আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার "অবিশ্বাসের দর্শন"

এক অসাম্প্রদায়িক উজ্জল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি এই মুহূর্তে যে বইটি পড়ছি,তার নাম "অবিশ্বাসের দর্শন"(এখনো বেশি দূর যাইনি)। লেখক প্রবাসী। অভিজিত রায় এবং রায়হান আবীর। বইটি তথ্য-উপাত্তে অত্যন্ত সমৃদ্ধ এবং নি:সন্দেহে লেখকদ্বয় সুলেখকই বটে। উনারা বিজ্ঞানের মাধ্যমে যুক্তির কৌশলে ধর্মের ব্যর্থতা এবং ঈশ্বরের অস্তিত্বহীনতা ব্যাখ্যা করেছেন।

এবং সেটা ভাল উদ্দেশ্যেই। তাদের উদ্দ্যেশ বিজ্ঞানমনস্ক একটি জাতি তৈরি করা। এজন্য তাদেরকে সাধুবাদ। আমিও তাদের সাথে যে দ্বীমত পোষন করছি তা নয় মোটেই। তবে কিছু কিছু জায়গায় খুব খটকা লাগল।

তারা মানব সভ্যতায় ধর্মের অবদানকে একেবারে "নাই" করে দিয়েছেন। এটা ঠিক মানব সভ্যতায় আজকের অবস্থানে ধর্মের অবদান যথেষ্ঠ নেতিবাচকই বটে। তবু "নাই" যে তা বলা যাবে না। একটা অংশ এরকম,বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ ই ধর্মপ্রাণ,তবু এটি পৃথিবীর শীর্ষ দূর্নীতিবাজ দেশগুলোর একটি। অন্যদিকে সুইডেনের মানুষজনের ধর্মীয় রীতিনীতির প্রতি বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা তেমন একটা নেই বললেই চলে।

কিন্তু পৃথিবীর সবচেয়ে শান্তিপূর্ন ও কম দূর্নীতির দেশ সুইডেন। তাহলে এই যে ধর্মীয় রীতি নীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে লাভটা কী হল?ধর্মটা কী কোন প্রোডাক্টিভ মাধ্যম হতে পারল? নি:সন্দেহে অনেক শক্ত যুক্তি। হয়তো এরও অনেক শক্তিশালী প্রতি যুক্তি রয়েছে। কারন কোন জাতির উন্নতির জন্য ধর্ম তেমন গুরত্বপূর্ন মাধ্যম বলে মনে করা অর্থহীন,এর পিছনে আরও অনেক অর্থনৈতিক,সাংস্কৃতিক কাঠামো অবকাঠামো জড়িত। আমি সে আলোচনায় যাচ্ছি না।

আমার প্রশ্ন হচ্ছে,যারা ভাল আছে এখনও, সৎ এবং নিষ্ঠাবান মানুষ যারা আছেন আমাদের দেশে(যদিও তারা সংখ্যায় অধিক নন)তাদের মানস গঠনে ধর্ম কিন্তু অনেক গুরূত্বপূর্ন অবদানই রেখেছে। কিংবা গ্রামের খুব সাধারন কৃষক বা সাধারণ মজুর যারা কেবল ধর্মীয় নৈতিকতার জোরে অন্যায় থেকে বিরত থাকে,নির্লোভ থেকে স্বাত্তিক জীবন যাপন করে তাদের ক্ষেত্রে ধর্মই কিন্তু ভাল থাকার সুন্দর মাধ্যম। আরও একটি শক্ত প্রশ্ন হল কোন প্রতিষ্ঠানের(ধর্ম একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান)কার্যকারীতা নিয়ে। কোন আইন প্রনয়ন করা এবং তা কার্যকর করা-সম্পূর্ন দুটি ভিন্য আঙ্গীক। যদিও আইন বা রীতি নীতি প্রনয়ণের সময় প্রনয়নকারীদের মাথায় থাকে তা কার্যকর প্রকৃয়ার সহজকরণের দিকে।

তবে সেটা আধুনিক যুগের আইন প্রনয়নকারীদের ক্ষেত্রে বলা চলে। যেসব মহামানব(জনমানসে) ধর্ম প্রবর্তন করেছেন কিংবা যাদের মাধ্যমে ধর্মীয় বানী জনমানসে এসে পৌছেছে তারা এ বিষয়ে কতটা সচেতন ছিলেন সে বিষয়ে সন্দিহান। হয়ত হাজার হাজার বছর আগে এতটা সচেতন থাকা তাদের পক্ষে সম্ভবও হয়নি। যাহোক,যারা ধর্মীয় আইন প্রনয়ন করেছেন তারা বড় মাপের দার্শনিক। সেটা কার্যকর করা তাদের কাজ নয়।

