ভালবাসি
ভারতকে বাংলাদেশের ভূখ- ব্যবহার করে ট্রানজিট দেয়া নিয়ে সরকারের মধ্যে লুকোচুরি চলছে। এ ব্যাপারে বিভিন্ন দপ্তর ও ব্যক্তি একেক সময় একেক কথা বলছেন। তাদের মধ্যে এ নিয়ে কোনো সমন্বয় নেই। কেউ বলছেন, দীর্ঘমেয়াদি ট্রানজিটের কথা। কারো বক্তব্য, পরীক্ষামূলক স্বল্পমেয়াদি সুবিধা দেয়া হোক।
এ কারণে সরকারের শীর্ষ মহলও বিভ্রান্ত। অন্যদিকে ট্রানজিট বিষয়ক কোর কমিটি বলেছে, ট্রানজিট সুবিধা পেলে তিন ধরনের লাভ করবে ভারত। তাই এ লাভের অংশে বাংলাদেশের অধিকার আছে। ফলে বাংলাদেশকে লাভের ভাগ দিতে হবে। তাদের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ভারতের পণ্য ভারতেই যাবে।
এতে ভারতের আর্থিক লাভ হবে। একইভাবে ভারত তার পণ্য নিয়ে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে সংক্ষিপ্ত পথে যাবে। এতেও ভারতের আর্থিক লাভ হবে। তাই এ লাভের একটা অংশ বাংলাদেশকে দিতে হবে। এছাড়া ভারতের পণ্য পরিবহনের জন্য অবকাঠামো উন্নয়নে বাংলাদেশকে বিনিয়োগ করতে হবে।
এ বিনিয়োগের অর্থ ভারতের কাছ থেকেই আদায় করতে হবে। এ জন্য বাংলাদেশকে পণ্য পরিবহনের চার্জ দিতে হবে। এছাড়াও ভারতীয় পণ্য পরিবহনের কারণে বাংলাদেশের পরিবেশ ও প্রতিবেশসহ বেশ কিছু ক্ষতি হবে। যার জন্য ভারতকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। কিন্তু সরকারের একটি অংশ এই প্রস্তাব মানতে নারাজ।
তারা ফি ও চার্জ নেয়ার যে সুপারিশ করা হয়েছে তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করছেন। তারা চান নামমাত্র ফি নিয়ে ভারতকে ট্রানজিট দেবে। অথচ এক দেশের ওপর দিয়ে আরেক দেশের পণ্য পরিবহনের জন্য আন্তর্জাতিক আইনে চার্জ নেয়ার বিধান আছে। গ্যাট ১৯৯৮ এর আর্টিক্যাল-৫ এ বলা হয়েছে, কোনো দেশের পণ্য আরেক দেশের ওপর দিয়ে পরিবহন করলে চার্জ দিতে হবে। ফলে এই আইনের বলেই বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ভারত বা অন্য যে কোনো দেশ পণ্য পরিবহন করলে বাংলাদেশ সার্ভিস চার্জ নিতে পারবে।
তবে বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তির ধারায় বলা হয়েছে, এক দেশ আরেক দেশের নৌ, সড়ক এবং রেলপথ ব্যবহার করে পণ্য পরিবহন করতে পারবে। সেখানে সার্ভিস চার্জের বিষয়ে কিছুই বলা হয়নি। এখন ভারত এ চুক্তির আলোকে চাইছে বিনা চার্জে তাদের পণ্য পরিবহন সুবিধা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওই চুক্তিতে যেহেতু চার্জের বিষয়ে কিছু বলা হয়নি, তাই বাংলাদেশ চাইলেই এখন চার্জ দাবি করতে পারে। আর তা করতে না পারা হবে তাদের কূটনৈতিক ব্যর্থতা।
তাছাড়া ভারতের সাথে বাংলাদেশের সড়ক এবং রেলপথ ব্যবহার করা বিষয়ক কোনো চুক্তিও নেই। তাই এ দু'পথে পণ্য পরিবহন করতে হলে বাংলাদেশ-ভারতকে একটি চুক্তির আওতায় আসতে হবে। আর সে চুক্তিটি হতে হবে ট্রানজিট প্রোটকলের আওতায়। উল্লেখ্য, বর্তমানে বাংলাদেশের সাথে ভারতের নৌ-পথে পণ্য পরিবহনের জন্য ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট প্রোটকল আছে। যার সংক্ষিপ্ত নাম হচ্ছে আইডবিস্নউটিটি।
