পরাঞ্জয়ী... বৃষ্টিতে ভেজা মানা, দমকা হাওয়ায় জানলা গলে যদি বৃষ্টি আমায় ছুঁয়ে যায় তবে মানা করি কেমন করে? ন্যাকা ন্যাকা কথা বলা আমার স্বভাব নয়। তবুও মাঝে মাঝে ন্যাকা সাজতে ইচ্ছে করে। খুব ঢং করে বলতে ইচ্ছে করে "চল বৃষ্টিতে ভিজি!" আমার দিন কাল গুলো কেমন যেন "চলছে গাড়ি যাত্রা বাড়ি" টাইপ করে এগিয়ে যাচ্ছে। একলা বিকেল গুলো পান্সে আর ধোঁয়াশা লাগে। সন্ধ্যা গুলো অসহ্য লাগে।
অবিরাম বিদ্যুৎ চমকানো কিংবা দ্রিম করে বাজ পড়লে ভয় পেতে ইচ্ছে করেনা। ভয় ইচ্ছে করে পাওয়া যায় কি না ভাবছেন? ইচ্ছে করে ভয় পাওয়া যায়না, কিন্তু ইচ্ছে করে ভয় পাওয়াটাকে ভুলে থাকা যায়! "কি করছ লীনা?" মিতু আপার ডাকে ভাবনার জগত থেকে এক লাফে বাস্তবে ফিরে আসি। "কিছুনা আপু" হেসে জবাব দিলাম। "মন খারাপ কেন?" জিজ্ঞেস করলেন তিনি। বললাম "না তো আপু, মন খারাপ না, বৃষ্টি দেখছি"।
"আচ্ছা দেখ" বলেই উনি কাপড় ছেড়ে হাত মুখ ধোয়ার জন্য ব্যতিব্যস্ত হলেন। এটা ৩ রুমের একটা ছোট্ট ফ্ল্যাট। এর এক রুম সাবলেটে ভাড়া দিয়েছেন এর মালিক। বাকি ২ রুম নিয়ে তারা থাকেন। এই ছোট্ট রুমে থাকি আমরা তিন জন।
আমি মিতু আপু আর রুনু আপু! মাসের শেষে হাতে টান পড়া তিনটি মেয়ে মিলেমিশেই আছি! আমি ২ মাস আগে ঊঠেছি এখানে। শাহেদ, আমার স্বামী, দেশে থাকতে আমরা একটা বাসা নিয়ে ছিলাম। এক রুমের চিলেকোঠা। শাহেদের চাকরীটা মোটামুটি সুবিধার থাকলেও, পি এইচ ডি করার উচ্চাশা নিয়ে টাকা জমাচ্ছিল। তাই টেনেটূনে থাকা!
শাহেদের সাথে বিয়েতে আমার বাবা রাজি হয়নি, তাই আলিশান ঘর, বিলাসি জীবনের মুখে ছাই দিয়ে পালিয়ে বিয়ে করা।
যোগ্যতায় শাহেদ পিছিয়ে ছিল না, কিন্তু বাবা আমাকে প্রতিষ্ঠিত না করে বিয়ে দেবেন না এমন পণ করেছিলেন। তাই বাবার মন ভেঙ্গে শাহেদের সংসার গড়েছিলাম। শাহেদ নিজের লোকাল বাসে চড়া, ফ্ল্যাটের বদলে চিলে কোঠায় থাকা আর হিসেব করে মাছ মাংস খাওার টাকা জমিয়েও ইউরোপে পি এইচ ডি করার টাকা জমাতে পারল না। শেষ মেস কিছু ব্যাংক লোন নিয়ে গত ২ মাস আগে চলে গেল। শাহেদের সাথে সাথে থেকে শাহেদের চলে যাওয়াকে ত্বরান্বিত করেছি বলা যায়।
