বয়ে চলা সময়কে ধরে রাখার একটা প্রয়াস তখন অনেক ছোট আমি, ক্লাস থ্রি কিংবা ফোরে পড়ি, ২০০০ বা ২০০১ সাল। বড়ভাইয়ের বদৌলতে বই পড়ার অভ্যাস তৈরী হয়ে গেল। আর আমার দুলাভাই ছিলেন বইয়ের পোকা,তার বইয়ের কালেকশন যেমন বিশাল তেমনি অবাক করার মত। তখন বিভিন্ন ধরনের বই পড়ছি। দুলাভাইয়ের ছোটভাই একদিন হাতে তুলে দিলেন একটা চিকন কিন্তু ভারি বই, অবাক হয়ে দেখলাম বইটার পেইজ একদম অন্যরকম আর মুদ্রণ অসাধারণ।
লেখকের নামটা খুব অদ্ভুত -- ইয়ে. পেরেলম্যান আর বইয়ের নাম অঙ্কের মজা,প্রকাশ পেয়েছে মস্কো থেকে ! পড়া শুরু করলাম, অনেক অংশই বুঝলাম না,কিন্তু কিছু গণিতের গল্প ছিল,যেগুলো অনেক মজার। নেশা চেপে গেল।
ভাইয়াকে বইটা দেখানোর পর জানলাম যে ঐ বইগুলো আসলে রাশিয়া (তখনকার সোভিয়েত ইউনিয়ন) থেকে আসে, অনুবাদ করানো হয় মূলত পশ্চিমবঙ্গের লোকদের দিয়ে,বাংলাদেশের মনে হয় একজনই ছিল (হায়াৎ মামুদ)। এদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল মস্কোতে, এরাই সোভিয়েত সাহিত্যগুলো অনুবাদ করে দিত বাংলায়। কোল্ড ওয়্যারের সময় ওরা নিজেদের ভাবধারা আর কালচারকে বাইরের পৃথিবীর সাথে পরিচিত করে দেবার জন্য এই উদ্যোগ নিয়েছিল।
অনেক ধরনের বইয়েরই অনুবাদ করা হয়েছিল ওই সময় - চিরন্তন সাহিত্য,বিজ্ঞান,সমাজতন্ত্র,সাইন্স ফিকশন আরও অনেক। '৯০ এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আর বই আসে নি।
আমার স্কুলের কাছেই ছিল সোনাদিঘি মোড়ের পুরাতন বইয়ের মার্কেট (এটা রাজশাহী শহরে নীলক্ষেতের ইকুইভ্যালেন্ট)। আস্তে আস্তে রাশিয়ান বই কালেক্ট করা শুরু করলাম,যাদের সংগ্রহে ছিল তাদের কাছ থেকে নিয়ে পড়া শুরু করলাম। ম্যাক্সিম গোর্কির 'মা' আর বিখ্যাত ছোটগল্পগুলো।
আর রাশিয়ান 'আলেকজান্ডার বালায়েভ' এর 'উভচর মানব' তো একটা ক্ল্যাসিক বই। [এবারের বইমেলায় দেখলাম এটাকে কোন এক পাবলিকেশন যেন প্রকাশ করছে,আসল বইটার পুরা নকল করে অনুবাদক হিসেবে একজন বাংলাদেশির নাম লেখা কিন্তু আসলটা ননী ভৌমিকের ছিল ]
পরে জানলাম, শুধু রাশিয়ানরা না -- আমেরিকান,চাইনিজ,কোরিয়ান এরাও বাইরের দুনিয়ার সাথে নিজের দেশকে ও ভাবাদর্শকে পরিচিত করানোর জন্য ওদের চিরন্তন সাহি্ত্যগুলো বিশ্বের বিভিন্ন ভাষার অনুবাদ করে নাম-মাত্র মূল্যে ছেড়ে দিত। ২০০৬ সালে নীলক্ষেতে একটা মার্কিন বাংলা বই দেখেছিলাম। আর ছোটবেলায় পড়া অনেক ছবিওয়ালা রূপকথার বইগুলো ছিল চাইনিজ। চাইনিজ বইগুলোও সুন্দর ছিল।
