‘গণমাধ্যমের কার্যক্রম’ এবং ‘গণমাধ্যমকর্মীর দায়িত্ব পালনে প্রতিবন্ধকতা’ বর্তমানে আলোচিত বিষয়। গত দুই দশকে বিশ্বজুড়ে ঘটেছে তথ্যপ্রযুক্তির অভাবনীয় পরিবর্তন। তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে মানুষ সময় ও দূরুত্বকে করেছে জয়। বিশ্বকে এনেছে হাতের মুঠোয়। তথ্যপ্রযুক্তির অবদানের ফলে গণমাধ্যমের আজকের এ স্বর্ণযুগ।
গণমাধ্যমের ফলে আমাদের সংস্কৃতিতে পাচ্ছি ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের চলতি পরিস্থিতির খবরের সঠিকতা। গণমাধ্যমে ভিন্নতা আসায় রাষ্ট্র পরিচালনায় দায়িত্বে বসানো ব্যক্তি সম্পর্কে আমরা হতে পারছি কিছুটা হলেও সচেতন। আমাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে বিভিন্ন অঙ্গীকে উপস্থাপন করতে পারছি সহজ ও স্বাবলীলভাবে। বহির্বিশ্বের সঙ্গে করতে পারছি প্রতিযোগিতা।
গণমাধ্যমের দায়িত্ব হলো আমাদের সম্মুখে তুলে ধরা বাস্তব সমাজচিত্র ও নিরপেক্ষ তথ্যনির্ভর খবরা-খবর।
সাহিত্যকে যদি সমাজ দর্পণ বলা হয় তাহলে গণমাধ্যমকে বলা হয় বিশ্ব দর্পণ। বর্তমানে আমরা এও বলতে পারি, গণমাধ্যম জীবনযাত্রার চলমান অভিযান। সমাজের সভ্যতা ও সংস্কৃতির এবং প্রতিমুহুর্তে ঘটে যাওয়া ঘটনার গণমাধ্যম অন্য একটি দর্পণ। মনে হয় এ গণমাধ্যম আমাদের জীবনের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে আছে। গণমাধ্যম নদীর মতো আমাদের এ ক্ষুদ্র জীবনের সঙ্গে মিশে গিয়ে নিয়ে এসেছে সাগরের মতো গভীরতা।
জীবনকে করেছে গতিময়, ফিরিয়ে দিয়েছে সজীবতা।
বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে শুধু একটি সরকারি টিভি চ্যানেল ছিল। সরকারি ব্যবস্থাপনায় ও নিয়ন্ত্রণাধীন থাকায় এ চ্যানেলটির তেমন অগ্রগতি এবং উন্নয়ন সম্ভব হয়নি। এ চ্যানেলে কি আমরা সঠিক তথ্য পেয়ে থাকি? উল্লেখ্য, বিটিভিতে ‘এই দিন সেই সময়’ অনুষ্ঠানটির কতোটুকু যুক্তিকতা আছে? এ অনুষ্ঠানে যা উল্লেখ করা হয়, আমরা নিরপেক্ষ বিচার করলে দেখতে পাই, তার থেকেও ভয়াবহ অবস্থা বর্তমানে বিরাজমান। তাই বলতে পারি, ‘বিটিভি তুমি কার? যে যখন তখন তার’।
তাতে কি আমাদের সঠিক তথ্য উন্মোচন হওয়া সম্ভব? সঠিক তথ্য জানতে কি এ চ্যানেল যথাযথ? এ অবস্থার অবসান ঘটিয়ে বাংলা ভাষার প্রথম আন্তর্জাতিক স্যাটেলাইট চ্যানেল ‘এটিএন বাংলা’র যাত্রা শুরু হয় ১৫ জুলাই-১৯৯৭ সালে। এর পর থেকে এখন পর্যন্ত অনেক বেসরকারি চ্যানেলের আবির্ভাব হচ্ছে, যা আমাদের চাহিদা মেঠাতে অনেকটাই সক্ষম।
গণমাধ্যমের ফলে আমরা এখন হয়ে গেছি লাগামহীন ঘোড়ার মতো সঠিক ও নিরপেক্ষ তথ্যানুসন্ধানী। গণমাধ্যম চায় না, সেই স্বাধীনতার মধ্যে নিজের স্বার্থে কেউ লাগাম লাগিয়ে দেবে। কিন্তু কেউ ঘোড়ার মতো লাগাম লাগানোর চেষ্টা করলে গণমাধ্যম হয়ে যাবে দৌড়ের ঘোড়ার মতো, যার গতিনির্ধারণ করা তখন ওডিয়োমিটার দ্বারাও সম্ভব হবে না।
