"আমারে ফিরায়ে লহো অয়ি বসুন্ধরে, কোলের সন্তানে তব কোলের ভিতরে"-শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
তারপরে লাগামহীন ছুটেচলাঃ
আমার লাইফের সবথেকে মজার পর্ব শুরু হয় এস এস সি পরীক্ষার পরে। তখন আমার পাখনা গজাইতে শুরু করে মাত্র। সালমান কিংবা আমির স্টাইলে শর্ট শার্ট পড়ি। আব্বুর ভয়ে চুল ছোট রাখতে হয় বলে জেল দিয়ে সব চুল দাঁড় করিয়ে রাখি। চোখে চশমার পরিবর্তে সানগ্লাসে পাওয়ার সেট করে নেই।
একবার তো মানিব্যাগের সাথে সালমান খান স্টাইলে চেইন ঝুলায়া আব্বুর হাতে খাইলাম রাম ধমক। আমি নিজেই মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ভাবতাম আমি এতটা স্মার্ট কেমনে হইলাম? যাইহোক, তখনো আমার ভেতরে চাপা নারীবিদ্বেষী মনোভাব বিরাজমান। আমার আম্মাজান আমাকে নিয়ে গর্ব করতেন যে আমি মেয়েদের বেইল দেই না। পরবর্তীতে ছেলের অমূল পরিবর্তনে শরমিন্দা হয়েছিলেন।
এস এস সি পরীক্ষার পরে অধিকাংশ সময় আমি ফার্মগেটে আমার ফুপ্পির বাসায় থাকতাম।
সেখানে আরেক বিজরমা ফুফাত ভাই আছে। ও বয়সে আমার বড় হলেও একই সাথে পড়তাম দুজনে। ফুপ্পির বাসায় যেয়ে উপন্যাস নিয়ে চুপচাপ বসে থাকতাম। ফুপ্পিদের বাড়িওয়ালার বোনের মেয়ে পড়তে আসতো বড় আপুর কাছে। একদিন সেই মেয়ে এসে আমাকে দেখে হা করে তাকিয়ে আছে।
আমি চিল্লায়া ডাক দিলাম ফুপ্পিরে। সেই থেকে শুরু হলো যন্ত্রনা। আমি ফুপ্পিদের বাসায় গেলে সেই মেয়ে এসে আমাকে জ্বালাতন করবেই। আমাকে এসে বলতো,”ভাইয়া , আন্টি ( মানে আমার ফুপাত বোন) বলেছে আপনি খুব ভালো স্টুডেন্ট। আমার প্র্যাক্টিক্যালে সমস্যা, আপনি আমাকে প্রাকটিক্যাল করাবেন?” আমি বুঝতাম না যে আমার ফুপাত বোন এই মেয়ের আন্টি হলে আমি ভাইয়া হই কিভাবে? আপু একদিন আমাকে সামনে রেখে বললো,” ও তো তোমার মামা হয়! তুমি ভাইয়া বলো কেন?” মেয়ে লজ্জিত হয়ে বলে আমি ওনাকে কখনো মামা ডাকতে পারবো না।
এই গেলো এক কাহিনী।
একবার আমাদের সবাই গেলাম ফুপ্পিদের বাসায় বেড়াতে। সেই মেয়ে এসে আম্মুকে আন্টি বলে ভাব নেয়া শুরু করলো। আমার ফুপ্পি সব জানতো। ফুপ্পি পরে আম্মুকে খুলে বলল সেই মেয়ের ঘটনা।
মেয়ে আমার ছোট বোনকে বলে যে ও যে ছেলেকে বিয়ে করবে তার নামের ফার্স্ট অ্যালফাবেট অবশ্যই আর (R) হতে হবে আর ছেলের বার্থডে অবশ্যই ১৫ জানুয়ারি হতে হবে। শুরু হল আমার দুর্দিন। সবাই আমাকে নিয়ে টিপ্পনি করতে লাগলো অথচ আমি নারীবিদ্বেষী! যাইহোক, সেই মেয়ের চোখের একটু সমস্যা ছিল। ঘন ঘন চোখের পাতা পরত। আমার সামনে আসলে আবার সেইটা বেড়ে যেত।
সুতরাং আমার দুই ফুপাত বোন এই নিয়ে আমার সাথে ঠট্টা বিন্দুমাত্র ছারত না। শেষে এই মেয়ের যন্ত্রনায় আমি ফুপ্পিদের বাসায় যাওয়া বন্ধ করে দিলাম। সেইবছরের শেষ দিকে সেই মেয়ের বাবা এসে মেয়েকে আমেরিকাতে নিজের কাছে নিয়ে গেলেন। আমি আবার ফুপ্পিদের বাসায় যাওয়া শুরু করলাম।
আমার লাইফের সব থেকে দুঃখী মুহূর্তের একটি হচ্ছে এস এস সি পরীক্ষার ফলাফলের দিন।
আশা করলাম এ প্লাস। দেখি এ গ্রেড আসছে। কান্নাকাটি করে আমি অস্থির। মার্কশিট হাতে পেয়ে কান্না আরও বেড়েছিল কারন, ম্যাথ আর সায়েন্সের চার সাব্জেক্টে (বায়োলজি সহ) এ প্লাস, বাকিগুলা সব এ গ্রেড। আর একটা সাব্জেক্টে প্লাস পাইলেই আমার এ প্লাস হয়।
