একজন সুনাগরিক আজকাল ভার্সিটি লাইফের শেষ প্রান্তে এসে কেমন যেন দার্শনিক হয়ে পড়েছি!২৫ বছরের কোটা পার না করতেই নিজেকে কেমন যেন বৃদ্ধ বৃদ্ধ বলে মনে হয়!পড়াশোনার চাপে পড়ে এমনই পিষ্ট হয়ে গেছি,মনে হয় জীবনে রসকষ বলতে আর কিছু বাকি নেই! সেইসাথে আমাদের নষ্ট সমাজ ব্যবস্থার চোখ রাঙ্গানি ত আছেই!গল্পের বই গুলোতে যখন লেখকদের শৈশবের বর্ণনা পড়ি,আব্বু আম্মুর কাছে যখন তাদের ছোটবেলার গল্প শুনি,তখন সেগুলোকে সত্যি বলে মনে হয়না,মনে হয় কল্পকথা!আমাদের সময় দেখেছি বয়স ৪ বছর পার হতে না হতেই বাচ্চাকে ভাল স্কুলে ভর্তির জন্য যুদ্ধ,ভাল স্কুলে ভর্তি করার পর এস এস সি,এইচ এস সি তে ভাল ফল করার জন্য যুদ্ধ,তার পরেও রক্ষা নাই!এরপর শুরু হয় ভাল ভার্সিটিতে ভর্তির জন্য যুদ্ধ!ভার্সিটিতে ভর্তির পর যে হাফ ছেড়ে বাঁচব, কিসের কি??তখন আবার শুরু হয় পাস করার যুদ্ধ,এরপর ভাল চাকরি পাওয়ার যুদ্ধ,আর মেয়ে হলে ত কথাই নাই!তাকে ভাল বিয়ে দেয়ার জন্য যুদ্ধ,বিয়ের পর স্বামী ও তার সংসারের সবার মন জুগিয়ে চলার জন্য যুদ্ধ,বাচ্চা হবার পর আবার বাচ্চা কে নিয়ে সেই একই যুদ্ধের পুনরাবৃত্তি!!a vicious cycle!!!এত যুদ্ধের ডামাডোলে আমাদের ইচ্ছা,আকাংক্ষা ও স্বপ্নগুলোই যেন কোথায় হারিয়ে যায়!
কিন্তু এখন আমি আমার ছোটবোনকে যখন দেখি,তখন আমার আর আমার নিজের হারানো শৈশব নিয়ে আফসোস হয়না!বরং তার বদলে আমার ছোটবোনের জন্য আমার মনে ভয় কাজ করে!মাঝে মাঝে ভাবি,আমার নিজের যখন সন্তান হবে,তখন তার চারপাশের পরিবেশটা কেমন হবে?এটা চিন্তা করেই আমার মনে ভয়ের বদলে আতংক জায়গা করে নেয়!
আমার ছোটবেলা এতটা স্বপ্নময় না হলেও অতটা খারাপও ছিলনা!আমি ভিকারুন্নিসার ধানমণ্ডি শাখার ছাত্রী ছিলাম। ক্লাস ৫ এ আমাদের ক্লাসের সাথে অ্যাটাচড যে বাথরুম ছিল,সেটায় একটা বাথটাব ছিল। সেটাকে কল্পনায় আমরা সিন্দবাদের জাহাজ মনে করে নিতাম!স্টিলের স্কেল গুলো হত আমাদের তলোয়ার। তারপর কল্পনার জলদস্যুদের সাথে আমাদের সে কি মারামারি!
মনে আছে ক্লাস ৫ এ আমাদের ৫ বেস্টফ্রেন্ড মিলে একটা গ্রুপ বানিয়েছিলাম-নাম ছিল bayanics! কথা নাই,বার্তা নাই,হঠাৎ আমরা ৫ বান্ধবী একসাথে চিৎকার দিয়ে উঠতাম- BAYANICS R R!!!এর যে কি অর্থ,তা আমরা নিজেরাও জানতাম না কিন্তু!
মনে আছে টিফিন টাইমে আমরা ক্রিকেট খেলতাম। যারা ক্রিকেট খেলতে পারতাম না,তারা সবাই হতাম আম্পায়ার!!
