অনেকটা হুট করে, কোন পূর্বাভাস ছাড়াই শুনলাম একটা মুটের কথা। আচ্ছা, মুট আবার কি? আইনের ছাত্রদের জন্য পড়াশোনার বাইরে একমাত্র বিনোদন টাইপের কিছু একটা (আসলে আইনী বিতর্ক প্রতিযোগিতা) । সে যাই হোক উপলক্ষ্য একটা যখন পাওয়াই গেলো, সেটাকে ভালোভাবে কাজে লাগানো দরকার। শুরু হল জল্পনা-কল্পনা আর প্রস্তুতি।
ভারতীয় ভিসা নিয়ে কথা বলার কিছু নাই, তবে এটা ঠিক আগে যত জটিলতা শুনেছিলাম সে রকম কিছু মনে হল না।
ঠেকে যেটা শিখলাম, সেটা হলো মতিঝিল বুথে অ্যাপ্লাই করাটাই ভালো, একদিন পরে ভিসা দিলেও ভীড়টা একটু কম হবে। লম্বা লাইনে দিন পার করে করে তিনজনের ভিসা হয়ে গেল, এবার টিকেট কাটার পালা। আমাদের মুট ছিল গুজরাতে, যাওয়ার প্ল্যান করলাম ট্রেনে। কলকাতা থেকে আহমেদাবাদ, মাত্র ২১০০ কিঃমিঃ পথ তাতে সময় লাগবে ৩৬ ঘণ্টা। এর বাইরেও ঘোরাঘুরির যে প্ল্যান করেছি তাতে বাস ও ট্রেন মিলিয়ে আরো হাজার চারেক কিলোমিটার রাস্তায় কাটানোর ইচ্ছা।
এই জার্নির খবর শুনেই বন্ধুমহল মোটামুটি চিরবিদায়-টিদায় জানিয়ে দিল।
সোহাগের টিকেট কেটে বেনাপোলের উদ্দ্যেশে যখন যাত্রা শুরু হল, তখন কেমন যেন হু হু করে ঊঠলো মন। ব্যাগের মধ্যে ভাজ করা আজিজ থেকে সদ্য কেনা মুক্তিযুদ্ধ আর বাংলাদেশ লেখা টিশার্ট, দেশপ্রেম কেন যেন হঠাত করেই বেড়ে গেলো জানি না। সবচেয়ে বড় আশ্চর্য এই যে, বাসের প্রতিটা যাত্রী তাদের কথাবার্তার পদে পদে বুঝিয়ে দিচ্ছে ভারতের প্রতি অসন্তোষ। “ঠ্যাকায় না পড়লে ওই **** এর দেশে কেউ যায় না কি?” লোকমান ভাই অবশ্য বাসের চাকা ঘোরার সাথে সাথেই ঘুমিয়ে যেতে পছন্দ করেন, আমি আর সারোয়ার ভাই চুপচাপ এইসব হট টক শুনি আর আসন্ন ভারত অভিযান নিয়ে প্ল্যান করি।
বেনাপোল বর্ডার, আর ওপারে পেট্রাপোল। আমার ভিসায় লেখা অবশ্য হরিদাসপুর। সোহাগ পরিবহনের এপার-ওপারের দালাল আর কুলি গ্যাং, সব সিস্টেম করা। কিছু টাকা এখানে খসাতেই হল। ইমিগ্রেশন বলে আদৌ কিছু আছে মনে হয় না।
তবে ইন্ডিয়ান কাস্টমসের সামনে সবাইকেই দাড়াতে হয়। সবার শঙ্কা ডলার আর টাকা নিয়ে। ওখানে বাংলাদেশ থেকে রুপি করে নিলে পুরাই ধরা, আবার আমাদের টাকা বেশি নিয়ে গেলেও ভ্যাজাল। শালারা চায় ডলার, আর সেই ডলারটা নিজেদের দেশে ভাঙ্গানো হোক। যখন আমাকে জিজ্ঞেস করলো, "“আর কিচু আচে টাচে নাকি”", মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেলো।
আসলে ওদের বাংলার এই হিন্দি টানগুলো সহ্য হতে চায় না।
বর্ডার চেকপোস্টে বিএসএফ দেখে মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল, কাস্টমসে সেটা আরো একটু বাড়লো আর ফাইনালী, যখন ওপারের বাসে ঊঠলাম......... হোয়াট দ্য হেল, এ কি বাস !!! ভলভো বটে, কিন্তু এই মডেল আমাদের দেশে নামলে পাব্লিক দুই দিনে বাস দিত ভেঙ্গে। কন্ডাক্টর ক্যাচ ক্যাচ করতেসে, “আরে মশাই বসুন দিকি, থামুন না !!” (আবার সেই বাংলা টান)। এক পিচ্চির গগনবিদারী কান্নার মাধ্যমে যাত্রা হল শুরু!!!
