তরুণ নামের জয়মুকুট শুধু তাহার, বিপুল যাহার আশা, অটল যাহার সাধনা আমার মূল লেখাটি এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন
আমরা সাধারণত ভেবে থাকি, আরব মানেই ইসলাম। আরব মানেই ইসলামের একনিষ্ঠ খাদেম ও অনুসারী। আরবদের কোনো অনাচার দেখলে আমরা হায় হায় করে বলি, গেল গেল, ইসলাম গেল। আরবদের মুখে সিগারেট দেখলে অনেক সরলপ্রাণ বাংলাদেশি জিভে কামড় দিয়ে বলে, হায় আল্লাহ! আরবরাও বিড়ি খায়!!
আদৌ কি ব্যাপারটি এমন?
আল্লাহ পাকের অপার মহিমার একটি নিদর্শন হল আরব ভূখণ্ডে শেষ নবীর আগমন। মহানবীর আত্মপ্রকাশের আগে আশপাশের রোম ও পারস্যবাসীর চেয়ে আরবরা যেমন ছিল অশিক্ষিত বর্বর তেমন ছিল কিছু অনন্য গুণ আর বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন।
আল্লাহ পাক ইসলামের মাধ্যমে তাদের সম্মানিত করে শ্রেষ্ঠ মানুষ হিসেবে পরিচিতি দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন- তাদের এ সম্মান ও উন্নতি কেবল ইসলামেরই বদৌলতে। শূন্য থেকে উঠে এসে তারা একসময় শাসন করেছিল প্রায় গোটা বিশ্ব।
পৃথিবীর কোনো ধর্ম কিংবা মতবাদ বা জাতি-সভ্যতা কখনো এক অবস্থায় স্থায়ী হয়নি। এটাই নিয়তি। উত্থান, উন্নতি ও অবনতি- এ তিনটি পর্যায়ের ভাগ্য সবাইকে বরণ করতে হয়।
সে হিসেব করলে আরবদের অবস্থান খুব সহজেই বিবেচনা করা যায়।
শেখ মুহাম্মদ আল আরিফী আরবদেশের বর্তমান মশহুর ও জনপ্রিয় বক্তাদের একজন। সৌদি আরবের এ আলেম তরুণসমাজের কাছে বেশ জনপ্রিয়। তরুণদের এক সমাবেশে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, রাসুল এর সহধর্মিনীদের নাম কে কে বলতে পারো? একজনও সঠিক উত্তর দিতে পারেনি। রাসুল এর কন্যা কয়জন ছিলেন, তাদের নামগুলো বলতে বলা হলেও কেউ তা পুরো বলতে পারেনি।
এরপর তিনি জিজ্ঞেস করলেন, বার্সেলোনার খেলোয়াড় কতজন ও কে কে? এবার সবাই প্রায় দাঁড়িয়ে গেল, কার আগে কে জবাব দেবে তা নিয়ে রীতিমত হৈ হুল্লোড় লেগে গেল। তিনি ‘আসতাগফিরুল্লাহ’ পড়ে সবাইকে বসতে বললেন। এরপর আক্ষেপ করে বললেন, ‘তরুণ বন্ধুরা, এ আরব সীমানার বাইরের লোকেরা তোমাদের সাহাবিদের সন্তান বলে ভাবে, তোমাদের চেহারা দেখে নিজেদের সৌভাগ্যবান বলে মনে করে, আর তোমাদের এ দশা? নিজের রাসুলের সন্তান সম্পর্কে, তার পরিবার সম্পর্কে তোমরা কিছুই জানো না?’