২ দিন পর পর কথা নাই,বার্তা নাই,বান্ধবীদের মধ্যে আমাদের সে কি ঝগড়া!ঝগড়ার টপিক ছিল,কাল তুই অমুকের সাথে বসেছিস,আমার সাথে বসিস নাই কেন??অথবা কাল তুই আমার সাথে কম কথা বলেছিস, কিন্তু অমুকের সাথে বেশি কথা বলেছিস কেন??নিজেরাই আড়ি নিতাম,আবার নিজেই কেঁদে বুক ভাসাতাম!পরদিন পার হতে পারতোনা, আবার ভাব!!আবার ২ দিন পর অন্য কারনে আড়ি!
ধর্ম ক্লাসে স্যার সবসময় পড়া ধরতেন।
বেশিরভাগই আমরা পড়ে আসতাম না, কেউ কেউ পড়ে আসত। পড়া না পারলে স্যার দাড়া করিয়ে রাখতেন। এমন অনেকবার হয়েছে যে আমি পড়ে এসেছি,কিন্তু আমার বান্ধবী পড়ে আসেনাই,স্যার ওকে দাড়া করিয়ে রেখেছেন দেখে আমি পড়া পারা সত্ত্বেও স্যারকে বলেছি-স্যার পারিনা!!মনের সুখে বান্ধবির সাথে ক্লাসে দাঁড়িয়ে থেকে হি হি করে হেসেছি!
কত ক্লাসে লুকিয়ে লুকিয়ে ৩ গোয়েন্দা পরতে গিয়ে ধরা খেয়েছি!স্যাররা বই নিয়ে যেতেন,টিচার্স রুমের সামনে দাঁড়িয়ে ঘ্যান ঘ্যান করেছি- স্যার,প্লিজ বই গুলা দিয়ে দেন!!
ফ্রেন্ডশিপ ডে আসলে আমাদের ব্যাস্ততার সীমা থাকতো না। সারা ক্লাস বসে বসে খালি ফ্রেন্ডশিপ ব্যান্ড বানাতাম!কারটা কত সুন্দর হয়,তা নিয়ে চলত কম্পিটিশন।
হাউজের কাজে,সায়েন্স ফেয়ারে আমাদের উৎসাহ উদ্দিপনার ত কোন শেষই ছিলনা!কি সব হাস্যকর প্রজেক্টই না করেছি!আবার সেইসব প্রজেক্টের জন্য টিচার দের কাছ থেকে উৎসাহও পেয়েছি!
মনে আছে ক্লাস ১০এর র্যাগ ডে তে আমাদের সবার কি কান্না!অথচ আমরা সবাই জানি যে কলেজে গেলেই আবার তাদের সাথেই দেখা হচ্ছে!!
পুরা স্কুল আর কলেজ লাইফ মিলিয়ে কেবল একবারই বিক্ষোভের মুখ দেখেছি! হামিদা আলি আপার অপসারনের বিরুদ্ধে উত্তাল ভিকারুন্নিসা দেখেছি!মনে আছে গার্জিয়ানরা আন্দোলন করতে করতে স্কুলের ভিতর ঢুকে গিয়েছে!আমরা সবাই ভয়ে ক্লাসের সিটকিনি তুলে বসে আছি!হঠাৎ আমার মনে পরল নিচ তলায় ক্লাস ১ এ আমার ছোট বোন একা!সবার নিষেধ অগ্রাহ্য করে এক ছুটে বিক্ষুব্ধ গার্জিয়ান দের ভিড় ঠেলে ৫ তালা থেকে ১ তালায় নেমে ক্লাস ১ এর দিকে ধেয়ে গেলাম।
গিয়ে দেখি ক্লাসের এক কোনায় বসে আমার ৬ বছর বয়সী ছোট বোন হু হু করে কাঁদছে! চিলের মত ছোঁ মেরে বোনকে কোলে তুলে নিয়ে এক ছুটে ৫ তালায়!আমার ছোট বোনের কান্না থামানোর জন্য পুরা ক্লাস ব্যস্ত হয়ে উঠল।
ম্যাট্রিকে এ+ পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাসায় এসেছি প্রানের বান্ধবী এ+ পায়নি,এই দুঃখে!