গণমাধ্যমকে অবশ্যই তার নিজস্ব গতিতে চলতে দিতে হবে, গণমাধ্যমকেও নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করবে তার দায়িত্বও গণম্যাধমকেই নিতে হবে। আশ্রয় পাবে না কোন পক্ষপাতিত্বের, তা না হলে গণমাধ্যমকে যে উদ্দেশে স্বাগতম জানাচ্ছি সে উদ্দেশ্যই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। গণমাধ্যমে রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের হস্তক্ষেপ মানে আমাদের তথ্য জনার অধিকারে হস্তপেক্ষ করা। গণমাধ্যম যেন না হয় কোনো ব্যক্তির হুমখির সম্মুখীন। কোনো গণমাধ্যম যদি রাজনৈতিক দলের সভা, মিটিং সরাসরি সম্প্রচার করে, অন্য রাজনৈতিক দলের উচ্চপর্যায়ের কোনো ব্যক্তি যদি বলেন, ‘আজকে যাদের সভা-মিটিং সরাসরি সম্প্রচার করা হচ্ছে, আমরাও ওইপর্যায় এলে আমাদেরও সভা-মিটিং সরাসরি সম্প্রচার করে কি না দেখবো? কথাটিও কি গণমাধ্যমের প্রতি এক ধরনের হুমখী নয়? তবে অবশ্যই গণমাধ্যমের দায়িত্বও সমদৃষ্টিতে সবাইকে বিচার করা।
সরকারি-বেসরকারি টিভি চ্যানেলে নাটকে ফুটে উঠে গ্রাম থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষের হাসি-কান্না, কুটবুদ্ধিসম্পূর্ণ জটিল সম্পর্কের চিত্র। বাঙালি জন্মসূত্রে কবি ও বাউল। বাউলের একতারার মধুর সুরে বেজে উঠে আনন্দ-ব্যদনা-সুখ-দুঃখ। টিভি চ্যানেলের খবরের মাধ্যমে জানতে পারি প্রতিমুহূর্তের খবর, পেছনের খবর সর্বোপরি খবরের পেছনের খবর। তার পেছনের নির্লসভাবে কাজ করে থাকে অক্লান্ত পরিশ্রমী, মেধাবী, সৎ, ন্যায়-নিষ্ঠাপরায়ণ গণমাধ্যমকর্মী।
সেই গণমাধ্যমকর্মীগদের দায়িত্ব পালনের প্রতিবন্ধকতা কালো মেঘের মতো ভর করছে। জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িছে? কেন জানি, সাম্প্রতিক সময়ে স্বাভাবিকভাবে হোক এবং অস্বাভাবিকভাবেই হোক গণমাধ্যমকর্মীর ওপর নেমে এসছে মেঘের ঘনঘটা। গণমাধ্যমকর্মীর ওপর যতোটুকু না ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করছে তার থেকে অসনিসংকেত নিয়ে আসছে পুরো গণমাধ্যমের ওপর। হঠাৎ করে আকাশ থেকে উল্কা এসে পড়ে, আকাশের ক্ষতস্থান অপূরণীয় থেকে যায়। গণমাধ্যমকর্মীর জীবন মেঘের বজ্রপাতের মতো অকাল প্রাণনাশও গণমাধ্যমের জীবনকে করছে রুগ্ন।
সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা ‘তারেক মাসুদ’ এবং মিশুক মুনীর। ‘কাগজের ফুল’ চলচিত্র নির্মাণ করতে গিয়ে নিজেই তাজা ফুল গাছ থেকে ঝরে পড়ে গেলেন। যিনি আমাদের দেশের একটি সম্পদ। কালের কণ্ঠের দৈনিক পত্রিকার সিনিয়র রিপোর্টার ‘নিখীল চন্দ্র ভদ্র’ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আজো নিজের জীবনের সঙ্গে লড়ছেন। ‘আমাদের সময়’ দৈনিক প্রত্রিকার রিপোর্টার দীনেশ রায় দায়িত্ব পালনে নিজ পরিবার রেখে পরপারে চলে যান।
সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি যারা অন্যদের খবর নিয়ে খবরে খবর ছাপান, আজকে তারাই খবরের শিরোনামে তাজা খবর হয়ে উঠছেন। যে হত্যাকা- দেশব্যাপী নাড়া দিচ্ছে। চিন্তার বিষয় হয়ে উঠে গণমাধ্যমে। এ দম্পতির রেখে যাওয়া আদরের দুলাল অবুঝ শিশু মেঘের জীবন কি হবে? প্রধানমন্ত্রী কেন? জাতিসংঘের মহাসচিবও যদি মেঘের দাযিত্ব নেন, তা হলেও কোনো অংশে অবুঝ শিশুর দঃখের ক্ষত কমবে না। কখনো মুছবে না, খুনিদের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে পড়ে থাকা নিজ মা-বাবার লাশের কথা।
এ যেন মেঘের জীবনে দুঃখের কালো ছায়া। যে কালো ছায়া মেঘের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে বিষীয়ে তুলবে।
কিছুটা হতবাক করেন, কিছুটা ভাবীয়ে তুলেন গণমাধ্যমকর্মীদের। জন্মীলে মরিতে হবে, এটিই চিরন্তন সত্য। কিন্তু সে মৃত্যুটি যেন স্বাভাবিকভাবে হয় এটিই সবার কাম্য।
