"আমারে ফিরায়ে লহো অয়ি বসুন্ধরে, কোলের সন্তানে তব কোলের ভিতরে"-শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কৈশোরের কিছুটা সময়ঃ
আমার কৈশোরের সময়টা শুরু করা যায় ঢাকা শহর নামের এক বন্দী খাঁচার সাথে পরিচয়ের মাধ্যমে। তখন আমার বয়স দশ থেকে এগারো। গ্রামের স্কুলে চতুর্থ শ্রেণীর ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে দাদা দাদু বললেন ঢাকায় বেড়াতে যাবেন। কিন্তু এই বেড়াতে যাওয়া হবে আমার শেষ যাওয়া সেটা আমি খুব ভালো করেই জানতাম। আমার দাদী সারারাত কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলতেন।
যে দাদাকে কখনো কাঁদতে দেখিনি সেও দেখতাম কাঁদছেন আমাকে ছাড়া থাকতে হবে ভেবে। আমিও কান্না করতাম কখনো উত্তরের ঘরের পেছনে কখনো পশ্চিমের কোলা-য় (বাড়ির অপেক্ষাকৃত নিন্মাংশ)। আমরা তিনজন সূক্ষ অভিনয় করে যাচ্ছিলাম শেষের দিনগুলোতে। কেউ কাউকে বুঝতে দেই না আমাদের তিনজনের মাঝে কতখানি ভালোবাসা।
এভাবেই দিনযাপনের একটা সময়ে ঢাকায় আমাদের বাসায় চলে আসতে হলো।
শহরে দাদুর দমবন্ধ হয়ে আসে এই অজুহাতে কিছুদিন পরে তিনি আর দাদা আমাকে রেখে চলে গেলেন গ্রামে। আমার সকাল হয় কাঁদতে কাঁদতে, রাতে বালিশ ভেজা চোখের পানিতে। আমার ধারনা দাদা দাদীর সাথে কোন নাতির এতখানি ভালোবাসা খুব কম গড়ে উঠে। আমি বারান্দার গ্রিল ধরে ঢাকা চিটাগাং রোডের গাড়ি চলতে দেখতাম। একসময় চাপা কান্না সইতে না পেরে শব্দ করে কান্না করতাম।
বাসার সবাই আমাকে সার্কাসের কোন ক্লাউনের মত দেখত। আমি কাঁদছি আর সবাই দেখেও না দেখার ভান করছে। মাঝে মাঝে আব্বু অনেক বেশী রাগ করতেন। আমার মা ছিলেন বেজায় খুশি, কারন তার ভাইদের বাসা আমাদের বাসার কাছেই। প্রায় প্রতিদিন বিকেলে সে চলে যায় সেখানে।
আমি আমার গ্রামের প্রতিটি জিনিস প্রতিটি বস্তুর কথা মনে করে কাঁদি।
শহরের জীবনে নিজেকে মানিয়ে নিতে বেশ বেগ পেতে হলো। পথঘাটে দেখেশুনে অনেক সতর্কতার সাথে চলতে হয়। রাস্তা পার হওয়ার সময় দাঁড়িয়ে দুইপাশের গাড়ির অবস্থান মাপতে হয়। তারপরে পথ চলতে হয়।
মাঝে মাঝে এমন হতো যে আমি আনমনে হাটছি, রিকশার টিন টিন শব্দে সম্ভিত ফিরে পেয়ে দেখি আমি রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাটছি। বারান্দা থেকে গ্রিলের খাঁজকাটা আকাশ দেখতে ভালো লাগতো না, তবুও তাকিয়ে থাকতাম, ভাবতাম আমার দাদা দাদু হয়ত এখন আকাশে তাকিয়ে আছে। আমি দিন গুনতাম তাদের অপেক্ষায়। ভাবতাম আমি কখন বড় হব, দাদু বলতেন আমি বড় হলে একা একা তার সাথে দেখা করতে যেতে পারব। আব্বু দাদা দাদুকে ফোন করে বার বার চলে আসতে বলতেন, কিন্তু তারা গ্রাম ছেড়ে আসবে না, আর আমাকে তাদের কাছ থেকে নিয়ে আসায় তারাও আব্বুর উপরে রাগ।
