আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

"জ্ঞানী" [mini story]

আমার বাবা ছিলেন একজন জ্ঞানী ব্যক্তি। বলা যেতে পারে একেবারে জ্ঞানগর্ভ, জ্ঞানরত্ন, জ্ঞানতীর্থ, জ্ঞানান্বিত। অন্যদের জ্ঞানি করার লক্ষে জ্ঞান সম্প্রসারণই ছিল তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে তাঁর সবচেয়ে বড় ও নিকটতম লক্ষ ছিলাম আমি। তাঁর জ্ঞানের আলোকে আমাকে গড়েপিটে মানুষ করার সাধনায় জীবনের একটা বড় সময় তিনি ব্যয় করেছিলেন।

সাহিত্য বাবা ছিলেন আমার প্রথম এবং অপরিহার্য ভাবেই একমাত্র গুরু। তাঁর প্রাণান্তকর অনুপ্রেরণায় আমি তাঁর প্রিয় বই “তিনশত কবিতায় বঙ্গীয় বিবর্তন” এতবার পড়েছিলাম যে এখনও আমি প্রায় পুরটা বই’ই উল্টো দিক দিয়েও মুখস্ত বলতে পারি। এই বইটা ছাড়া আমার হাতে অন্য কোন বই দেখলেই তিনি ভ্রু কুঁচকে দীর্ঘক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকতেন। তাঁর চোখের ভাষার বিভিন্ন রকম মানে হতে পারে। আমার কাছে কেবল একটা মানেই প্রকট হয়ে ধরা পড়ত, “বঙ্গীয় বিবর্তনের তিনশ কবিতা বগলের তলায় পুরে রাখার জিনিস না।

বার বার পড়ে অনুধাবন করার জিনিস। “ এরপর যা হওয়ার কথা তাই হল। প্রস্তরবৎ কঠিনং এই সকল কবিতার অর্থ, গূঢ়ার্থ, ভাবার্থ, বিষয়-পদবিন্নাস ও কালানুসারে ধারাবাহিক উপস্থাপনা ইত্যাদি আমার ভিতর জলবৎ তরলং হয়ে প্রবেশ করল। বাবা আমাকে গান’ও শেখাতেন। তাঁর অতি প্রিয় গান ছিল “বৈশাখে বলেছি তারে পৌষের কথা।

” স্বাভাবিক ভাবেই আমার কর্ণকুহরে এই গান ব্যতিত অন্য কোন গানের অনুপ্রবেশ পুরোপুরি নিষিদ্ধ ছিল। এল.পি.তে অন্য কোন গান ভুলক্রমেও যদি বাজিয়ে ফেলতাম বাবার অবিস্মরণীয় বানি চিরন্তনী আমার শ্রবনিন্দ্রিয়ে যার পর নাই আঘাত হানতো। তিনি বলতেন “এই সব ছাইপাঁশ শুনে কান ভারি করার মানে... ... ... ইত্যাদি, ইত্যাদি... এখনও তো ওই গানটার অন্তরাটাও ঠিক মতো ধরতে পারোনা। ” অনুরূপ দৃশ্য এর অবতারনা হলে তাৎক্ষনিক ভাবেই তিনি আমার সঙ্গিত গুরুর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতেন। ডেকে বলতেন “এসো, আমি তবলায় বসলাম।

একবার গেয়ে শোনাও দেখি কতটা হল। ” সেই সময় এখনকার মতো ঘরে ঘরে টেলিভিশন ছিল না। FM তো কল্পনাতীত। সেকালে আমাদের আকাশ প্রচারিত বিনোদন বলতে ছিল বেতার। নিয়ম করেই শোনা হতো।

মনে পড়ে তখন প্রত্যেক ভোরে বেতারে ব্যায়ামের অনুষ্ঠান হতো। একদিন বাবা আমাকে সকাল সকাল তুলে দিয়ে উহা সুন্তে বসলেন। এবং আমার জন্য সর্বাঙ্গীণ হিতকর হিসেবে ওইদিনে প্রচারিত চার নম্বর ব্যায়ামটা তাঁর মনে ধরল। বাবা আমাকে কষে সেই ব্যায়াম শেখালেন। সেটা মন্দ ছিলনা বটে কিন্তু অতি আগ্রহ বশত আমি অন্য কোন ব্যায়ামে মন দিতে চাইলেও বাবার কারনে কখনও শরীর দিতে পারিনি।

বাবা ধৈর্য ধরে আমাকে বোঝাতেন যে আমার ক্ষীণকায় শরীরটাকে যদি দৈর্ঘে-প্রস্থে বাড়ানোর ইচ্ছা থাকে তাহলে ওই চার নম্বর ব্যায়ামটাই হতে পারে আমার একমাত্র সাহায্যকারী। অতঃপর আমার উচিৎ বার বার চর্চার মাধ্যমে ব্যায়ামটা পুরোপুরি আয়ত্ত করা। মাঝে মাঝে বাবা বিরক্ত হয়ে এ’ও বলতেন “যদি তোমার মামাদের মতো বেঁটে-বাঁটকুল হয়ে থাকতে না চাও তাহলে আর ওই চার নম্বরকে অবহেলা করনা বাবা। ” একটা জিনিস বাবা নিজে রোজ খেতেন, আমাকেও খাওয়াতেন। সেটা হল সিদ্ধ ডিম।

হাস-মুরগি ভেদ নেই। একটা হলেই চলতো। আমি কখনো-সখনো ডিমের অমলেট বা টুপা খেতে চাইলেই বাবা সিদ্ধ ডিমের যাবতীয় উপকারিতার লম্বা ফিরিস্তি শুনাতেন। সেই সাথে সিদ্ধ ডিম এতদিন আমাকে কত কত ক্যালরি, কত ক্যালসিয়াম, কত আয়রন, ভিটামিন A B C D ইত্যাদি দিয়েছে সেগুলো স্মরণ করিয়ে দিতেন। তখন তাঁর মুখ দেখে বুঝা যেতো যে ডিম সিদ্ধর উপর আমার এই অকৃতজ্ঞতায় তিনি যারপরনাই ব্যথিত।

বাবা আর আমাদের মাঝে নেই। তবে তাঁর জ্ঞানের প্রভাব চিরন্তন ভাবে রয়ে গেছে আমার মাঝে। আজ যখন আপনাদের আমার বাবার গল্প শোনাচ্ছি তখন পর্যন্ত আমি একমাত্র যে বইটি পড়েছি তা হল “তিনশত কবিতায় বঙ্গীয় বিবর্তন”, একমাত্র যে গানটা আমি গাইতে শিখেছি তা হল “বৈশাখে বলেছি তারে পৌষের কথা”, শরীর রক্ষার জন্য আজও আমি সেই একটা ব্যায়ামই করতে পারি- বেতারের চার নম্বর। আর বহুরূপী স্বাদ উৎপাদী ডিমের একটি মাত্র স্বাদের সাথেই আমার জিভ পরিচিত; সিদ্ধ ডিমের স্বাদ! [রুশ গল্পের ছায়া অবলম্বনে] ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.