তার কয়েকদিন পরই হারু আর মুহিতের ভাই রুপাকে রেখে গেল ঢাকা। রুপার ভাতের কষ্ট দূর হলো, ক্ষুধার জ্বালা থেকে সে মুক্তি পেল। মুহিত ভালো মানুষ, ইয়াসমিনও খারাপ নয়। তিনবেলা ভাত খেতে দেয়, ঈদ, কোরবানি ঈদে জামাকাপড় কিনে দেয়। তার বাবা-মাকেও শাড়ি-লুঙি কিনে দেয়।
রুপা মুহিতকে খালু এবং ইয়াসমিনকে খালা আম্মা বলে ডাকে। দীর্ঘ সাত/আট বছর এবাড়িতে থাকতে থাকতে সে এ বাড়িটাকে অনেকটা আপন করে নিয়েছে। আপন করে নিয়েছে খালা, খালু আর তাদের একমাত্র সন্তান তমালকে।
রুপার বয়স এখন কত হবে? ষোল কিংবা সতেরো। কয়েকমাস আগে রুপা গ্রামের বাড়ি গিয়েছিল।
তখন বাবা-মাকে বলতে শুনেছে তার বিয়ের কথা। কথাটা তার বাবা মুহিতকেও বলেছে, মুহিত তার প্রতিশ্রুতি মতো যৌতুকের পঞ্চাশ হাজার টাকা দিতে চেয়েছে। ইয়াসমিন দিতে চেয়েছে কানের দুল। তারপর শুরু হয়েছে রুপার জন্য পাত্র দেখা। ক’দিন আগে হারু ফোন করে মুহিতকে জানিয়েছে রুপার বিয়ের কথা।
আগামীকাল বাবা রুপাকে নিতে আসবে অথচ আজ তার জীবনে এক চরম অনিশ্চয়তা।
রুপা আর অষ্টমীর চরের সেই শ্যামলা বর্ণের, চোয়াল ভাঙা রুপা নেই। দীর্ঘদিন ঢাকা শহরে ছাদের নিচে আর ফ্যানের বাতাসে থেকে তার চেহারায় অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আজকাল রুপাকে দেখে আর সহজে কেউ সেই রুপাকে খুঁজে পাবে না। তার চেহারায় যেন এক প্রকার ঔজ্জ্বলতা এসেছে, শরীরে মাংস বেড়েছে, সে এখন ভরপুর যৌবনের এক তরুণী।
শুধু চেহারায় নয়, শৈশবে রুপা একটা এন.জি.ও’র স্কুল থেকে ক্লাস ফাইভ পাস করেছে তার সেই একাডেমিক শিক্ষার কোন উন্নতি হয়নি কিন্তু ঢাকায় সে তার খালা আম্মার গল্পের বই আর প্রতিদিন পত্রিকা পড়ে পড়ে স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছে। তার কথাবাতার্য় আধুনিকতা এসেছে রুপা এখন শুধু তরুণীই নয়, আধুনিক এক তরুণী।
তমাল রুপার চেয়ে প্রায় তিন বছরের বড়। একসঙে ছোটবেলা থেকে মানুষ হয়েছে। মুহিত আর ইয়াসমিন দু’জনকে ছোটবেলা থেকে একই চোখে দেখেছে, ধীরে ধীরে রুপা ভুলতে বসেছে যে সে এ বাড়ির গৃহপরিচারিকা।
তমাল এখন কলেজে পড়ে। দু’জনের এক সময়ের খেলার সাথীর মধ্যে যেন একটা অন্যরকম সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।
রুপর জগত খুব ছোট, শৈশবে ব্রহ্মপুত্র নদের অষ্টমীর চর এবং কৈশোর আর তারুণ্যে ঢাকা শহরের একটি বাসার চার দেয়াল। তার জীবনে পুরুষ মানুষ বলে তার বাবা, খালু আর তমাল। বাবার কথা মনে পড়লে তার দু’চোখে পানি এসে যায়, খালুকেও সে শ্রদ্ধা করে বাবার চেয়ে কোন অংশে কম নয় কিন্তু তমালর বেলায় যেন বুকটা অন্যরকম হয়ে যায়।
তমালের চোখের দিকে তাকাতেই রুপার বুক যেন কেমন কেমন করে, রুপার বুকে একটা ঢেউ বার বার করে প্রতিরোধের পাড় ভেঙে চুরমার করে দিতে চায়। রুপা ব্রহ্মপুত্র নদের ঢেউ দেখেছে, পাড় ভাঙ্গা ঢেউ। কাশবন দেখেছে, ছোটবেলা কাশবনে লুকোচুরি খেলেছে, শরতে আকাশের চাঁদ দেখেছে, দেখেছে চাঁদের সঙে মেঘের লুকোচুরি খেলা কিন্তু তমালের চোখের দৃষ্টি রুপার হৃদয়ের প্রতিরোধের দেয়াল ভাঙ্গা ঢেউ, তমালের সঙে তার লুকোচুরি খেলা। এসব তমালকে তার ভালোবাসা কী না।
