লজ্জা, ঘৃণা আর অপমানে মুহিত যেন মাটির সঙে মিশে গেছে। সে দিনের বেলা বাসায় থাকলে সবসময় কারো না কারো সঙে কথা বলে, অনেক রাত অবধি ইয়াসমিনের সঙে কথা বলে কিন্তু আজ তার মুখে কোন কথা নেই। উত্তরা থেকে ফিরে ইয়াসমিনের কাছ থেকে সবকিছু শুনে তার মুখের ওপর একটা গভীর কালো মেঘের ছায়া পড়েছে। এখন রাত বারোটা বাজে। সাধারণত এত রাত মুহিত জেগে থাকে না, আজ তার চোখে ঘুম নেই।
ইয়াসমিন সেই যে সন্ধ্য্যা থেকে কাকে কাকে ফোন করছে তার কোন শেষ নেই এখন সেও অনেকটা ক্লান্ত। কিন্তু ঘুম আসছে না, বিছানায় সেও ছটফট করছে।
মুহিত জিজ্ঞেস করল, কী হলো?
কই কিছু তো হলো না, কাল ওকে নিয়ে ক্লিনিকে যেতে হবে। আগে এম.আর করা দরকার, তারপর যা হয় হবে।
কোন সমস্যা হবে না তো?
কী সমস্যা হবে?
ছোট মেয়ে এম.আর করতে গিয়ে যদি কোন সমস্যা হয়।
আমি সে চিন্তা করছি না।
তো?
আমি ভাবছি হারুর কথা।
হারুর কথা বলতেই মুহিত চমকে উঠল, ও তোমাকে তো একটা কথা বলতে ভুলেই গেছিলাম।
কী কথা?
কাল হারু ফোন করেছিল।
কী বলল? ইয়াসমিন কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল।
বলল রুপার বিয়ে এক সপ্তাহ পিছিয়েছে।
ইয়াসমিন যেন প্রাণ ফিরে পেল, এমন একটা খবর তুমি আমাকে বলতে ভুলে গেলে? যাক বাঁচা গেল।
কেন?
এই এক সম্পাহের মধ্যে রুপাকে সুস্থ করে তুলতে হবে। আল্লাহর অশেষ রহমত, রুপার বিয়েটা না পেছালে আরো কী যে হতো।
কী করবে এখন?
সবার আগে রুপাকে পাপ মুক্ত করতে হবে।
পাপ মুক্ত।
মুহিত বিছানা থেকে উঠল। ইয়াসমিনের মুখের দিকে তাকালো। আজ একদিনেই ইয়াসমিনের চেহারায় যেন বয়সের ছাপ বেড়ে গেছে। দুশ্চিন্তাগ্রস্থ মুখ শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।
মুহিত ইয়াসমিনের কপালে একটা হাত রাখল। ইয়াসমিনও বিছানা থেকে উঠে বসল। মুহিত কথাটা উপস্থাপন করতে গিয়ে একটা ঢোক গিলল, ইয়াসমিন তোমাকে একটা কথা বলতে চাচ্ছি?
ইয়াসমিন ধীর শান্ত কণ্ঠে বলল, বলো।
আচ্ছা রুপা তো আমাদের সঙে অনেক বছর থেকে আছে।
হ্যাঁ।
তুমি কি মেয়েটার খারাপ কিছু দেখেছ?
ইয়াসমিনের চোখের সামনে ফুটে উঠল রুপার সুন্দর জ্বলজ্বলে, নিষ্পাপ একটা মুখ। এই মুখ ইয়াসমিন সাত-আট বছর থেকে দেখে আসছে। এই দীর্ঘ সময়ে রুপা কোনদিন একটা মিথ্যা কথা বলেনি, যেকোন বিষয়ে এতটুকু চালাকি করেনি। কোনদিন খাবার পাতিল থেকে একটা দানা না বলে খায়নি, এই নিষ্পাপ মেয়েটিকে সে দোষারোপ করবে কীভাবে? আর তমাল? যাকে সে নিজের পেটে দশ মাস দশ দিন ধারণ করেছে, শৈশব থেকে তিল তিল করে লালন-পালন করেছে। নিজের আদর্শ দিয়ে মানুষ করেছে সে তার আদর্শকে এমনভাবে জলাঞ্জলি দিলো? তার মান-সম্মান এমনভাবে মিশিয়ে দিল।
এই ঘটনা যদি ফাঁস হয়ে যায় তবে তাদের সম্মান থাকবে কোথায়? আত্মীয়-স্বজন, মিডিয়া, নারী অধিকার সংগঠনগুলোকে তাদের বিরুদ্ধে উঠে-পড়ে লাগবে। এতো গেল আইন আর সমাজের কথা। আর বিবেক? নিজের বিবেকের কাছে সে কী জবাব দিবে?