এমনই অপর একজন প্রসিদ্ধ বক্তা আয়েয আল কারনি। তার বই এখানে বর্তমানে বিক্রয়ের শীর্ষ তালিকায়। তিনি এক সমাবেশে বলছিলেন, ইউরোপিয়ানরা এক সন্তানের জন্ম দিয়ে তাকে ভালো করে মানুষ করে, শিক্ষা-দীক্ষায় তাকে দক্ষ করে মহাকাশে পাঠায় গবেষণার জন্য।
আর আমরা গণহারে সন্তান জন্ম দিচ্ছি রাসুলের উম্মত বৃদ্ধির জন্য, কিন্তু পরিচর্যা করছি না। ফলে এক এক বাবার দশ পনেরটি সন্তান, কেউ চুইঙ্গাম মুখে, কেউ আইপড নিয়ে ঘোরে, কেউ হুক্কা ফুঁকে আর রিয়াল উড়িয়ে বেড়ায়।
আরবদের বর্তমান সামাজিক অবস্থার কিছুটা অনুমান হয়তো এখান থেকে করা যায়। সম্পদ, প্রাচুর্য আর বিলাসিতা আরবদের বদলে দিয়েছে এবং দিচ্ছে। বিশ্ব মানচিত্রে আরবদেশগুলোর সংখ্যা বিশ-একুশটি হলেও নিজেদের স্বকীয়তা তারা ভুলে যাচ্ছে।
বিশেষ করে পারস্য উপসাগর অঞ্চলের ছয়টি দেশ ভাসছে ভোগ ও অপচয়ের সাগরে। ইসলাম পালন তাদের কাছে নেহায়েত কিছু আচার আর রীতিনীতির নাম। তরুণ প্রজন্ম চরম মাত্রায় আসক্ত হচ্ছে নিত্যনতুন ভোগসামগ্রী ব্যবহার ও পাশ্চাত্য বিনোদনে। এ দেশগুলোর অধিবাসীরা আমোদ প্রমোদে এতই ব্যস্ত যে, রাজনীতি কিংবা শাসকদের নিয়ে তাদের ভাবার সময় নেই। তাই তুলনামূলকভাবে উপসাগর অঞ্চল অনেকটা উদাসীন হয়ে আছে রাজনীতি থেকে।
কুয়েত ও বাহরাইনে কিছুটা ‘গোলযোগ’ রয়েছে, তাও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এসব দেশে মদ ও নেশার জোগান তেমন অসাধ্য কিছু নয়। ঝাঁকে ঝাঁকে এখানে আসছে মার্কিন ও ইউরোপিয়ান পর্যটক ও পেশাজীবীরা, তাদের বিনোদন ও মনোরঞ্জনের জন্য যা কিছু প্রয়োজন সব কিছুর রয়েছে বর্ণাঢ্য আয়োজন। এ আয়োজনে দলে দলে ভিড়ছে আরব মুসলিম তরুণরাও। ’
এ ছয়টি দেশের বাইরে মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকায় যে আরব দেশগুলো রয়েছে, তারা এখনও ঔপনিবেশিক সংস্কৃতিতে নাক ডুবিয়ে আছে।
আলজেরিয়া, মরক্কো অঞ্চলের তরুণরা আরবির চেয়ে ফরাসী ভাষা ও সংস্কৃতিতে দারুণ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। তুলনামূলকভাবে অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে জীবনযাত্রার মান এখানে নিম্নমানের হওয়ায় উন্নত জীবনের স্বপ্ন চোখে তারা পাড়ি জমাচ্ছে দলে দলে ফ্রান্সে ও আশেপাশের ইউরোপ-অঞ্চলে।
ওদিকে মিশর, সিরিয়া, লেবানন অঞ্চলের প্রজন্ম সম্পূর্ণ ভিন্ন কালচারে বেড়ে উঠছে। খোলামেলা সংস্কৃতি ও আচার পরিবেশে সেখানে অনেক কিছুই হারিয়ে যাচ্ছে। গোটা আরব অঞ্চলে পারিবারিক বন্ধন এখনও মজবুত হলেও যারা দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে তারা এ বন্ধন ভুলে যায়।
