আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ছাত্ররাজনীতির প্রয়োজনীয়তা ও পরিবর্তনের ঐতিহাসিক প্রাসঙ্গিকতা

শান্তির জন্য সংগ্রামী বলা যায় স্বাধীনতার প্রায় দুই যুগ পরে এরশাদের পতনের পর থেকেই দেশে ছাত্র রাজনীতির প্রয়োজনীয়তা ও অপ্রয়োজনীয়তা বিষয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। এইসময়ে ছাত্রসংগঠনের নেতা কর্মীদের সামনে পূর্বের ন্যায় আন্দোলন সংগ্রামের স্বাভাবিক চরিত্র না থাকায় কিছু কিছু অপকর্মের সাথে জড়িত হয়ে পড়ে। ইতিহাসের নির্মম বাস্তবতা, জিয়াউর রহমান অবৈধ পথে ক্ষমতায় এসেই জাতীয় রাজনীতি এবং ছাত্ররাজনীতি উভয় ক্ষেত্রেই অর্থ ও অস্ত্রের সহজলভ্যতা দিয়ে রাজনীতির চিরচেনা সেই ত্যাগের মহিমায় উজ্জ্বল নীতির রাজা লালন করাই রাজনীতি এই অহংকারকে ভয়ংকর ও কুতসিত চরিত্রদান করেন। কাকতালীয়ভাবে ’৯১ এর নির্বাচনেও বিএনপি সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের চরিত্রে কালিমা লেপনের যে অপচেষ্টা জিয়াউর রহমান করেছিলেন, তারই হাতে গড়া দলের নেতা কর্মীরা মহাউদ্দ্যমে এবার খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে যেন জিয়াউর রহমানের সেই অসমাপ্ত কাজই করতে শুরু করেছিলেন।

তখনও একবার আজকের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মতিঝিলের শাপলা চত্বরে ছাত্রদের হাতে বইখাতা তুলে দিয়ে ক্লাসে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে ছাত্রলীগ তথা ছাত্ররাজনীতিকেই রক্ষা করেছিলেন। কিন্তু যে বিষবাষ্প রাজনীতির মাঠে ছড়ানো হয়েছিল তা সংগঠনকে খুব সহজে স্পর্শ না করতে পারলেও ব্যক্তির পর্যায়ে খুব সহজেই পৌঁছে গিয়েছিল। এমনই একপর্যায়ে সাবেক রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করার কথা বললে তথাকথিত সুশীলের খুব প্রশংসাও কুড়ান। এইধরনের সুশীলেরা কখনই ছাত্ররাজনীতির অতীত ভুমিকা, থাকার প্রয়োজনীয়তা এবং কিভাবে থাকা উচিত সেগুলোর বিষয়ে কোন পরামর্শ দেন না। তাঁদের সোজা কথা ছাত্ররাজনীতির প্রয়োজন নেই।

খেয়াল করলে দেখা যাবে এই সুশীলদের একটি অংশ অবসরপ্রাপ্ত সামরিক বা বেসামরিক আমলা, একটি অংশ ব্যবসায়ী, একটি অংশ ছাত্রজীবনে বাম রাজনীতি করে হালে পানি না পেয়ে এখন এনজিও ব্যক্তিত্ব, কিছু বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজের শিক্ষক। তারা ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করার জন্য দৃশ্যমান যেসব যুক্তিগুলো দেখান, সেগুলো ছাত্রসংগঠনগুলো একটু সুনজর ও সাংগঠনিক কার্যপরিধি বৃদ্ধি করলেই সমাধান সম্ভব। কিন্তু খেয়াল করবেন, এই সুশীল মশায়রা কখনই সমাধানের কথা বলবেন না। একেবারে বন্ধই করতে হবে। কেন? কারন, পাকিআমল থেকেই সামরিক শাসন আমাদের শোষণ করছে বারবার।

