আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নজিরবিহীন সব অনিয়ম

নজিরবিহীন একের পর এক অনিয়মের মাধ্যমে ঋণ দিয়ে বেসিক ব্যাংক আমানতকারীদের অর্থ মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। একই সঙ্গে ব্যাংকটি ঋণের সুদ আদায় না করেই আয় হিসাবে তা দেখিয়ে ব্যাংকের আসল চেহারা আড়াল করেছে।
সাড়ে চার বছর ধরে এসব নজিরবিহীন অনিয়ম করে চলেছে বেসিক ব্যাংক। এ নিয়ে ব্যাংকিং মহলে ব্যাপক আলোচনা থাকলেও বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। তবে পরিস্থিতি সংকটপূর্ণ হয়ে উঠলে ব্যাংকটির বিভিন্ন শাখায় পরিদর্শন চালিয়ে নানা অনিয়ম চিহ্নিত করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।


পরিদর্শন শেষে বাংলাদেশ ব্যাংক বেসিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে (এমডি) এ-সংক্রান্ত একটি চিঠি দিয়েছে। গত ১৯ জুন ব্যাংকের গুলশান শাখা নিয়ে দেওয়া একটি চিঠিতে নজিরবিহীন সব ঋণ বিতরণ, ঋণ প্রস্তাব আসার আগেই বা দ্রুততার সঙ্গে ঋণ অনুমোদন, অস্তিত্বহীন বা ভুয়া ও কাগুজে প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়ার একাধিক উদাহরণ দেওয়া হয়েছে। ১৫ জুলাইয়ের মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা পালন করে জানাতেও বলা হয়েছে চিঠিতে।
২০১৩ সালের শুরুতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেসিক ব্যাংকের গুলশান, দিলকুশা, শান্তিনগর ও রাজশাহী শাখাতে বিশেষ পরিদর্শন কাজ চালায়। এরপর গত ১২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে করণীয় নির্ধারণ করে চিঠি দেওয়া হয় এমডি কাজী ফখরুল ইসলামকে।

এর একটি জবাব এমডি দিলেও বাংলাদেশ ব্যাংক তাতে সন্তুষ্ট হয়নি। সর্বশেষ ১৯ জুন দেওয়া চিঠিতে বাংলাদেশ ব্যাংক বেসিক ব্যাংকের এমডিকে তীব্র ভাষায় ভর্ৎসনা করেছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘আপনাদের বক্তব্য বাস্তবতা ও ব্যাংকিং রীতিনীতি বিবর্জিত, যা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। ’
কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, অস্তিত্ব-বিহীন কাগুজে, বেনামি ও কর্মচারীর নামে তৈরি প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়া, ঋণ ছাড় করার শর্ত পালন না করা, ঋণ হিসাবের বিপরীতে কোনো আদায় না থাকলেও নিয়মিত সুদ চার্জ করে তাকে আয় দেখানো, চাতুরির মাধ্যমে পুনঃতফসিল ছাড়াই ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বাড়িয়ে খেলাপি না দেখানো এবং বিধিবহির্ভূতভাবে ঋণের নামে বিপুল অর্থ আত্মসাতের সুযোগ করে দিয়েছে বেসিক ব্যাংক। এ জন্য শাখা ব্যবস্থাপকসহ প্রধান কার্যালয়ের ঋণ কমিটি ও প্রধান কার্যালয়ের ঋণ ছাড়করণ কমিটির সদস্যদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়ে তা জানাতে বাংলাদেশ ব্যাংককে জানাতে বলা হয়েছে।


বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ ১৯ জুনের চিঠির বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে বেসিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কাজী ফখরুল ইসলাম গত ২৭ জুন আর কিছু না লেখার জন্য বলেছিলেন। ওই দিনই প্রথম আলোতে ছাপা হয়েছিল বেসিক ব্যাংকে বড় জালিয়াতি শীর্ষক প্রতিবেদন। তবে গতকাল অনেক চেষ্টা করেও এমডির ফোনে যোগাযোগ করা যায়নি। এমডি ও আরও দুজন ডিএমডিকে মুঠোফোনে খুদে বার্তা পাঠিয়েও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
ঋণের টাকা ভাগাভাগির উদাহরণ: বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের ১২ ফেব্রুয়ারি পাঠানো চিঠিতে বলেছে, এআরএসএস এন্টারপ্রাইজ ও ব্রাদার্স এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারীরা পরস্পরের মামা-ভাগনে।

