আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রাজনীতিকদের প্রজ্ঞা যখন লোপ পায়

রাজনীতিকদের প্রজ্ঞা যখন লোপ পায় ফকির ইলিয়াস ======================================== বিষয়টি নিয়ে আমার লেখার ইচ্ছে মোটেও ছিল না। তবুও না লিখে উপায় নেই। কারণ কোন দেশে রাজনীতিকদের প্রজ্ঞা শক্তি যখন লোপ পায় তখন মানুষ ধৈর্যচ্যুত হতেই পারে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস ইস্যুতে বাংলাদেশে এখন তেমনটি হচ্ছে। দেশের মন্ত্রীরা, দায়িত্ববান ক্ষমতাসীনরা এই ইস্যুটি নিয়ে চর্বিতচর্বণ করছেন।

যা তারা না করলেও পারতেন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, তিনি ক্ষমতাসীন এলজিআরডিমন্ত্রী। তার আরেকটি পরিচয় আছে। তিনি বাংলাদেশের অন্যতম রাজনৈতিক স্তম্ভ প্রজ্ঞাবান রাজনীতিক সৈয়দ নজরুল ইসলামের ছেলে। তিনি ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে কটাক্ষ করে কথাবার্তা বলেছেন।

প্রশ্ন তুলেছেন ইউনূসের নোবেল প্রাপ্তি নিয়েও। সৈয়দ আশরাফের কাছ থেকে জাতি এমন বক্তব্য প্রত্যাশা করেনি। তিনি কেন এমন কথা বলবেন। প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে একটি সমাবেশে সৈয়দ আশরাফ কি দলীয় সভানেত্রীকে খুশি করার জন্য এমন বক্তব্য দিলেন? সে প্রশ্ন আসতেই পারে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস নোবেল লরিয়েট।

তা মীমাংসিত বিষয়। নোবেল একটি পুরস্কার। বিশ্বের এমন পুরস্কার আরও আছে। কোন সংস্থা নিজ বিবেচনায় সে পুরস্কার কাউকে দিতেই পারে। তাতে দোষের কিছু নেই।

তা নিয়ে এত ঈর্ষান্বিত কিংবা মাতামাতি করার কী আছে? ড. মুহাম্মদ ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা। গ্রামীণ ব্যাংক কি বাংলাদেশ, বাংলাদেশের মানুষের জনস্বার্থবিরোধী কোন কাজ করেছে? যদি করে থাকে তবে রাষ্ট্রীয় আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। তা নিয়ে কূটচাল করে 'হার্ডটাইম' দেয়ার কোন যৌক্তিকতা নেই। কোন বরেণ্য ব্যক্তিকে কটাক্ষ করারও কিছু নেই। বাংলাদেশে তেমনটিই হয়েছে এবং হচ্ছে।

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের মুখে যখন 'টোটালি রাবিশ' শব্দের মতো অপাঙক্তেয় বচন এ প্রজন্ম শোনে, তখন তাদের হতাশ না হয়ে উপায় থাকে না। একজন সিনিয়র মন্ত্রী ও বর্ষীয়ান রাজনীতিককে এমন উচ্চবাচ্য করতে হবে কেন? এটা জাতির জন্য অবশ্যই চরম দুর্ভাগ্যের ব্যাপার। ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল লরিয়েট। আমরা জানি এবং মানি বিশ্বের বিভিন্ন বড় বড় পদক ও পুরস্কারগুলো পেতে হলে শক্ত লবিং করতে হয়। থাকতে হয় শীর্ষস্থানীয়দের সঙ্গে সুসম্পর্ক।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস কী প্রক্রিয়ায় নোবেল পেয়েছেন, তা কোন মানুষের কাছেই আর এ মুহূর্তে বিবেচ্য বিষয় নয়। তিনি নোবেল পেয়েছেন সেটাই বড় কথা। তার নোবেল প্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার বার বিশ্বমিডিয়ায় 'বাংলাদেশ' নামটি উচ্চারিত হয়েছে। ইউনূসের তত্ত্ব যাই হোক না কেন, তিনি বিশ্বের অনেক ভাষাভাষী, অনেক সংস্কৃতি ও ভূখ-ের মানুষের কাছে পথ প্রদর্শকের মতো। তা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই।

ইউনূস, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের ব্যক্তিগত বন্ধু। সেই আলোকে বর্তমান সেক্রেটারি অফ স্টেটস হিলারি ক্লিনটনেরও প্রিয়ভাজন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন টানাপড়েনের সব পর্যায়েই 'লিভ হিম অ্যালোন' অর্থাৎ তাকে তার কাজ করতে দিন এমন মনোভাব ব্যক্ত করেছে। তারপরও ইউনূস ইস্যুতে বর্তমান সরকার যেন স্বস্তিতে থাকতে পারছে না। কেন পারছে না? আমরা দেখেছি ওয়ান-ইলেভেন পরবর্তী সময়ে ড. ইউনূস সক্রিয় রাজনীতিতে আসার খায়েশ পোষণ করেছিলেন।