শহরের মানুষের জীবন সম্পূর্ণ ভিন্ন। শত শত অচেনা মুখের খবর কেউ রাখে না। হাটতে হাটতে দেখা যেত ভাঙ্গা পীচের কাঁদায় পা মাখিয়ে ফেলেছি।
আমি ঢাকায় আসার মাসখানেক পরে খুব বৃষ্টি হলো। পানি জমে পথঘাট ডুবে গেল।
আমার ইচ্ছে করলো এই পানিতে হাটার। চুপচাপ ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম পথে হাটতে। রাস্তার পানিতে নেমে দেখি শহরের সব আবর্জনা ভাসছে পানিতে। মানুষের মলমুত্র অবলীলায় ঘুরে বেরাচ্ছে। বাসার দিকে হাটতে লাগলাম।
পানিতে পা টিপেটিপে হাটতে হাটতে একসময় গেলাম বড় এক ড্রেনের ভেতরে। হাবুডুবু খেয়ে ফিরলাম বাসায়। শহরে ড্রেনে পর্যাপ্ত স্লাপ নেই, যার ফলে আমাকে ড্রেনের ফাক গলে ডুবাডুবি খেলতে হয়েছিল। ঢাকা শহরের একটা বিরক্তিকর ব্যাপার ছিল ধূলা। চোখমুখ অন্ধকার লাগতো পথে নামলে।
বিকেল বেলায় পাশের বাসার শাওন ভাইয়ের সাথে ছাদে উঠতাম ঘুড়ি উড়াতে। আমি ঘুড়ি উড়াতে পারতাম না। শাওন ভাইয়ের সাথে সুতায় মাঞ্জা দিয়ে ঘুড়ি ছাড়া হতো আকাশে। রোদে সুতা শুকিয়ে মাঞ্জায় ধার আসতো। একবার সুতায় মাঞ্জা দিয়ে আমরা আকাশে ঘুড়ি ছারলাম, সব সুতা ছেরে আমরা অপেক্ষায় রইলাম।
একটু পরে শুরু হলো বৃষ্টি। সব গেলো ভেস্তে।
এরই মধ্যে স্কুলে ভর্তি পরীক্ষা চলে গেছে। আমি ক্লাস ফাইভে ভর্তি হবো। মামার স্কুলে ভালো পরিচিত লোক থাকায় ভর্তি পরীক্ষা না দিয়েও শুধু ভাইবা দিয়ে স্কুলে ভর্তি হয়ে গেলাম।
ঢাকার স্কুলে শিক্ষা ব্যাবস্থা অদ্ভুত। পাঠ্যবইয়ের সাথে আরবি শিক্ষা, সাধারন জ্ঞান, কম্পিউটার আর কয়েকটা বিষয় যুক্ত। সবার মাঝে প্রতিযোগিতা। যারা হাসিমুখে থাকে তাদের পেছনে লুকানো থাকে বিষের ছুরি। এরই মাঝে আমার দুইজন ভালো বন্ধু জুটে গেলো।
একজনের নাম শাহিন, অন্যজনের নাম সাকিল। স্কুল শেষ করে ঘুরে বেড়াতাম সন্ধ্যা পর্যন্ত। তিনজনের মধ্যে আমি ছিলাম সবথেকে সরল সহজ প্রকৃতির। মিথ্যা কথা বলতে জানি না, ছেলেদের সাথে ক্রিকেট কিংবা ধস্তাধস্তি বা বোমবাস্টিং খেলতে ভয় পাই। তবুও অতিচালাক দুই বন্ধু ছিল আমার ভরসা।
আর বেঈমান দুইটা আমাকে বিপদে ফেলে পালিয়ে যেত। একবার স্কুলের পেছন দিয়ে যে পরিত্যাক্ত বাড়িটি ভূতের বাড়ি বলে খ্যাত সেখানে আমাকে একা রেখে দুইটাই চলে এসেছিল।
ছোট বেলা থেকে আমি পড়ালেখায় খুব মনযোগী হলেও ঢাকায় আসার পরে খুব ফাঁকিবাজ হয়ে গেলাম। সারাদিন হাটতাম পথে পথে। হুমায়ুন আহমেদ তখন আমাকে দেখলে তার অদ্ভুত চরিত্রের নাম “হিমু” না রেখে নিশ্চিত “রিয়েল ডেমোন” রাখতেন।