আইন(ধর্মীয় আইন)কার্যকর করে সাধারণ মানুষ,যারা প্রশাসনিক পর্যায়ে থাকে । আইন প্রনয়ন এবং কার্যকর এই দুই স্তরের মাঝখানে আরেকটি স্তর রয়েছে এবং আমার মনে হয় সেটাই সবচেয়ে গুরূত্বপূর্ন এবং সেটা হল কোন আইন বা রীতির মর্মার্থ উদ্ধার,সেটা বুঝেই মানিষ কার্যকর করার পন্থা ঠিক করে নেয়। এই বোঝার কাজটা হতে পারে বড় ধরণের ভুল বা অপব্যাখ্যা। যেমন,ধরুন,ইসলাম ধর্মের কোরআন শরীফের কোথাও কিন্তু লেখা নেই যে,কাউকে খুন করলে তার শিরচ্ছেদ করতে হবে,কিংবা চুড়ি করলে তার হাত কেটে নিতে হবে। অথচ,আরব আমিরাতের প্রশাসন সেটাই করছে।

হিন্দু ধর্মে এমন অনাচার আরো বেশি। মূলত এই উপলুব্ধিটাই আমাকে লিখতে বসিয়ে দিল,বেশিরভাগ মানুষ যুগে যুগে ধর্মীয় রীতি বা বানীগুলো নিজেদের সুবিধার্থে ব্যাবহার করেছে না বুঝে,বা ইচ্ছে করে। এক্ষেত্রে আমি হিন্দু ধর্মীয়দের অন্যতম প্রধাণ ধর্মগ্রন্থ শ্রীমদ্ভগবদ্ গীতার একটি অংশের সাহায্যে কেবল মাত্র একটি উদাহরণ দিচ্ছি... ব্রাক্ষ্মণক্ষত্রিয়বিশাং শূদ্রাণাঞ্চ পরন্তপ কর্মানি প্রবিভক্তানি স্বভাবপ্রভবৈর্গুণৈ । । ৪১ শমো দমস্তপ:শৌচং ক্ষান্তিরার্জবমেব চ।

জ্ঞানং বিজ্ঞানমাস্তিক্যম্ ব্রক্ষ্মকর্ম স্বভাবজম্। । ৪২ শৌয্যং তেজো ধৃতির্দাক্ষং যুদ্ধে চাপল্যপলায়নম্ দানমীশৃভাবশ্চ ক্ষাত্রং লর্ম স্বভাবজম্। । ৪৩ কৃষিগৌরক্ষ্যবাণিজ্যং বৈশ্যকর্ম স্বভাবজম্ পরিচর্যাত্মকং কর্ম শূদ্রস্যাপি স্বভাবজম্।

। ৪৪ (অষ্টাদশ অধ্যায়,মোক্ষযোগ) অর্থ: ৪১। স্বভাবের গুণেই ব্রাক্ষ্মণ ,ক্ষত্রিয়,বৈশ্য,শূদ্র-এই চারি জাতির কর্ম বিভক্ত হইয়াছে। ৪২। শম,দম,ক্ষমা,তপস্যা,শৌচ,আস্তিক্য,শুচিতা,জ্ঞান,সরলতা-এইসব ব্রাক্ষ্মনের ধর্ম।

৪৩। শৌর্য,বীর্য,পরাক্রম,যুদ্ধ,শাসন,প্রভুত্ব...এইসব ক্ষত্রিয়ের ধর্ম। ৪৪। কৃষিকার্য,গোপালন ও বাণিজ্য বৈশ্যের কর্ম। আর সেবা হইতেছে শুদ্রের কর্ম।

এখন আসা যাক ব্যাখ্যায়। এখানেই মূলত সমস্যা তৈরি হয়েছে। সাধারণভাবে যারা ধর্ম ব্যাখ্যা করেণ এবং যা আমরা মেনে এসেছি তা হল,হিন্দু ধর্মে চারটিজাতিভেদ রয়েছে মানুষের মধ্যে আর তা হল ব্রাক্ষন,ক্ষত্রিয়,বৈশ্য ও শূদ্র। এর মাঝে সবচেয়ে ভাল বা শ্রেষ্ঠ জাত হল ব্রাক্ষণ এবং এদের কাজ হল খালি পূজা করা,এদেরকে সেবা করবে আর তিন জাতের মানুষজন। এদেরকে ছুলে এদের জাত যাবে।

এদের সেবা করাই পরম পূন্যের কাজ,প্রথম তিন জাত ভিন্য শূদ্ররা হল অস্পৃশ্য। এদের হাতে ভাত খাওয়া হল কিনা অন্যপাপ ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় গীতায় এসব কথা কিচ্ছু লেখা নেই। গীতায় যা লেখা আছে তার মূল ব্যাখ্যা হবে এরকম। মানুষের স্বভাব তিন রকম-সাত্ত্বিক,রাজসিক ও তামসিক।

