কুসংস্কারের উৎপত্তি ভয় থেকে। নৃশংসতার উৎস হলো ভয়। আর ভয়কে জয় করে জ্ঞান। দার্শনিক বাট্রান্ড রাসেলের এই উপলব্ধি যে কত প্রমানিত সঠিক তা কুসংস্কার গুলির উদঘাটন হওয়ার পর বুঝা যায়। পৃথিবীর প্রায় সব সমাজ, জাতীও গোষ্টির মধ্যে কুসংস্কার প্রচলিত।
তবে অশিক্ষিত লোকের মধ্যে বেশি। শিক্ষা ও বিজ্ঞানে অগ্রগতিতে কুসংস্কারের প্রভাব কমে যাচ্ছে দিন দিন। বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশের মতো আমাদের সমাজে অনেক কুসংস্কার প্রচলিত আছে। শহরে অশিক্ষিত ও স্বল্পশিক্ষিতদের মধ্যে ও গ্রামে কুসংস্কারের প্রচলন আনেক। কুসংস্কারের কারণে সমাজে, পরিবারে ও ব্যাক্তিগত জীবনে নেতিবাচক প্রভাবই বেশী পরে।
সহজ সমাধান কঠিন হয়ে পড়ে। সময়ের অপচয় ও অর্থনৈতিক ক্ষতি দুটিই হয়। ছোট কোন সমস্যার জন্য প্রচুর ভোগান্তির মধ্যে হাবুডুবু খেতে হয়। এর মধ্যে সুবিধাবাদী কিছু লোক অর্থনৈতিক লাভের জন্য অনেক কিছু করে থাকে। মাত্র কিছু দিন আগেও এক সাপে কাটা মৃত ব্যক্তির লাশ কবর থেকে উঠিয়ে জীবন্ত করে দেবে বলে দৃতের আত্মিয়ের কাছ থেকে কয়েক হাজার টাকা নিয়ে তারপর লাশ চরে ফেলে পালিয়েছে ওঝা।
ব্যক্তিগতভাবে আমি চিকিৎসক বলে বেশ কিছু কুসংস্কারের বিশ্বাসী লোকদের তাদের বিশ্বাসের কথা শুনতে হয়। চিকিৎসা ক্ষেত্রে কুসংস্কারের প্রভাব বেশি, মাঝে মধ্যেই কোন না কোন রোগী বা রোগীর সাথে আসা লোকজনদের মুখে শুনতে হয় যে, তারা জন্ডিসের চিকিৎসা করে এসেছে ভূতে ধরে ছিল ছাড়ানো হয়েছে এখন ডাক্তারী চিকিৎসা লাগবে।
গ্রামেগঞ্জে যেটা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর কুসংস্কার সেটা হল প্রসূতি মা-দের সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার পর সদ্য প্রসূতি ‘মা’ কে নিরামিষ খাওয়ানো। যখন সদ্য প্রসূতি মাকে প্রোটিন খাওয়ানো বেশী দরকার তখন নিরামিষ খাওয়ানো হল বেশির ভাগ প্রচলিত মতামত।
পঞ্চাশ/পঞ্চান্ন বছর আগে যখন কলেরা সমন্ধে ধারণা অন্তত গ্রামেগঞ্জে ছিলনা তখন মানুষ ভয়ে আতংকিত হয়ে অনেক কিছুই করত।
