মুহিতের এক বন্ধু আমেরিকা থেকে বাংলাদেশে এসেছে প্রায় এক মাস হলো। আজকাল করে তার সঙে দেখা করতে যাওয়া হয়নি। আজ শনিবার কিছুক্ষণ আগে সে তার বন্ধুর সঙে দেখা করার জন্য উত্তরার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছে। ইয়াসমিন মুহিতকে ফোন করল, হ্যালো।
মুহিত কিছুটা বিরক্তির সুরে বলল, হ্যালো, কী হলো আবার?
ইয়াসমিন কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল, এই তুমি একটু বাসায় আসো তো।
আমি তো এখনো উত্তরায় পৌঁছাইনি।
আজ উত্তরা যেতে হবে না।
কেন? এত তাড়া কীসের?
আজ তোমাকে উত্তরা যেতে হবে না। তুমি এখনই বাসায় আসো।
মুহিত কিছুটা রাগান্বিত স্বরে বলল, কী হয়েছে আগে বলোতো?
ফোনে বলা যাবে না, তুমি তাড়াতাড়ি চলে আসো।
মুহিত কোনকিছু না বলে মোবাইলের লাইন কেটে দিল।
প্রায় ঘণ্টা খানেকের মধ্যে মুহিত এলো। বাসায় ঢুকেই ইয়াসমিনের ওপর এক চট নিল, কী হয়েছে বলোতো?
আগে ভেতরে আসো, বাইরে থেকে চেঁচামেচি করো না, বলে ইয়াসমিন দরজা বন্ধ করে দিল।
মুহিত ডাইনিং স্পেসে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে?
আগে বেড রুমে চলো, তারপর বলছি।
মুহিত বেড রুমে ঢুকল।
ইয়াসমিন বেড রুমের দরজা বন্ধ করে দিয়ে চাপাস্বরে শোনো, বলে বলতে শুরু করল।
মুহিত দাঁড়িয়ে ইয়াসমিনের কথা শুনছিল সবকিছু শুনে তার মাথাটা যেন এলোমেলো হয়ে গেল, আমাদের ছেলে, তমাল এমন কাজ করেছে!! বলে সে ধপাস করে খাটে বসে পড়ল।
হুঁম আমাদের ছেলে, কী পাপ করেছিলাম যে এমন ছেলে পেটে ধরেছি!
কিছুক্ষণের নিরবতা। তারপর ইয়াসমিন প্রথমে কথা তুলল, এখন সবার আগে প্রয়োজন এই পাপ থেকে মুক্ত হওয়া।
মুহিত সরল প্রকৃতির মানুষ, একটু উদাসীন টাইপেরও।
খুব সহজে ঘাবড়ে যায়, মাথার ঘিলু এলোমেলো হয়ে যায়। সে ভেঙে পড়ল। মাথা নত করে বসে রইল।
ইয়াসমিন তাড়া দিল, চুপ করে বসে থাকো না, কিছু একটা করো?
আমি কী করবো? এই কলঙ্কের কথা কাকে বলব? কাকে বলব যে আমার ছেলে–, বলে সে আর বলতে পারল না, ঘৃণার সুরে বলল, ছিঃ, ছিঃ, ছিঃ!
তমাল বাসায় ফিরল সন্ধ্যা নাগাদ। প্রতিদিন মা দরজা খুলে দিয়েই তমালকে জিজ্ঞেস করে, কী রে দেরি করলি কেন? মুখটা শুকনা কেন? ইত্যাদি, ইত্যাদি।
সাধারণত মায়েরা যেসব কথা বলে কিন্তু আজ ইয়াসমিন তার মুখের দিকে তাকালো না। তমাল কিছুটা অনুমান করল, মায়ের মাথা নিচু করে মুখ কালো করে দরজা খুলে দেয়ায় ভয়ে তার বুক কেঁপে উঠল। সে কিছু বলল না। সোজা তার রুমে চলে গেল।
তমালের ডাক পড়ল কয়েক মিনিট পরই।
মায়ের গম্ভীর কণ্ঠের ডাক, ডাকটা তমালের কানে ভয়ঙ্কর শোনাল, তমাল এ রুমে আয় তো।
তমাল কোন কথা বলল না। তার রুম থেকে মায়ের রুমে গেল। বাবা যে বাসায় আছে তমাল আগে বুঝতে পারেনি। সাধারণত মুহিত বাসায় থাকলে চুপ করে রুমে বসে থাকে না।
তমাল বাসায় পা দিয়েই বাবার উপস্থিতি টের পায়। অবশ্য বাবা-মা’র সঙে তার সম্পর্কটা ভয় পাবার মতো না, আতঙ্কেরও না, গার্জিয়ান আর সন্তানের মতো না, যেন একেবারে বন্ধুত্বপূর্ণ কিন্তু আজ যেন বাবাকেও তার ভয়ঙ্কর বলে মনে হলো। তার চিরপরিচিত বাবা-মা’কে অন্য গ্রহের মানুষ বলে মনে হলো।
মুহিত বালিশে গা এলিয়ে দিয়ে শুয়ে আছে, ফ্যানটা জোরে চালু করা আছে কিন্তু তারপরও সে শুধু ঘামছে। ইয়াসমিন মুহিতের পায়ের কাছে পা ঝুলিয়ে দিয়ে বিছানায় বসে আছে।
দু’জনের চোখে-মুখে যেন একটা দুশ্চিন্তা, একটা অনিশ্চয়তা, একটা গভীর আতঙ্কের ছাপ পড়েছে।
এতক্ষণে তমালের কাছে বিষয়টা ষ্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তার মুখের ওপরও একটা কালো মেঘ জমেছে, হৃৎপিণ্ডটা দ্রুতগতিতে চলছে। সে রুমে ঢুকে মাথা নত করে অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে রইল।
ইয়াসমিন বরাবরই কোন কথা বলার আগে ভনিতা করে, অনেক বুঝিয়ে-সুজিয়ে কথা বলে, আজ তার কোনটিই করল না।
সোজাসোজি জিজ্ঞেস করল, রুপার সবর্নাশ করেছিস কেন?
