আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জ্ঞানী আলাপ!

মুক্ত যাযাবর বিদেশের আর বাংলাদেশের চুল কাটার সেলুনের প্রধান পার্থক্য আমি দেখেছি- বিদেশের সেলুনে আপনি বসলেন, অল্প কথায় আপনার কাছে জেনে নেবে আপনি কেমন করে চুল কাটাতে চাচ্ছেন? তার পর আপনার মাঝে সামান্য বিরক্তির সৃষ্টি না করে আপনার চুল কাটা শেষ করে বলবে, “ভাই চুল কাটা শেষ”। এর মাঝে পারত পক্ষে আর কনো কথা হবে না। ভাবছেন বাংলা বলবে কিভাবে বিদেশের সেলুনে? ভাই নরসুন্দর যে বাংলাদেশী! পক্ষান্তরে বাংলাদেশী সেলুন, কি এসি করা কি নরমাল সেলুন, নরসুন্দর ভাইজান এমন এমন সব প্রসঙ্গে এবং এমন কঠিন কঠিন কথা বলতে থাকবে যে আপনি সদ্য বি. সি. এস পরীক্ষায় উত্তীর্ন হয়েও যদি সেলুনে যান আপনার মনে হবে, আহা উনি কি জ্ঞানই না রাখেন! মনে আছে আমরা ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় আমার এক বন্ধু এক সেলুনে যেতোই না শুধু নাপিতটা বেশী কথা বলে বিরক্ত করে বলে। অথচ দেখুন দুটি অবস্থানের দুটি সেলুনেই কিন্তু বাংলাদেশী নাপিত। কিন্তু কি গুনগত পার্থক্য।

কেন, কি জন্য এমন হয়েছে সেগুলো আলাপ আজকে করবো না। শুধু বলতে চাচ্ছি এই যে বিস্তারিত/বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ হয় বাংলাদেশের সেলুনে, চা স্টলে, এই প্রখর জ্ঞানের আলাপ কে আমরা ভাই-বোনেরা নাম দিয়েছিলাম “জ্ঞানী আলাপ”। আমাদের দেশের বাড়িতে আমার থাকার ঘরটির বামপাশে ছিলো নাপিতের দোকান, ডান দিকে ছিলো চার দোকান। তাহলে বুঝতেই পারছেন কি প্রখর জ্ঞানীদের এবং জ্ঞানী আলাপের মাঝে আমাদের বড় হওয়া। আমরা পাঁচ ভাই-বোন একই টেবিলে পরতে বসতাম, কিন্তু পালা করে মায়ের চোখ ফাকি দিয়ে আমরা কেও কেও যেয়ে মাঝে মাঝে জ্ঞানী আলাপ শুনে আসতাম।

মাঝে মধ্যে হেভী টপিক্স এর কনো জ্ঞানী আলাপ হলে আমরা সবাই পড়া ফাকির মারের ভয়কে উপেক্ষা করে সবাই এক সঙ্গে জ্ঞানী আলাপ শুনতে যেতাম। কিছু হট জ্ঞানী আলাপের নমুনা দিচ্ছিঃ জ্ঞানী আলাপ নমুনা ১- টেলিভিশনের বিভিন্ন টক শো তে যেমন সনচালোক থাকে, তেমনি অলিখিত নিয়ম আনুযায়ী জ্ঞানী আলাপের ও একজন সনচালোক ও একজন স্পিকার দরকার পরে। সনচালোকের কাজ জ্ঞানী আলোচনার টপিক টা উথথাপন করা(যেটার ভাগ অত্যান্ত সচারু ভাবে পালোন করেছেন চায়ের দোকানের বয় “জিন্নাহ” আমারা সত্যিই আবাক হতাম তার বহুর্মূখী চিন্তা ও বিস্তর প্রশ্ন উদ্ভাবনের ক্ষমতা দেখে!), আর স্পিকার হিসাবে নাপিত “আজগর” তো অতুলনীয় নিষ্ঠার সাথে তার কাজ করে গেছেন। তার একটা মূদ্রাদোষ ছিলো, কিছুক্ষন পর পর “বুইল্লানা” অর্থাৎ “বুঝলেনা” বলা। তাই যখন কনো সদস্যকে তার ব্যাক্ষা দিয়ে “স্পিকার” সাহেব “বুইল্লানা” বলতেন তখন তার বক্তব্যটার ভারটা বোঝা যেতো।