পরে আবার ঘোষণা দিয়েই তিনি সরে দাঁড়ান। তারপরও প্রধান দুই দলই তাকে প্রতিদ্বন্দ্বী কিংবা প্রতিপক্ষ মনে করেছিল। কায়েমি স্বার্থবাদ কিংবা পারিবারিক রাজনীতির ধারাবাহিকতা ক্ষুণ্ন হয় কি না, তা নিয়েও শঙ্কিত ছিলেন কেউ কেউ। এটা খুবই লজ্জা এবং হতাশার কথা, স্বাধীন বাংলাদেশে আমাদের অনেক বরেণ্য রাজনীতিকরা মুখে সার্বভৌম গণতন্ত্রের কথা বললেও, কাজকর্মে তার প্রতিফলন ঘটাতে পারছেন না। না পারার কারণ হচ্ছে বড় দলগুলোতে নেপথ্য স্বৈরশক্তির প্রভাব।

দলগুলোতে গণতন্ত্র না থাকার কারণে ব্যক্তি বিশেষের ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপরই নির্ভর করছে রাজনীতিকদের ভাগ্য। ফলে ধনকুবেরাও খুব সহজে এমপি হতে পারছেন। প্রকৃত রাজনীতিকরা চলে যাচ্ছেন স্বেচ্ছা নির্বাসনে। এই যে প্রক্রিয়া, তা কি বিধিসম্মত? তা কি গণতন্ত্রকে পরিপুষ্ট করার পক্ষে সহায়ক? না, সহায়ক নয়। যে দেশে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় রাজনীতিকদের কর্মভাগ্য নির্ধারিত হয় না, সে দেশের রাজনীতিকদের মুখে বিশ্ব পরিক্রমার প্রক্রিয়া নিয়ে বড় বড় কথা শোভা পায় না।

কারণ গোটা বিশ্বই এখন ভাসছে লবিং জোয়ারে। দেশের বরেণ্য আলোকচিত্র শিল্পী নাসির আলী মামুন সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র সফরে এসেছিলেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের টিমের সদস্য হয়ে। তাকে নিয়ে নিউইয়র্কের 'মুক্তধারা' এক আড্ডার আয়োজন করেছিল। সেই আড্ডায় নাসির আলী মামুন অনেক কথা বলেন ড. ইউনূসের বর্ণাঢ্য জীবন ও কর্ম সম্পর্কে। মামুন বলেন, ড. ইউনূস মূলত অত্যন্ত নিঃসঙ্গ মানুষ।

তিনি যখন হাসেন, তখন আমার মনে হয় তার পাঁজরের দুঃখগুলো ঝরে পড়ছে। জানতে চাই, বর্তমান সরকারের সঙ্গে ইউনূসের সম্পর্কের অবনতির পর তার সময় কেমন কাটছে? মামুন বলেন, কোন ঝড় তার তা-ব নিয়ে বয়ে গেলে জনপদের অবস্থা যেমন হয়, ইউনূস এখন তেমনি। ড. মুহাম্মদ ইউনূস এমন একটি বাংলাদেশের নাগরিক, যে দেশে মানবিকতা এখন চরমভাবে বিপন্ন। বাংলাদেশ এখন এমন এক দেশ, যে দেশে একজন শিক্ষকের মৃত্যুর পর তার সহকর্মী একজন শিক্ষক কয়েক লাইনের স্মৃতিচারণটুকু লিখতে 'ওয়েস্ট অফ টাইম' মনে করছেন। ওই সহকর্মী শিক্ষক এই সময় অপচয় না করে, সেই সময়টুকু ছাত্রছাত্রী পড়িয়ে, টিউশনি ফি কামাই করাকে অধিক মুনাফার কাজ মনে করছেন।

একজন চিকিৎসক তার নিজ এলাকায় অনুষ্ঠিত ফ্রি চিকিৎসা ক্যাম্পে যেতে অনীহা দেখাচ্ছেন। বরং সেই সময়টুকু নিজ চেম্বারে উচ্চ ফিতে রোগী দেখলেন। বিশ্বের খুব কম দেশেই এমন মর্মান্তিকভাবে মানবতার পরাজয় ঘটেছে। ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মত্যাগের বাংলাদেশে গত চারদশকে এমন দয়া-মায়াহীনতার নৈরাজ্য কেন সৃষ্টি হলো? বাংলাদেশে অনেক উচ্চ শ্রেণীর ধনিক আছেন, যারা ট্যাক্সের অর্থ পরিশোধ করেন না। অনেকে ব্যাংক থেকে বড় বড় অঙ্ক ঋণ নিয়ে নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করছেন।

ঋণ খেলাপি হওয়ায়, বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস বিল, ফোন বিল পরিশোধ না করায় এই বাংলাদেশে এমপিদের সংসদ সদস্য পদ খারিজ হয়ে যাচ্ছে। শিক্ষাগত যোগ্যতার মিথ্যা তথ্য দেয়ার কারণে কোন কোন এমপির আসন নিয়ে টানাহিঁচড়া হচ্ছে। সেই দেশেই একজন নোবেল লরিয়েটকে নিয়ে নগ্ন বাক্যবাণ ছুড়ছেন ক্ষমতাসীনরা। এর চেয়ে দুঃখজনক সামাজিক অবক্ষয় আর কী হতে পারে। ড. ইউনূস সমালোচনার ঊর্ধ্বে তা আমি বলছি না।

তার সাফল্য-ব্যর্থতার পক্ষে-বিপক্ষে কথা হতেই পারে। কিন্তু তাকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করা হবে কেন? এর অবসান দরকার। খুব দুঃখের সঙ্গে আমিও বলতে চাই- প্লিজ লিভ হিম অ্যালোন। তাকে তার কাজ করতে দিন। ১৬ মে ২০১২ ----------------------------------------------------------------- দৈনিক সংবাদ / ঢাকা/ ১৮ মে ২০১২ শুক্রবার প্রকাশিত ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.