স্বাধীনতা পেলেও পাকি আশীর্বাদপুষ্ট জলপাই রঙা বাহিনী বারবার আমাদের ভাগ্যের শিকে ছিড়েছে। রাজনৈতিক দলকে জনগণের সামনে বিবস্ত্ররুপে উপস্থাপন করে বারবার ধোঁকা দিচ্ছে। আর এই তথাকথিত সুশীল ভদ্রলোকেরা সবসময় হাঁটুতে বুদ্ধিওয়ালা জলপাই বাহিনীর মগজে গোবররুপে স্থিত হয়েছে। ফলাফল যা হবার তাই হয়েছে। শেষরক্ষা কারো হয়নি।

আর এই শেষরক্ষা না হওয়ার পিছনে কারন হল ছাত্রনেতা, ছাত্ররাজনীতি এবং সাবেক ছাত্রনেতা ও ছাত্ররাজনীতির কণ্টকাকীর্ণ পথ পেরিয়ে যারা জাতীয় নেতা হয়েছেন তাঁরাই। এই সুশীলদের সামনে শত্রু তাই ছাত্ররাজনীতি। ছাত্ররাজনীতি থাকলে দেশে দেশপ্রেমিক জাতীয় নেতা তৈরী হবে, এটা তাঁরা কোনভাবেই মেনে নিতে পারেনা। বাস্তবতা হচ্ছে, কিছুকাল যাবত দেশে যেভাবে ছাত্ররাজনীতি চলছে এভাবে চলা কোনভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। এটা শুধু সুশীলদের কথা না, যারা একসময় ছাত্ররাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন তাঁরা, এমনকি এদেশের আমজনতাও চায়, পরিবর্তন আসুক।

সমস্যা তৈরি হয়েছে যথাযথ প্রক্রিয়ায় সমাধান করতে হবে। মাথায় ব্যথা তাই বলে মাথা ফেলে দিলে চলবে না, চিকিৎসা করে সুস্থ করতে হবে। ব্রিটিশ ভারতবর্ষে যখন ছাত্ররাজনীতির গোড়াপত্তন হয় তখন যেভাবে সাংগঠনিক কাঠামো ও কর্মপরিচালনা করা হয়েছে, ভারত ও পাকিস্তান ভাগ হওয়ার পরে আগের সংগঠন যেমন প্রয়োজনীয়তা হারিয়েছে আবার জন্ম নেয়া নতুন সংগঠনও ভিন্নরূপে আত্মপ্রকাশ ঘটায়। এক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ মাইলফলক। রাষ্ট্রীয়ভাবে জাতিগত শোষণ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি রাজপথেও এই সংগঠনটি জন্মলগ্ন থেকেই গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখে।

জিন্নার নেতৃত্বাধীন যে মুসলিম লীগের নেতৃত্বে পকিস্তান স্বাধীন হলো, সেই মুসলিম লীগের অন্যায় ও শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য বিরোধীদল হিসেবে শুধু পূর্ব পাকিস্তানে নয় সমগ্র পাকিস্তানেই ছাত্ররাই প্রথম একটি রাজনৈতিক দল গঠন করে। তারপর ধীরে ধীরে অনেক সংগঠনের জন্ম হয়েছে এবং কালের আবর্তে অনেকে হারিয়েও গেছে। যেমন ছাত্ররাজনীতি অনেক নেতা তৈরী করলেও সময়ের সাথে অনেকেই পথ চলেন নি বা পারেন নি। প্রায় এক যুগ ছাত্ররাজনীতির একজন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে ছাত্ররাজনীতির কল্যানকর ও গৌরবের বিষয়গুলোর যেমন প্রয়োজনীয়তা বোধ করি তেমনি ছাত্ররাজনীতির বিপথগামিতায় অনিশ্চিত বাংলাদেশের দুঃস্বপ্নের হতাশায় নিমজ্জিত হই। আর খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে বলেই মনে করি, ছাত্ররাজনীতির নীতিগত ও কর্মগত পরিবর্তন সময়ের দাবী।

