বিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে আজ যখন মানুষ মঙ্গলে পাড়ি জমানোর আয়োজন করছে, মহাশূন্যে বসতি স্থাপনের তোড়জোড় করছে বিভিন্ন মরণ ব্যাধির বিরুদ্ধে তার অস্ত্রকে করে তুলেছে আরো শাণিত, মাতৃগর্ভের বাইরে সন্তান ধারণের চিন্তা করছে ঠিক সে সময়ে আমাদের দেশের এক বিরাট জনগোষ্ঠী মনে করে মানুষের চাঁদে যাবার ঘটনা ভিত্তিহীন তাদের ইমান নষ্ট করার পশ্চিমা ষড়যন্ত্র, ভূমিকম্পের সময় আজান দিলে ক্ষয়ক্ষতি হবে কম, ‘শেতলা দেবী’র পূজা দিলে বন্ধ হবে কলেরা ।
হরলিকস খেলে না কি ছেলে মেয়েরা ‘লম্বা-শক্তিশালী-বুদ্ধিমান’ হয়ে যায়। ডেটল সাবান না কি ৯৯% জীবাণু মেরে ফেলে । ফেয়ার-এন্ড-লাভলী (অথবা ফেয়ার-এন্ড-হ্যান্ডসাম) নাকি গায়ের রঙ ফর্সা করতে পারে । আধুনিক কুসংস্কার ।
এদেরকে বলা হয় অপবিজ্ঞান । সাধারণ মানুষের মধ্যে বিজ্ঞানের একটি ইতিবাচক প্রভাব আছে । তাই বিজ্ঞানের মুখোশ নিয়ে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করা অত্যন্ত সহজ । নানা রকম মানুষের নানা রকম সংস্কার আছে । কোন কোন সংস্কারকে আমরা কুসংস্কার বলি, কোন কোনটাকে ভালো মন্দ কিছুই না বলে প্রশ্রয়ের দৃষ্টিতে দেখি ।
যেমন অনেকে ১৩ সংখ্যাটিকে এড়িয়ে চলেন । আনলাকি থার্টিন বেশ প্রচলিত একটি সংস্কার ।
‘রাত্রে গাছতলায় ঘুমানো বা বিশ্রাম নেয়া টিক নয়। ’ এই প্রচলিত বিশ্বাসটির কথা ধরা যাক । রাতের বেলায় উদ্ভিদের সালোক সংশ্লেষণ (যে প্রক্রিয়ায় উদ্ভিদ সৌরশক্তির সাহায্যে তার খাদ্য তৈরি করে এবং অক্সিজেন নির্গত করে) প্রক্রিয়া বন্ধ থাকে, কিন্তু শ্বসন (এতে নিগর্ত হয় কার্বন-ডাই-অক্সাইড) চালু থাকে ।
ফলে রাতে উদ্ভিদের আশেপাশে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের আধিক্য ঘটে । জানা কথা, মানুষের জন্যে কার্বন-ডাই-অক্সাইড মোটেই ভাল নয় । সাপের কামড়ে ডাক্তারের বদলে ওঝার শরণাপন্ন হয় এখনো বেশির ভাগ মানুষ । সাপ সম্পর্কে কত রকম কুসংস্কারই না চালু আছে আমাদের মাঝে । সাপুড়েরা নানারকম আষাঢ়ে গল্প করে মানুষকে বিভ্রান্ত করে চলেছে নিয়মিত ।
বীণ বাজালে সাপ ছুটে আসে একথা বিশ্বাস করার লোকের অভাব নেই । আর সাপ সম্পর্কে অদ্ভুত সব অসত্য গল্পে ভরা আমাদের লোককাহিনীগুলো, রূপকথাগুলো । আর সিনেমা গুলোর তো কথাই নেই । এসব পড়ে দেখে শুনে সাপ সম্পর্কে আমাদের কুসংস্কার এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে - সাপে কামড় দিলে সোজা যে হাসপাতালে নেয়ার দরকার তা না করে ওঝার হাতে সময় সঁপে দিই । বিভিন্ন পশুপাখি নিয়েও প্রচুর কুসংস্কার রয়েছে মানুষের মনে ।
গভীর রাতে পেঁচার ডাক শুনলে অমঙ্গল আশঙ্কায় অনেকেরই গা ছমছম করে ।
ভ্রান্ত বিশ্বাস-সংস্কারের মধ্যে যেগুলোর কোন প্রামাণিক ভিত্তি নেই । কুসংস্কার বা ভুল বিশ্বাসগুলো ছাড়া প্রচলিত বিশ্বাসের সবচেয়ে ক্ষতিকর উপাদান হচ্ছে ‘অন্ধ বিশ্বাস’। অন্ধ বিশ্বাসগুলোর মূল ভিত্তিই হচ্ছে ধর্ম । অন্ধবিশ্বাস কতটা ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারে তার আর একটি উদাহরণ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি জেহাদী জোশের ছাত্রমন্ডলীর ।