দেখা যেত পাতলা পায়খানা ও বমি করে এক/দুই দিনের মধ্যে প্রচুর মানুষ মারা যেত। তখন গ্রামেগঞ্জে মানুষের ধারনাই ছিল কোন আলাইবালাই আক্রমন করেছে বা কুনজর পড়েছে। আমাদের গ্রাম এলাকার বর্তমান বাড্ডা থানার পূর্ব প্রান্তে বড় বেরাইদ নামের গ্রামে আমার বাল্যকালে দেখেছি রাত্রিকালে বয়স্ক লোকজন হারিকেন ও লাঠি নিয়ে বিভিন্ন স্লোগান দিতে যাতে রোগ বালাই দূর হয়। তখন কলেরার চিকিৎসা ও কারণ মানুষের মধ্যে জানা ছিল না এবং সে রকম ডাক্তারও গ্রামে ছিল না। বর্তমানে কলেরা শব্দের সাথে প্রায় সব এলাকার মানুষ পরিচিত আছে এবং এই রোগের করণীয় প্রায় সাধারণ মানুষের মধ্যে ও জানা আছে।
এবং কলেরা চিকিৎসার ব্যবস্থা প্রায় সব এলাকায় বিদ্যমান। আলোচনার আরম্ভে আমি প্রসুতি ও সন্তানের ব্যাপারে যে সকল কুসংস্কার আছে সেগুলি প্রথমে আলোচনা করতে চাই। সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর মায়েদেরকে নিরামিষ খাওয়ানোর ধারনা অনেক পুরানো কাল থেকে চলে আসছে গ্রামেগঞ্জে। যাহা দূর্বল ‘মা’ কে আরও দুর্বল করে দেয়। এই ক্ষতিকর অভ্যাস থেকে সদ্য প্রসূতি মায়েদের রক্ষা করা খুব দরকার।
গ্রাম অঞ্চলে একটি হাসপাতাল চালাতে গিয়ে এই সমস্যার সমাধান আমাকে খুজতে হয়েছে। ডেলিভারীর পরে সদ্য প্রসুতি মা-এর শ্বাশুড়ী বা মা কেউ না কেউ তার সাথে থাকে, তাদেরকে বুঝিয়ে বলেছি যে, আপনার মেয়ে বা ছেলের বউকে যে খাবার খেতে দিবেন তার মধ্যে মাছ, মাংস, ডিম ও দুধ এর মধ্যে দুধসহ যেকোন কমপক্ষে অন্য একটা থাকতে হবে। যদি সবগুলো পারা যায় তবে আরও ভাল। তা নাহলে সে দুর্বল হয়ে যাবে। নার্সদের দেখিয়ে খাবার খাওয়ানোর কথা বলেছি।
এলাকার হিন্দু ও মুসলিম দুই দিকেরই অভ্যাস একই রকমের। কিন্তু হাসপাতালে ডেলিভারী হওয়ার পর খাওয়ার ব্যাপারে এই অবশ্য করনীয় যতদূর পারাযায় তাতে ধীরে ধীরে আমাদের এলাকার লোকজন সচেতন হচ্ছে বলে আমার ধারনা, কারণ নার্সদের বুঝিয়ে বলাতে ওরা এই ব্যাপারে খুবই খেয়াল করতো এবং অবশ্যই পরবর্তী সময়ে এই সদ্য প্রসুতি মাকে আমিষ খাওয়ানোটা অবশ্য কর্তব্য মনে করবে যদি হোম ডেলিভারীও হয় ।
শিশু ভূমিষ্ট হওয়ার পরে প্রথমে হতে মায়ের বুকের দুধ সন্তানকে দেওয়া সবচেয়ে ভাল। কিন্তু আগের পুরানো নিয়ম হলো প্রথম কিছু দুধ বুক থেকে ফেলে দেওয়া। এই ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলা এবং শাল দুধ খাওয়ানোর জন্য উদ্ভুদ্ধ করা খুবই দরকার।