সারাজীবন ইসলাম শিক্ষায় ৮০ এর উপরে পাইলাম আর এস এস সি তে যেয়ে এ গ্রেড! আমার কান্না দেখে কে। তারপরেরও ছেলের পাশের খবরে আব্বু বিশাল মিষ্টি বিতরন কর্মসূচি হাতে নিলেন।
ঢাকার ভালো কয়েকটা কলেজে ভর্তি পরীক্ষা দিলাম। তার মধ্যে টিকলাম উদয়ন স্কুল এন্ড কলেজে আর বি এ এফ শাহিন কলেজের কুর্মিটোলা শাখায়। শেষে চান্স পাইলাম নটরডেমে, কিন্তু সায়েন্স থেকে না, আর্টস বিভাগ থেকে।
টেকনোলজি নিয়ে পরার ইচ্ছা আমার তাই নটরডেম বাদ পড়ল। আমাদের বাড়ি শনিরআখরা থেকে কুর্মিটোলা বিশাল দূরে তাই বি এ এফ শাহিন কলেজও বাদ পড়ল। আর উদয়ন কলেজ নিয়ে ভয় পাইলাম যে সেখানে নাকি বন্দী জীবন। শেষে ডিসিশন নিলাম ধানমণ্ডি আইডিইয়াল কলেজে এডমিশন নেব। দুই বন্ধু নিলো কিন্তু আমি চুপচাপ বসে রইলাম।
শেষে যেয়ে বাড়ির কাছের দনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে ভর্তি হইলাম। এর পেছনে কারন ছিল যে আমি ফাঁকিবাজি করার সুযোগ পাবো। তাই হলো, দুই বছরে মাত্র তিনটা প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস করেছিলাম। আর পরীক্ষার সময় চার সাবজেক্টে দুইহাজার ঘুষ দিয়ে ১০০ মার্ক নিশ্চিত করেছিলাম।
কলেজে উঠে দুষ্টামির ষোলকলা পূর্ণ করলাম।
গ্রামের সেই ভদ্র ছেলেটি হয়ে উঠলো বন্ধুদের কাছে দুষ্টামির শিরোমনি। কলেজের সামনে টং দোকানে বসে ক্লাস ফেলে আড্ডা আর কলেজ ফেরত মেয়েদের টিজ না করলে দিনটাই মাটি হয়ে যেত। বেশকিছু দিনেই বন্ধুমহলে জনপ্রিয় হয়ে গেলাম। প্রথম এলকোহল পান করার অভিজ্ঞতা হলো কিন্তু তখনো আমি সিগারেট ধরিনি। মাহমুদ ভাইয়ের কোচিংয়ে বেশ জনপ্রিয় ছিলাম আমি।
সেখানে নাসরিন নামের এক মেয়েকে ভীষণ মনে ধরে গেল। সমস্যা হলো মেয়ে ছিল বাস্তববাদী। প্রেম ভালবাসায় বিশ্বাস করতো না। কিন্তু মেয়ের সাথে ভালোই ভাব হলো। একদিন মাহমুদ ভাইয়ের মোবাইল থেকে মেয়ের ফোন নাম্বার নিলাম চুপিসারে।
বিকেল বেলায় ছাদে উঠে মেয়েকে ফোন দিয়ে খাইলাম মেয়ের মায়ের কাছে রামধোলাই। সেই মেয়ে হয়ত এখনো জানেই না তার মা আমার ভালোবাসা অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দিয়েছিল।
কেমেস্ট্রি পড়তাম আজাদ স্যারের বাসায়। স্যার খুব ভালো জানতেন আমাকে। আজাদ স্যার পূর্বপরিচিত ছিলেন বিধায় আমার উপরে তার নজর ছিল বেশী।
ঠিকভাবে পড়া কমপ্লিট করতাম না বলে তিনি আমাকে মেয়েদের ক্লাসে এন্ট্রি করিয়ে দিলেন। একগাদা মেয়ের মাঝখানে পরে আমার দুষ্টামি চুপসে গেলো। এইবার নানাভাবে আমি মেয়েদের দ্বারা টিজ হতে শুরু করলাম। দুঃখের কথা কাউকে বলতেও পারতাম না। আর বন্ধুরা আমাকে হিংসা করতো কারন আমি নাকি তাদের গার্লফ্রেন্ডদের সাথে ক্লাস করি।
আজাদ স্যার ক্লাস নিতেন অদ্ভুত সিস্টেমে। তিনি পানির রাশায়নিক বিশ্লেষণ দিতেন আজব সিস্টেমে। দুটি মেয়েকে দেখিয়ে বলতেন এরা দুজন বউ আর আমাকে দেখিয়ে বলতেন এইটা জামাই, এই দুই পরমানু বউ আর পরমানু জামাই মিলে গঠিত হয় পানি। মেয়েরা মুখ টিপে হাসত আর আমি পারলে কাইন্দা বাঁচি।