এই মামা-ভাগনে এক কোম্পানির নামে ঋণ নিয়ে আরেক কোম্পানিতে ও ভিন্ন খাতে ব্যবহারও করেছে।
১৯ জুনের চিঠিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, উভয় প্রতিষ্ঠানকেই ঋণ দিতে অনীহা প্রকাশ করে বেসিক ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে বিরূপ মন্তব্য করা হয়েছিল। তা সত্ত্বেও ব্রাদার্স এন্টারপ্রাইজের ২০১২ সালের ২৭ মার্চের প্রস্তাবে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ২৮ মার্চ ৬০ কোটি টাকার এসওডি ঋণ অনুমোদন করে। একইভাবে এআরএসএস এন্টারপ্রাইজের ২০১২ সালের ১৬ জানুয়ারির প্রস্তাবে ১৮ জানুয়ারি পর্ষদ ৫০ কোটি টাকার এসওডি, ১০ কোটি টাকার এলসি বা ঋণপত্র (পিএডি বা রপ্তানি দলিলাদির বিপরীতে অগ্রিম) ও পাঁচ কোটি টাকার এলটিআর (বিশ্বাসের ঋণ) অনুমোদন করে। পরবর্তীকালে গ্রাহকের ১৯ এপ্রিলের আবেদনে, শাখার একই দিনের প্রস্তাবে পরিচালনা পর্ষদ ওই দিনই এসওডি ৯৫ কোটি টাকায় বৃদ্ধি করে।

এসওডি হলো একধরনের ঋণ, যার বিপরীতে ১০০ ভাগ নগদায়নের মতো অর্থাৎ সঞ্চয়পত্র ও এফডিআর জাতীয় জামানত থাকার কথা। বেসিক ব্যাংক এসব জামানত না নিয়ে তার ব্যবসায়িক পণ্যের বিপরীতে এসওডি দিয়ে থাকে। তবে এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শক দল মজুতের তালিকা শাখাতে পায়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের চিঠি অনুযায়ী, এআরএসএস এন্টারপ্রাইজের ধানমন্ডির ঠিকানায় প্রতিষ্ঠানটির একটি নামফলক থাকলেও তা মূলত আর্কেড রিয়েল এস্টেটের অফিস। এই দুই প্রতিষ্ঠানেরই স্বত্বাধিকারী একই ব্যক্তি।

প্রতিষ্ঠানটির নামে নেওয়া ঋণের অধিকাংশ অর্থই আর্কেড রিয়েল এস্টেটের নামে স্থানান্তর করা হয়েছে। এই অর্থ দিয়ে রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় ব্যবহার করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক চিঠিতে বলেছে, ‘ঋণের অর্থ ভিন্ন খাতে ব্যবহার করা হয়েছে। ’
এই ঋণের কোনো অর্থ ফেরত বা জমা না পড়লেও ১২ কোটি ৯০ লাখ টাকার সুদ আয় দেখিয়েছে বেসিক ব্যাংক। ঋণটি আদায়ের সম্ভাবনা ক্ষীণ উল্লেখ করে বাংলাদেশ ব্যাংক চিঠিতে একে খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত করতে নির্দেশ দিয়েছে ফেব্রুয়ারির চিঠিতে।