যা সম্প্রতি নবায়ন করা হয়েছে। তবে কোর কমিটি চুক্তি নবায়নের বিরোধিতা করে। তাদের বক্তব্য ছিল, আলাদা কোনো চুক্তি না করে এটিকে ট্রানজিটের আওতায় নিয়ে আসা। কোর কমিটির প্রস্তাবে আরো বলা হয়েছে, বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে আইডবিস্নউটিটি চুক্তিটি সংশোধন করে ট্রানজিট প্রোটকলে নিতে হবে। প্রয়োজনে পরীক্ষামূলকভাবে স্বল্পকালীন ট্রানজিট সুবিধা দেয়ার জন্য বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক চুক্তি করা যেতে পারে।
কিন্তু ভারত তা মানতে রাজি নয়। ভারত ট্রানজিটের আওতায় চুক্তি না করে দীর্ঘমেয়াদি দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক চুক্তি করতে আগ্রহী। জানা গেছে, ২০১১ সালের ডিসেম্বরে ট্রানজিট বিষয়ক কোর কমিটি প্রথম তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়। এরপর সরকারের পক্ষ থেকে তা পুনরায় যাচাই-বাছাই করার জন্য ফেরত পাঠানো হয়। এরপর চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে দ্বিতীয় দফায় কোর কমিটি তাদের প্রতিবেদন সরকারের কাছে পাঠায়।
কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, বিদ্যমান পরিবহনের জন্য যে অবকাঠামো রয়েছে, তাতে আগামী দু-তিন বছরের মধ্যে পুরোপুরিভাবে প্রতিবেশী দেশগুলোকে ট্রানজিট দেয়া ঠিক হবে না। এ ছাড়াও বর্তমানে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে যে সমঝোতা স্মারক রয়েছে, সেগুলোও পুরোপুরি ট্রানজিটের জন্য উপযোগী নয়। পাশাপাশি বেশকিছু আইনগত বিষয় ভাবনার প্রয়োজন রয়েছে। একই সঙ্গে ট্রানজিট দেয়ার জন্য স্থল, রেল ও নৌ-পথকে উপযোগী করতে বিনিয়োগের জন্য বর্তমানে প্রায় ৫২ হাজার ৫৩৯ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা প্রয়োজন। সুপারিশে আরো বলা হয়েছে, স্বল্প পরিসরে ট্রানজিট সুবিধা দেয়া হলেও দীর্ঘমেয়াদে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা ছাড়া পুরোপুরি ট্রানজিট দেয়া ঠিক হবে না।
ট্রানজিট দিতে হলে বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষকে আরো আধুনিকায়ন ও উন্নত করতে হবে। এর পাশাপাশি বিদ্যমান কাস্টম আইনকেও সংশোধন করতে হবে। সর্বোপরি সরকারকে ট্রানজিটের সুবিধাভোগীদের সঙ্গে সমঝোতা করতে বিদ্যমান যে চুক্তি রয়েছে তা আরো যুগোপযোগী করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজনে উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করতে হবে। জানা গেছে, বিদ্যমান দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তির মতো বিভিন্ন চুক্তিকে যুগোপযোগী করার সুপারিশ রেখেছে কোর কমিটি।
প্রয়োজনে একটি 'জাতীয় ট্রানজিট কর্তৃপক্ষ' গঠন করা যেতে পারে। যে কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ট্রানজিটের পুরো বিষয়টি পর্যবেক্ষণ এবং সময় সময় পর্যালোচনা ও মনিটরিং করা হবে। ট্রানজিটের বিষয়টি সাময়িক নয়, যে কারণে ট্রানজিটের বিভিন্ন সুবিধা যাতে বাংলাদেশ, ভুটান ও নেপাল পেতে পারে তার জন্য একটি আঞ্চলিক পরিপূর্ণ চুক্তির প্রয়োজন রয়েছে। কমিটি ৬২ পৃষ্ঠার চূড়ান্ত প্রতিবেদনে ২৫টি বিষয়ে বিস্তারিত উল্লেখ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে ট্রানজিটের রুট চিহ্নিত করা, বিনিয়োগের স্থানগুলো চিহ্নিত করা, আঞ্চলিক ট্রানজিট চুক্তি করা, ট্রানজিট ফি নির্ধারণ করা, ট্রানজিটের অর্থনৈতিক সফলতা ও ঝুঁকি, পরিবেশের জন্য বিপজ্জনক বিষয়, অভ্যন্তরীণ দায়দায়িত্ব ইত্যাদি।