কলেজে উঠে তো যেন পাখাই গজিয়ে গেল!কে কত ক্লাস বাং করতে পারে!আম্বিয়া আপা ক্লাসের মাঝখানে দৌড়ে দৌড়ে যেয়ে মেয়েদের ধরে নিয়ে আসতেন!আপাদের চোখে ফাকি দেয়ার জন্য লাইব্রেরিতে গিয়ে বসে বসে গল্প করতাম,যাতে ধরা খেলেও বলতে পারি-আপা,পড়ছিলাম লাইব্রেরিতে!!আবার গাজী আজমল স্যারের ক্লাস করার জন্য কমার্সের মেয়েরাও ক্লাসে এসে ভিড় জমিয়ে রাখত!
মনে আছে-কলেজের র্যাগ ডের পর ৩ দিন পর্যন্ত র্যাগ ডের টিশার্ট টা বুকের সাথে চেপে ধরে রেখে হাউমাউ করে কেঁদেছি- বন্ধুদের ছেড়ে নতুন জীবনে পা বাড়ানোর শোকে। আজ কলেজ ছাড়ার এত বছর পরও হাজারো ব্যস্ততার ভিড়ে বন্ধুদের খোঁজ নিতে ভুলিনা!এত বছর পরেও আমাদের সেই স্কুলের গায়ে একটু আঁচর এলেই আমরা সব কিছু ছেড়ে ছুঁড়ে প্রতিবাদী হয়ে উঠি!
আমি আতংকিত হয়ে যাই আমার ছোটবোনকে দেখলে!এই অল্পবয়সেই তাদের চারপাশে কত কদর্যতা,যা আমরা কোনোদিন ওর মত বয়সে চিন্তাও করতে পারিনাই!আমার বোন তো যথেষ্ট বড়ই, ক্লাস ১০ এ পড়ে। আমার কষ্ট লাগে যখন আমি ক্লাস ১-২ এর বাচ্চাদের হাতে প্ল্যাকার্ড দেখি,যাতে লিখা-ধর্ষক পরিমলের বিচার চাই! এই ৬-৭ বছরের বাচ্চাগুলোও ধর্ষণের অর্থ বুঝে গেল!!এই ব্যর্থতা কার,এই দায় ভার কার?? এই ছোট ছোট বাচ্চাগুলাও এই সত্যের মুখোমুখি হল- শিক্ষকরাও ভক্ষক হতে পারে,আর তার বিচারের জন্য এত আন্দোলনও করতে হয়??আজকাল মায়েদের নিজেদের মেয়েকে সাবধান করে দিতে হয় প্রতি পদে পদে-“মা, কেউ ডাকলে তার কাছে একা যাবিনা, গায়ে কেউ হাত দিলে আমাকে জানাবি, চিৎকার করবি...” কিন্তু কেন??সমাজ কি এখন এতটাই পচে গেছে,যে বাচ্চা মেয়ে দের সম্ভ্রম রক্ষা নিয়েও মেয়েদের মাদের চিন্তিত থাকতে হয়??তাহলে মানুষ কিভাবে দাবি করে যে তারা একটি প্রগতিশীল সমাজের অংশ? এটি কি প্রকৃতপক্ষে সমাজের পশ্চাদপসরণের লক্ষন নয়??
আমি আল্লাহর কাছে এখন প্রার্থনা করি-আল্লাহ,আমাকে ভবিষ্যতে কোন মেয়ে সন্তান দিওনা!এই কদর্য সমাজে আমি একটি মেয়ে সন্তানকে প্রতিপালন করার কথা চিন্তাও করতে পারিনা!
শুধু কি মেয়ে??একটি ছেলে সন্তানই বা কতটুকু নিরাপদ?? নিরাপদ হলে কি মাদ্রাসার মত একটি পবিত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একটি বাচ্চা ছেলেকে তার শিক্ষক দ্বারা যৌন হয়রানির স্বীকার হতে হয়??
অন্ধকার আছে বলেই আলোর মাহাত্য আমরা বুঝতে পারি। নিরাশা আছে বলেই আমরা আশা নিয়ে বেঁচে থাকতে ভালবাসি।
কবি সুকান্তের একটি কবিতা মনে পড়ছে-
“এই পৃথিবীকে শিশুদের বাসযোগ্য করে যাবো আমি
নবজাতকের কাছে এই আমার দৃঢ় অঙ্গীকার। “
আমি অঙ্গীকার করিনা,কিন্তু মনে মনে আশা রাখি,হয়ত ভবিষ্যৎ পৃথিবী আমার সন্তানের বাসযোগ্য হয়ে উঠবে। হয়ত এই সমাজ একদিন আমার সন্তানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবে। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।