ব্যক্তি যদি বিকৃত রুচির পরিচায়ক হন, তাহলে সংগঠনের খুব বেশী কিছু করার নেই। তারপরও কিছু নিয়মের বাঁধনে আবদ্ধ করে রাখলে অনেকাংশেই সুফল আসে। যখন এদেশে ছাত্ররাজনীতির গোড়াপত্তন হয়, তখন যেভাবে পরিচালিত হয়েছে এখনো সেভাবেই ঐতিহ্য ধরে রেখে পরিচালিত হতে হবে তার কোন যৌক্তিকতা নেই। বহমান হোক চেতনায় সমুজ্জল ঐতিহ্য, পরিচালনায় আসুক নতুনত্ব। তাই সময় এসেছে নতুন করে ভাববার।

নতুন প্রজন্মের কাছে গ্রহনযোগ্য হিসেবে ছাত্ররাজনীতিকে উপস্থাপন করার। ইতিহাস বলে, ছাত্র সংগঠন শুরু থেকে অন্য কোন জাতীয় সংগঠনের অঙ্গসংগঠন ছিলনা। জিয়াউর রহমান সামরিক ফরমানবলে অঙ্গসংগঠন হতে বাধ্য করে। এর পরে বিগত ১/১১ এর পরবর্তী সরকার আবার জাতীয় সংগঠনকে নির্বাচন কমিশনের আইনের ছকে বেঁধে ছাত্রসংগঠনকে অঙ্গরূপে অস্বীকার করতে বাধ্য করে। যা এখনও বহাল আছে।

এবং এই আইন বাতিলের প্রয়োজনীয়তা ছাত্রসংগঠনগুলো এখনো অনুভব করেনি। অথবা প্রয়োজন নেই। ‘৭১পূর্ববর্তী সময়ে পড়ালেখার চেয়ে জরুরী ছিল অস্ত্র চালনা শিক্ষা, দেশ গঠনের প্রয়োজনীয়তার চেয়ে জরুরী ছিল স্বাধীন দেশ অর্জন। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে জরুরী হয়েছে দেশ গঠন এবং সেজন্য উচ্চশিক্ষায় নিজেকে গড়া। আর এই নিজেকে গড়ার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র ব্যবস্থা যদি কোন প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে তার প্রতিবাদ এবং সফলতা অর্জনই এখন ছাত্রসংগঠনগুলোর প্রধান কাজ হওয়া উচিত।

কিন্তু যেহেতু আমাদের জাতীয় রাজনীতির চরিত্রে পরিবর্তন খুব ধীর গতির তাই ছাত্রসংগঠন এর ক্ষেত্রেও রাতারাতি পরিবর্তন অসম্ভব। তদুপরি নিজেদের স্বার্থ ও সুবিধার বিষয়টি ছাত্রসংগঠনের নিজেদেরকেই বুঝতে হবে ও সেইমতো কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে হবে। ১৯৪৮ সালে ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠার পর থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে এই সংগঠনটিই সবচেয়ে প্রাচীন। তাই এর পর যত ছাত্রসংগঠনের জন্ম হয়েছে কেউ স্বীকার না করলেও সত্যি যে, সকল সংগঠনই কোন না কোনভাবেই ছাত্রলীগকে অনুসরন করেছে। তাই অদুর ভবিষ্যতেও যাতে অন্যান্য সংগঠন ছাত্রলীগকে অনুসরন করে নিজেদের পরিবর্তনের পথে নিয়ে যেতে পারে সেই ঐতিহাসিক ভুমিকায় ছাত্রলীগকেই অবতীর্ণ হতে হবে।

নিকট অতীতে ছাত্রদের হাতে ছাত্রলীগের নেতৃত্ব তুলে দেওয়ার লক্ষ্যে নেতা নির্বাচনের জন্য ২৯ বছর বয়স নির্ধারিত করা হয়েছে। যা সকলের কাছেই গ্রহযোগ্যতা পেয়েছে। ইতিহাসে সাক্ষ্য দেয়, এই সংগঠনটি একসময় প্রতিবছরই সম্মেলনের মাধ্যমে নেতা নির্বাচন করত এমনকি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সম্মেলন করতে ব্যর্থ হলে আপনা আপনিই আগের কমিটি ভেঙ্গে যেত এবং যথাযথ গঠনতান্ত্রিক নিয়মে পূর্ব নির্ধারিত সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির কাছে সম্মেলন আয়োজনের জন্য সর্বময় দ্বায়িত্ব ন্যস্ত হতো। এমন নিয়মের কড়াকড়ি ফিরিয়ে আনা উচিত। বামধারার চর্চারত অনেক সংগঠনই নিয়মিত সম্মেলন করে।