জীববিদ্যার ক্লাশে ‘ডারউইনের মতবাদ’ পড়ানোর সময় এরা প্রায়শ বিকট শব্দ, উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করে থাকে। তাদের ধারণা তাদের এই আচরণ ডারউইনের জানানো সত্যকে ঢাকাতে পারবে । পরীক্ষার দিন ডিম খেতে বারণ। তাতে নাকি পরীক্ষা খারাপ হয় । সন্তান জন্মাবার পর মা ও শিশুকে প্রায় এক মাস থাকতে দেয়া হয় আঁতুড় ঘরে ।
এই আতুঁড় ঘর হলো বাড়ির মধ্যে সবচেয়ে নোংরা একটি ঘর । এই একমাস প্রসূতি মাতাকে এই আঁতুড় ঘরে প্রায় বন্দী করে রাখা হয়, অস্পৃশ্য করে রাখা হয় । অনেকেই ভাবেন আত্মার সাথে আত্মার যোগাযোগ ঘটে টেলিপ্যাথির মাধ্যমে । আধ্যাত্মিক উপায়ে অনেককিছু অর্জন করা যায় । যদিও এধরনের কোন বৈজ্ঞানিক তথ্য-প্রমান এখনো পাওয়া যায় নি ।
ভাঙা আয়না নিয়ে অনেক দেশেই রয়েছে বদ্ধমূল ভ্রান্ত বিশ্বাস । বাংলাদেশে কুসংস্কারে বিশ্বাসী অনেকে মনে করেন, ভাঙা আয়নায় মুখ দেখলে আয়ু কমে যায় ।
মহাশুন্যে পৃথিবীর অবস্থানকে ধরা যাক । পৃথিবীতে কোন বস্তুকে অবলম্বন ছাড়া আমরা ভেসে থাকতে দেখি না । মনে হয় কোন দৃশ্যমান অবলম্বন ছাড়া বস্তুর ভেসে থাকা সম্ভব নয় ।
এবার এই তত্ত্বটিকে পৃথিবীর ক্ষেত্রে প্রয়োগ করলে বলতে হবে পৃথিবী দাঁড়িয়ে রয়েছে ‘নাগরাজ বাসুদেবে’র সহস্র এক ফণার ওপর । কিংবা এটি রয়েছে কোন কচ্ছপের পিঠে । অথচ, নিউটন এসে দেখালেন পৃথিবী শুন্যে ভেসে রয়েছে কোন অবলম্বন ছাড়াই । সাধরন মানুষ প্রতিনিয়ত অপবিজ্ঞানের শিকার হচ্ছি । সবচেয়ে প্রকট, নগ্ন অবৈজ্ঞানিক তত্ত্ব যেটা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার মাঝে প্রভাব বিস্তার করে আছে তা হল জোতিষশাস্ত্র ।
জোতিষশাস্ত্র অত্যন্ত প্রাচিন একটি তত্ত্ব । এর সাথে বিজ্ঞান কোনো ভাবেই খাপ খায় না । শিক্ষিত শ্রেণীর বিশাল একটা অংশ জোতিষশাস্ত্রের ফাঁদে আটকা পড়ে আছে । সাধারন মানুষের নির্ভরতা সুযোগ নিয়ে অনেকেই জোতিষচর্চার ব্যবসা ফেঁদে যুগ যুগ ধরে আমাদেরকে ঠকিয়ে আসছে । লবণ নিয়ে কুসংস্কার আছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ।
লবণ ফেললে নাকি অমঙ্গল হয় । কখনো যদি হাত থেকে লবণের পাত্র পড়ে যায়, তাহলে অজানা অমঙ্গল থেকে বাঁচতে কুসংস্কার বিশ্বাসীরা এক চিমটি লবণ চট করে ছিটিয়ে দেয় বাঁ কাঁধে ।
এক ভদ্রলোক বই লিখেছেন । ‘পৃথিবী নয় সূর্য ঘোরে । ’ বই-এর প্রথম পাতায় একটি বিজ্ঞাপন দিয়েছেন, অনেক টাকা পুরস্কারের ।