যশোর রোডের দুইপাশে বিশাল বিশাল সব পুরোন গাছ, ছায়াদার একটা টানেলের মত। তবে রাস্তায় ঝাকির পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে বেশি।
বামুনগাছিতে একটা ব্রেক দিয়ে বারাসাত ছাড়িয়ে দমদম হয়ে বাস পৌছল মহানগর কোলকাতায়। এই শহর সম্পর্কে আমার আইডিয়া শুধু ফেলুদা, টেনিদা আর ঘনাদা’র বাসভূমি হিসেবেই, এখন পর্যন্ত পজেটিভ । তাই পাশের যাত্রীর খোচাতে তাকিয়ে দেখতে যখন সে দাত বের করে আমাকে একটা দোকান দেখালো......... বড় সাইনবোর্ড - "“দিশী ও বিলেতি মদের দোকান”"......... বেশি একটা অবাক হইনি।
মারকুইস স্ট্রীটের ব্যস্ততা
কোলকাতার বাংলাদেশী পাড়া মারকুইস স্ট্রীটে নেমে প্রথম কাজ হোটেল খোজা। আমি এদিকে তাজ ট্রাভেলসের “শাকিল ভাই”য়ের কাছ থেকে আমাদের টিকেট নিয়ে আসলাম।
কেউ যদি কখনো কলকাতা হয়ে ভারতের অন্য কোথাও যান তাহলে যোগাযোগ করতে পারেন (তাজ ট্রাভেলস +91 98313 66984) ব্যবসায়ী হলেও বাংলাদেশী ট্যুরিস্টদের জন্য যথেষ্ট হেল্পফুল মনে হয়েছে। তার দোকানে কোম্পানীর নামের চেয়েও বড় করে লেখা, “শাকিল ভাই”!
আমাদের ট্রেন ছিলো রাতে, সময় কাটাতে আমি আর সারোয়ার ভাই বেরিয়ে পড়লাম জওহরলাল নেহেরু রোড ধরে। রাস্তায় গাড়ী বলতে তো মারুতি সুজুকি আর অ্যাম্বাসাডর, তাই আমার সেদিকে খেয়াল নাই, তবে একেকটা রয়াল এনফিল্ড বাইক যখন টান দিচ্ছে আশ পাশ থেকে, সারোয়ার ভাই কেমন যেন শিউরে শিউরে উঠছেন। হাটতে হাটতে সামনে পড়লো কোলকাতা আর্ট কলেজ। একটু হেজিটেট করে পরে ঢুকেই গেলাম সেখানে।
ওখানে গিয়ে কথা বলতেই চম্পা দিদি নামক একজন ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ওদের সবগুলো স্টুডিও, ক্লাস আর গ্যালারিগুলো দেখিয়ে দিলেন। আমাদের চারুকলা ইন্সটিট্যুটের চেয়ে ওদের ইন্টেরিওর অনেক সুন্দর, আর ক্যাম্পাসটা যদিও অনেক ছোট কিন্তু সমৃদ্ধ। সবচেয়ে বড় কথা অচেনা দুই বিদেশীকে যেভাবে তারা ট্রিট করলো, এটা অসাধারণ। শুনেছিলাম এরা নাকি বাংলাদেশিদের দেখতে পারে না, ভুল আস্তে আস্তে ভাংতে শুরু করলো। এরপর সামনেই নিউ মার্কেট বা হগ সাহেবের বাজার......... যদিও এটা অনেক পুরাতন আর বিখ্যাত, তবুও আমাদের নিউ মার্কেট এর চেয়ে অনেক ভালো, অন্তত অ্যাপিয়ারেন্সে।
ভিতরে গিয়ে অবশ্য অনেক ভ্যারাইটির দোকান, মেয়েদের অন্তর্বাসের ঝলমলে শোরুমগুলোর কিঞ্চিত আধিক্য আমার বাঙ্গাল চোখে একটু ‘কেমন যেন’ লাগলো। মার্কেট থেকে বেরোতেই সামনে অনেকগুলো খাবারের স্টল। পাওভাজি আর এক রকমের নোনতা চাট চেখে দেখতে দেখতে নামলো সন্ধ্যা, আর হঠাত করেই ধুন্ধুমার বৃষ্টি। অফিস ফেরত কলকাতার বাবুদের সাথে দৌড়ে আমরাও প্রায় কাক ভেজা হয়ে ফিরলাম হোটেলে। সে রাতে ট্রেন ধরার টেনশনে আর অন্য কিছু করা হল না।
ঠুং ঠুং ঘন্টা বাজিয়ে রাস্তার উপর দিয়ে চলা রংচটা ট্রাম দেখতে দেখতে ভাড়ের চা খেয়ে টেয়ে হাওড়া জংশনে দৌড়!