ফিজিক্স পড়তাম সাখাওয়াত স্যারের বাসায়।
তার মত ভালো মনের মানুষ দুনিয়াতে খুব কম দেখেছি। তিনি ফিজিক্সের তুলনায় নীতিবাক্য বেশী শুনাইতেন। বাস্তব জীবনে তিনি ছিলেন চমৎকার মানুষ। কলেজ জীবনে কিছু শিখে থাকলে তার কাছে প্রাপ্ত বিদ্যাই ছিল অমুল্য। এমন কোন ছাত্র নেই যে তার সুনাম করতো না।
সাখওয়াত স্যারের সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল ফিজিক্সের আরেক টিচার আবুল স্যার যাকে সবাই আকামা বলে ডাকতো। তিনি ছিলেন মাকুমদা মানে অজাতশ্মশ্রু মানে তার দাড়ি মোছ উঠত না। সেই জন্যে সবাই তাকে আবুল কালাম মাকুমদা বা সংক্ষেপে (আকামা) বলে ডাকতাম। কলেজের এমন কোন ছাত্র ছিল না যে তাকে মনে মনে গালি না দিত। একদিন তার ক্লাসে একছাত্র বলেই ফেললো, “শালা নিউটনের মাথায় আপেল না পইরা ডাব পরলে এই ফিজিক্সের জন্ম হইত না, আর আকামার ক্লাসও করতে হইত না।
“
এলাকার মধ্যে আমাদের নামডাক ভালো। আমার দাদীর ভাই ছিলেন এলাকার সভাপতি। সুতরাং আমি পুরাই ফর্মে। এলাকার আপদে বিপদে আমরা বন্ধুরা খুব সক্রিয়, এই যেমন কোন বাইরের ছেলে এলাকার কোন মেয়ের সাথে প্রেম করলে সেই ছেলেকে পিটিয়ে ঠ্যাং ভাঙ্গা কিংবা কোন ছোট ভাই দেয়ালে নিজের নাম প্লাস দিয়ে কোন মেয়ের নাম লিখলে তাকে ডেকে এনে চপকানো অথবা এলাকায় নতুন কোন ভাড়াটিয়ার যুবতি মেয়ে থাকলে তাদের খেয়াল রাখা ছিল আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। তাহাদের ডিশ এন্টেনার লাইন, টেলিফোনের লাইন, পানির লাইন সব ঠিক আছে কি না তা আমরা অতি উৎসাহের সংঙ্গে জানতে দড়জায় নক করতাম।
এইসব জনহিতকর কাজের মাধ্যমে এলাকায় আমরা অনন্য এবং সকলের ভালোবাসার পাত্র। আর আমাদের সকল কর্মকাণ্ডের মূল ছিল হারামি ফাহাদের বাসায়। ফাহাদ অল্পতে উত্তেজিত হয় বলে ওকে তারছিঁরা না বলে আদর করে আমরা তারখাম্বা ডাকতাম। রাতের বেলায় ফাহাদের ছাদে বসতো আমাদের গানের জলসা আর সিগারেটের আড্ডা, মাঝে মাঝে এলকোহল পার্টি। আমি কিন্তু তখনো সিগারেট ধরিনি।
ঢাকার মধ্যে খুব ভালো ফ্রেন্ড সার্কেল গড়ে উঠলো। প্রায় প্রতিটি এলাকায় ভাব নিয়ে ঘুরে ফেরা। ছোট চাচার বাইক ছিল দুইটা। প্রায়ই একটা নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম।
একদিন থার্টিফার্স্ট নাইটে শরীর খারাপ বলে ওদের সাথে আড্ডা না দিয়ে বাসায় এসে দিলাম ঘুম।
ঘুমানোর সময় ভাবলাম শালারা বোতল খুলবে আর আমি ঘুমামু? অনেক কষ্টে ঘুমাইলাম। সকালে আব্বা এসে বলে সবগুলারে নাকি পুলিশ ছাদের উপরে থেকে ধরে নিয়ে গেছে। আমার চোখ কপালে। গেলাম ফাহাদের বাসায় দেখি পাগলা ঘুমাইতেছে। পরে জানলাম মাতালগুলা রাতে হৈ চৈ করছে।
কে জানি পুলিশে ফোন করছে। পুলিশ আইসা সবগুলারে লাইনে দাঁড় করাইয়া চটকনা দিছে পরে তন্ময় এর বড় ভাই তুহিন ভাই অনুরোধ করে ছারাইছে। ফাহাদের ভাষ্যমতে,“ মামা , মাল খাইয়া পিনিক পাই নাই, পুলিশ চইলা গেছে পরে তুহিন ভাই যে থাপ্পর মারছে, তার মধ্যে একশতে একশ পিনিক পাইছি। “
আমার শৈশব, কৈশোর আর তারপরের লাগামহীন দিনগুলি - ৭
পরের পর্বে থাকছে প্রেমবেলা আর আমার দূর্ভোগ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।