যাইহোক, স্কুলে দারুন ফাঁকিবাজ ছিলাম আমি। ছোট বেলা থেকেই স্কুলের প্রতি অনিহা ছিল, কিন্তু পরীক্ষা দিতে দারুন লাগতো। স্কুলে ক্লাস না করেও বরাবর ফার্স্ট ছিলাম আমি। ঢাকার স্কুলের টিচাররাও বেশ অদ্ভুত। আমি যে টিচারের কাছে ম্যাথ করতাম তিনি আমাদের সামাজিক বিজ্ঞান ক্লাস নিতেন।
একদিন ক্লাসে তিনি হঠাত করেই আমাকে ক্লাস ক্যাপ্টেন ঘোষণা করে দিলেন। ক্লাসের ক্যাপ্টেন হয়ে আমার খুশি হওয়ার কথা থাকলেও আমার ভীষণ মন খারাপ করলো, কারন এখন আমি আর স্কুল ফাঁকি দিতে পারবো না। আমাদের বিজ্ঞান টিচার ছিলেন ভীষণ বদরাগী। তিনি বলতেন ৩৬ প্রকার শাস্তি সম্পর্কে তিনি ট্রেনিং নিয়েছেন। তারমধ্যে সবথেকে কঠিন শাস্তি হচ্ছে বসার বেঞ্চি ঘারে দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা।
আর সর্বনিন্ম শাস্তি হচ্ছে ডাস্টার ছুরে মারা। একদিন এক ছেলেকে ডাস্টার মেরে কপাল কেটে দিলেন। আর যখন টিফিন পালানো কোন পাপী স্টুডেন্ট সামনে পড়তো তখন বেত দিয়ে এমনভাবে পেটানো হতো যে, যতক্ষন বেত না ভাঙ্গে ততক্ষন পেটান জায়েজ। এইসব কারনে টিফিনের পরে দেখা যেত তার ক্লাসে কোন স্টুডেন্ট নেই, ক্লাসের ক্যাপ্টেন হওয়াতে আমি আর কিছু গোবেচারা ছাত্র থাকতো বিজ্ঞান ক্লাসে। তরল, বায়বীয় আর উদ্বায়ী পদার্থ নিয়ে আমরা ব্যাস্ত হয় পরতাম।
জীবনের প্রথম বেতের বারি খেয়েছি ঢাকার স্কুলেই।
আমাদের ধর্ম শিক্ষক ছিলেন ধূর্ত প্রকৃতির লোক। টুপির নিচের দুটি চোখ দেখে তাকে শিয়ালের মত লাগতো। তার একটা বাজে অভ্যেস হলো, তিনি অবিশ্বাসী। ধর্ম শিক্ষক এমন হয় কিভাবে কে জানে।
আমরা ঠিকভাবে পড়া বললেও তিনি ভাবতেন আমরা ভুল বলছি, সুতরাং ফার্স্ট বেঞ্চ থেকে লাস্ট বেঞ্চ পর্যন্ত সবাই পশ্চাৎদেশে বেতের আঘাত সহ্য করতো। একসময়ে এমন হল যে, আমরা দেখলাম পড়া পারলেও মাইর খেতে হয় না পারলেও, তাই সবাই পড়া না কমপ্লিট না করেই বসে থাকতাম। আরেকটা মজার ব্যাপার ছিল, আমরা পড়া পারি না বললে তিন থেকে চারটা বেতের বারি পড়তো আর যেইসব অতিভদ্র ছেলে পড়া পারি বলে হাত তুলতো আমাদের অবিশ্বাসী স্যার তাদের আরও বেশী করে বেতের বারি দিতেন।
আগেই বলেছি স্কুল আমার কাছে বরাবরের মত ভয়ংকর এবং হিংস্র একটা স্থান। আমার দমবন্ধ হয়ে আসতো।
একসময়ে স্কুলে ফাঁকি দেয়া শুরু করলাম। সাধারন ছাত্র ফাঁকি দিলে যে শাস্তি, ক্যাপ্টেন ফাঁকি দিলে তার ডাবল শাস্তি। কিন্তু আমাকে তারপরেও শুধরানো গেলো না। চুপচাপ শাস্তি মেনে নিতাম। একটা ব্যাপার ঘটতো, একদিন স্কুলে ফাঁকি দিলে পরপর কয়েকদিন স্কুলের প্রতি অনিহা চলে আসতো।