তমাল অস্বীকার করার চেষ্টা করল, রুপার!!
ইয়াসমিন তমালর গালে ঠাস করে একটা চড় মারল, মনে হয় বুঝতে পাচ্ছিস না?
তমাল আর কোন কথা বলতে পারল না।
এজন্য তোকে পেটে ধরেছিলাম, না? এজন্য তোকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করতে চাচ্ছি, না? একটা ফুলের মতো নিষ্পাপ মেয়ের জীবনটা নষ্ট করার জন্য…
তমালর দু’চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল। সে আর অস্বীকার করতে পারল না।
রুপার গ্রামের বাড়ি কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী উপজেলার অষ্টমীর চরে। চার বোন এক ভাইয়ের মধ্যে রুপা সবার বড়।
বাবা দিনমজুর। এই অষ্টমীর চরে সারা বছর কাজ থাকে না, আশ্বিন-কার্তিক এই দু’মাসকে এ অঞ্চলে মঙ্গার মাস বলে। মঙ্গার এ দু’মাস বাবা হারু মিয়া প্রায় বেকার থাকে, তখন প্রায় দিনই ভাত রান্না হয় না। কোনদিন কারো বাড়ি থেকে ভাত চেয়ে এনে ভাগাভাগি করে খেয়ে দিন কাটাতে হয়। অনেক দিন ক্ষুধার জ্বালায় ঘুম হয়নি, তখন রুপার মনে হতো পৃথিবীতে ক্ষুধার জ্বালাই সবচেয়ে বেশি কষ্ট।
রুপার দূর-সম্পর্কের এক ফুপু এমনি এক মঙ্গার দিনে এলো তাদের বাড়িতে। কথায় কথায় রুপার মা তাদের অভাব অভিযোগের কথা বলল। হরুরই বা দোষ কী? খালি হাতের ওপর এতবড় একটা সংসার ও চালাবে কী করে? তারওপর মঙ্গার সময় তো আবার কাজ থাকে না।
রুপার মা ফিসফিস করে বলল, আপা বাচ্চাগুলো আজ সারাদিন কিছু খায়নি, মুখের দিকে তাকাতে পারছি না। আপনার ভাই গেছে জোড়গাছ হাটে, পকেটে একটা টাকাও নেই, কী যে বাজার থেকে আনবে আর বাচ্চাগুলোর মুখে দিব সেই চিন্তায় কুলোতে পারছি না, বলতে বলতে রুপার দু’চোখ পানিতে ভরে উঠল।
রুপার এই ফুপুটিও গরীর কিন্তু তার তার স্বামী নৌকার মাঝি, কাজেই তার অবস্থা ততটা খারাপ নয়। তাদের দিনে দু’য়েকবার ভাত জোটে।
তছিরন বলল, আমি তোমার কাছে একটা কাজে এসেছি।
রুপার মা কষ্টের হাসি হেসে বলল, আমাদের কাছে আবার কী কাজ?
ক’দিন আগে তোমার দুলাভাই বাড়িতে গিয়ে বলল, ঢাকার এক সাহেব একটা মেয়ে চেয়েছে তার বাড়িতে কাজ করার জন্য।
রুপার মায়ের মুখটা উজ্জ্বল হলো, সাহেবের বাড়ি কোথায়?
কুড়িগ্রাম।
আজ রাতে একবার হারুর সঙে আলাপ করো যদি দিতে চাও তো তোমার দুলাভাইকে বলো, ও এসে রুপাকে নিয়ে যাবে। তবে প্রথমবার রুপার সঙে হারুকেও ঢাকা যেতে হতে পারে।
রুপা অদূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফুপু আর তার মায়ের কথা শুনছিল। মা তাকে কাছে ডেকে নিল, রুপা যাবি?
কোথায় মা?
ঢাকা।
রুপা সারাদিন কিছু খায়নি।
দূপুর এবং বিকেলে পানি খেয়ে ক্ষুধা নিবারণের চেষ্টা করেছে। তার এই দূর-সম্পর্কের ফুপুকে তার খুব আপন, খুব কাছের মনে হলো। রুপার চোখের সামনে এক থালা ভাতের ছবি ভেসে উঠল। তার দু’চোখ পানিতে ছলছল করে উঠল। রুপা জিজ্ঞেস করল, ওরা ভাত খেতে দিবে?
রুপার একথার উত্তর দিল তার ফুপু, হ্যাঁ শুধু ভাত কেন? কাপড়-চোপড়ও দিবে, বড়লোক মানুষ ওদের কি আর টাকার অভাব আছে? বলে তছিরন রুপার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, রুপা বড় হলে ওর বিয়ের সময় ডিমান্ডের জন্য টাকাও দিবে।
রুপার মায়ের দু’চোখ পানিতে ভরে গেল। দু’য়েক ফোঁটা পানি গণ্ডদেশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল। সে রুপাকে আবার জিজ্ঞেস করল, যাবি মা?
রুপা একবার মাথা উঁচু আরেকবার নিচু করে তার সম্মতি জানালো।
চলবে...
গডফাদার-০১ ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।