আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার হোস্টেল জীবনের খুটিনাটি

যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে. সেই ছোটবেলা থেকেই বড় ভাই, বোন, আত্মীয়দের কাছ থেকে শুনে এসেছি তাদের হোস্টেল জীবনের নানারকম ইতিহাস। তাদের বেশিরভাগ গল্প জুড়েই থাকতো হোস্টেলের / মেস বিভিন্ন বিষয়াদি নিয়ে কথা। এইসব কোনটা হাসির কিংবা আবার কোনটা অতীব কষ্টের। তবে প্রায় সবাই এক বাক্যে স্বীকার করে নিতো যে হোস্টেল জীবনের মত মজা আর নেই। পারিবারিক বাধা না থাকায় এই জীবনটা তাই মুক্ত পাখির মত।

ডানা মেলে উড়ার সময় হল এটাই। তাদের এমন রঙ্গীন রঙ্গীন সব নষ্টালজিক কথা শুনে মনের গভীরে ইচ্ছে জেগেছিল যে আমিও যদি এরকম হোস্টেলে থাকতে পারতাম! এইচ এস সি পাশের পর যখন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির সময় হল তখন কেন জানি সেই ইচ্ছেটা দমে গিয়েছিল। ঢাকায় স্থানীয় হওয়াতে হয়ত ব্যপারটি হয়ে উঠে নি। আর আব্বা আম্মাও হয়ত চাইতেন না আমাকে দূরে রাখতে। তাই বাসায় থেকেই পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হয়েছিল।

স্নাতক, স্নাতকত্তোর শেষ করেছি এভাবেই। ফলে ইচ্ছের প্রকাশটা হয়ে উঠে নি। কিন্তু ভাগ্যের কি খেলা! মনের সেই বাসনা আজ আমার পূরণ হয়েছে। ২০১১ সালের শেষের দিকে মাষ্টার্স করতে বাহিরে চলে আসি। আর এসেই এখানে হোস্টেলে উঠি।

যদিও দেশে থাকতেই হোস্টেলের সিট আগে থেকেই বুকিং দিয়ে রেখেছিলাম। আমি যেই হোস্টেলে উঠেছি সেই হোস্টেলে বাঙ্গালী কোন ছাত্র / ছাত্রী নেই বললেই চলে। এখানে বেশিরভাগ বাঙ্গালী ছাত্র / ছাত্রী মেস করে বাহিরে থাকে। এখানে বলে রাখা ভাল যে আমার হোস্টেলে থাকার কারণ হল ঠান্ডা! এখানে শীতের সিজনে মাইনাস ৪৪ – ৫০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা পর্যন্ত যায়। যাই হোক, এই হোস্টেলের বেশির ভাগ ছাত্র / ছাত্রীই চাইনিজ! কিছু পাকিস্তানি, নাইজেরিয়ান, ইরানের ছাত্র / ছাত্রীও আছে।

প্রথম যখন এসেছি তখন থেকেই খেয়াল করে আসছি চাইনিজরা ইংলিশ বলতে যেয়ে ৩/৪ বার মাথা ঠোকায়, কিংবা চুল ছিড়ে কিংবা আবার তোতলায়। এখানে আমরা বাঙ্গালীরা চাইনিজদের বলি “নাক বোচা” কিংবা “চ”। ওদের সাথে ইংলিশে কথা বলতে যেয়ে মাঝে মাঝে কিভাবে ওদের বোঝাবো সেই নিয়ে কিছুক্ষণ ভাবতে হয়। সহজে কিছু না বোঝার একটা বাতিক লক্ষ্য করা যায় এদের মধ্যে। দুর্ভাগ্যক্রমে আমার রুমমেটগুলো সব চাইনিজ।

আমার সাথে ৫ জন চাইনিজ ছাত্র থাকে। প্রতি জনের ১ টা করে রুম। আর একটা কমন রান্নাঘর। কেউ যদি বলে বাঙ্গালীরা বেশি খায় তাহলে আমি অবশ্যই এর প্রতিবাদ করবো। কারণ চাইনিজদের দেখি তারা আমাদের থেকে ৩ গুণ বেশি খায়।

খাওয়া দাওয়া এদের কাছে মুখ্য ব্যপার বলেই আমার মনে হয়। ওরা যেমন খায় তেমনি আবার নষ্টও করে। স্বভাব চরিত্রের দিক দিয়ে ওরা বেশ ভদ্র, নরম। কিন্তু টেবিল ম্যানার, বাথরুম ব্যবহার কিংবা রান্নাঘর ব্যবহারে ওদের থেকে নোংরা হয়তো আর পাওয়া যাবে না। ওরা যখন খায় মুখ দিয়ে অসহ্য রকম শব্দ করতে করতে খায়।

একটা উদাহরণ দেই। ওরা যখন টেবিলে বসে তখন মাংসের হাড্ডি সব টেবিলের উপর রেখে দেয়। সেটা ২/৩ দিন অবধি টেবিলে থাকলেও তাদের ভ্রুক্ষেপ নেই। রান্নাঘরে যখন রান্না করে তখন আমি পারতপক্ষে সেখানে যাই না। প্রচন্ড নোংরা আর আগোছালো করে রাখে তারা।