গণমাধ্যমকর্মীরা হবেন যোদ্ধার মতো সাহসী এবং এভারেস্ট জয়ীর মতো থাকবে মনোবল। বর্তমানে কাজ করতে গিয়ে তারা বারেক ফিরে চায়। কি যেন ভয় তাড়া করে ফিরে। কি যেন দিব্যমান সাহসী চলার পথে পিছুটানে। কি যেন ভয় ভয় মনের মাঝে বাসা করে নেয়।
গণমাধ্যমকর্মীদের চলার পথে থাকবে না কোনো কাটা, পথ হবে প্রশস্ত, পথে থাকবে না কোনো বন্ধুরতা।
কোনো ঘটনা ঘটার পর ওই ঘটনা হয়ে পড়ে টিভি চ্যানেলের টকশোর উপকরণ। চলতে থাকে সভা মিটিং। সরকার কর্তৃক গঠন করা হয় তদন্ত কমিশন। আবার কখনো বা উচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক ব্যক্তিরা কর্তৃক ঘোষণা করা হয় ‘২৪, ৪৮, ৭২ ঘণ্টার মধ্যে অপরাধীদের আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে।
’ যদিও এ ‘সময়’ স্বাভাবিক সময়ের সঙ্গে তুলনা করা যায় না। এ সময়ের হিসাব আমাদের জানা নেই। সময় বেঁধে দিলেন আর তদন্ত কমশিন গঠন করলেন, দায়িত্ব শেষ হয়ে গেল? বিরোধী দল কর্তৃক করা হয়ে থাকে নিন্দা বা প্রতিবাদ সভা। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে জানানো হয় সমব্যদনা এবং তার সঙ্গে মাঝেমধ্যে কখনো দেয়া হয় সামান্য আর্থিক সাহায্য। অধিকাংশ ঘটনার ক্ষেত্রে এভাবেই হয়ে থাকে পরিসমাপ্তি।
আবার কখনো বা দৈনিক পত্রিকায় থেকেও ঘটনাটি বিলীন হয়ে যায়। বছরের পর বছর ধরে ওই ঘটনাটির দিন প্রত্রিকার পাতায় কিছু লেখালেখি হয়ে থাকে। সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে কোনো একদিন তাও আর লেখা হয়ে উঠে না। ভুলে যাই। এমন ভুল, যেন মনে হয়; কোনোদিনই এ ঘটনাটি আমরা শুনেনি।
আর ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার? হয়তো তার ওপর নির্ভরশীল ছিল পরিবারের প্রতিটি সদস্য। তাদের জ্বলে-পুড়ে মরতে হয় মাসের পর মাস, বছরের পর বছর একটি সুষ্ঠু বিচারের আশায়। অবশেষে ঘরে ফিরতে হয় ব্যর্থতার থলে নিয়ে। দুঃখের দহনে ক্ষয়ে ক্ষয়ে শেষ হয় জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত।
আমরা চাই না, কারো অবহেলার জন্য গণমাধ্যমকর্মীদের মনে কোনো ধরনের ভয়ের জন্ম হোক।
দায়িত্ব পালনে পিছপা হোক। বিশ্বায়ন মূলত একটি সর্বব্যাপী ও সার্বক্ষণিক চলমান প্রক্রিয়া। তথ্যপ্রযুক্তি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসারের জন্য গণমাধ্যম পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি মানুষকেই একটি একীভূত বিশ্বব্যবস্থায় মিলিত করছে। আমরাও কষে পড়তে চাই না এ বিশ্বব্যবস্থার উন্মুক্ত আসর থেকে। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে গণমাধ্যমের সাহসী অভিযাত্রাকে অভশ্যই স্বাগতম জানাই।
আর তার একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছে গণমাধ্যমকর্মীরা। গণমাধ্যমকর্মীদের দিতে হবে সমাজের একটি বিশেষ মর্যাদা। দিতে হবে তাদের চলার পথে স্বাধীনতা। করতে হবে তাদের জীবনের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা। তাদের পথকে করতে হবে কাঁটামুক্ত।
রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের অপকর্মের কথা অপমুক্ত করতে গিয়ে কোনো গণমাধ্যমকর্মীকে যেন কারোর হুমখির সম্মুখীন না হতে হয়। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।