কিন্তু যেহেতু তাঁদের ভাত্রিপ্রতিম মুরুব্বী সংগঠনগুলো এদেশে এখনো জনগণের আস্থা অর্জন করে রাষ্ট্রীয় দ্বায়িত্ব পালনে যেতে পারেনি, সমালোচনার গন্ডীতেই সীমাবদ্ধ রয়েছে, তাই তাঁদের কর্মকাণ্ডকে জনগন এখনও আপনরুপে গ্রহন করেনি এবং দৃশ্যমানও নয়। দেশে আরও একটি বৃহৎ ছাত্রসংগঠন রয়েছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠার পর থেকে আজো পর্যন্ত তাঁদের একটি গঠনতন্ত্র তৈরী করতে পারেনি। যদিও তাঁদের ভাত্রিপ্রতিম সংগঠন বিএনপি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় একাধিকবার অধিষ্ঠিত হয়েছে। ’৯০ এর ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগসহ প্রগতিশীল প্রায় সকল সংগঠনের ভিতরে গ্রুপিং-দ্বন্ধ দারুনভাবে প্রকাশিত থাকায় ছাত্রদল ডাকসুতে জয়লাভ করে এবং স্বাভাবিকভাবেই এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ছাত্রসমাজের সাথে মিলিত হয়ে আন্দোলনে অংশ নেয়।

এছাড়া এই সংগঠনটি ছাত্ররাজনীতিকে কলংক ব্যতিরেকে অন্য কোন উপহার আদৌ দিতে পারেনি। তবে হ্যাঁ, কথা আসতে পারে যে, তাঁদের সংগঠনের নেতারাও এমপি, মন্ত্রী হচ্ছে, জনগন ভোট দেয়। কিন্তু এদেশের সচেতন মহল জানে, এমপি বা মন্ত্রী হলেই দেশপ্রেমিক গনমানুষের নেতা হওয়া যায় না। তাই পরিবর্তনের ধারায় ছাত্রলীগকেই অগ্রনী হিসেবে দেখতে এবং ভবিষ্যতের দেশ পরিচালনার ভার গ্রহন করার জন্য জাতীয় নেতা তৈরি করার প্রজনন ক্ষেত্র তৈরি করতে ছাত্রলীগের যেকোন ভুমিকা জনগন সাধুবাদ জানাবে বলেই বিশ্বাস করি। একসময় যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল চিঠির মাধ্যমে রাস্তাঘাট ছিল দুর্গম এখন মুঠোফোন, ইন্টারনেট এবং রাস্তাঘাটও অনেক উন্নত।

আগে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা (শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান) ছিল অপ্রতুল এখন প্রতি থানা বা উপজেলায় একাধিকতো বটেই অনেক ইউনিয়নেও কলেজ স্থাপিত হয়েছে। ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে এবং অনেক পরেও আওয়ামীলীগ বা অন্য কোন সংগঠনের থানা বা ইউনিয়ন পর্যায়ে কার্যক্রম ছিলনা। সেসময়ে ৬দফা, ’৭০ এর নির্বাচন, ’৬৯ এর ছাত্রগন অভ্যুথান ও মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহনের উদ্দেশে জনগনকে সংগঠিত করার লক্ষ্যে গ্রামে গঞ্জে সংগঠনের পরিধি বৃদ্ধি করতে হয়েছে। সময়ের সাথে সাথে অনেক প্রয়োজনই সফলতার মাধ্যমে তার বর্তমান চেহারা হারিয়ে নতুন প্রয়োজনরুপে দৃশ্যমান হয়। তেমনি সেসময় যেভাবে সংগঠনের কর্মকৌশল নির্ধারণ করা হয়েছে এবং সেগুলোর অনেকগুলোই সফলতার মাধ্যমে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে, কিন্তু বর্তমানে প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে।