প্রথম থেকেই বাচ্চাকে মায়ের দুধ খাওয়ানো আরম্ভ করতে পারলে মা ও শিশুর জন্য খুবই উপকারী এবং অর্থনৈতিক ভাবেও লাভবান। দেখা যায় ছডিঘরে (সদ্য ভূমিষ্ট হওয়ার পর যে ঘরে মা ও শিশুকে কিছু দিনের জন্য রাখা হয়) আলো বাতাস যাতে না ঢুকতে পারে সে ব্যবস্থা করা হল আগের ধ্যান ধারণা। কিন্তু আলো বাতাস যাতে ঢুকে এবং ঘর যাতে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখে সে ব্যবস্থা হল স্বাস্থ্য সম্মত মা ও শিশু উভয়ের জন্য। নবজাত শিশুর মাথার কাছে বালিশের নিচে লোহার টুকরা রাখে, যেটা হয় ম্যাচের বাক্সের মধ্যে অথবা কোন কিছু জড়িয়ে। ধারনাটা হল অশুভশক্তি যাতে ভর না করে।
প্রায় সময় চিকিৎসা করার জন্য যাওয়া ডাক্তাররা ও এইসব লোহার টুকরা রাখার কথা জানতে পারে না। ১৯৮৪ সালের দিকে মানিকগঞ্জের দৌলতপুর উপজেলার একবাড়ীতে ডেলিভারী করাতে গিয়ে আমাদের ফ্যামিলি প্ল্যানিং এক কর্মীকে দেখলাম এমন করতে, যাই হোক আমি নিষেধ করলাম এবং এই অভ্যাস যাতে ফ্যামিলি প্ল্যানিং এর কর্মী ভবিৎতে যাতে না রাখে এমন তাকে বুঝিয়েছি। গর্ভবতী মহিলারা বাড়ীর বাহিরে গেলে আচলে রসুন বেধে দেয় যাতে কোন অনিষ্ট না হয়। ব্যাপারট ব্যক্তিগতভাবে আমি কখনো দেখিনি। গর্ভবতী অবস্থায় উচ্চরক্তচাপ থাকলে, প্রিএ্যাকলাম্পশিয়া ও এ্যাকলাম্পশিয়া অবস্থায় সাধারণত শরীরে অতিরিক্ত পানি থাকে, রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখার জন্য ঔষধ খাওয়ার সাথে সাথে অতিরিক্ত লবণ খেতে মানা করা হয়।
কিন্তু অনেকে লবণ ভেজে খেয়ে থাকে। তাদের ধারণা লবণ ভেজে খেলে তাতে কোন ক্ষতি হবে না। তাই এ ব্যাপারে সাবধান থাকা দরকার কারণ লবন খেলে শরীরের রক্তচাপ স্বাভাবিক হয় না বরং ক্ষতির কারণ হয়ে দাড়ায়।
আফ্রিকার সুদানে, মিশরের কিছু অংশে, সাদে, মৌরতানিয়ায়, মেয়েদের খতনা করানো হয়। এখানেও বেশির ভাগ অশিক্ষিতদের মধ্যে এটা প্রচলিত তবে কিছু কিছু শিক্ষিত পরিবারের মধ্যে এটা প্রচলিত আছে।
লিবিয়ার মিজদা হাসপাতালে ডিউটি করার সময় এমন একটা সুদানি মহিলার ডেলিভারী আমাকে কন্ডাক্ট করতে হত। কিন্তু আমার আগে মিশরী ডাক্তার গাইনি ও অবস্টেট্রিক্স বিশেষজ্ঞ আছে এমন এমন একটি হসপিটালে তাকে রেফার করে দিয়েছে। মিদদা হাসপাতালে রেখে ডেলিভারী করার জন্য আমাকে অনুরোধ স্বত্ত্বেও ঐ ডেলিভারীর দায়িত্ব না রেখে সরকারী বিনা পয়সায় এ্যাম্বুলেন্সে গেরিয়ান হাসপাতালে পাটিয়ে দিয়েছি। কারণ সেখানে সিজারসহ সবকিছুর ব্যবস্থা আছে। আমার জানা ছিল খতনা করা মহিলাদের ডেলিভারীর সময় কিছু সমস্যা হয়, তার মধ্যে পেরিনিয়াল টিয়ার খুব বেশী হয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।