শপিং, প্যাকিং সব! শাহেদ যখন অনেক যুদ্ধ করে আমাকে বিয়ে করল, আমি ভেবেছিলাম শাহেদের পুরো স্বপ্নটাই হয়ত আমি। কিন্তু খুব জলদি আমি বুঝে ফেলেছিলাম, শাহেদের কাছে সব কিছু এক একটা প্রজেক্ট। কোড মিলিয়ে প্রজেক্ট কমপ্লীট করা হয়ে গেলেই অন্য প্রজেক্টে হাত দেওয়া। লীনা প্রজেক্ট শেষ হতেই পি এইচ ডী প্রজেক্ট শুরু। শাহেদের পুরো স্বপ্ন থেকে সরে গিয়ে এক কোণায় বসে আমি দেখলাম তার চলে যাওয়া।
যদিও মাঝে মাঝে বলত "আমি বরং না যাই"। কিন্তু সেখানে কোন নেশা ছিল না থেকে যাবার। কিংবা যখনি ইউরোপ যাবার প্রসঙ্গ আসত চক চক করত ওর চোখ দুটো! তাই "থেকে যাও" কিংবা "যেওনা" বলবার রুচিবোধ আমাকে তাড়িত করেনি কোনদিন। যাবার আগে শুধু জানিয়েছিলাম, "তুমি বাবা হচ্ছ"। মনের এক কোণে কোথায় যেন রিন রিন করে একটা দ্বিপ জলছিল, শাহেদ যাবেনা, আমাকে ফেলে, বাবুটাকে ফেলে।
কিন্তু গেল, চলেই গেল।
বহুদিন পর মামনির সাথে কথা হল আজ। সেই থেকেই জানলায় বসে থাকা। ২ মাস ধরে মামনি কে বলার চেষ্টা করছিলাম,আমি মা হতে চলেছি। কিন্তু পারছিলাম না।
শাহেদ একদিন হঠাত বলল "লীনু, আমি বাবা হতে চাই"। শাহেদের মুখে "চাই" টূকু শুনে না বলার সাধ্য আমার কোনদিন হয়নি। তাই পরদিন সকালে অমিতব্যয়ী হাতে কেনা কন্ট্রাসেপশনের প্যাকেট গুলো ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দিলাম। ওগুলো ফেলবার সময় এম বি এ, নিজের একটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, অনেক কিছুই আমার আসে পাশে ঘোরাঘুরি করছিল। আমি তাদেরকেও "দরজা খোলা আছে" বলে বিদেয় দিলাম।
শাহেদের "চাই" এর কাছে এসব খুব বেশি মূল্যহীন! শাহেদ কে ভালবাসবার পর আমি আর লীনা ছিলাম না, যেন শাহেদের ডীমন হয়ে গেলাম। ওর সব প্রয়োজন,ওর চাওয়াগুলোর ডীলার হয়ে গেলাম। এখন আর নিজেকে নুতন করে লীনা বানাবার থিওরি আমার জানা নেই। আমি নিজে কি চাই সে কথা আমি ভুলে গেছি। হ্যা ইচ্ছে করেই ভুলেছি।
কারন শাহেদ যদি জিবীত কোন প্রাণীকে ভালবাসে তার লেখাপড়ার বাইরে, সে আমি। ওর সে দমবন্ধ ভালবাসাকে নিয়েই আমার জগত। সে জগতে কোনদিন কোন সন্দেহ কিংবা চিনচিনে ব্যাথাময় ক্ষোভ জমা হবে ভাবিনি আমি। কিন্তু মামনির বলা কথাগুলো কানের ভেতর নাকি মাথার ভেতর বিষাক্ত গোখরোর মত ফোঁস ফোঁস করে যাচ্ছে! তবে কি সব প্রেমেই কিছু জ্বালাতন এসেই যায়?