কোলকাতা আর্ট কলেজ - ছবি তোলা নিষেধ তবু তুললাম
এরপর প্রায় অর্ধ-ভারত ঘুরে সপ্তাহদুয়েক পর আমরা আবার ফিরলাম কলকাতা, এবারে আগের চেয়ে অনেক অভিজ্ঞ। সময় নষ্ট না করে ঘোরাঘুরিতে লেগে গেলাম, যদিও হাতে সময় নেই মোটেও। দেশে ফেরার আগমুহূর্ত, তাই নিউ মার্কেট থেকে হাল্কা কিছু কেনাকাটা। এসপ্ল্যানেড হয়ে হাটতে হাটতে চলে আসলাম ময়দান......... যাকে ছোটবেলা থেকে জানি গড়ের মাঠ হিসেবে। শহীদ মিনার পাশে রেখে হাটছি খোলা ময়দানে।
মাঠটা অবশ্য এতোটা খোলামেলা না, অনেক জায়গায়ই বেদখল মনে হল। ইডেন গার্ডেন স্টেডিয়াম পাশেই, ড্রাম বিটের শব্দ আর হইচই শুনে বোঝা গেলো ভিতরে নাইটরা আছে, খান সাহেবও আছেন। ঐ হুজুগে না গিয়ে চলে আসলাম গঙ্গার ধারে। এতো সুন্দর বাধানো নদীর পাড়......... একটু পর পর একটা ঘাট, বসার বেঞ্চি, ওয়াকওয়ে আর তার পিছনে ডুবে যাচ্ছে বিকেলের সূর্য। ঢাকা আর বুড়িগঙ্গার কথা মনে হতেই............
পড়ন্ত বিকেল - গঙ্গার তীরে
মূলত কোলকাতা ছিলো আমাদের ট্রানজিট পয়েন্ট......... তাই অন্য শহরগুলোর মত এটা ঘুরে দেখতে পারিনি সেভাবে।
খারাপ লাগার মধ্যে যা আছে......... বাঙ্গালীর শহরেও হিন্দিতে কথা বলা, বেশ নোংরা আর অগোছালো আর মানুষ টানা রিকশা............ যেটা সবচেয়ে জঘন্য মনে হয়েছে। কিন্তু তারপরও কোলকাতার একটা আলাদা “কিছু একটা” আছে, যা তাকে সবার চেয়ে আলাদা করে রাখে, এক অন্য রকম উজ্জ্বলতায়। আরাফত হোটেলের পয়তাল্লিশ টাকার সেইরকম বিরিয়ানী খাওয়া থেকে শুরু করে গঙ্গার ঘাটে কাটিয়ে দেয়া নরম বিকেল কিংবা সদর স্ট্রীটে হাটতে হাটতে রঙ বেরঙ্গের মানুষ দেখা............... নাই বা দেখা হল ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল কিংবা সাইন্স সিটি বা সল্টলেকের আভিজাত্য, সাধারণ কলকাতাই কেন জানি অসাধারণ লেগেছিলো আমাদের সবার চোখে।
ইডেন গার্ডেন স্টেডিয়াম
পুনশ্চঃ ভারত ভ্রমণের উপর বাংলায় কার্যকর কোন রিসোর্স আমি অনলাইনে বহু খুজেও পাইনি, তাই আগামীর ভ্রমণেচ্ছুদের একটু সাপোর্ট দিতে চাই.........
যারা যেতে চান - ৩০০ টাকা ভিসা প্রসেসিং ফি, ১১০০ টাকা ঢাকা-বেনাপোল ভলভো (সোহাগ, শ্যামলী, গ্রীণ লাইন), ওপারে গিয়ে আবার ২২০ রুপির টিকেট কাটতে হবে। থাকবার হোটেল সদর স্ট্রীটে বা মারকুইস স্ট্রীটে আছে অসংখ্য, দু’জনের জন্য নূন্যতম ৪০০ রুপি থেকে রুম পেতে থাকবেন।
খাবারের খরচ খুবই কম............ আমরা তিনজন একবেলা প্রায় পেটচুক্তি খেয়েছিলাম ১৬০ রুপীতে। মুসলমান হোটেল একটু জিজ্ঞেস করলেই পাবেন যদি হালাল খেতে চান, আরাফাতটা বিখ্যাত। পাতাল রেল আছে, সবচেয়ে কম খরচে যোগাযোগ। ট্রামে উঠে দেখতে পারেন, আর মানুষ টানা রিকশা ব্যবহার না করাটাই ভালো।
আর হ্যা, বাংলাদেশী ১০০ টাকায় ৬০-৬৫ রুপী হবে।
কোলকাতা থেকে ডলার ভাঙ্গিয়ে নিলে ভালো দাম পাবেন। (বর্ডার থেকে না করাটা ভালো, পুরা ধরা খাওয়ায় দিবে !!!)। ভারতের আর পাচটা শহরের থেকে কলকাতায় ডলারের রেট বেশি পেয়েছি।
তো............ সময় নিয়ে বেরিয়ে পড়ুন !!!!!
Click This Link ভারত মন্থন - গুজরাত পর্ব ১
সভ্যতার কলঙ্ক
কোলকাতার ট্রাম - আজো চলছে গড়িয়ে গড়িয়ে ! ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।