তো একদিন আমাদের বাসায় আমার এক খালা আসলো তার “এপেন্ডিসাইটিসের” প্রচন্ড ব্যাথা নিয়ে। মহুকুমা শহরে তো আর কথায় কথায় এম্বুলেন্স হাজির করা যায় না, তাই তাদের আসতে হয়েছিলো “নৌভ্যানে”। রিক্সা-ভ্যান এর উপর ছই দেওয়া হয় বলে অনেকটা নৌকা নৌকা ভাব আশে। যাহোক নৌভ্যানে আসার কল্যানে এটা মোটামুটি ব্যাপক প্রচার পেলো তথাকথিত জ্ঞানীদের মাঝে। সন্ধ্যা হতেই একে একে সব জ্ঞানী সদস্য আসা শুরু করলো, যথারীতি জিন্নাহ টপিক উথথাপন করলো।

“আচ্ছা ভাই আইজক্যা এই বাড়িত যে মেয়্যাডা আইলো, তার কি হইছে?” জনৈক জ্ঞানী, “ অর তো এপিনডিস হইছে, অপারেশন করা লাগবো”। সনচালোকের প্রশ্ন, “ আচ্ছা ভাই, এপিনডিস কি?” জ্ঞানী, “বুঝস নাই, ভাত খায়া উইঠা হাইরা পচিম মিহা দৌড় ফালাইলি, প্যাটের নাড়ীর মধ্যে ভাত ঢুইকা যায়, তহোন নাড়ী অপারেশন কইরা ভাত ফালান লাগে। এরে কয় এপিনডিস। ” এদিকে আমাদের পাঁচ ভাই-বোনের মাথার মধ্যে হেভী স্পিডে চিন্তা চলছে। কেনো পশ্চিম দিকে দৌড় দিলে নাড়ীতে ভাত ঢুকবে, কেন অন্ন্য দিকে দৌড় দিলে নয়? ইতিমধ্যে আমার মেজ বোন কারন আবিষ্কার করে ফেলল।

“দেখ পৃথিবী তো পশ্চিম থেকে পূবে নিজ অক্ষের উপর ঘোরে, তাই কেউ পশ্চিম দিকে দৌড় দেওয়া মানে সে পৃথিবীর গতির বিপক্ষে যাচ্ছে। আর মাত্র ভাত খাওয়ার পর ভাত গুলোও সময় পায় না ছোট ছোট টুকরায় ভেঙ্গে যাবার। তাই ভাতের অধিকতর বেশী সংখক তল পেটের ভিতরের তরলে ধাক্কা খেয়ে নাড়ীতে ঢুকে যায়! কঠিন ব্যাক্ষ্যা। উত্তেজনায় আমার ছোট বোন, যাকে আমরা পাহারায় রেখেছিলাম, “মা আসে কিনা দেখতে। ” ও ভুলেই গেলো পাহারা রাখার কথা, যা হবার তাই হলো।

৫ জনই পড়া রেখে গল্প করার জন্য খেলাম মার। কিন্তু অত্যান্ত সুন্দর জ্ঞানী আলোচনা শুনে ঐ দিন সবার মন ভালো হয়ে গিয়েছিলো। জ্ঞানী আলাপ নমুনা ২- তখন আমি “কম্পিটেন্সি” পরিক্ষা দেয়ার জন্য বাসায় বসে খুব কঠিন পরাশুনা চালাচ্ছি। সারাদিন-সারারাত তো আর পড়া যায় না। বাসা থেকে বের হতে হবে, একটু হাটাহাটি করতে হবে।

কিন্তু কথিত জ্ঞানীদের জালায় বাসার সামনে হাটার জো তো নেই। তাই আমি অনেক চিন্তা করে একটা উপায় বের করলাম। সাধারানত জ্ঞানী আলাপ শুরু হয় সন্ধ্যার দিকে, সেই হিসাবে আমি অনেক হিসাব করে বেলা ৪টা তে হাটতে বের হলাম। কিন্তু “যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই রাত্রি হয়”। এক জ্ঞানী চাচা ডেকে উঠলেন, ভাইস্তা কোনে যাও? অগত্যা কাছে যেতে হলো, “চাচা একটু হাটতে বের হয়েছি”।