একই সঙ্গে অনাদায়ী সুদ স্থগিত সুদ হিসাবে স্থানান্তর করতে বলা হয়েছে।
ব্রাদার্স এন্টারপ্রাইজের ধানমন্ডির ঠিকানায় গিয়েও বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন দল দেখেছে এটি একটি আবাসিক ঠিকানা। বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, এআরএসএস এন্টারপ্রাইজ ও ব্রাদার্স এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী পরস্পর মামা-ভাগনে। এই প্রতিষ্ঠানটির নামে নেওয়া ঋণের বেশ কিছু পরিমাণ অর্থ আর্কেড রিয়েল এস্টেটের নামে স্থানান্তর করা হয়েছে। এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারীকে প্রশ্ন করা হলে তিনি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শক দলকে জানিয়েছেন, তিনি ও তাঁর মামা একসঙ্গে ব্যবসা করেন।

তাই ব্যবসায়িক প্রয়োজনে মাঝেমধ্যে একজনের হিসাবের টাকা অন্যজনের হিসাবে স্থানান্তর করা হয়ে থাকে। এ ছাড়া ঋণের অর্থ থেকে পে-অর্ডারের মাধ্যমে জমি কিনতে ব্যয় করা হয়েছে। এই জমি আবার কয়েক গুণ বেশি মূল্য দেখিয়ে প্রতিষ্ঠানটির ঋণ হিসাবের বিপরীতে এবং কিছু জমি এআরএসএস এন্টারপ্রাইজের ঋণের বিপরীতে বন্ধক রাখা হয়েছে।
ফেব্রুয়ারি মাসে লেখা চিঠিতে এই ঋণ আদায়ের সম্ভাবনা ক্ষীণ উল্লেখ করে একে সন্দেহজনক পর্যায়ে খেলাপি চিহ্নিত করা এবং আয় খাতে স্থানান্তরিত অনাদায়ী সুদ স্থগিত সুদ হিসাবে স্থানান্তর করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বেসিক ব্যাংক তা মানেনি।


এরপর ১৯ জুনের চিঠিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, ‘আপনারা নিম্নমানে শ্রেণীকরণ করেছেন বলে জানিয়েছেন, যা গ্রহণযোগ্য নয়। সরেজমিনে পরিদর্শনেও প্রতিষ্ঠানটির অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। এভাবে বেনামি ও অস্তিত্ববিহীন ঋণের নামে বিপুল অর্থ আত্মসাতের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। ’
বাংলাদেশ ব্যাংক আরও বলেছে, বেসিক ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় শাখাকে ক্লিন সিআইবি (কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণ তথ্য ব্যুরোর প্রতিবেদন) নিয়ে ব্রাদাসের ঋণ ছাড় দিতে বললেও শাখা ২০১২ সালের ৩০ এপ্রিল ২৯ কোটি ৪০ লাখ টাকা সিআইবি না নিয়েই ছাড় করে। আবার ৩০ এপ্রিলের সিআইবি প্রতিবেদনে ব্রাদার্স এন্টারপ্রাইজকে ক্ষতিজনক বা লোকসানি পর্যায়ের খেলাপি দেখানোর পরও পরবর্তীকালে অল্প সময়ের মধ্যে ঋণের বাকি ৩০ কোটি টাকার বেশি অর্থ ছাড় করা হয়েছে।


বাংলাদেশ ব্যাংকের চিঠিতে গুলশান শাখার আরেক গ্রাহক ডেল্টা সিস্টেমস লিমিটেডের ঋণ অনিয়ম, ঋণের অর্থ অন্য ব্যাংকের অনিয়মিত দায় পরিশোধে ব্যবহার ও সরেজমিনে পরিদর্শন দলের মালামাল না পাওয়া এবং অতিমূল্যায়নের তথ্য তুলে ধরেছে। একইভাবে বেশ কয়েকটি শিপিং লাইন, যেমন শিফান শিপিং লাইনস, এস সুহি শিপিং লাইনস, ব্রাদার্স এন্টারপ্রাইজ, দিয়াজ হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট ও এসজিএফ শিপিং লাইনসের ঋণ যাচাই-বাছাই ছাড়া দ্রুত অনুমোদনের কথা বলা হয়েছে। আবার এক ব্যক্তির ছবি একাধিক নাম দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মালিক বানানোর কথা উল্লেখ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ।

সোর্স: http://www.prothom-alo.com     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.