ইয়াসমিন না সূচক মাথা নাড়ল।
এত অল্প বয়সে মেয়েটা এতবড় একটা ধকল সইতে পারবে?
তাছাড়া আর কী করার আছে?
সকালবেলা বিছানা থেকে উঠেই ইয়াসমিন রুপার কাছে গেল। ইয়াসমিনকে দেখে রুপা চমকে উঠল, খালাম্মা।
ইয়াসমিন রুপার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে মা।
রুপা বুঝতে পারল না। সে জিজ্ঞেস করল, কেন খালাম্মা?
তোকে আমার সাথে এক জায়গায় যেতে হবে।
কোথায় খালাম্মা?
এত কথা জানতে চাবি না রুপা। আমার ওপর তোর বিশ্বাস নেই।
রুপা কিছুটা অনুমান করতে পারল। সে মনে করেছিল ইয়াসমিন তাকে খোলামেলা করে বলবে। কিন্তু সে একটু সাজিয়ে গুছিয়ে বলতে শুরু করল, তুই তো বুঝতেই পাচ্ছিস আমরা সবাই তোর ব্যাপারটা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি। আর কিছু প্রশ্ন করবি না মা, আমি যা যা বলছি ঠিক তা তা করবি। মনে কর আমি তমাল আর তোর দু’জনেরই মা।
রুপা ইয়াসমিনের মুখের দিকে তাকালো, না ইয়াসমিনের চোখে মুখে কোন চাতুরতা নেই একটা অসহায়ত্ব আছে, দুঃশ্চিন্তায় এই এ’কদিনেই তরতাজা মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে। রুপা আর কথা বাড়ালো না।
এতক্ষণ ইয়াসমিন রুপার চৌকির কোণায় বসেকথা বলছিল। এবার উঠে দাঁড়ালো, তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে মা। আমি আসছি।
রাজধানীর কোন নামী-দামি ক্লিনিক না। হাসপাতালে চাকুরি করা এক নার্সের বাসা। এ ধরণের কেইসে কোন হাসপাতাল কিংবা ক্লিনিকে গেলে অনেক ঝুঁক্কি-ঝামেলা পোহাতে হয়, অনেক সময় পুলিশ কেইস হয়ে যায়। এসব ভেবেই ইয়াসমিন অনেক খোঁজাখুঁজি করে এই নার্সের ঠিকানা পেয়েছে। তার সঙে মোটা অঙ্কের টাকার দফা-রফা হয়েছে।
সবকিছু ঠিকই ছিল, সফলভাবে এম.আর সম্পন্ন হয়েছে কিন্তু শেষ র্পযন্ত মুহিত যা আশঙ্কা করেছিল তাই হয়েছে। ব্লিডিং বন্ধ হচ্ছে না। নার্স বলেছিল কিছুক্ষণ পরই ব্লিডিং বন্ধ হয়ে যাবে কিন্তু কয়েক ঘণ্টা পরও বন্ধ হলো না। মুহিত বেশ চিন্তায় পড়ল। সে বার বার করে ইয়াসমিনকে জিজ্ঞেস করল, দেখো আর মনে হয় দেরি করা ঠিক হচ্ছে না।
নাকি কোন ক্লিনিকে নিয়ে যাবো?
কিন্তু শেষে থলের বিড়াল বেরিয়ে পড়ার আশঙ্কায় ইয়াসমিন ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়ার সাহস পাচ্ছে না। অবস্থার আরো অবনতি হওয়ায় মুহিত আর ইয়াসমিনের কথা শুনল না। ফোন করে এ্যাম্বুলেন্স নিয়ে এলো কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। রাস্তায় ট্র্যাফিক জ্যাম, এ্যাম্বুলেন্স এগোচ্ছ খুব ধীর গতিতে আর রুপার অবস্থার অবনতি হচ্ছে দ্রুতগতিতে। আর কয়েক’শ ফুট দূরেই ক্লিনিক, রুপা একবার চোখ তুলে তাকালো, ইয়াসমিন রুপার মাথার চুলগুলো পেছনের দিকে এলিয়ে দিয়ে বলল, এখন ভালো লাগছে মা?