সাত্ত্বিক শব্দের অর্থ হল সদ্ গুনজাত,ফলাকাংখাহীন(ভাল কাজ করেও কাজের ফল কীহবে তা না ভাবা এবং "আমি করি" এমনটা নাভেবে ঈশ্বর আমাকে দিয়ে করিয়ে নিয়েছেন এমনটা ভাবা),নির্মল ও পবিত্রতা। রাজসিক শব্দের অর্থ হল রজ:গুনপ্রধান, ফলাকাংখা এবং শক্তিমত্তা। এবং সর্বশেষ তামসিক শব্দের মানে হল,অজ্ঞতাজনিত দোষ,আধার,মোহ। এই স্বভাব অনুযায়ী মানুষের কাজের রকম হওয়া উচিত চার রকম। অতএব মানুষ হতে পারে চার ধরণের।

যথা ব্রাক্ষ্মণ,ক্ষত্রিয়,বৈশ্য,শূদ্র। যারা সদ্ গুনজাত বা সাত্ত্বিক মানুষ তারা সাধারণত জ্ঞানচর্চা বা সাধনা করে,নির্লোভ থেকে সরলতা,ক্ষমা ইত্যাদি সদ্ গুনের চর্চা করে,এসকল গুনসম্পন্ন মানুষদের ব্রাক্ষ্মণ বলা হবে। এ শ্রেণীর লোকের জাগতিক বিষয় আশয়ের(অর্থ বিত্ত এবং প্রেম ভালবাসা) প্রতি কোন রকম মোহ থাকবেনা। আর যাদের বিষয় আশয়ের প্রতি মোহ থাকবে,প্রবল শক্তিমত্তা ও পরাক্রমশালী অর্থাৎ রাজসিক গুনসম্পন্ন তারা সাধারণত যুদ্ধ করে। তাই তাদেরকে ক্ষত্রিয় বলা হয়।

(এই ধর্ম যখন প্রণয়ণ করা হয় তখন যুদ্ধ গুরুত্বপূর্ন একটি পেশা ছিল) রাজসিক গুনসম্পন্ন কিন্তু প্রবল শক্তিমত্তার অধিকারী নয়,অথচ প্রবল বৈষয়িক জ্ঞানসম্পন্ন তারা কৃষিকাজ,গরু-ছাগল পালন এবং বাণিজ্য এসকল কাজ করতে পারে(ঐসময়ে রাজকার্য,তপস্যা,ছাড়া এসকল পেশার বাইরে আর তেমন কোন পেশা উল্লেখযোগ্য অবদান রাখত না সমাজে)। এদেরকে বলা যাবে বৈশ্য। আর যারা তামসিক গুনসম্পন্ন,যারা অশিক্ষিত,অজ্ঞ,কুসংস্কারাচ্ছন্ন তাদেরকে বলা যাবে শূদ্র এবং অনিবার্যভাবেই অবশিষ্ট(সেই সময়ের) তাদের সেবাধর্মী কাজগুলোকেই বেছে নিতে হবে যেমন মুটে,কুলি,ছুতার,মুচি ইত্যাদি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে একজন চিকিৎসক বা সেবিকার কাজ ও সেবামূলক। তাহলে তারা কি শূদ্র? এই যে চারটা শ্রেনী করা হল,তা অর্থনৈতিক কাঠামোর দৃষ্টিকোণ থেকে নয়,নিতান্তই মানুষের স্বভাবের সাথে মিলিয়ে একটা সামাজিক পেশা বেছে নেবার প্রাথমিক পরামর্শ।

তাই একে ভিত্তি করে সমাজে চারটি অর্থনৈতিক ভারসাম্য তৈরীর প্রচেষ্টা গীতার উদ্দেশ্য নয়,বরং মানুষই এই বানীগুলোকে কাজে লাগিয়ে ভারসাম্য তৈরির বদলে উদ্দেশ্যমূলকভাবে বৈষম্য তৈরি করেছে। সেক্ষেত্রে কোন চিকিৎসক যদি স্বভাবে ব্রাক্ষ্মন হয় তবে সে তাই। কিংবা যে মুচি সেও যদি ভাল হয়,নির্লোভ হয়,সাত্ত্বিক হয় সেও স্বভাবগতভাবে ব্রাক্ষ্মণ। আবার কোন ব্রাক্ষ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণকারী ব্যক্তি যদি সদ গুনসম্পন্ন না হয় রাজসিক বা তামসিক হয় সেক্ষেত্রে সে ব্রাক্ষ্মণ নয়। এই চারটি ভেদ মূলত মানুষকে স্বভাব বা আচারনগত দিক থেকে বিভক্ত করেছে।

অর্থনৈতিক বা পেশাগত বৈষম্য মানুষের উর্বর মস্তিষ্কজাত একটি চিন্তা ছাড়া আর কিছু নয়। এবানীগুলোকে অপব্যাখ্যার মাধ্যমে কাজে লাগিয়েই মানুষ তার সামাজিক কাঠামো থেকে শুরু করে সবকিছু সাজিয়েছে। ফলে প্রভাবিট হয়েছে তার রাজনীতি,অর্থনীতি,সংস্কৃতি। পরিবর্তীত হয়েছে এ উপমহাদেশের ইতিহাস। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।