জীবনের নতুন বাঁক।
ঘড়ির কাঁটা ১০টা ছুঁইছুঁই। টিটু মামার বইয়ের দোকানে প্রাত্যহিক আড্ডাপর্ব সেরে বাড়ির দিক ফিরছি। রেলগেটে আসতেই পেছন থেকে কেউ একজন খসখসে গলায় ডেকে উঠল, ‘ভাস্তে, বাড়ির দিক যাবা নাকি?’ পেছন ফিরে দেখি, মালেক চাচা। তাঁর বহুদিনের পুরোনো ঝরঝরে রিকশা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন যাত্রীর অপেক্ষায়।
খানিকটা এগিয়ে গেলাম তাঁর দিকে। অনেক দিন পর মালেক চাচার সঙ্গে দেখা। চেহারায় বয়সের ছাপ পড়ে গেছে। কপালে অগুনতি ভাঁজ। গলার নিচের চামড়া ঝুলে গেছে।
চোখ কোটরগত। মুখভরা উসকোখুসকো দাড়ি। কিছুটা বিস্ময় প্রকাশ করে বললাম, ‘মালেক চাচা, আপনি না রিকশা চালানো ছেড়ে দিয়েছেন?’
‘হুম্ম, ছাড়ছিলাম, আবারও চালানো শুরু করছি। ’
‘কিন্তু আপনার শরীরের যে অবস্থা দেখছি...’
‘কিচ্চু করার নেই। পেট তো চালাতি হবি, নাকি? যাগ গে এসব কথা, তা তুমি বাড়ি আইচো কবে?’
‘এই তো, কয়েক দিন হলো।
’
‘তা এখন তো বাড়িতেই যাবা, নাকি? দেরি না করে রিকশায় উইঠে পড়ো। ’ মালেক চাচার আহ্বানে বেশ দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে যাই আমি। এমন জীর্ণশীর্ণ মানুষটার ঘাড়ে চেপে বসতে কেমন যেন অস্বস্তি লাগে। তা ছাড়া বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার পর তিনি কিছুতেই ভাড়া নিতে চাইবেন না।
মালেক চাচার সঙ্গে পরিচয় আমাদের বহুদিনের।
একসময় বাবা তাঁর রিকশায় নিয়মিতই চলাচল করতেন। বছর চারেক আগে তিনি মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়লে রিকশা চালানো ছেড়ে দেন। এরপর বাড়িতে এলে তাঁর সঙ্গে খুব একটা দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি। যা হোক, তাঁর অনুরোধ অগ্রাহ্য করতে পারলাম না। একপর্যায়ে উঠতেই হলো তাঁর রিকশায়।
ওঠার কিছুক্ষণ পরই এক পশলা বাতাস কোত্থেকে এসে শরীরে স্পর্শ বুনে গেল। নাকে এসে লাগল রাস্তার পাশের আমের মুকুলের গন্ধ। সব মিলিয়ে এক অপার্থিব পরিবেশ চারপাশজুড়ে।
‘তো চাচা, এ বয়সে আবার রিকশা চালানো শুরু করেছেন কেন? আপনার তিন ছেলে আয়-রোজগার করে না?’ আমার প্রশ্ন শুনে খানিক চুপ রইলেন তিনি। হয়তো এ ধরনের প্রশ্ন শুনতে শুনতে তিনি ভীষণ ক্লান্ত, বিরক্ত।
‘ছেলেরা আছে তাঁদের মতন। বিয়েথা করে সবাই যার যার সংসার নিয়ে আলাদা হয়ে গেছে। বাপ-মায়েরে দেখার তাঁদের টাইম কই!’ মালেক চাচার কণ্ঠে চাপা অভিমান আর হতাশা। একটু বিরতি নিয়ে তিনি বলতে থাকেন, ‘মাঝে মাঝে মনে কী হয় জানো, ভাস্তে? মনে হয়, সব ছাইড়ে-ছুড়ে একদিক চইলে যাই। কিন্তু...’
‘কিন্তু কী?’ কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করি।
‘কিন্তু পারিনে খালি তুমার চাচির জন্যি! আমি চইলে গেলি বুড়ি বড্ড একা হইয়ে যাবি। তারে দেখার আর কেউ-ই থাকপিনে। ’ স্বগতোক্তির মতো আওড়ান তিনি। রাত ১০টায় মধুখালীর এ রাস্তায় শ্মশানের নীরবতা নেমে আসে। সেই নীরবতা-নিস্তব্ধতার পায়ে পায়ে মালেক চাচার রিকশা এগিয়ে চলে বাড়ির দিকে।
বি.দ্র. লেখাটি প্রথম আলোর 'ছুটির দিনে'র (৩১ মার্চ,২০১২) ঘর-মন-জানালা বিভাগে প্রকাশিত। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।