যাইহোক, আমাকে শুধরাতে না পেরে আমাকে ক্যাপ্টেন্সি থেকে বরখাস্ত করা হলো। আমি তখন ঈদের খুশি। স্কুল ফাঁকি দিয়ে দশটাকা ঘণ্টা সাইকেল ভাড়া নিয়ে ঘুরতাম। টিফিন টাইমে আমাদের স্কুল গেটের বাইরে যেতে দেয়া হতো না। অনেক ছেলেপেলেকে দেখতাম দেয়াল টপকে স্কুল পালাতে।
আমি তখনো দেয়াল টপকানো জানি না। একদিন সাহস করে পালাতে গেলাম। দেখি দেয়াল আমার থেকে ডাবল উঁচুতে। কোনমতে শহিদমিনারের সিঁড়িতে উঠে দেয়াল ধরে হাত আর প্যান্টের হাটুর দিক দিয়ে ছিলে উঠলাম দেয়ালে। পেছন দেখি এক স্যার বেত নিয়ে আসতেছে।
চোখ বন্ধ করে দিলাম লাফ। একপা গিয়ে পরলো ড্রেনের ভেতরে। আমার তখন হুশ নেই। কোনমতে উঠে দৌড়াতে শুরু করলাম। স্কুল বাসার কাছাকাছি ছিল।
বাসার সামনে যেয়ে দেখি আমার এক পা ড্রেনের ময়লায় কালো হয়ে গেছে। বিশ্রি গন্ধ। বাসায় যেয়ে সাবান ঘষতে শুরু করলাম। বজ্জাত গন্ধ সাবান ঘষার পরেও থেকে যায়।
এভাবেই ফাঁকিবাজি করে একবছর পেরিয়ে গেলো।
শহরের হাবভাব তখন একটু একটু বুঝতে শিখেছি। কিন্তু শহরের ছেলেদের মত স্মার্ট হতে পারিনি। দাদা দাদু তখন আমাকে ছাড়া থাকতে না পেরে শহরে। পরের বছরে আব্বু বাসা চেঞ্জ করে বাসা নিলেন আমাদের উলেন সুয়েটার ফ্যাক্ট্ররির পাশে। সুতারাং আবার স্কুল চেঞ্জ।
স্কুলে ভাইবা এক্সামে ডাকা হলো আমাকে। এই স্কুলেই আমি এস এস সি পরীক্ষা দিয়েছি। মাঝে এ কে হাই স্কুলে কিছুদিন ক্লাস করে ভালো না লাগায় আবার ফিরে এসেছিলাম। ভাইবাতে কুরবান আলী স্যার আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন,” আচ্ছা তুমিতো ক্লাস সিক্সে উঠবা, তাহলে ক্লাস ফাইভের একটা কবিতা বলো তো বাবা। “ আমি তখন ক্লাস সিক্সের বই হাতে পেয়ে এপিঠ ওপিঠ মুখস্ত করে ফেলছি, স্যারকে বললাম,” স্যার ফাইভের কবিতা ভুলে গেছি, ক্লাস সিক্সের একটা কবিতা শুনাই?”
ভাইবার স্যারেরা হতভম্ব হয়ে একে অপরের দিকে তাকানো শুরু করেছে।
আমি এডমিশন নিলাম ক্লাস সিক্সের ডি সেকশনে। আমার রোল পড়লো ২৮ যেখানে ডি সেকশনে ছাত্র ৩২ জন। ভাগ্য ভালো এ সেকশন আর ডি সেকশনের ক্লাস একসাথে পরল। আমার সাথে ভালো সখ্যতা হয়ে গেলো বায়েজিদ ( বর্তমানে আমেরিকাতে আছে) আর নয়নের সাথে (বর্তমানে বুয়েটে অধ্যায়নরত। ) প্রথম বেঞ্চিতে চারজনের বসার জায়গা থাকলেও আমি নয়ন আর বায়েজিদ ছাড়া কেউ বসতো না, কারন স্যার প্রথম বেঞ্চ থেকে পরা ধরেন।
এস এস সি পর্যন্ত আমরা তিনজন এই একই বেঞ্চে ছিলাম। নয়নের একটা আশ্চর্য ব্যাপার ছিল...