তমালের সঙে তার শুধু লুকোচুরি খেলাই না কখনো কোন কারণে দরজা খুলে দিতে গিয়ে অসাবধানতাবশতঃ কিংবা ইচ্ছাকৃত দুষ্টামির কারণে তমালর হাতের সামান্য ছোঁয়ায় তার হৃদয়ে তোলপাড় শুরু হয়।
রুপা জানে না এটাকে প্রেম বলে কী না।
একদিন তমাল কলেজ থেকে এলো নিত্যদিনের চেয়ে অনেক আগে। এমন যে কোনদিন আসে না তা নয়। আবার বাসায় কেউ না থাকলেও তমাল আর সে বাসায় থেকেছে খুব স্বাভাবিকভাবে। কিন্তু সেদিন যেন রুপার একটু ভিন্ন রকম মনে হলো।
রুপার মনের মধ্যে তখন বিয়ের বউ সাজসাজ ভাব। সে তখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ঘন ঘন নিজের প্রতিবিম্ব দেখছে। তমালর কলিং বেল এর ধরণ সে বোঝে। তাই সে একটু লজ্জা পেল। কয়েক সেকেন্ড আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সহজ হলো।
তারপর দরজা খুলে দিল, কী রে দরজা খুলে দিতে দেরি হলো যে?
রুপা লজ্জায় কিছুটা রাঙা হয়ে গেল, কাজ করছিলাম।
কী কাজ?
বাসায় কত কাজ থাকে, তুমি ছেলেমানুষ তুমি আর কাজের কী বুঝবে।
আচ্ছা, বলে তমাল তার রুমে চলে গেল।
কয়েক মিনিট পর তমাল কাপড় ছেড়ে মৃদু কণ্ঠে ডাক দিল, এই রুপা, একটু এদিকে আয় তো।
ডাকটা স্বাভাবিকভাবেই কিন্তু রুপা যেন চমকে উঠল।
রুপা কোনকিছু না বলেই তমালর রুমের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালো। এমন কতদিন তো বাসায় কেউ না থাকলেও রুপা তমালের রুমে ঢুকেছে, কাজ করেছে, দু’য়েকটা খোশগল্পও করেছে কিন্তু আজ তার বুকের তেতরটা কেমন যেন ওলট-পালট করে উঠল, হৃৎপিণ্ডের গতি বেড়ে গেল। সে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইল।
দরজায় দাঁড়িয়ে থাকলি কেন? ভিতরে আয়।
রুপা মাথা নত করে দরজায় দাঁড়িয়ে রইল।
এক অজানা আশঙ্কায় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল, নিজের অজান্তে মুখ থেকে অষ্ফুট একটা কণ্ঠস্বর বেরিয়ে এলো, না!
তমাল রুপার একটা হাত ধরে তাকে রুমের ভেতরে নিয়ে গেল। তমাল তার হাত ষ্পশ করতেই আগের আছড়ে পড়া ঢেউটা আরো যেন উত্তাল হলো, রুপা একবার নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করল কিন্তু তার হাত যেন ততক্ষণে অনুভূতিহীন হয়ে গেছে।
রুপা তমালর রুমে যাওয়ার আগে মাথায় ওড়না দিয়ে ভালো করে বুক ঢেকেছে, ওড়না দিয়ে মাথায় ঘোমটা দিয়েছে। তমাল রুপার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রুপার মাথা থেকে ঘোমটা সরিয়ে তার থুতনি উঁচু করে ধরে বলল, তুমি খুব সুন্দর রুপা, খুব সুন্দর!!
নিজের প্রশংসা শুনে রুপার মুখটা লজ্জায় রাঙা হয়ে গেল।
রুপা একবার ডাইনে-বাঁয়ে তাকালো, তার তাকানো দেখে মনে হলো কেউ নেই জেনেও সে যেন কাউকে খুঁজছে, যেন একটা আশ্রয়।
তমাল রুপার একটা হাত ধরে আরেকটা হাত পিঠে দিয়ে এক’পা-দু’পা করে বিছানার দিকে নিয়ে গেল। রুপা নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়ার মৃদু চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। তার সমস্ত শরীর যেন অবশ হয়ে গেল। একটা লজ্জা, একটা অজানা আশঙ্কায় রুপা কিছু বলতে পারছিল না। তার তোলপাড় বুকের ভিতর থেকে একটা চাপা নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো, আমার খুব ভয় লাগছে তমাল।
কীসের ভয়?