“আচ্ছা ভাইস্তা তুমি তো জাহাজে চাকরী করো, ঝড় উঠলে কি করো(ফরমেটেড কশ্চেন, ধরা খাওয়াতে এম্নিতেই মন খারাপ কনো ভাবে ফরমেটেড উত্তর দিলাম)। উত্তর শেষ হওয়ার আগেই এক মামা প্রশ্ন করে বসলেন, “তোমরা কি তিমি মাছ বা মৎস্যকন্যা দেখছো?” তিমি মাছ দু একটা অনেক দূর থেকে দেখলেও, মৎস্যকন্যা কাল্পনীক এটা বলতেই সমস্বরে কয়েক জ্ঞানী প্রতিবাদ করে উঠলো। সবচেয়ে উত্তেজিত জ্ঞানী আমাকে বল্লো, “তুমি জানো না, সমূদ্রে তিমি মাছের পিঠে চড়ে মৎস্যকন্যা সারা সাগর চড়ে বেড়ায়। এটা তার নানীর বাবার খালাতো ভাই এর মামা সুন্দরবনে বাঘ শিকার করতে যেয়ে দেখেছিলেন”। আমি হু-হা করে তারাতারি পার করি।

আলাপ জমে উঠেছে, রহমত চাচা আরেক কাপ চা ও আরেক জনের জন্য একটা পানের অর্ডার দিয়ে, ডান পা টা জম্পেশ করে চিয়ারের উপর তুলে বসলেন। তা দেখে আমার বুকে শংকার বিগ ড্রাম বেজে উঠলো, “খাইছে আজ না জানি কখন ছাড়া পাই!” রহমত চাচা, “ভাইস্তা সাগরে বড় বড় চিংড়ি মাছ আছে না?” “হ্যা চাচা, অনেক বড় লবষ্টার পাওয়া যায়। আমি একবার একটা খেয়েছিলাম। একটা লবষ্টারে পুরা প্লেট ভরে গিয়েছিলো”। “নানা আমি এতো ছোট চিংড়ীর কথা বলতাছি না।

মানে জাহাজের চেয়ে বড় চিংড়ী মাছ আছে না কি?” আমি বললাম, “চাচা এত বড় প্রানী তো পৃথিবীতে নাই। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রানী নীল তিমি। একটা পূর্ন বয়ষ্ক নীল তিমি ২৪মিঃ/৮০ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে। কিন্তু সবচেয়ে ছোট জাহাজও তো ১০০মিঃ”। রহমত চাচা, “তুমি ঠিক জানোনা ভাইস্তা, বিজ্ঞানীরা ভূল বলে।

আমার আপন নানা জাহাজে হজ্জে যাওয়ার সময় গভীর সমূদ্রে হটাত আওয়াজ আসলো এই জাহাজ থামা। ক্যাপ্টেন তো জাহাজ থামায় না, তারপর তারা দেখলো দুইটা বড় বড় ঠ্যাং পানি থেকে উঠে আসলো। তা দিয়ে জাহাজের পিছনের অংশ ধরে রাখলো, তারপর ধীরে ধীরে পানির উপর আসতে লাগলো, তারা দেখতে পেলো এটা একটা চিংড়ী মাছ, জাহাজের থেকে বড়”। জ্ঞানী আলাপ হেভী জমে গেছে, আমি দেখতে পাচ্ছি সবার নিঃষ্মাস ঘন হয়ে আসছে, চোখ চকচক করছে। বিভিন্ন জ্ঞানী তাদের বিভিন্ন মন্তব্য করছেন।

জ্ঞানী আলোচনার স্পিকার “বুইল্লেন্না, বুইল্লেন্না” বলে জ্ঞান ঝারছেন। পাঠক অতন্ত দুঃখিত। রহমত চাচার নানার জাহাজে তারপর কি হয়েছিলো বলতে পারছি না। ওনাদের চোখ চকচকে হওয়া মাত্র আমি সুযোগ বুঝে পগার পার। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.