ফিলিস্তিন গোটা আরব অঞ্চলে আবেগের প্রতীক। এতদিন ধরে চলা সংঘাতে নিরাশ হয়ে ফিলিস্তিন ছেড়ে আশপাশের দেশগুলোতে স্থায়ী হয়েছেন অনেকে, দেশত্যাগী এদের সংখ্যা ফিলিস্তিনে বর্তমান বসবাসরতদের প্রায় দ্বিগুণ। যারা এখনও সেখানে রয়ে গেছেন, তাদের চোখে মুখে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ছায়া। আরব শাসকদের মনে এ নিয়ে দুঃখবোধ থাকলেও মার্কিন বন্ধুদের চোখরাঙানির ভয়ে তারা অনেক উদ্যোগ থেকে পিছিয়ে যান।
ইতিহাস সাক্ষী, আরবরা যখন জেগেছে তখনই ইসলামের বৃক্ষ নতুন করে সতেজ হয়েছে।
আর সেজন্যই ইসলামের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বা বৈরি পশ্চিমা শক্তি নিত্যনতুন ভোগ ও আয়েশী সামগ্রীর জোগান দিয়ে মোহগ্রস্ত করে রেখেছে তাদের।
এসবের ছোঁয়ায় দিনদিন পশ্চিমমুখী হচ্ছে আরবরা। গ্রীষ্মের ছুটি কাটাতে ইউরোপ আমেরিকায় বাগানবাড়ি কিনছেন শেখরা। রঙিন কাচঘেরা গাড়িতে বিদেশি ললনাদের নিয়ে ঘুরে বেড়ায় যুবরাজরা।
অন্যান্য আরব অঞ্চল তো বটেই, সৌদি আরব ও আশপাশের দেশগুলোতেও বিকৃতি ঘটছে আরবি ভাষার।
ইংরেজির সাথে মিশ্রণ তো বটেই, উচ্চারণভঙ্গির নতুনত্বে হারিয়ে যাচ্ছে বিশুদ্ধ আরবির চর্চা ও কথোপকথন। যাদের রক্ত ও ঘামের বিনিময়ে মরুর বুকজুড়ে পিচঢালা রাজপথ, আকাশচুম্বী দালান, বালুভূমিতে যারা পানির ঝর্ণার কারিগর, সেইসব সাধারণ শ্রমিকদের অনেক আরব মানুষ হিসেবেও গণ্য করতে ইতস্তত করে, তাদের পাওনা নিয়েও চলে হাজার রকমের টালবাহানা। অথচ নিজেদের ভেতর দশজনের জন্য একশ’ জনের খাবার নিয়ে বসে সেসবের অপচয় দেখলে চোখে পানি চলে আসে গরীব দেশ থেকে আসা ক্ষুধার্ত মানুষগুলোর।
এতকিছুর পরও ইসলামের যেটুকু এদের মধ্যে বাকি আছে, তাও নেহায়েত কম নয়। বিশুদ্ধ আকিদা বিশ্বাস এদের সবচেয়ে প্রশংসনীয় বিষয়।
পীরপূজা, মাজারপূজা, ভণ্ডামি থেকে এখনও এ অঞ্চলের লোকজন অনেক দূরে।
সাম্প্রতিককালের আরব বসন্ত নাড়া দিয়েছে অনেককে। কিন্তু এরপরও যদি তাদের ভাগ্যে সুদিন ফিরে না আসে, তবে পরিণতি হবে আরও ভয়াবহ। কারণ এসব বিপ্লব ও প্রতিবাদের নামে আরব তরুণদের হাতে চলে এসেছে অস্ত্রের ভাণ্ডার। নিছক সামান্য বিষয় নিয়ে গোত্রে গোত্রে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ার ইতিহাস তারা এখনও কিন্তু ভোলেনি।
কেউ একজন বলেছিলেন, ইসলাম যদি কোনও গাড়ি হয়, তবে আরবরা এর পেট্রল-ডিজেল। ’ কিন্তু আজ ভাবার বিষয়, ইসলামের এ জ্বালানিতেই যদি ভেজাল ছড়িয়ে পড়ে তবে আর আশার বাণী কে শোনাবে আমাদের? চারিদিকে উঁচু উঁচু টাওয়ার আর প্রাসাদের ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে আরবদের মূল পরিচয়, তবু এ নিয়ে ভাবছেনা কেউ, এটাই আশ্চর্যের! ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।