এখন প্রতিটি ওয়ার্ড/ ইউনিয়নে মুরুব্বী সংগঠনের পাশাপাশি যুবসংগঠন, স্বেচ্ছাসেবকসংগঠন, কৃষকসংগঠন এমনকি অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও শ্রমিকসংগঠনও তাঁদের সাংগঠনিক কার্যক্রম চালাচ্ছে। আরও রয়েছে নানারকম পরিষদ/ফোরাম ও সাংস্কৃতিকসংগঠন। এহেন পরিস্থিতিতে ছাত্রসংগঠনগুলোকেও ভাবতে হবে ওয়ার্ড/ ইউনিয়ন/পৌরসভা/ থানা/ উপজেলা/ জেলা/ মহানগর প্রভৃতি শাখা থাকার প্রয়োজনীয়তা আছে কিনা। মোদ্দাকথা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে ছাত্রসংগঠনের কোন শাখা থাকাটা বর্তমান সময়ে অযৌক্তিক। ছাত্ররাই যেহেতু ছাত্ররাজনীতি করবে ও নেতৃত্ব দিবে তাহলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে কারা নেতৃত্ব দিবে? সকলেইতো কোন না কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র তাহলে যে যেখানে পড়ালেখা করে সেখানেই নেতৃত্ব দিবে।

বর্তমান বাস্তবতায় উপলব্ধিগত বিষয় হলো, এখন যেহেতু দেশ গঠনই আমাদের সকলের প্রধানতম দ্বায়িত্ব, তাই ন্যুনতম ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত ছাত্রদের রাজনীতি থেকে দূরে রাখার ব্যবস্থা করা উচিত। ক্লাস নাইন থেকে ‘রাজনীতি শিক্ষা’ নামক অবাধ্যতামুলক কোন শিক্ষাকার্যক্রম পাঠ্য করা যেতে পারে। তাতে করে আমাদের রাজনীতির মৌল বিষয়গুলো, ঘটনার অববাহিকায় ব্যক্তির ভুমিকা ও রাজনীতির আদর্শিক প্রয়োজনীয়তার মতো মৌলিক সত্যাসত্য উদ্ঘাটনে পাঠক ব্রতী হবে এবং নিজেই স্বিদ্ধান্ত নিতে পারবে। এতে করে ছাত্রসংসদ চালু করা সম্ভব হবে। নতুন ছাত্রবান্ধব ছাত্রনেতা তৈরী হবে।

জাতীয় সংগঠনের নেতারা ছাত্রসংগঠনে পকেটের কর্মীকে নেতা বানানোর জন্য অর্থলগ্নি করবেনা, সাবেক নেতারাও আশীর্বাদপুষ্টকে মদদ দিয়ে অন্যায় কর্মে লিপ্ত করবে না। টেন্ডারবাজিতে ছাত্রনেতা/ কর্মীদের ব্যবহার কমবে। টাকার বিনিময়ে পদ বেচাকেনার পথ রুদ্ধ হবে। নির্মম বাস্তবতা হলো, ছাত্রসংগঠনগুলো তাঁদের বিভিন্ন শাখা কমিটিগুলোকে কখনোই গ্রুপিং এ উসকে দেয় না, এধরনের কুকর্মে সেখানকার স্থানীয় মুরুব্বী সংগঠনের নেতারা ছাত্রসংগঠনের কর্মীদের নির্লজ্জভাবে ব্যবহার করে থাকেন। সোজা কথায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে কোন ছাত্র সংগঠন না থাকাই বাঞ্ছনীয়।

