যখন বিকাল হতে থাকে, হতে হতে সূর্যটা ঢলে পড়ে, পড়তে থাকে এদেশে 'ধর্মানুভূতি' শব্দটিকে নানাভাবে বর্ণনা করা হয় যার ফলে এমন একটা আরোপিত ধারণা লক্ষ্যনীয় - বাঙালির 'ধর্মানুভূতি' যে কোন দুর্বল আঘাতেই ঠুনকো দেয়ালের মত ধ্বসে পড়ে। ধর্মানুভূতি আহত হবার আশঙ্কায় - এর ব্যাখ্যায় ধর্ম বিষয়ক যেকোনো সমালোচনাকেই খারিজ করে দেয়া হয় বলে অনেকে বলে থাকেন। একসময় আমিও বলতাম। তারা বলেন, এমনকি নাস্তিক পরিচয় প্রদানেও অনেকের ধর্মানুভূতি আহত হয়। যা বিগত কয়েকদিনে স্পষ্টভাবে ভিন্ন প্রতীয়মান হয়েছে।
উগ্রবাদী রাজনৈতিক কিছু ধর্ম-ব্যবসায়ী ছাড়া প্রায় সকল ধর্মপ্রাণ মানুষকে (প্রধানমন্ত্রীসহ) বলতে শুনেছি, আপনি নাস্তিক হন কোনো অসুবিধা নাই, কিন্তু ধর্মবিদ্বেষ বা হেট-স্পিচ কেন করবেন?
এদেশে ধর্মের নানা বিষয় নিয়ে ন্যায্য সমালোচনা অতীতে হয়েছে, এখনও নানা মানুষ করে বেড়াচ্ছেন। একটু গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে সামষ্টিক মানুষের ধর্মানুভূতি আক্রান্তের ঘটনাগুলো খুবই অনুধাবনযোগ্য ও উদাহরণময়, ফলে এর প্রতিকারও সম্ভব।
সাধারণত, আমার দেখা মতে, নবী, রাসুল, ইসলামের স্মারক কোনো বিষয় ও কীর্তিকে যখন কদর্য শব্দ/বাক্যে/বস্তুতে উপস্থাপন করা হয় - এদেশে শুধু নয়, সারা বিশ্বের মুসলমানরাই আক্রান্ত বোধ করে। বিষয়গুলো এমন, কেউ হযরত মোহাম্মদ (সা) কে গালি দিয়ে একটা কথা বললো। এমন নয় যে তার নামের শেষে (সা) নাই দেখে মুসলমানরা ক্ষেপে একটা লঙ্কাকান্ড তৈরী করলো।
অমুসলমানরা সারা বিশ্বে নবীর নামের শেষে দরুদ না পড়েই উল্লেখ করছে, সেজন্য মুসলমানরা তাদেরকে মারার জন্য হুলিয়া জারি করছে না। ফলে ঐ গালিটাই আসলে অ-হজমযোগ্য হয়ে দাঁড়ায়। ধর্মানুসারী অনেক মানুষ নিজেদের আপনজনের থেকে তার ধর্মগুরুদের হৃদয়ে স্থান দেয়, তাদের জন্য এটা বড় আঘাত।
সারা বিশ্বের মুসলমানদের কাছে কোন বিষয়গুলো স্পর্শকাতর মনে হয় তা দীর্ঘ কয়েক যুগে আমাদের কাছে স্পষ্ট হবার কথা। ইসলাম/আল্লাহ/নবীকে নিয়ে কদর্য কার্টুন, মুভি - কিছু অশ্লীল শব্দ/বাক্য সংযুক্তির ফলে সাধারণ মুসলমানরা উত্তেজিত হয়ে ওঠে।
মনে রাখা দরকার, আমি কেবল কিছু বিশেষ শব্দ/বাক্যের কথা বলছি - যা সাহিত্যে, সিনেমায়, গল্পে, ব্লগে বা লিখিত, শ্রুত বা চলচ্চিত্র মাধ্যমে হোক না কেনো, এগুলো চিহ্নিত করা খুব কঠিন নয় এবং ধর্মানুভূতি আক্রান্ত হবার পরে যে নৈরাজ্যের ঘটনাগুলো আমরা বিগত কয়েক দশক ধরে দেখে এসেছি - তার পেছনের কারণ হিসাবে সুপ্রতিষ্ঠিত ভাবা যায়।