ক্লাস ফাইভে নয়নের রোল ছিল তিন, আর আমাদের ফরিদা ম্যাডামের ছেলে শুভ্র (এখন সম্ভবত চুয়েটে) এর রোল ছিল এক। ক্লাস সিক্সে উঠে নয়নের টাইফয়েড হলো। টাইফয়েডে মানুষের একটা না একটা ক্ষতি হয়, কিন্তু নয়নের বেলায় তার উল্টো হয়ে গেলো। নয়নের মেধাশক্তি এতটা বাড়ল যে কেউ ওর ধারে কাছে ভিড়তে পারে না।
কিছুদিনের মধ্যে ওর নাম রটে গেলো সারা স্কুলে। প্রতিক্লাসে প্রথম স্থান নিয়ে এস এস সি এবং এইচ এস সি তে গোল্ডেন এ প্লাস নিয়ে বুয়েটে চান্স পেয়ে গেলো।
আমার বাসায় জাকির নামের ভার্সিটির একজন কেমেস্ট্রি স্টুডেন্ট পড়াতে আসতেন। দারুন পড়াতেন জাকির স্যার। ভীষণ রাগি বলে খুব মাত্রায় ভয় পেতাম তাকে।
তার চোখের দিকে তাকালে আত্মার পানি শুকিয়ে যেত। যেদিন পড়া কমপ্লিট করতে পারতাম না সেদিন বগলে রসুন দিয়ে শাওয়ার নিতাম। শুনেছি বগলে রসুন দিয়ে বৃষ্টিতে ভিজলে শরিরের তাপমাত্রা বাড়ে। কিন্তু অদ্ভুত কারনে আমার শরিরের তাপমাত্রা বাড়ত না। পড়ার মাঝে পানি খেয়ে আসার কথা বলে গ্যাসের চুলা জ্বালিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম।
যখন শরীর একটু গরম হতো তখন করুণ চেহারা নিয়ে স্যারের সামনে যেয়ে বলতাম জ্বর আসছে। আমার মায়াকারা চেহারায় মাঝে মাঝে ছুটি দিলেও অধিকাংশ সময় তিনি বসিয়ে রাখতেন।
ক্লাস সেভেনে যেয়ে ডি সেকশন থেকে এ সেকশনে ১৮ নম্বরে চলে এলাম। স্যারদের দৃষ্টি প্রসন্ন হলো আমার প্রতি। ডি সেকশন থেকে শুধু আমি আর বায়েজিদ এ সেকশনে এসেছিলাম।
প্রথম বেঞ্চের আমাদের তিনজনকে স্যাররা একটু বেশী ভালো জানতেন। তবে আমাদের ধর্ম স্যার কাউকে ভালো জানতেন বলে আমাদের মনে হয় না। উচ্চতায় অত্যাধিক খাটো বলে তাকে “দেড় ব্যাটারি” ডাকতো ছাত্ররা। তিনি ক্লাসে ঢুকলে আমরা সবাই যখন দাড়িয়ে পড়তাম তখন তিনি বলতেন,” যারা পড়া পারো তারা বসো, আর যারা না পারো দাঁড়িয়ে থাকো। “ আমরা আবিষ্কার করেছিলাম স্যার যখন পড়া ধরেন তখন তিনি ঝিমান, আর আমরা কি বলছি সেটা খেয়াল থাকে না।
পরা শেষ করে যখন বলতাম স্যার শেষ, তখন তিনি খুশি হয়ে বলতেন বসো। অধিকাংশ দিন আমরা না পড়েই বসে থাকতাম। স্যার পড়া ধরলে গরু, কিংবা বিড়ালের রচনা অথবা পাশের তিনতলার মেয়েটির সাথে বন্ধু সাঈদের প্রেমলীলা সবিস্তর বর্ণনা করতাম। স্যার খুশি হয়ে বলতেন বসো।
ক্লাস এইটে আবার আমাকে দেয়া হলো ক্লাসের ক্যাপ্টেনের দায়িত্ব।
ফারুক স্যার আর শুক্কুর আলী প্রধানিয়া স্যার আমাকে ক্যাপ্টেনের দায়িত্ব দিয়ে পড়লেন বিশাল মুশকিলে। শেষে আমাকে না পেয়ে খুঁজতে খুঁজতে চলে গেলেন বাসায়। আরও একবার তিনি বাসায় এসেছিলেন আমার এস এস সি পরীক্ষার আগে। স্কুলে তখন এক্সট্রা ক্লাস চলতো আর আমি ক্লাস না করে বাসায় বসে টেলিভিশন দেখতাম। স্যার আমাকে খুঁজতে খুঁজতে না পেয়ে গেলেন বন্ধু ফাহাদের বাসায়।
বেঈমান শালা ফাহাদ স্যারকে আমার বাসার দরজা দেখিয়ে দিয়ে চলে গেলো। আর স্যার এসে আব্বু আম্মুর সামনে ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করলেন। আর ওয়াজ মাহফিলের শ্রোতাদের মত আমি “ আমিন” এর বদলে “ জ্বি স্যার” বলতে লাগলাম।
আমার শৈশব, কৈশোর আর তারপরের লাগামহীন দিনগুলি - ৫
(পর্বভিত্তিক ভাবে চলবে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।