রান্না খাওয়া দাওয়া শেষে প্লেট, গ্লাস না ধুয়েই তারা বেসিনে রেখে দেয় ৩/৪ দিন। এ অবস্থায় রান্না করার সুযোগ পাওয়া খুব কষ্ট। কারণ তরকারি কাটার জায়গায় তাদের জিনিসপত্র এলোমেলো ভাবে থাকে। আমি অনেকবার তাদের পরিষ্কার করতে বলি। তারা করে।

কিন্তু বলে লাভ হয় না। কারণ ১/২ দিন পর আবার একই অবস্থা হয়। আর বাথরুমের কথা নাই বা বললাম। হোস্টেলের নিয়ম বেশ কড়া। প্রতি মাসে একবার ইনপেকশন হয়।

একেক জন রুমমেটের একেকটা কাজ প্রতিমাসে থাকে। কেউ কাজ ঠিক মত না করলে তাকে সুযোগ দেয় ইনসপেকশনের লোক। ২ দিন পরে আবার এসে যদি একই অবস্থা দেখে তাহলে জরিমানা দিতে হয়। সেই সময়টুকুতেই যা একটু পরিষ্কার দেখতে পারা যায় রুমের চেহারা। মাঝে মাঝে মেজাজ এত খারাপ হয় যে মুখ দিয়ে গালি বের হয়ে আসে।

মাঝে মাঝে ওদের সামনেই দেই। ওরা বোঝে না! হোস্টেল ব্যবহার করার নমুনা দেখলে মনে হয় এটা তাদের নিজেদের বাড়ি। আমার এক রুমমেট আবার খুব দিল দরিয়া। তার প্রেমিকা সহ আরো ২ জন মোট ৪ জন বন্ধু তারা একসাথে খাওয়া দাওয়া, রান্না করে ৩ বেলা। তারা রান্না প্রতিদিন করে।

আমরা সাধারণত বাজার করি বাসে যেয়ে। কিন্তু সেই রুমমেট বাজার করে ট্যাক্সিতে যেয়ে। সম্প্রতি সে একটা টিভিও কিনেছে। টাকা পয়সা এদের কাছে মনে হয় হাতের ময়লা! চাইনিজগুলোর কমনসেন্স বলতে কিছু নেই মনে হয়। রাত ৩ টার দিকে একদিন ঘুমিয়ে আছি।

হঠাৎ দরজা জোরে লাগানোর শব্দ। সাথে চিল্লাপাল্লা, রান্নাবারা, বারবার দরজা খোলা আর সিড়ি বেয়ে রুমে আসা যাওয়া। এই অবস্থায় কেউ ঘুমিয়ে থাকতে মনে হয় কেউ পারবে না। আমিও পারি নি। বাতি অন করে দেখি ৩ টা বাজে! এই সময়ে তারা কোথা থেকে আসলো আর এখনই বা কেন এরকম শুরু করলো বুঝলাম না।

তাদের এই অত্যচার চলেছিল একদম টানা ৬ টা পর্যন্ত। একটুকুও ঘুমাতে পারি নি সেদিন। বসে বসে মুন্ডুপাত করছিলাম এগুলোর। বেশিরভাগ সাপ্তাহিক ছুটিতে রুমে পার্টির আয়োজন করে চাইনিজেরা। সেই সময়গুলোতে আমার পক্ষে রুমে থাকা এক কথায় অসম্ভব।

তাদের ক্রমাগত হাসাহসি, চিল্লাচিল্লি, রান্নাবারার ঠেলায় আমি রুম থেকে বের হয় যাই। পুরো ক্যাম্পাস একবার চক্কর দিয়ে আসি। তাদের পার্টি শেষে রুমমেটের প্রেমিকা আমাকে একদিন বিয়ার অফার করেছিল। মাঝে মাঝে তারা আমাকে শুকর খাওয়ার অফার করে। পরে তাদেরকে বুঝিয়ে বলায় এখন আর বলে না।

আপনারা প্রশ্ন করতে পারেন তাহলে এত যখন সমস্যা করে তাহলে কারো কাছে বিচার দাও না কেন? এখানে উত্তর হল এসব দেখাশোনার দায়িত্ব থাকে রেসিডেন্ট অ্যাসিসটেন্টের (আর এ) উপর। কিন্তু যাদের কাছে বিচার দিবো তারাই তো চাইনিজ! বিচার দিয়ে খুব একটা লাভ হবে না। আর আমি এখানে একা বাঙ্গালী। আমি কারো সহযোগিতাও পাবো না। খুব মজা লাগে যখন আমরা বাঙ্গালীরা চাইনিজদের সামনেই ওদের বদনাম গাইতে থাকি বাংলায়।

আমার সাথে কোন বড় / ছোট ভাইয়ের দেখা হলেই প্রথম কথা "আপনার চাইনিজ বন্ধুরা কেমন আছে?" ভাল মন্দ মিলিয়ে এই হল আমার হোস্টেল জীবন। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.