অসাধারণ ছবি আর গল্প।
দুলাভাই তার কালেশন থেকে পড়তে দিতেন কিন্তু তার রাশিয়ান বইগুলোর ওপর বিশাল লোভ ছিল, বুঝতে পেরে কয়েকটা বই একেবারে আমাকে আর ভাইয়াকে দানই করে দিলেন। দিলেন নিকোলাই গোগোলের 'তারাস বুলবা',অসাধারণ একটা বই। (শুনেছি, এটার ওপর সালমান খান নাকি 'ভির' নামের একটা সিনেমা করেছে,দেখি নাই,দেখার ইচ্ছাও নাই ) ।
বয়স বাড়ার সাথে অন্য ধাঁচের বই পড়া শুরু করলাম।
সোনাদিঘির মোড় থেকে কিনলাম 'সমাজতন্ত্রের অ-আ-ক-খ' । আমার মনে হয় সমাজতন্ত্রের ওপর রাশিয়ান লেখকদের একটা বিশাল অংশ অনুবাদ করা হয়েছিল। ভাইয়ার এক বন্ধুর ছিল এইসব সমাজতান্ত্রিক বইয়ের বিশাল কালেকশন।
দুলাভাইয়ের ছোটভাই আমার হাতে এবার তুলে দিলেন 'ব. সারগেইভের শারিরতত্ত্ব সবাই পড়ো',অদ্ভুত একটা বই, আরও অদ্ভুত এর ইনফরমেশন গুলো। 'মানুষের অ্যানাটমি ও ফিজিওলজি' আরেকটা অদ্ভুত বই (এটা ছিল না আমার কাছে,কিছুদিন আগে নীলক্ষেতে কিনলাম ৭০টাকা দিয়ে)।
পদার্থবিজ্ঞানের ওপর পড়া সেরা বই ছিল 'লেভ লান্ডাউ' এর 'সবার জন্য পদার্থবিদ্যা' বইটা - এটা চার খন্ডের একটা বই। পরে জানতে পারি লেখক একজন নামকরা বিজ্ঞানী আর তার লেকচারগুলো অনেকটা মার্কিন 'ফেইনম্যান লেকচারের' সমতুল্য। (কালেকশনে রাখতে পারেন, নীলক্ষেতে একটা দোকানে দেখলাম কয়েকদিন আগে,১২০ করে চাচ্ছে প্রতি খন্ড)। আর ২০০৮ এ একদিন ৩০ টাকা দিয়ে কিনলাম 'Universal Physical Constants' নামের একটা বই, বিভিন্ন ধ্রুবক যেমনঃ G,h এদের গল্প। পয়সা উসুল করা বই।
আরও কত বই পড়েছি মনে নাই।
শুধু বাংলা বই যে আসতো তা না। রাশিয়া আর কোরিয়ার বেশ কিছু ইংলিশ বইও আছে আমার আর আমার ভাইয়ের কালেকশনে। সেগুলোর কথা আরেকদিন বলব।
আমার অনেক স্মৃতি আছে বইগুলো নিয়ে।
তাই যখনই রাজশাহীর সোনাদিঘি বা ঢাকার নীলক্ষেতের ফুটপাতে হাঁটি তখন চোখ রাখি পুরাতন বইগুলোর দিকে। এই বইগুলো হচ্ছে ছাই চাপা আগুন, কখন ভাল একটা বই বের হয়ে যায় কে জানে ! আমার স্মৃতিগুলো শেয়ার করলাম। রাশিয়ান বইগুলো নিয়ে অন্যদের কাছ থেকে কিছু শুনতে চাই
পিঃ এসঃ গুগল করে কয়েকটা ভাল লিঙ্ক পেলাম
১. অনুবাদক অরুণ সোমের সাথে সাহিত্য-সংলাপ
২. নতুনভাবে বের হচ্ছে চিরায়ত রুশ সাহিত্য ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।