বিষয়টি অনেকটা এরকম- লেখক জানাচ্ছেন পৃথিবীর কোন ধর্মগ্রন্থ (বাইবেল, বেদ, বেদান্ত, গীতা, কোরান ইত্যাদি) খুলে যদি কেউ এমন কোন অংশ বা অংশবিশেষ দেখাতে পারে যেখানে রয়েছে পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরছে বা পৃথিবী স্থির নয় তাহলে লেখক তাকে বিশাল অংকের অর্থ দিয়ে পুরস্কৃত করবেন । ঐ মূর্খ লেখককে যদি ‘ডিসকভারী’তে চড়িয়ে মহাশূন্যে নিয়ে দেখিয়ে দেয়া হয় পৃথিবী ঘুরছে, তাহলেও সে তার ঐ বিশ্বাস থেকে একচুলও সরবে না । কারণ তার বিশ্বাসটি যে অন্ধ । হ্যারী পটার লিখে তার লেখক বিলিওনার হচ্ছেন কিন্তু তার পাঠক-দর্শক শিশুরা সত্য থেকে কতো দূরে আছে তা কী লেখকরা চিন্তা করেন !? বিশ্বে কুসংস্কার নেই এমন কোনও দেশ বা সমাজ নেই । প্রত্যেক দেশ ও সমাজে হাজার হাজার বছর ধরে কুসংস্কার দানা বেধে আছে ।
কুসংস্কার গুলো মূলত লোক মুখে প্রচলিত হয়ে সমাজে বসবাস করে । মাকড়সা মারলে পাপ হয় । গ্রিকরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে এ কথা । মাকড়সাকে সেদেশের অনেক বাড়িতেই সম্মানিত অতিথির মতো থাকতে দেওয়া হয় ।
বাইরে কোথাও বের হওয়ার সময় কোনও কিছু তে বাধা পড়লে অনেকে আবার ঘরে একটু বসে যায় কারণ তাদের ধারণা যাত্রার প্রথমে যখন বাধা পড়েছে তাহলে পথে বিপদ হতে পারে ।
ঘর থেকে বাহির হওয়ার সময় ঝাঁটা বা ঝাড়ুর সাথে ধাক্কা খেলে যাত্রা অশুভ মনে করা হয় । আবার যাত্রার শুরুতে কেউ হাঁচি দিলে সেটিকেও যাত্রার অশুভ লক্ষণ হিসেবে মনে করা হয় । বাড়ির পাশে যদি কাক এসে কা-কা করে ডাকতে থাকে তাহলে ধারণা করা হয় বাড়িতে মেহমান আসছে । এছাড়াও বাড়ির আঙ্গিনায় যদি পোকায় ঘর বাধে তাহলে সৌভাগ্যের লক্ষণ মনে করা হয় । কারও যদি পা’র তলা চুলকায় তাহলে ধারনা করা হয় দ্রুত অর্থ প্রাপ্তির সম্ভাবনা আছে ।
আবার যদি কারও চোখের পাতা লাফায় তাহলে ধারনা করা হয় জীবনে বিদেশ ভ্রমণের সম্ভাবনা আছে । ছোট বাচ্চাদের ক্ষেত্রে মায়েরা তাদের কপালে টিপ দিয়ে দেয় যাতে কারোও নজর না লাগে ।
আমাদের দেশে লোডশেডিং-এ যত মোমবাতি জ্বলে তার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে মোমবাতি জ্বলে মন্দির মসজিদ গির্জা প্যাগোড়া ফকির দরবেশ আউলিয়াদের মাজারে । এই মানত করা মোমবাতির আলোতে মনের কুসংস্কারের অন্ধকার আরো গাঢ় হয়, আমরা এগিয়ে চলি অন্ধকারের দিকে । এখন আমাদের দরকার একটি ঝকঝকে নতুন বিজ্ঞান-প্রজন্ম ।
সংস্কারে মসৃণ হওয়ার দরকার নেই, যুক্তিতে রুঢ় হলেই হলো । পৃথিবীর উন্নত প্রায় প্রত্যেক দেশে ধর্মীয় পরিচয় ছাড়াই বিয়ের ব্যবস্থা আছে । এমন কি জীবন যাপনে আমাদের যেমন ধর্মীয় পরিচয় দিতে হয় । নানা ফরম পূরণ করতে গিয়ে লিখতে হয় ধর্ম । তা অনেক দেশেই নেই ।
পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে দুই ধর্মের দুইজন বিয়ে করতে পারে । আইনগত কোন সমস্যা নেই । এছাড়া ইউরোপ আমেরিকাতেও একই অবস্থা । সেখানে শুধু বিয়ে নয়, কোন কাজেই ধর্মীয় পরিচয় দেয়ার প্রয়োজন হয় না । সমাজের কুসংস্কার তাড়াতে হবে জ্ঞানের আলো দিয়ে ।
মানুষ কি এখনও সভ্য হয়নি ? সভ্য হতে আর কত শিক্ষার প্রয়োজন ? কত সচেতনতার প্রয়োজন ? আমাদের মনগুলো কবে কলুষমুক্ত হবে ? ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।