এমনকি গঠনতন্ত্রের সংশোধনী এনে ছাত্র সংগঠনের কোন নেতা বা কর্মীর জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কোন প্রার্থীকে সমর্থন করে প্রচার প্রচারনায় অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করা উচিত। যারা যে জাতীয় রাজনৈতিক সংগঠনের ভাত্রিপ্রতিম তাঁরা মনোনয়ন নির্ধারিত হলেই কেবল নির্বাচনী কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করার সাংগঠনিক বিধান থাকা বাঞ্ছনীয়। এসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রেরও দ্বায়িত্ব রয়েছে। নির্বাচন কমিশনের নিয়মে ছাত্রসংগঠন যেহেতু কোন মুরুব্বী সংগঠনের অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠন নয়। তাই যেকোন জাতীয় সংগঠন আদর্শিকভাবে তাঁদের অনুসারী ছাত্রসংগঠনের আইনগতভাবে অভিবাবক নয়।

তাহলে ছাত্রসংগঠনের কি সাংগঠনিক বা রাজনৈতিক বা রাষ্ট্রীয়ভাবে কোন নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকবে না? অবশ্যই থাকা উচিত। স্ব স্ব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তো কর্তৃপক্ষই দ্বায়ীত্বশীল অবিভাবক। কিন্তু সংগঠনের চরিত্র যখন জাতীয় রুপ ধারণ করবে তখন অবশ্যই শিক্ষা মন্ত্রনালয় অথবা ইউজিসি কেই দ্বায়িত্ব নিতে হবে। কারন ছাত্রসংগঠনগুলো নির্দিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরেও তাঁদের সরকারের সাথে বিভিন্ন দাবীদাওয়া বা প্রয়োজন নিয়ে কথা বলবে। তাছাড়াও সরকারে উচিত ছাত্ররাজনীতির কথা বলার সীমানা নির্ধারণ।

এক্ষেত্রে হয়ত কণ্ঠ রোধের কথা উত্থাপিত হবে। তাহলে কী সবসময় দেশের বা বাইরের যেকোন বিষয়ে যখন তখন সভা-সমাবেশ করে নিজেদের ব্যস্ত রাখবে? মোটকথা এক্ষেত্রেও একটা যুতসই নির্দেশনা ছাত্রসংগঠনগুলোর নিজেদের যুগোপযোগী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য থাকা প্রয়োজন। এদেশের রাজনীতি সংশ্লিষ্ট ও সচেতন মহল জানে, কারা কি উদ্দেশ্যে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ বা কলুষিত করার পাঁয়তারা করছে। পূর্ব পাকিস্তান থাকাকালীন সময়ের আইয়ুবের মার্শাল ‘ল থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশে কিছুকাল আগের তত্বাবধায়কের আড়ালে বাস করা ভয়ংকর ক্ষমতাধরদের বিরুদ্ধে ছাত্রসংগঠন ও ছাত্ররাই সর্ব প্রথম আন্দোলন ও প্রতিবাদ গড়ে তোলে। সেজন্য সুশীলের আড়ালে বাস করা একধরনের কুশীল ও মিডিয়ার অবাধ তথ্যপ্রবাহের সুযোগে একশ্রেনীর মিডিয়াও চায়না এদেশে ছাত্ররাজনীতির অমসৃণ পিচঢালা পথ বেয়ে দেশপ্রেমিক জননেতা তৈরী হোক।

অবসরপ্রাপ্ত সামরিক ও বেসামরিক আমলা মহাশয়রাও তাঁদের ভবিষ্যতে এমপি, মন্ত্রী ও উপদেষ্টা হওয়ার সুপ্ত বাসনার তাড়নায় তাঁরাও চায়না গনমানুষের ভাগ্য গড়ার যোগ্য কারিগর গড়ে উঠুক। দুঃখজনক হলেও সত্যি, ’৯০ এর আগে প্রায় প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রসংসদ নির্বাচন হতো। কিন্তু জনতার ভোট প্রদানের মাধ্যমে ফিরে আসা গণতন্ত্রের শুরু থেকেই সেটা অন্ধকার গুহায় স্থায়ীত্ব লাভ করেছে এক অদৃশ্য কারনে। যে দলটি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসেছিল তাঁরা সেসময় ক্ষমতায়ন না হলে দল হিসেবে তাঁদের অস্তিত্ব এবং বাংলাদেশের সার্বিক অবস্থা আজ ভিন্ন আঙ্গিকে ভিন্ন উচ্চতায় দেখা যেত। সেই ক্ষমতাশীল রাজনৈতিক দলটির অরাজনৈতিক আচরনের কারনে রাজনৈতিক সংস্কৃতি এদেশে বেড়ে উঠতে পারেনি।