ঢাকা শহর কত বড়, এখানে কত বিচিত্র মানুষ, চোখের সামনে বিল্ডিংগুলো কীভাবে তরতর করে বেড়ে উঠছে।
ব্রম্মপুত্রের চর থেকে ঢাকা আসার সময় ক্ষুধার্ত রুপার চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল এক থালা ভাত আর একদিন চিলমারীতে রাস্তার সামনে দাঁড়িয়ে টি.ভি’তে দেখা ঢাকা শহর। খুব সুন্দর আলো ঝলমলে রুপকথার মতো শহর ঢাকা। ঢাকায় এসে সেই স্বপ্নের এক থালা ভাত পেয়েছে, ক্ষুধা কী তা এই ক’বছরে সে টেরও পায়নি। রুপার ক্ষুধা নিবারণ হয়েছে, ক্ষুধার জ্বালা থেকে মু্ক্তি পেয়েছে কিন্তু ক্ষুধার জ্বালা মেটাতে গিয়ে সে যা হারিয়েছে তা তার জীবনের অমূল্য সম্পদ। তার সম্ভ্রম, যা নারীরা জীবন দিয়ে রক্ষা করে।
আর সে! সে কী না সরল বিশ্বাসে উজাড় করে দিয়েছে মিথ্যা বিয়ের প্রুতিশ্রুতিতে। নিজের ওপর রুপার ঘৃণা হলো।
আর তার কাছে রুপকথার মতো আলো ঝলমল ঢাকা শহর! তার কাছে ঢাকা শহর আবার আলাদা কী? সেতো সেই যে চার দেয়ালে বন্দি বাসায় ঢুকেছে আর বেরোতে পারেনি। এই ক’বছরে রুপা বাসা থেকে বেরিয়েছে হাতে গোনা কয়েকবার। সে ঢাকা শহর দেখেছে জানালায় দাঁড়িয়ে।
আগে বাসা থেকে দূরে দেখতে পেতো, অন্ততঃ কয়েক’শ ফুট দূরে, তারপর কাছাকাছি অনেক বড় বড় বিল্ডিং গড়ে উঠল। রুপা আগে বাসার জানালার কাছে দাঁড়িয়ে যে ঢাকা শহর দেখতো তা আর দেখা হলো না।
এই তো কয়েক মাস আগে ইয়াসমিন একবার রুপাকে মার্কেটে নিয়ে গিয়েছিল। মার্কেক কী? না মার্কেট না মেলায়। আসলে ইয়াসমিন তাকে নিয়ে গিয়েছিল মেলায় কিছু কেনাকাটার জিনিস ক্যারি করার জন্য।
এই যেমন: ঝাড়ু, বালতি, পিঠা বানানোর বেলন ইত্যাদি। রুপার চোখ ঝলসে গেছে সেই আলোক সজ্জায়। এটা যেন মেলা না রুপার কাছে অন্য এক পৃথিবী। হ্যাঁ সত্যি রুপার কাছে অন্য এক পৃথিবী! ব্রম্মপুত্রের চরে আমাবশ্যার অন্ধকারে রুপার কাছে সবকিছু আলোর মতো পরিস্কার। আর এই ঢাকা শহর! আলো ঝলমল এই ঢাকা শহর যেন রুপার কাছে আমাবশ্যার চেয়ে অন্ধকার।
এখানকার অনেক কাছের মানুষগুলোও যেন একেবারে অপরিচিত। এই যে ইয়াসমিনকে রুপা খালাম্মা বলে ডাকে সে কি রুপাকে কোনদিন আপন করে নিয়েছে? প্রথম থেকেই রুপাকে তুই তুই বলে সম্বোধন করেছে। আজ রুপা যখন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে তখন রুপাকে মা বলে সম্বোধন করেছে এটা কি উদ্দেশ্য প্রণোদিত না? রুপার চোখের সামনে ভেসে উঠল প্রতারক তমালের ছবি, সে একবার চোখ মেলে তাকালো তার চোখের সামনে বসে আছে বসে আছে ইয়াসমিন। রুপা ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিল। দু’চোখ বন্ধ করতেই স্নেহময়ী মায়ের ছবি ভেসে উঠল, ভেসে উঠল এক নৌকা বরযাত্রীসহ এক অপরিচিত বরের ছবি।
রুপা একটা জোরে নিঃশ্বাস নিল, যেন কষ্টের শেষ নিঃশ্বাস। মেহেদি মাখা হাত দু’টো ছড়িয়ে পড়ল এ্যাম্বুলেন্সের সিটে।
সমাপ্ত
রুপার বিয়ে-০১ ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।