ধর্ম বিষয়ক আলোচনা বা ইশ্বরের অস্তিত্বকে খারিজ করে দেবার যুক্তি উপস্থাপনের ভেতরে কোনো বিশেষ ধর্মের সম্মানীয় ব্যক্তিদের গালি (আমরা আমাদের সমাজে গালি বলতে বুঝি সেটাকে ধরে নিয়ে) দেবার প্রয়োজন হয় না। সম্ভবত এটাকে আমরা এক কথায় বলতে পারি ঘৃণার প্রচারণা বা বিদ্বেষ। একজন লেখক বা সমালোচক যিনি যুক্তি প্রদর্শন করতে সক্ষম, তিনি খুব সহজেই পরিমাপ করতে পারেন তার কোন বাক্য ও শব্দের ব্যবহার মানুষের কাছে কিভাবে গৃহিত হবে। সমাজের দেহ ও তার ভাজেভাজে লুকিয়ে থাকা নানা দর্শন ও সংস্কৃতিকে অনুধাবনের পরে একজন লেখক বা ব্লগার যখন ধর্ম বিষয়ক কোনো যুক্তিতর্ক প্রদর্শন করেন তখন তার এই সামাজিক সীমাবদ্ধতার কথা জানা থাকাটাই স্বাভাবিক হবার কথা।
গড়মাত্রায় ধর্মানুভূতি আহত হবার প্রকরণ অজস্ত্র এবং যত্রতত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এবং এটা অনিরূপনযোগ্য এমনভাবে উপস্থাপনের কোনো সুযোগ আমি দেখি না। আমাদের চারিপাশে অজস্ত্র মাওলানা, পীরসাহেবদের কুকীর্তি ফাঁস হবার ঘটনা আমরা অতীতে দেখেছি। জুম্মার নামাজে মসজিদ ভরা মুসুল্লী আর অন্যান্য ওয়াক্তে এক কাতারও হয় না - এসব নজির আমরা দেখি। ঘরে ঘরে হিন্দী চ্যানেল, ওয়েব জুরে পর্নো - এসব বাস্তবতা বিদ্যমান থাকা অবস্থায় এবং এর বেশীরভাগ দর্শক ও ভোক্তা আমাদের চারপাশের মানুষই। ফলে যেকোনো কিছু বললেই মুসলমানের ধর্মানুভূতি খসে পড়ে বলে যে প্রচারণা ও বিশ্বাস আমাদের কারো কারো বক্তব্যে উঠে আসে - তার সাথে আমি স্পষ্টতই দ্বিমত পোষণ করলাম।
যেকোনো দেশের গালিময়-কদর্য ভাষা/বাক্য/শব্দ প্রয়োগ করে - সাহিত্য, সিনেমা, শিল্পে কোনো ধর্মীয় স্বারক উপস্থাপন/বিবৃত করলে সংখ্যাগরিষ্ঠের মধ্যে আহত/নিহত হবার ঘটনা ঘটে - এটা এখন প্রমাণিত। ধর্মের শুদ্ধ/অশুদ্ধ আলোচনার ক্ষেত্রে যোগাযোগ সক্ষম ভাষার ব্যবহার ছাড়া যখন এমনটি করা হয় তখন কোনো বক্তব্যই বোঝানো সম্ভব হয় না।
আমার দেখা মতে বিভিন্ন ধর্মের মানুষ, ধার্মিক মানুষ অপরধর্মের মানুষকে আহত করার জন্য এমন গালিময় ভাষাও ব্যবহার করে থাকেন। যারা উভয়েই আস্তিক। কট্টর ক্যাথলিকদের কিছু ওয়েবসাইট ভ্রমন করে দেখতে পারেন তার কমেন্ট অপসনে অন্যান্য ধর্ম সম্বন্ধে বিশেষ করে ইহুদিদের নিয়ে কেমন যাচ্ছেতাই লেখা হচ্ছে।