কমিটি সড়কপথে ট্রানজিটের রুটগুলো মানচিত্রসহ চিহ্নিত করেছে। একই সঙ্গে এসব রুটে কি ধরনের যানবাহন চলবে ও তার ফি কত হবে, সে ব্যাপারেও সুপারিশ করেছে। এর পাশাপাশি রেলপথ ও নৌ-পথের রুটগুলো ফিসহ উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়াও চট্টগ্রাম বন্দর, মংলা বন্দর, স্থলবন্দরের বিদ্যমান অবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে এ প্রতিবেদনে। একই সঙ্গে কোথায় কি পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগের প্রয়োজন রয়েছে তাও উল্লেখ করা হয়েছে।
কমিটি ট্রানজিটের সঙ্গে আগামী দিনের পদ্মা বহুমুখী সেতুকেও অন্তর্ভুক্ত করেছে। কমিটি ট্রানজিট ফি যেভাবে নির্ধারণ করেছে তাতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন দেশের উদাহরণ টানা হয়েছে। একই সঙ্গে বিদেশি মোটরযান চলাচলের ওপরে কী ধরনের ফি হওয়া উচিত, সে বিষয়টি কমিটির প্রতিবেদনে স্পষ্ট করা হয়েছে। এর পাশাপাশি অর্থনৈতিক ভিত্তি তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে। বিশেষ করে ট্রানজিটের ফলে বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশ কীভাবে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে লাভবান হতে পারে তার একটি ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ রয়েছে এতে।
বিশেষ করে যে পরিমাণ বিনিয়োগ প্রয়োজন, ট্রানজিটের ফলে সে বিনিয়োগের সুফল কত দিনে কীভাবে পাওয়া যেতে পারে তারও একটি সারমর্ম তুলে ধরা হয়েছে কমিটির প্রতিবেদনে। ফি হিসেবে কাস্টম সার্ভিস চার্জ, বিদেশি মোটরযান প্রবেশ ফি, রাস্তা মেরামত ফি, নিরাপত্তা ফি, বায়ুদূষণ ফি ও শব্দদূষণ ফি কত হতে পারে সে বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। এ বিষয়ে বাণিজ্য সচিব গোলাম হোসেন যায়যায়দিনকে বলেন, ট্রানজিট চুক্তির ব্যাপারে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এখনো একমত হয়নি। ফলে এ নিয়ে মন্ত্রণালয়ের ভাবনাও নেই। কোর কমিটি যে প্রস্তাব দিয়েছে তা এখন প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে আছে।
তিনি আরো বলেন, যে কোনো দেশের সাথে চুক্তির আগে আলোচনা হয়। ফলে ট্রানজিট নিয়েও বাংলাদেশ-ভারত আলোচনা হবে। এ আলোচনা থেকেই একটা ফল বের হয়ে আসবে। কোর কমিটির সদস্য ড. রহমতউল্লাহ বলেন, তারা যে প্রস্তাব দিয়েছেন, সে প্রস্তাবে বলা হয়েছে ট্রানজিট দিলে ভারতের তিন ধরনের লাভ হবে। এ লাভের অংশে বাংলাদেশের দাবি আছে।
তাই ভারতকে এ লাভের অংশ বাংলাদেশকেও দিতে হবে। আর এক দেশের পণ্য আরেক দেশের ওপর দিয়ে সে দেশেই নেয়া হলে তাকে ট্রানজিট বলা যায় না। ট্রানজিট বলতে হলে অন্তত তিনটি দেশের অংশগ্রহণ থাকতে হয়। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।