অপরদিকে ডাক্তার, প্রকৌশলী, শিক্ষক, সাংবাদিক, কৃষিবিদ ও ব্যবসায়ী প্রভৃতি পেশাজীবী এবং তাঁদের বিভিন্ন সংগঠন সরাসরি দলীয় রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করেছে। আরো একটি সংস্থা যারা পাকিস্তান ঘরানায় এখনো এদেশের সকল কিছুতে বামহাত দিয়ে থাকে তাঁদেরও সুদুরপ্রসারী পরিকল্পনা থাকে ছাত্ররাজনীতিকে ধ্বংস ও বিতর্কিত করার লক্ষ্যে। উপরোক্ত সকল অশুভ শক্তির এক অদৃশ্য বন্ধনে অভিনব কায়দায় চলছে ছাত্ররাজনীতিকে ধবংসের নীলনকশা। এবং তারই ধারাবাহিকতায় জনগণের ভাগ্য গড়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত মূলধারার জাতীয় রাজনৈতিক দলেও সাবেক ছাত্রনেতাদের প্রভাব ক্রমশ অস্তমিত। এই দুরভিসন্ধির ফাঁদ থেকে দেশকে রক্ষা করার সময়োপযোগী স্বিদ্ধান্ত প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের মাধ্যমে ছাত্রসংগঠনগুলোকেই নিতে হবে।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় আমাদের জাতীয় জীবনে ’৪৭ এর পর থেকে ছাত্রসংগঠনগুলোই কখনো অহিংস পদ্ধতিগত আন্দোলন-প্রতিবাদ আবার কখনো সশস্ত্র বিপ্লবী ভুমিকায় আবির্ভূত হয়ে জাতীয় রাজনীতিকে কখনো মত ও পথ দেখিয়েছে আবার কখনো নিজেরাই নেতৃত্ব দিয়ে নায়কোচিত বীরের সম্মানে অধিষ্ঠিত হয়েছে। ’৫২ এর ভাষা আন্দোলন যা মূলত ’৪৮ থেকেই শুরু হয়েছিল এটার নেতৃত্বের পুরোভাগে ছাত্ররাই ছিল। ’৫৪ এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে জাতীয় রাজনীতি যখন দ্বিধান্বিত ও অনৈক্যে স্থিত তখন ছাত্রসংগঠনগুলোই নিজেদের মধ্যে ঐক্য স্থাপন করে জাতীয় রাজনীতিকে পথ দেখিয়েছে। ’৫৮ সালে আইয়ুব খান মার্শাল ‘ল জারী করার পরেও ছাত্রসংগঠনগুলোই প্রথম প্রতিবাদ করেছিল। ’৬২ এর শিক্ষা আন্দোলন নিজেদের জাতীয় প্রয়োজনে ছাত্রসংগঠনগুলোই নেতৃত্ব দিয়েছে।