মামনিকে যখন ফোন করলাম, তখন তিনি নামায থেকে ঊঠেছেন মাত্র। হয়ত ওযুটাও ছিল তখন।
মামনি জানতে চাইল "কেমন আছিস?"। বললাম "ভাল আছি। তোমরা কেমন আছ?" বাবা কেমন আছে কথাটা জিজ্ঞেস করতে গেলেই দেখি কি এক অভিমান এসে আমার গলা চেপে ধরে! "কেমন করে চলছে? শাহেদ কি চাকরি বাকরি কিছু ম্যানেজ করতে পেরেছে?" মামনি জিজ্ঞেস করলেন। "এখনো কিছু হয়নি, হয়ে যাবে খুব জলদি। চলছে ওর রেখে যাওয়া কিছু টাকা ভাঙ্গিয়ে, সাথে একটা টিঊশন পড়াই।
"মামনি বললেন "টিউশনি? যে মেয়েকে মুখে তুলে খাইয়ে দিতে হত সে টিঊশনও পড়ায়? বাহ, তুমি তো বেশ বড় হয়ে গেছ এক বছরেই! তো চাকরিতে এপ্লাই করছ না?" । আমি জবাব দিলাম "করছি, হচ্ছেনা। পড়াশুনাও তেমন করতে পারিনা। শরীরটা ভাল না"। "কেন কি হয়েছে?" মামনি জিজ্ঞেস করলেন।
"তুমি নানু হচ্ছ, ১৩ সপ্তাহ চলছে!" বললাম সুযোগ পেয়ে। ওপাশে মামনি কিছুক্ষন নিশ্চুপ থাকলেন ফোন ধরেই। তারপর বললেন "নিজেকে ধ্বংস করার এই একটা রাস্তাই বোধ হয় বাকি ছিল! সেটাও করলে? " আমি বললাম "সন্তান কি মা কে ধ্বংস করে মামনি?" দৃঢ় কন্ঠে মামনি বললেন "হ্যা ধ্বংস করে, যেমন তুমি করেছ তোমার বাবা কে! কিন্তু যার কারনে করলে সে কতখানি ভেবেছে তোমার কথা একবার ভেবে দেখ!" আমি বললাম "মামনি ও যা করছে তা তো আমার জন্যই করছে!" মামনি আবার বললেন " হ্যা সেটা তো দেখতেই পাচ্ছি, তো নিয়ে যাক এখন তোমাকে, নিজের সাথে সাথে তোমার উচ্চশিক্ষাও নিশ্চিত করুক! সেটা কি করেছে কিংবা করতে চেয়েছে? যদি চাইত তবে এভাবে এই অবস্থায় তোমাকে ফেলে রাখত না। একটা সাদা কাগজ নাও, মাঝখানে ভাঁজ কর। এক পাশে লেখ তুমি কি কি ছেড়েছ, আরেক পাশে লেখ শাহেদ কি কি ছেড়েছে কিংবা করেছে!" আমি ভরাট গলায় বললাম "মামনি, হিসেব করে কি ভালবাসা কিংবা সম্পর্ক হয়?" মামনি তেজী গলায় বললেন "না, হিসেব করে সম্পর্ক হয়না, তবে সম্পর্কের পর মাঝে মাঝে হিসেব করতে হয়, নিজের প্রাপ্তিটুকুকে ঝালিয়ে দেখবার জন্য! বুকে হাত রেখে একবার বলত, তোমার ভালটা তোমার বাবা ছাড়া আর কে ভেবেছিল? শাহেদের জন্য তুমি প্রয়োজন আর তোমার বাবার জন্য তুমি স্বপ্ন!" স্বপ্ন আর প্রয়োজন শব্দ দুটো আমাকে কেমন ঘোরগ্রস্থ করে দিল।
মামনি কি বলছিলেন ও পাশ থেকে আমি শুনতে পাচ্ছিলাম না। হঠাত সম্বিত ফিরে পেয়ে শুনলাম "যদি নিজের ভালটা এখনো বোঝো তবে ভেবে দেখ আরেকবার, সময় এখনো শেষ হয়ে যায়নি!" সমস্ত শরীর কেঁপে উঠলো। ঝাঝিয়ে ঊঠে বললাম "মামনি তুমি কি আমাকে খুন করতে পারবে? আমি তো তোমাদের অবাধ্য সন্তান! পারবে? তাহলে আমার নির্দোষ সন্তানটিকে আমি কেন মারব?" মামনি ফোন রেখে দিলেন রাগ করে। নিজের সন্তান কে তার সন্তান খুন করতে বলার কারনে হয়ত মামনির অযুটা ভেঙ্গে গিয়েছিল!
আমি এখন বৃষ্টি দেখছি। একলা জানলায় বসে।
শাহেদ কি বৃষ্টিতে ভিজেছিল কোনদিন আমার সাথে? মনে পড়েনা। আমার একলা সন্ধ্যাগুলো কেমন করে শাহেদের ঠিকানা খোঁজে সে খবর কি পায় সে? আমার ভেতরে বেড়ে ওঠা ভ্রূণটা যেদিন মানুষের রূপ নেবে সেদিন আমি থাকি বা না থাকি ওকে আমি লিখে যাব আমার প্রতি সেকেন্ডের যন্ত্রণাগুলো, আমার লাল ডায়রীতে! সেদিন যদি ও শাহেদকে বাবার আসনে না বসিয়ে অপরাধীর আসনে বসায় তবে কি শাহেদ নিজের নামের আগের ডক্টরেট শব্দটি জমা দিয়ে জামিন নেবে নিজের রক্তের কাছ থেকে? ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।