কেউ যদি জানে? যদি কিছু হয়?
কেউ জানবে না, তোর কিচ্ছু হবে না।
আমাকে ছেড়ে দাও তমাল, তুমি তো জানো আর ক’দিন পর আমার বিয়ে, আর তুমি কী না-
তমাল রুপার কথা শেষ হতে দিল না। তার মুখে হাত দিয়ে বলল, না অন্য কারো সাথে তোর বিয়ে হবে না।
তারমানে?
মানে, আমিই তোকে বিয়ে করবো।
সত্যি বলছ?
তমাল আবেগপ্রবণ হয়ে বলল, সত্যি, সত্যি, সত্যি।
আজ গভীর রাতে, নিদ্রাহীন, দুশ্চিন্তগ্রস্থ, অনিশ্চয়তার এই রাতে তমালর কথাগুলো রুপার কানে বার বার বেজে উঠল। সে বিছানা থেকে উঠে তমালর রুমের দিকে গেল। তমাল কোনদিন রুমের দরজায় ছিটকানী লাগায় না। রুপা দরজায় হাল্কা ঠেলা দিতেই দরজা খুলে গেল। রুপা দরজার ছিটকানীটা লাগিয়ে দিয়ে তমালর বিছানায় কোণায় বসে চাপাস্বরে ফিসফিস করে ডাক দিল, তমাল, এই তমাল।
তমাল চমকে উঠল, ঘুমের মধ্যে জিজ্ঞেস করল, কে?
এই চুপ, আমি রুপা।
রুপা তুই আমার রুমে? কেন?
হুঁম তোর সঙে আমার কথা আছে।
তমাল দু’হাতে চোখ কোচলাতে কোচলাতে বলল, আমার সাথে কী কথা?
রুপা কিছুটা রাগের সুরে বলল, কী কথা, না? মনে হয় কিছু হয়নি।
কী হয়েছে বলোতো?
তমাল তুমি আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলে না?
আমি তোকে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম? কই না তো। আমি তোকে বিয়ে করতে চাবো কেন? আর আমি তোকে বিয়ে করতে চাইলেই বুঝি বাবা-মা মেনে নিবে?
রুপা তমালর বাহুতে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, এই তমাল তুমি কী বলছ? তুমি কি এখনো ঘুমের মধ্যে আছ?
এবার তমাল স্বাভাবিক গলায় বলল, না আমি ঘুমের মধ্যে নেই একেবারে জেগে আছি।
চলো আমরা বিয়ে করে ফেলি।
তমাল দৃঢ় কণ্ঠে বলল, অসম্ভব, আমি তোকে বিয়ে করবো?
হ্যাঁ, আমাকে বিয়ে করবে। সেদিন যে তুমি আমাকে বললে, আমাকে অন্য কারো সাথে বিয়ে হতে দেবে না। আমাকে তুমি বিয়ে করবে। আর সেজন্যই তো আমি-বলতে বলতে রুপার কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে এলো।
রুপা তুমি এত বোকা কেন? কখন কোনদিন আবেগের বশে আমি তোকে বলেছি আমি তোকে বিয়ে করবো আর তুই বিশ্বাস করেছিস। সব কথা বিশ্বাস করতে হয় না।
তুমি বিয়ে করতে না চাইলে কি আমি… ছিঃ ছিঃ ছিঃ রুপা নিজেকে ধিক্কার দিল।
তমাল কোন কথা বলল না।
রুপা বলল, তুমি একটা ভণ্ড, প্রতারক, আমাকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে এখন সাধু সেজেছো, না?
তমাল বিরক্তির সুরে বলল, যা ভাগ, এতরাতে সিনক্রিয়েট করিস না।
আমি সিনক্রিয়েট করছি? এখনো সিনক্রিয়েট করিনি, তুমি যদি আমাকে বিয়ে না করো, আমার পেটের বাচ্চাকে অস্বীকার করো তবে মনে বেখো, আমিও তোমাকে ছাড়বো না।
কী করবে তুমি?
তোমাকে কিছু করবো না, এই পাপ থেকে মুক্তি পেতে আমি নিজেই দুনিয়া থেকে চলে যাবো।
আমাকে ভয় দেখাচ্ছ?
না ভয় দেখাচ্ছি না, সত্যি কথা বলছি। তুমি যদি আমাকে বিয়ে না করো তবে এই ঘুম থেকে উঠে তুমি আমার লাশ দেখবে।
চলবে...
রুপার বিয়ে-০১ ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।