ঐতিহাসিক ৬ দফা আন্দোলনে আওয়ামীলীগের মুসলিম লীগ পন্থীরা যখন ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে পাশ মার্ক দেয়নি বঙ্গবন্ধু আওয়ামীলীগ নেতাদের উপর আস্থা হারিয়ে ছাত্রসংগঠন তথা ছাত্রলীগকেই দেশব্যপী জনমত গড়ার দায়িত্ব দিয়েছিলেন এবং অত্যন্ত সফলতার সহিত ছাত্রলীগ জনগণের আস্থা অর্জন করেছিল, যদিও বাম ছাত্রসংগঠনগুলো ৬ দফাকে সিআইএ/’র এর ষড়যন্ত্র বলে কুতসা রটালেও পরবর্তীতে ছাত্রসংগঠনগুলো ৬ দফার সমন্বয়ে তাঁদের ১১ দফা নিয়ে মাঠে নামে এবং যার ধারাবাহিকতায় ’৬৯ এর গনঅভ্যুথান ঘটে। যার পুরো নেতৃত্ব ছাত্রসংগঠনগুলোই দেয়। ’৭০ এর নির্বাচনে জাতীয় রাজনীতি যখন নির্বাচনে অংশ নেওয়া না নেওয়া নিয়ে দ্বিধান্বিত তখনো ছাত্রসংগঠনগুলোই নির্বাচনে অংশগ্রহনের জন্য চাপ প্রয়োগ করে এবং সারাদেশব্যপী ছাত্রসংগঠনগুলো প্রচার প্রচারনায় অংশ নিয়ে জয়লাভ নিশ্চিত করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের পূর্বপ্রস্তুতি সর্বপ্রথম ছাত্রসংগঠনগুলোই গ্রহন করেছিল। রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশেও ’৭৫ পরবর্তী সময়ে পাকি সামরিক কায়দায় রাজনীতিকে কলুষিত করার পাঁয়তারার বিরুদ্ধেও ছাত্রসংগঠনগুলোই প্রথম প্রতিবাদ করে।

এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে জাতীয় রাজনৈতিক সংগঠনগুলো যখন মত ও পথের ভিন্নতায় বিভক্ত তখনো ছাত্রসংগঠনগুলোই একতাবদ্ধ হয়ে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পথকে ত্বরান্বিত করেছে। ছোট বড় অনেক সফলতা ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে নিকট অতীতে ২০০৮ এর আগস্টে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠের ঘটনাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা তীব্র প্রতিবাদেও যখন এদেশের তথাকথিত সুশীল সমাজ, মিডিয়া এমনকি অনেক রাজনৈতিক দলও উচ্চ কণ্ঠে কথা বলতে পারেন নি, তখন ছাত্রসংগঠনগুলোই সাধারন ছাত্রদের সাথে নিয়ে তথাকথিত সেনাসমর্থিত সরকারে ভিত কাঁপিয়ে দেয় যার ধারাবাহিকতায় আজ আবার গণতন্ত্র পুনর্বহাল হয়েছে। যে ছাত্ররাজনীতির শত লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে রক্তের আলপনায় এত উচ্চ সফলতার অতীত নির্মিত হয়েছে, সেই ছাত্ররাজনীতি বন্ধ হওয়া অথবা কলুষিত হওয়া জাতির জীবনে অভিশাপ স্বরুপ। আর সেজন্যই ছাত্র রাজনীতির সকল সফল আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া এবং অনেক আদিপাঠ নির্মাণ করেছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। তাই ছাত্রলীগেরই দ্বায়িত্ব সময়ের সাথে নিজেদের যোগ্যতার পরিশীলিত প্রকাশে সুন্দর আগামী নির্মাণে এবং দেশের নেতৃত্বভার গ্রহনের উপযোগী নেতা তৈরি ও জাতিকে সকল ক্রান্তিকালে পথ দেখানোর ভুমিকায় অবতীর্ণ হওয়া।

ছাত্ররাজনীতি দেশপ্রেমিক জাতীয় নেতা তৈরির কারখানা। তাই এই সময়েই নিজেদের দক্ষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য একাডেমিক পড়ালেখার পাশাপাশি মানুষের জীবন সম্পর্কিত সকল বিষয়ে পড়াশুনা করা একান্ত জরুরী। সেজন্য সংগঠনগুলোর উদ্যেগ নিয়ে পাঠচক্র করা উচিত। বর্তমানে ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠনগুলোর সাথে আলোচনা সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ গ্রহন করে ছাত্রসংগঠনগুলোর জন্য দিকনির্দেশনা প্রদান অথবা ছাত্রসংগঠনগুলো নিজেরাই সময়পোযোগী স্বিদ্ধান্ত গ্রহন করে দুষ্কৃতিকারী দের দুরভিসন্ধিমূলক দেশকে বিরাজনীতিকরনের অপচেষ্টাকে প্রতিহত করতে পারাই হবে সময়ের সাহসী প্রতিবাদ। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.