একই উদাহরণ প্রত্যেকটা ধর্মের ক্ষেত্রে দেয়া সম্ভব। ফলে কোনো নাস্তিক যদি এমন কদর্যময় ভাষার ব্যবহার করে সেটা যুক্তিবোধের জায়গা থেকে অনুধাবন করা কষ্টসাধ্য। এর পেছনে গোয়ার্তুমি, অজ্ঞতা, অন্যকে উসকে দিয়ে মজা নেবার বিৃকত আনন্দ (আমিও একসময় পেয়েছি) এবং সর্বোপরি বোকার মত কোনো বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক পরিকল্পনার অজান্তেই ক্রীড়ানক হয়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে।
বাংলাদেশের ব্লগ সংস্কৃতিতে ধর্মানুভূতি/ধর্মবিদ্বেষ/ঘৃণা প্রচারণা ইত্যাদি সরূপ বোঝার জন্য ব্লগের বিবর্তন ও জনপ্রিয়তার কালক্রম দেখাটাও গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। সমসাময়িক জাতিয় বিষয়/সামাজিক ইস্যুগুলো এবং ব্লগে সত্যিকারের পরিচয় লুকানোর সুযোগকে মাথায় রেখে বাংলা ব্লগের এ-যাবতকালের সকল ধর্মানুভূতি আহত হবার মত বাক্য/শব্দের ব্যবহারকে পর্যালোচনা করতে হবে।
এটার একটা স্থানিক মানদন্ড বা গ্রাউন্ডস রুল থাকা বাঞ্ছনীয় যা সময়ের প্রয়োজনে হয়তো আবির্ভূত হয়। ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে চালিত হয়। আমরা ইতোপূর্বে দেখেছি বাংলা ব্লগ শুরু থেকে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষের চিন্তার পরিধিকে বাড়িয়েছে, কখন সম্পূর্ণ পাল্টে দিয়েছে। যে কখনই একটা গালি শোনেনি - সে এখন বিপুল উদ্যমে গালি দিয়ে বেড়াচ্ছে। আবার অনেক গালিবাজ এসে ভদ্রস্থ আচরণ করতে বাধ্য হয়েছে।
অনেক ধর্মান্ধ মানুষ গোঁড়ামি থেকে ঊর্ধ্বে উঠতে পেরেছে আবার অনেক মানুষ ধার্মিক হবার প্রেরণাও পেয়েছে। এসবেরই অন্তর্নিহিত তাৎপর্য্য হলো বাংলা ব্লগের ভেতরগত মিথস্ক্রিয়ার একটা জীবন্ত পরিবর্তক দোলনযন্ত্র রয়েছে।
ফলে ধর্মানুভূতি মানুষের কিভাবে আক্রান্ত হয় তা আমরা বুঝি না বা তা অপরিমেয় বা তা বিচিত্র বা তা অবোধগম্য - এসব বলার সময় শেষ হয়েছে। 'ধর্মানুভূতি আহত' হবার সঠিক ব্যাখ্যার জন্য ধর্মের স্মারক ব্যক্তি ও বস্তু সম্পর্কিত কদর্য ভাষা ও বাক্যের উদাহরণগুলো পর্যালোচনা করে ব্লগের জন্য একটা গ্রাউন্ডস রুল তৈরী করলে উগ্র ধর্ম বিদ্বেষ অপসৃত হবে বলে মনে করি। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।