন পড়াশুনা করবে ? পড়াশুনা করবে ঐ যে ঐ দেখা যায়.. “প্রফেসরের বাচ্চা”! কারণ, ওকে হল থেকে বের করে দিলেও কোনও সমস্যা নাই।
একদম No Problem! ও নাচতে নাচতে বাপের আলিশান বাড়িতে উঠে যাবে। তার কানের কাছে সবসময় সদুপদেশ গুনগুন করে বেড়াবে। তার টিউশনি নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।
টিউশনি নিয়ে চিন্তা করবে তুমি, প্রোগ্রাম-পলিটিক্স করবে তুমি, বিপথে যাবে তুমি---------কারণ তুমি প্রফেসরের বাচ্চা না, তুমি বিশুদ্ধ ‘গরীবের বাচ্চা’।
এটুকু পড়ে অনেকে ভ্রু কুঁচকে তাকাবেন, “এহ্তেশাম! তুমি জানো না! শিক্ষক পিতার সম !!!”।
উত্তরে আমি বলবো না এ কথা পুরোপুরি গাঁজাখুরি। তবে আমি অনুরোধ করবো ওকথার সাথে মোবাইল কোম্পানির বিজ্ঞাপনগুলোর ন্যায় ছোট্ট করে ‘শর্ত প্রযোজ্য’ কথাটা জুড়ে দিলেই হল। শর্তটা হল—শিক্ষককে বর্ণহীন হতে হবে। এর রঙ ‘সাদা’ বা ‘নীল’ হলে উনি আর যাই হোক ‘পিতা’ হতে পারবেন না। কারণ পিতার গায়ে কোনও রঙ থাকে না! (চলবে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।